লাস্ট মেট্রো
লাস্ট মেট্রো
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
গিয়েছিলাম একটা ভীষণ প্রয়োজনে বেহালা। কি প্রয়োজন? কয়েকদিন আগে, অফিস ফেরত মেট্রো ধরতে দৌড়াবার সময়, সিঁড়িতে পা হড়কে পড়ে ডান পায়ের গোড়ালি মচকে গিয়েছিলো।
তারপর, ডাক্তার পথ্য ওষুধ কিছুতেই পায়ে জোর ফিরে পাচ্ছিলাম না। এদিকে ছুটি নিয়ে কাঁহাতক বাড়িতে বসে থাকা যায়? কাজ পাগল - এই দুর্নাম না থাকলেও, কাজ কামাই করে বসে থাকার রেকর্ডও নেই আমার। অগত্যা দাদুর একটা ওয়াকিং স্টিককেই সঙ্গী করে অফিস চলে গেলাম!
আমার সহকর্মী, বন্ধু শুভঙ্কর বললো - তুমি এক কাজ করো, আমার সাথে চলো। আমার পরিচিত এক ফিজিও দাদা আছে, তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। গ্যারান্টী দিচ্ছি, ফেরার সময় এই লাঠির তোমার দরকার পড়বে না!
এমন সুযোগ কি আর তখন ছাড়ি? হাফ সি.এল. নিয়ে দুজনে দৌড়ালাম বেহালা। সেই ফিজিও দাদার নাম পরিতোষ, তিনি আবার ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। তাঁর অ্যাপয়ন্টমেন্ট পাওয়াই মুশকিল - এত হাই ডীম্যাণ্ড তাঁর। শুধু শুভঙ্করদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের খাতিরে, সেদিনই আমার সুযোগ হ'ল তাঁর কাছে যাবার।
মাঝরাস্তায় গিয়ে জ্যামে ফাঁসলাম - মাঝেরহাট ব্রীজ ভেঙেছে! আমরা তখন বর্ধমান রোডে! মানে, আর কিছুক্ষণ আগে বের হলে আমরা... যাক গে, আবার ঘুরপথ ধরে ওদের বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন বেশ কয়েক ঘন্টা লেট হয়ে গেছি! তা'ও তো শুভঙ্করের হাতযশ, সে ওদিকের সব অলিগলি পাকস্থলি চেনে আর মোটরবাইক নিয়ে ঘোরে, নাহলে কখন পৌঁছাতাম কে জানে?
যাই হোক, পরিতোষদা ব্রীজ ভাঙার খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন বলেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় ছিলেন আমাদের। আমাকে শুভঙ্করের ঘরে বিছানায় শুইয়ে, একখানা গোটা অম্রুতাঞ্জন বাম গোড়ালিতে লাগিয়ে মালিশ করে করে, তাও ঘন্টা দেড়েকে পর যখন তিনি ক্ষান্ত দিলেন - আমি তখন আধমরা প্রায়।
পায়ে যা ব্যথা ছিলো সে সব তো কখন ভুলে গেছি, ম্যাসাজের সময় তাঁর আঙুল যখন চাপ দিচ্ছিলো হাড়ের ওপর - মনে হচ্ছিল, আঙুল না, কেউ যেন ওখানে নাট বল্টু ঘষছে! আর তেমনি হ'ল তার ব্যথা। ঐ ব্যথার চোটে আমি আসল ব্যথার কথা ভুলেই গেলাম একেবারে!
শুভঙ্কর রাতে ওখানে থেকে যেতে বললো। কিন্তু আমি বেরিয়ে পড়লাম মনের জোড় নিয়ে। এবার সত্যিই আশ্চর্য্য হলাম - পায়ের পাতা ফেলতে আর একটুও কষ্ট হচ্ছে না! আস্তে আস্তে, মানে সাধরণ গতিতে হাঁটলে মনেই হচ্ছিলো না - পায়ের চোটের জন্য স্টিক ব্যবহার করছিলাম কিছুক্ষণ আগেও!
আমি তো মহা খুশী হয়ে, ওখান থেক তখনই বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। শুভঙ্কর আমায় রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। তখন রাত প্রায় দশটা বোধ হয়। ভাবলাম, লাস্ট মেট্রোটা ধরে চলে যাবো দমদম। সেই স্টিকটা হাতে থাকলেও, ব্যবহার করছিলাম না তখন।
সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামলাম প্ল্যাটফর্মে। শেষ মেট্রো ঢুকতে তখনও বেশ কয়েক মিনিট বাকি দেখলাম ঘড়িতে। কিন্তু গোটা প্ল্যাটফর্ম জনশূন্য, এমনকি জি.আর.পিরও কাউকে দেখলাম না! নিত্যযাত্রী হওয়ায়, স্বাভাবিক ভাবেই আমার কাছে স্মার্ট কার্ড থাকায়, টিকিট কাউন্টারের দিকে ফিরেও তাকাইনি ঢোকার সময়। শেষ মেট্রোটা আছে তো - চলে যায়নি তো আবার?
এদিক ওদিক তাকিয়েও, কাউকে না দেখতে পেয়ে অগত্যা বসলাম একটা ফাঁকা স্টীলের চেয়ারে। উফ্ কি ঠাণ্ডা চেয়ার, এসি তো চলেনা, চলছেও না, তবু এত ঠাণ্ডা হল কিভাবে চেয়ারটা - কিছুই বুঝলাম না! উঠে পড়লাম, একটু এগিয়ে গেলাম প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে। দমদমে লিফ্ট আছে একটা - থার্ড বগী থেকে কাছে হয়, তাই।
এগিয়ে যেতেই দেখি - থামের গায়ে হেলান দিয়ে এক জোড়া তরুণ তরুণী, নিজেদের মধ্যে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমালাপে মত্ত। আলিঙ্গণবদ্ধপ্রায় তাদের নজরেই পড়ল না বোধ হয় সেখানে আমার উপস্থিতি! আমিও তাদের বিরক্ত করার চেষ্টা করলাম না।
এক তো এই নিস্তব্ধ নির্জন স্টেশনে একা একা কেমন গা ছমছম করছিল আমার, তারওপর এই আধখোঁড়া পা নিয়ে ওদের চটাতে মনও চাইল না। বরং আরও দুজন সহযাত্রী আছে ভেবে মনে একটু যেন বলও পেলাম। অবশ্য সে বলটুকু আমার স্থায়ী হল না খুব বেশি ক্ষণ।
ট্রেনের আলো এসে পড়লো প্ল্যাটফর্মে। বুঝলাম ট্রেন ঢুকছে, আমি এগিয়ে গেলাম প্ল্যাটফর্মের ধার পানে। হঠাৎ দেখি সেই তরুণ তরুণী আমার দিকে ধেয়ে আসছে! আমি তাদের ঐ আচরণে একটু অবাক হলাম - আমি তাদের প্রেমে তো কোন ব্যঘাত ঘটাই নি! তবে কি হাতের এই স্টিক দেখে, তারা আমায় পঙ্গু মনে করে মস্করা করতে চাইছে? আমিও মন শক্ত করে, তাদের প্রতিহত করার জন্য তৈরী হয়ে গেলাম।
ট্রেনটা এসে পড়েছে প্রায় পঞ্চাশ ষাট মিটারের মধ্যে, তারা দুজনে আমায় যেন ধাক্কা দিয়ে লাইনে ফেলে দেবার জন্য দ্রুতবেগে ধেয়ে এল। আমি তাদের গতিপথ থেকে নিজের শরীরটাকে খুব সাবধানে কিন্তু অতি দ্রুততায় সরিয়ে নিয়ে গেলাম। তারা নিজেদের গতি সংবরণ করতে না পেরে, দুজনেই গিয়ে আছড়ে পড়লো লাইনের ওপর!
আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলাম একটু - তাদের কি অবস্থা হল দেখবো বলে! কিন্তু কোথায় কে? লাইনে কেউ নেই! ট্রেনটাও ততক্ষণে আমায় অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। ট্রেনটা থামলো, দরজা খুলতেই আমি দ্রুত তার ভিতরে ঢুকে, প্ল্যাটফর্মের দিকে ফিরে তাকালাম। দেখি - সেই তরুণ তরুণী, তাদের সেই আগের জায়গাতেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়ছে!
আমি প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম ট্রেনের মধ্যে, কিন্তু এক সহযাত্রী আমায় প্ল্যাটফর্মের দিকে ঐভাবে তাকে দেখে বোধ হয় কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, আর আমার হাতের স্টিকটা দেখে হয়তো একটু সহানুভূতিও হয়েছিল বলে আমায় ধরে ফেললেন। তিনিই সীটে বসিয়ে দিয়ে, একটু জলও খাওয়ালেন আমায়।
পরে তাঁকে ঘটনাটা বলতেই, তিনি বললেন - এ' নাকি এখানকার রোজকার ঘটনা। আজ পর্যন্ত নাকি সবথেকে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা এই রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনেই ঘটেছে। এখানে লাস্ট ট্রেনে নাকি কোন যাত্রীই উঠতে সাহস পায় না তেনাদের এইরকম সব কাণ্ডকারখানার জন্য!