Partha Pratim Guha Neogy

Classics

4.0  

Partha Pratim Guha Neogy

Classics

লাল শাড়ি

লাল শাড়ি

6 mins
387


শান্তিদা নামে যেমন ব্যবহারেও তেমন। প্রকৃত অর্থে গোবেচারা। ঘাবড়ে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান মাঝে মধ্যেই। যেমন ধরুন, জিনিস হারিয়ে ফেলার সময় কেমন জানি অদ্ভুতুড়ে স্বভাবের হয়ে যান তিনি। আশ্চর্যের যেটা সেটা হলো তিনি যে সত্যি সত্যিই কিছু হারিয়েছেন তা প্রাথমিক ভাবে বুঝতেই পারেন না। ফলে না বোঝার মত ব্যবহার করে থাকেন। বৌদি ভাবেন উনি ভান করছেন, এতে বৌদির রাগ বাড়ে। বৌদির ধারনা জন্মায় যে শান্তিদা জেনে শুনে এই না বোঝার ভান করে থাকেন। আদতে সেরকম লোক কিন্তু একেবারেই নন শান্তিদা, কিন্তু এটা বোঝাবে কার সাধ্যি।


লাল রঙের একটা বুটিকের শাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না বৌদি। লক ডাউনের কিছুদিন পরের ঘটনা। সবে মাত্র চারিপাশ হাঁসফাঁসের থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। বাতাস বইছে টলমল করে। মানুষের মনে প্রবল টেনশনের সঙ্গে সঙ্গে অল্প করে মুক্তির স্বাদ ফিরে এসেছে। প্রচুর নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে এখন। দোকানপাট খুলছে এক এক করে। কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান যেমন খুলছে, শাড়ির বুটিকের দোকানও খুলছে। আর শুধু সেটাই নয় প্রায় চার পাঁচ মাস ঘরবন্দী, স্টাইল বন্দী বাঙালি মহিলাদের কাছে প্রাণের ঝুঁকির থেকেও শাড়ি বেশী আকর্ষণীয়।


লাল রঙের শাড়ি পাচ্ছেন না বৌদি। তন্ন তন্ন করে ঘরের চারপাশ খুঁজলেন। আলমারির প্রত্যেককটা তাক খুঁজলেন। বাড়িতে চারটে আলমারি। পৌনে চারটে আলমারি জুড়ে বৌদির অবস্থান, একটি ছোটো, পাতলা, হাল্কা, স্টিলের আলমারির অর্ধেকের অর্ধেক খানা শান্তিদার কপালে জুটেছে। তাতেই কোনমতে শান্তিদার সংসার। এ নিয়ে সামান্য মুখ খুলেছো তো নারী আন্দোলন আর নারীর প্রতি অবিচারের ভয় দেখান বৌদি। সেন্টিমেন্টাল ইস্যু। তাই অর্ধেকের অর্ধেক আলমারি থাক, সর্বসাকুল্যে দুটি তাকই থাক, ভিতর আর বাহিরের আভূষনের গন্ধ মাখা মেশামেশিই থাক, ঘামে চপচপ মুখ দেখাদেখি থাক, কিন্তু তাক আর বেশী চাইবেন না শান্তিদা সেটা মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছেন। নিজের এহেন আলমারির কথা মনে এলেই শান্তিদা, তারপরেই গলা ছেড়ে গান ধরেন "যা কিছু হারায়েছি তা আমার নয়।" আজও গলা ছেড়ে সেটাই গাইতে শুরু করে দিলেন শান্তিদা। আর গাইবি তো গা একেবারে বৌদির কানের ডগায়।

আর যাবে কোথায়। চেঁচিয়ে উঠলেন বৌদি, "শান্তু , আমার লাল রঙের শাড়ি যে তুমিই ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছো সেটা নিয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। তার উপর আবার আনন্দে গান করা হচ্ছে, যা হারিয়েছে তা আমার নয় ? হারাবে না কিছুই শান্তু। শাড়ি না পেলে তোমার আনন্দের দিন কিছুতেই যাবে না। এই আমি বলে রাখলুম। "


এটা অভিশাপ না হুমকি সেটা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি শান্তিদা। এমনটা প্রায়ই ঘটে। এইতো গেলবারের শীতে ঝাল ঝাল লঙ্কা, কাসুন্দি, সরষের তেল, বিট নুন, ধনে পাতা দিয়ে জম্পেশ একটা কদবেলের আচার করে ছাদে নিয়ে গিয়েছিলো বৌদি। রবিবারের দুপুর, শান্তিদার অফিস ছিলো না, নীচের ঘরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। বৌদি ছাদে গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন আরাম করে বই পড়বেন, আর কদবেলের আচারের স্বাদ নেবেন বলে। হঠাৎ শান্তিদার চিৎকার। দরকারে কিছুক্ষনের জন্যে নীচে নেমে আসতে হোলো বৌদিকে। বই আর কদবেলের আচার ছাদে রেখেই চলে আসেন তিনি। তারপরই লেগে যায় দক্ষযজ্ঞ। ছাদে ফিরে বৌদি আর কদবেলের আচার খুঁজে পান না। ফাঁকা বাটি। কি সাংঘাতিক কান্ড। দিনে দুপুরে ডাকাতি। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলোনা আচার। ওদিকে বৌদির সমস্ত রাগ গিয়ে পরল শান্তিদার উপরে। প্রায় দুশো ডেসিবেল শব্দ তান্ডবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বৌদি, ম্রিয়মাণ শান্তিদা। এমন চলতে থাকে শান্তিদার প্রতি। শান্তিদা বুঝেই উঠতে পারিছিলেন না দোষটা ঠিক কি করলেন। বুঝে ওঠার আগেই যত দোষ নন্দ ঘোষের মত শান্তিদার উপরে বর্ষিত হল সম্পূর্ণ রোষ । অবশেষে সব ঝামেলার শেষে বৌদি হঠাৎ করে উপলব্ধি করলেন বই পড়তে পড়তে পুরো আচারটাই তিনি খেয়ে ফেলেছেন। আর পুরোটাই যখন খেয়ে নিয়েছেন, বাটিতে আচার থাকবে কি করে? সে যাত্রায় বৌদির স্মৃতি ফিরে আসায় রক্ষে পেয়েছিলেন শান্তিদা। সব ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। জল আরো ঘোলা হয়। নাটক চলতেই থাকে। শান্তিদার বর্ষা কাটেনা কিছুতেই। কিন্তু ওই, কেমন নির্বাক হয়ে যান শান্তিদা। মনেই পড়ে না আসলে করেছেনটা কি।


সেই শান্তিদা আবার চাপে পরলেন লাল রংয়ের শাড়ি নিয়ে। বৌদির খুব পছন্দের শাড়ি। লকডাউনের মনখারাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে আজকাল বৌদি এসব কিনে আনছেন। কয়েকদিন আগে শান্তিদাকে বলে রেখেছেন যেভাবে জিনিস বাড়ছে তাতে চতুর্থ আলমারির আরো একটা তাক তার চাই। একজন পুরুষ মানুষের জামাকাপড়ের জন্যে আর কতটুকুই বা জায়গা লাগে, একটা তাকই যথেষ্ট। শান্তিদা সামান্য উত্তেজনায় কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন সেদিন, বৌদির রক্তচক্ষু দেখে আর এগোলেন না সে পথে, বরং রাগটাকে নিমেষে মৃদু মুখ চাপা হাসিতে পরিনত করে দাঁত খিটমিট করে বলে উঠলেন "নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, বাড়ির সব কটা আলমারি তোমার বাবার, ইয়ে মানে আমার শ্বশুরমশাইয়ের নিজের হাতে বানানো, তার মেয়ে ইচ্ছেমতন ব্যবহার করবে নাতো কে করবে?" 


শান্তিদার কথাটা বলার সময় হুঁশ ছিলো না। করোনা হয়েছিলো কিছুদিন আগে। করোনা নাকি মস্তিস্কেও ছাপ ফেলে যাচ্ছে। সেরকমই কিছু একটা। নাহলে এমন ভয়ঙ্কর কথা বলবার বেহিসেবী সাহস শান্তিদা কি করে? অতঃপর বৌদি গম্ভীর হলেন। পরপর সাতদিন রান্না করেন নি বৌদি। গুম মেরে বসেছিলেন। শান্তিদা প্রতিদিন গুনে গুনে ডজন খানেক বার ক্ষমা চেয়েছেন, কিন্তু রাগ ভাঙেনি বৌদির। অবশেষে আজকাল হোম ডেলিভারি চলছে। তবে হ্যাঁ, মেনু কিন্তু পছন্দ করে দিচ্ছেন বৌদি। আজ দুপুরে ভেটকি মাছ হলে রাতে চিকেন, দুপুরে পমপ্লেট হলে রাতে মাটন, দুপুরে কাতলা হলে রাতে বিরিয়ানি। এর চাইতে হাজার খানেক গালাগাল আর কয়েকশো ধমক দিলেও বোধয় ভালো ছিলো। হজম হয়ে যেত। কিন্তু এমন হোম ডেলিভারির খাবারের বিল কিছুতেই হজম হচ্ছে না শান্তিদার। শান্তিদা নিজেকেই নিজের মারতে ইচ্ছে হলো। সামান্য রাগেন না শান্তিদা, কি যে হলো, একটু হাসি মুখে রাগ দেখিয়েছেন কি, পকেট ফাঁকা।


লাল রঙের শাড়ি পাচ্ছেন না বৌদি। কয়েকদিন আগের কেনা। সব রাগ গিয়ে জমা হল শান্তিদার কপালে। বেধড়ক ঝাড়, মুখে। শান্তিদার ঝাড় খেয়ে অভ্যেস হয়ে গেছে। বৌদির চোদ্দপুরুষের স্বভাব, সে তো আর এমনিতে যাবে না। বৌদির মা ঝাড়তেন তার বর কে, মায়ের মা ঝাড়তেন তার বর কে, তার মায়ের মা। পুরো চোদ্দপুরুষের ব্যাপারস্যাপার, নারী ঝাড়েন, পুরুষেরা কান বন্ধ করে শোনেন। তাও না হয় আজকাল শান্তিদা ঝাড়বার টাইমে হেডফোন কানে লাগিয়ে জম্পেশ হিন্দি গান চালিয়ে দেন। আর দিদি নাম্বার ওয়ানের মত ওই হেডফোন কানে দিয়ে বৌদির লিপ রিডিং করে রিএক্ট করেন। যখন বুঝতে পারেন বৌদি মোটামুটি শান্ত, তখন শান্তিদা কান থেকে হেডফোন নামিয়ে নেন। পাকাপাকি বন্দোবস্ত আর কি। 


যাই হোক এদিনও তাই করলেন শান্তিদা। বৌদির জলপাই রঙের বুটিকের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। সব রাগ গিয়ে পরলো শান্তিদার উপর। এমনকি শান্তিদা তার অন্য কোনো বান্ধবীকে শাড়িটা দিয়েছেন বলেও বৌদি দোষারোপ শুরু করে দিলেন। হেডফোনে তখন বাজছিলো একটা মজার গান। শান্তিদা চোখ বুজে সামান্য হেসে উঠলেন। বৌদি ভাবলেন বৌদির কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন শান্তিদা। যেন হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, কে হে তুমি, আমার যাকে ইচ্ছে দেবো, তোমার কি? 


প্রচন্ড রাগ জমা হচ্ছে বৌদির মনের গভীরে। যা বারুদ ভরা আছে, বিরাট কিছু বিস্ফোরণ যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। বৌদি একটা হাতা হাতে নিলেন, একেবারে রনচন্ডী। কোমড়ের আঁচল নিলেন গুটিয়ে। এগিয়ে আসছেন শান্তিদার দিকে। মুখে অসম্ভব রাগ, যেন এই পৃথিবীটাকেই ধ্বংস করে দেবেন তিনি। প্রায় কাছে চলে এলেন শান্তিদার। শান্তিদা আরামে বসে কানে হেডফোন গুঁজে শুনছিলেন নাটক। নাটকের নাম অবাক জলপান। বৌদি প্রায় কাছে চলে এসেছেন শান্তিদার। হাতের হাতাটা শক্ত করে ধরা। সবে মাত্র হাতা হাতে হাত মাথার উপরে তুলেছেন বৌদি, এমন সময়…


শান্তিদা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিলেন। বৌদি প্রচন্ড উত্তেজিত। শান্তিদা তখন কেমন নির্বাক হয়ে নাটক শুনছেন, অবাক জলপান। নাটকের মধ্যে লেখা আছে একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? শান্তিদা তখন সেই জায়গাটাই শুনছেন । খুবই আকর্ষণীয় অংশটা। বৌদি তখন হাতা হাতে শান্তিদার সামনে। শান্তিদা খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রায় অজান্তেই বৌদির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন "লাল হয়ে গেছ, জল খেয়ে নাও।"


সামান্য এটুকু কথা। নড়ে গেলো যেন চারিপাশ। বৌদি কেন জানিনা নিজেকে আয়নায় দেখে নিলেন - চমকে নিজের শাড়ির দিকে তাকালেন একবার। আশ্চর্য, তার পরনেই তো সেই লাল রঙের শাড়িটা। যেটা নিয়ে এত তোলপাড়। 


শান্তিদা কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্ত থাকেন। এই ঘটনাতেও চুপচাপ ছিলেন।

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics