ক্যানভাস
ক্যানভাস
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
জীবনকে অনেকে অনেক ভাবে সাজাতে চায়। আমিও সাজাতে চাই, সুদীপ্ত পাহাড়ের গায় ওই গারো সবুজ গাছগুলো তাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। এটা শিল্পীর চোখে একটা ক্যানভাস। আমার জীবনেও আমি ক্যানভাসে ডুবে থাকতে চেয়েছিলাম। যেখানে একটি প্রাণবন্ত হৃদয় আছে। আমি এমন একজনকে খুঁজছি, যে আমার জীবনকে সবুজ রঙে রাঙিয়ে তুলবে। তাই আজ আমার সুতপাকে খুজে পেয়েছি। তাকে নিয়ে আজ আমার সবুজের অভিযান।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার মামার বাড়ি শিলিগুড়ি, মামাদের একান্নবর্তী পরিবার অনেক বড়। তিন মামা তাদের ছেলেমেয়ে সব মিলিয়ে পনেরো জনের মতো লোক। একই উঠোনে একই ছাদের নিচে এই পরিবার যৌথ পরিবারের তকমা নিয়ে চলছে। যা এখনকার সময়ে অত্যন্ত বিরল।আমি অনেকদিন পর মামার বাড়ি গেছি বলে আমাকে পেয়ে মামাতো ভাই বোনেরা যেন হাতে স্বর্গ পেল। পলাশ, অসীম, জয়ন্তি আমার সমবয়সী। প্রতাপ দা আমার থেকে একটু বড়। ওই বাড়িতে গিয়ে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বসে কয়েকদিনের প্ল্যান তৈরি করলাম। একদিন পিকনিক হবে বাড়ির ছাদে ছেলে মেয়েরা নিজেরাই বাজার করবে এবং রান্না করবে। আর একদিন আমরা বেঙ্গল সাফারি তে যাব এমনভাবে ভ্রমণের বেশ কয়েকটি তালিকা তৈরি করলাম। যেদিন গেলাম তার পরদিন আমরা কোথাও গেলাম না। বাড়িতে বসে একসাথে গল্পগুজব হৈ হুল্লোর করে কাটালাম সেদিনই ওই বাড়িতে এক নতুন অতিথি এলো। আমার বড় মামির ভাইয়ের মেয়ের শ্রেয়া। ওর বাড়ি কাটোয়া। থার্ড ইয়ারে পড়ে, শুনেছি ভালো আর্টও করতে পারে। জয়ন্তী আমার সাথে শ্রেয়ার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিল। প্রথম দর্শনে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ওর মুখের স্নেহ মাখা আভিজাত্য রয়েছে। পরদিন আমরা সব ভাই-বোনেরা মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম বেঙ্গল সাফারির দিকে। ওখানে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম।যেদিকে তাকাই সেদিকেই সারিসারি সেগুন, শাল আর সবুজ গাছে ঘেরা ঘন জঙ্গল। দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো প্রবেশ কম। গা ছমছমে পরিবেশ জঙ্গলের কোনে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গাছের ডালে ডালে অসংখ্য অচেনা পাখির ডাক।এত সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি কিন্তু সবার মনে একটা কথা, বাঘ অথবা হরিণ কিছু দেখতেই হবে। মুহুর্তের মধ্যে দুটো বাইসন আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে পালালো আর আমরা চিৎকার করে উঠলাম। ওই দেখো বাইসন বাইসন। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দেখি একটা জলাধারের পাশে বুনো শুয়োর শিকার করে খাচ্ছে বাঘ। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পরল। ড্রাইভার বলল, গাড়ি থেকে বের হবেন না। গাড়ি থেকে বসেই ছবি তুলুন। সবাই যে যার মত স্মার্টফোনে ছবি তুলতে লাগলো। আমি আমার বড় লেন্স দেওয়া ক্যামেরায় ছবি তুললাম আর ভিডিও করলাম। আমি যখন লেন্সের চোখ রেখে ছবি তুলছি বুঝলাম কে যেন আমার পেছনে এসেছে। তার চুলগুলো আমার মুখে এসে পড়ছে। মিষ্টি আতরের গন্ধ ভেসে আসছে। আমি পেছন ফিরে দেখি শ্রেয়া,আমার দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসি হাসছে। সে বলল আপনি কি ভিডিও করছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। ও বলল, আমি একটু চোখ রেখে দেখব। আমি বললাম নিশ্চয়ই। শ্রেয়া আমার পাশে বসে লেন্সের চোখ রেখে দেখতে লাগল। ও বলে উঠলো বাঃ দারুন তো। আজ রাতেই কিন্তু সব ভিডিও দেখাতে হবে। আমি বললাম, দেখাবো । আপনি যখন দেখতে চাইছেন অবশ্যই দেখাবো। শ্রেয়া বলল, আমাকে আপনি না বলে তুমি বলে ডাকবেন। আমি বললাম ঠিক আছে। তবে এখনকার মতো আপনিই চলুক, দুজনে হেসে উঠলাম। এক পলকে ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে বার কয়েক ওর মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি তুললাম।
রাতে খাবার আগে সবাই মিলে বসে পড়লাম হলঘরে। আমি কম্পিউটার সেট করে সারা দিনের ছবি ও ভিডিও দেখালাম। যখন শ্রেয়ার বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মুখের ছবি গুলো সবাই দেখলো, তখন সবাই এক সুরে বলে উঠলো, একি, কখন এত সুন্দর ছবি তুললি দাদা? আজ শ্রেয়াকে যে ভারী সুন্দর লাগছে। শ্রেয়া তো লজ্জায় চুপ হয়ে গেল। জয়ন্তি আমার কানে ফিসফিস করে বলল, তবে কি দাদার মনে মনে মন গাঁথা হয়ে গেছে? আমি বললাম, নারে, তোরা যা ভাবছিস তা নয়।
রাতে ঘুমোতে গেলাম ঘুম আর আসছে না।বারবার শ্রেয়ার মায়াবী মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই বনে একটু কথা এবং ওর গায়ের গন্ধ জানো এখনো আমার নাকে লেগে আছে। ওসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে জয়ন্তীর ডাকে ঘুম ভাঙলো। উঠে স্নান সেরে খেয়েদেয়ে সবাই মিলে মাটিগাড়ায় সায়েন্সসিটি দেখতে গেলাম। সঙ্গে শ্রেয়াও গেল। সায়েন্স সিটিতে অনেক কিছু দেখার মাঝে অল্প সম
য়ের জন্য বন্য আবহে তৈরি একটি ঘর সেই ঘরে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। একটু পরেই উত্তর বঙ্গের সবগুলি বনের ছবি পশু পাখির ডাক স্নিগ্ধ আবহ তৈরি করে দিল, যেন আমরা সবাই উত্তরবঙ্গের সবগুলি দর্শনীয় স্থান ঘুরে এলাম। প্রাণভরে উপভোগ করলাম। সেদিনও সারাদিন শ্রেয়া আমার পাশে পাশে থাকলো, সেলফি তুললাম, নিজে অনেক ছবি তুলল আমার ক্যামেরা থেকে।
এমনি করে কয়েকদিন সবাই মিলে দলবেঁধে মিরিক, দার্জিলিং, সেবক ঘুরে এলাম। প্রতিদিনই শ্রেয়া আগের চেয়ে বেশি করে আমার কাছে থাকতে লাগল। বেশি কথা ইয়ার্কি ও কিছু কাজের কথা বলল। একসাথে ছবি তোলা আমার ক্যামেরা দিয়েও ও বেশকিছু ছবি তুলল। মনে হল মনের দিক দিয়েও আমরা দুজন কাছে চলে এসেছি। আপনি থেকে দুজনেই তুমিতে চলে এলাম।
পরদিন আর কোথাও গেলাম না। রাতে সবাই মিলে বাজার করে দোতলার ছাদে আনন্দ করে পিকনিক করলাম। এসবের মাঝে সময় হলেই আমি ছবি তুললাম।
তার পরদিন সকালে ঘরে বসে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ করছি। এমন সময় শ্রেয়া আমার পাশে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে বলল, বেশতো ছবি আঁকতে পারো। আমি বললাম, না তেমন কিছু নয়। এটা আমার ছোটবেলার হবি। তাই ধরে রেখেছি। আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে বলল, মিরিকের সবকিছুই তো তুমি নিয়ে এসেছো, ভারী সুন্দর হয়েছে। আমাকে একটা ছবি এঁকে দেবে? আমি বললাম, চেষ্টা করব। ও বলল, না কালকেই দিতে হবে, পরশু আমি বাড়ি চলে যাব, আমার ফেরার টিকিট করা আছে।
রাতেই আমি চটপট করে ওর মুখের ছবিটা এঁকে ফেললাম। সকাল হলেই শ্রেয়া সোজা আমার ঘরে এসে হাজির। আমি তো দেখে অবাক, সে বলল, কই এঁকেছো, দেখি? প্রথমে আমি না না করলেও পরে বললাম, এঁকেছি তবে ভালো হয়নি। সে বলল দেখি। আমি ছবিটা ওর হাতে দিলাম। ও দেখে বলল বাঃ কি সুন্দর হয়েছে। এত সুন্দর তোমার আঁকার হাত। আমি বললাম, তেমন নয়, এঁকে যাচ্ছি। শ্রেয়া ছবিটা টেবিলে রেখে বলল, আমিও তোমার জন্য একটি উপহার এনেছি। আমি বললাম, দেখি কি? ওর হাতে আঁকা আমার মুখের ছবিটা হাতে তুলে দিল। কি সুন্দর, অবিকল আমার মুখ। মনে হল শ্রেয়া আমার চেয়ে বেশি ভালো ছবি আঁকতে পারে। আমি বললাম, বাঃ এত সুন্দর তোমার হাত। সুন্দর ছবি আঁকতে পারো তো দেখি। ও একটু মুচকি হেসে বলল, না, তেমন কিছু না শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছি। শোনো, তোমার জন্য আরেকটি ছবি আছে। এই বলে সে আরেকটি ছবি আমার হাতে তুলে দিল।
দেখলাম একটি মানুষের ছবি। কিন্তু তার বুক চেঁরা, তার হৃদপিণ্ডটা রয়েছে বাইরে। আমি দেখে বললাম, এ কী এটা যে হৃদয়হীন মানুষ.... ও বলল, হ্যাঁ তাই। আমি বললাম, মানে? মানে তাই বোঝার জন্য তোমাকে দিলাম, তুমি বুঝে আমাকে বলবে। আমি মনে মনে ভাবলাম, এটা কিসের ইঙ্গিত? হৃদয়হীন মানুষ থাকতে পারে? এটা কোন নিষ্ঠুর মানুষের ছবি। তবে কি ও আমাকে বোঝাতে চাইছে আমি একজন হৃদয়হীন মানুষ? ওকে বললাম, এটাতে কি তুমি আমাকে বোঝাতে চাইছো। আমি হৃদয় হীন মানুষ, আমার মধ্যে স্নেহ ভালোবাসা মায়া কিছুই নেই? ও মুচকি হাসি হেসে বলল, বুঝতে পেরেছ তবে। তুমি তাই। এই বলে ঘর থেকে আমার আঁকা ছবি টা নিয়ে চলে গেল।
পরদিন ও রাতের ট্রেনে যাবে। আমি জয়ন্তী বাবাই গেলাম ওকে স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিতে। আমি আগেই একটি ছবি এঁকে নিয়ে গেছি। ট্রেন ছাড়ার আগে ওর হাতে দেব।ঠিক তাই করলাম ট্রেন ছাড়ার আগে ওর হাতের ছবিটা দিলাম বললাম, এটা তোমার ছবির প্রশ্নের উত্তর। ও তাড়াতাড়ি করে খুলে দেখল ছবিটা,দেখে হাসিমুখে আমাকে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। তুমি ভালো থেকো। জয়ন্তি বলল, দেখি শ্রেয়া ছবিটা দেখি। ও দেখালো, ছবিতে আঁকা একটি ছেলে মানুষ তার বুকের হৃদয়ে আঁকা একটি মেয়ের মুখ। জয়ন্তি বলল, দারুন হয়েছে দাদা। শ্রেয়া, এবার বুঝলি তো দাদা তোকে কোথায় জায়গা করে দিয়েছে। ও কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ট্রেন ছাড়ার সময় হল ধীরে ধীরে ট্রেনটির প্ল্যাটফর্ম ছাড়লো আর আমরাও চলে এলাম।
তারপর অনেকদিন কেটে গেল আমি বাংলায় পিএইচডি করলাম। ও এমএ পাস করল। এই সময়ের মধ্যে শ্রেয়ার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি, তবে প্রতিদিন ফোনে কথা হতো। আমি যখন কলেজে চাকরি পেলাম, তখন ওকে একদিন বললাম, এবার কি আমার হৃদয়ের স্থায়ীভাবে আসার সময় হয়েছে? ও বলল, হ্যাঁ তোমার যদি হৃদয়ে স্থান দেওয়ার মতো সময় হয়ে থাকে আমি প্রস্তুত।
সে যেন নতুন জীবনের নতুন ক্যানভাস।আমরা দুজনে একসঙ্গে আমাদের জীবনের রঙিন ক্যানভাস কে রঙিন করে সাজিয়ে তুলতে ঘর বাঁধলাম।