STORYMIRROR

Gopa Ghosh

Romance Others

3  

Gopa Ghosh

Romance Others

#lovelanguage

#lovelanguage

5 mins
199

যখনকার কথা বলছি তখনো আমাদের দেশ স্বাধীন হয় নি। চল্লিশের দশক। দেশে ভাতের অভাব থাকলেও দেশ প্রেমের অভাব ছিলো না। মায়া এমন একটা পরিবারে জন্ম নিয়েছিল যার প্রতিটি সদস্যই দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। কেউ অস্ত্র দিয়ে, কেউ কলম দিয়ে, আবার কেউ নিরবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রসদ যুগিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। মায়া সেই যুদ্ধটা করতো কণ্ঠ দিয়ে। অপূর্ব গানের গলা ছিল তার। মায়ার কন্ঠে দেশাত্মবোধক গান শুনে চোখের জল ফেলবে না এমনটা হত না। প্রতিটি শব্দে যেনো দরদ ছুঁয়ে যেত তার গানে। বেশ কিছু গান সে নিজেই লিখে নিজের সুরেই গাইত। আর সেগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। 

একদিন বারান্দায় বসে নিজের মনে গুনগুন করছিল একটা গানের কলি,

"দেশ মোদের মা,

তাকে শিকলে বেঁধে রেখেছে যারা,

তাদের ক্ষমা কোরো না"

হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বুকটা কেঁপে উঠলো। আবার পুলিশ এলো নাকি। কারণ আগের দিন মায়ার দাদার খোঁজে বার তিনেক পুলিশ এসেছিল। দরজা খুলে বেশ চমকে গেলো। দ্যাখে জয়ন্ত। জয়ন্তর পরিচয় দিতে গেলে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। মায়ার বাবা হরনাথ আর জয়ন্তর বাবা শ্যামা চরণ ছোটবেলার বন্ধু আবার প্রতিবেশীও বটে। শ্যামা চরণ ছোটো থেকেই খুব মেধাবী। পাশ করে বেশ বড় পদে চাকরি পেয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিল। তবে বন্ধু হরনাথ কে ভোলেনি। প্রায়ই তার বাড়িতে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। হরনাথ ব্রিটিশদের অধীনে কাজ করায় আগ্রহী না থাকায় নিজের জমি জমা দেখাশুনা করেই সংসার চালাতো। ক্রমে দুই বন্ধু সংসারী হলো। শ্যামা চরণ এর ছেলে জয়ন্ত জন্মানোর আগেই হরনাথ দুই ছেলের বাবা হয়েছিলেন। দুই পরিবার দূরে থাকলেও যে কোনো অনুষ্ঠানে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। জয়ন্ত হওয়ার প্রায় ছ'বছর পর মায়ার জন্ম। শ্যামা চরণ খুব খুশি হয়েছিলেন বন্ধুর মেয়ে হওয়াতে আর তখনি এই মেয়েকেই একদিন তার ঘরের বউ করে নিয়ে যাবেন বলে কথাও

দিয়ে দেন। কিন্তু ভবিষ্যত বলে অন্য কথা। জয়ন্তর ডাক্তারি পড়তে বিলেত পাঠানো নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। হরনাথ চেয়েছিলেন দেশেই থেকে যেনো ডাক্তারি পাশ করে কিন্তু শ্যামা চরণ বিলেত থেকে পাশ করিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। 

ওদের বিয়ে দেবার সিদ্ধান্তে হরনাথের আগে মত থাকলেও পরে বেঁকে বসলেন। এদিকে দুজন দুজনকে অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছে। যদিও মায়া জানে বাবার মত না থাকলে তার কিছু করার থাকবে না। জয়ন্ত ডাক্তারি পাশ করে ফিরলো। সেদিন মায়া দের বাড়ি দেখা করতে গিয়ে বেশ ভালো করেই বুঝলো মায়ার পরিবার বিলেতে গিয়ে প্র্যাক্টিস করা ভালো ভাবে নেবে না। এই দেশভক্ত পরিবারটিকে সে বেশ ভালো করেই জানে। কিন্তু বাবার ইচ্ছা সে বিলেতে গিয়ে বসবাস করে। একদিন মায়া কে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো "তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও না, সত্যি করে বলো, আমার দোষ টা কি?" মায়া যেনো এই প্রশ্নটা জয়ন্তর থেকে আশাই করেছিলো, এমনভাবে উত্তর দিল "তুমি অনেক বড় ডাক্তার হয়েছো, তোমার বাবা এই দেশে নয় বিলেতেই তোমাকে সেটেল্ড করতে চান আর আমি আমার দেশ ছেড়ে যেতে পারবো না" এই পর্যন্ত শুনেই জয়ন্ত বলে ওঠে "তুমি না গেলে যেও না, কিন্তু এটা জেনে রেখো তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না"। মায়া দ্যাখে জয়ন্তর চোখ জলে চিক চিক করে উঠেছে। এভাবেই কেটে যায় আরো কিছু কাল। জয়ন্ত বিলেতে নয় এই দেশেই এক সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে কাজ করতে থাকে। বাবার সাথে এই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। শেষে জয়ন্তর কথাই মেনে নিয়েছে। 

এদিকে মায়ার এক গানের অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পুলিশ গিয়ে সব ভন্ড করে দেয়। মায়াকে এর আগেও প্রশাসনের তরফ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল কিন্তু সে শোনে নি। এবার মায়া কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো বড় সাহেবের কাছে। কার্পেট বিছানো এক খুব বড় ঘরে বসে আছে বড় সাহেব। মায়া জয়ন্তদের বাড়িতে এর আগেও দেখেছিল এই সাহেব কে। শ্যামাচরনের এত উন্নতির কারণ যে এই সাহেব সেটা তার অজানা নয়। ঘরে ঢুকেই শ্যামাচরন কে দেখতে পেলো। এবার মায়ার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ওর গ্রেপ্তারের খবর পেয়েই সে কন্যা সম বন্ধু কন্যা কে উদ্ধার করতে এসেছে। মায়া কে দেখেই সাহেব বলে উঠলো "ইউ আর ভেরী নটি গার্ল" এবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলে উঠল "হামি ম্যানি টাইমস তুমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছি, আর দিবো না"

মায়ার কণ্ঠ যেনো গর্জে উঠলো "আমি গান করবো, আর এই গান আমার দেশের প্রতি ভালোবাসা" সাহেব শেষের কথাগুলো কিছুটা বুঝতে না পেরে শামাচরণ এর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই শ্যামা চরণ ইংরেজি তে বুঝিয়ে দিল। সাহেবের মুখ গম্ভীর হলো। ইংরেজি তে শ্যামাচরণ কে বুঝিয়ে দিলো এটাই শেষ, এর পরে গান করে যদি এভাবে লোক জড়ো করে তাহলে মায়াকে গ্রেপ্তার করতে সে বাধ্য হবে, শ্যামা চরণের কোনো কথা আর শুনবে না। মায়াকে নিয়ে সেদিন শ্যামা চরণ বাড়ি পৌঁছে হরনাথ কে বার বার সতর্ক করে গিয়েছিল যেনো মায়াকে কোথাও এভাবে গান গাইতে না দেয়। হর নাথের উত্তরে অবশ্য ভালো ভাবেই বুঝেছিল মায়া যা করছে তাতে বাড়ির প্রশ্রয় আছে ষোলো আনা।কেটে গেছে আরও বেশ কয়েক বছর। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মায়া এখন আর যুবতী নেই, পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স। বিয়েটা আর করা হয়ে ওঠেনি। আসলে মনটা অনেক আগেই ও জয়ন্ত কে দিয়ে বসেছিল। জয়ন্ত অনেকবার চেষ্টা করেছিল বিয়ের কিন্তু হর নাথ রাজি হয় নি। মায়া তার গানের স্কুল নিয়ে থাকে সারাটা দিন।হর নাথ বেশ কয়েক বছর গত হয়েছেন। মায়ার বড় দাদা ব্রিটিশদের গুলিতে অনেক আগেই শহীদ হয়েছিলেন। ছোটো দাদা তার সংসার নিয়ে কলকাতায় থাকে। মায়া একা। জয়ন্ত শেষবার ওর ওপর খুব অভিমান করে বলে গিয়েছিল "আমি আর আসবো না, কোনোদিন মনে পড়লে তুমি যেও"। মায়া যাবে মনে করলেই বা কি, জয়ন্তর নিশ্চয়ই এখন ভরা সংসার, সেখানে মায়ার যাওয়াটা ঠিক দেখায় না। জীবন টা জয়ন্তর স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে দেবে মনে স্থির করে রেখেছিল। একদিন গানের স্কুলের কয়েকজন ছাত্রী বারবার কড়া নেড়েও সাড়া পেলো না। মায়া ধুম জ্বরে বিছানায় পড়ে। উঠে যাহোক করে দরজা খুলতেই আর দেরী না করে ওকে নিয়ে কয়েকজন প্রতিবেশী হাসপাতালে গেলো। মায়া জ্ঞান হারিয়েছিল। জ্ঞান ফিরে দেখল ওর কপালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে জয়ন্ত। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। জয়ন্ত জিজ্ঞেস করলো "কেমন বোধ করছো মায়া?" মায়ার কণ্ঠ রোধ করছিল দলা পাকানো কান্নাটা। তবু "ভালো"বলে চুপ করে থাকলো। এভাবেই কেটে গেলো কয়েকদিন, মায়া ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে উঠলো। একদিন জয়ন্তকে জিজ্ঞেস করে বসলো "তুমি বিয়ে করেছো?" জয়ন্ত মায়ার নাড়ি দেখার জন্য হাতটা নিয়ে বলে উঠলো "না, কারণ আমার হৃদয়ে আর কারোর জন্য জায়গা ছিল না, সেখানে তুমি আছো, শুধু তুমি"। মায়ার চোখ জলে ভরে ওঠে। তাদের ভালোবাসা ত্যাগেই সার্থক হয়েছে। দেশের প্রতি ভালোবাসা আর মনের মানুষের ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance