STORYMIRROR

Aparna Chaudhuri

Drama

1  

Aparna Chaudhuri

Drama

কুট্টুন - ৮

কুট্টুন - ৮

6 mins
1.0K


আজ হোলি। বিল্ডিঙের নিচে পার্কিং এর সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে একটা ‘ইনফ্লেটেড পুল’ লাগানো হয়েছে। তাতে জলের ট্যাঙ্কার এসে জল ভরে দিয়ে গেছে। ওই পুলে রঙ গুলে তাতে বাচ্চা বুড়ো সবাই ডুববে। পুলের পাশে নানা রকম মিষ্টি আর নোনতার স্টল। আর তার পাশে বানানো হয়েছে একটি বার। সেখানে হার্ড ড্রিংক, সফ্ট ড্রিংক, ভাঙ্গের সরবত আর জল সব পাওয়া যাচ্ছে।

“ নিচে তো দারুণ কাণ্ড হচ্ছে। তাই ভাবি তিনশো টাকা পার হেড চাঁদা নিয়ে এরা হোলিতে করবে কি?” কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেখর গল্প করছিল নির্মলার সাথে।

“আমাদের সময় হোলি মানে একটা পিচকারি, এক প্যাকেট রঙ, ব্যাস, পুরনো জামাকাপড় পরে নেমে পড়... এখন হোলির সংজ্ঞাই বদলে গেছে।”বলল নির্মলা।

“মাম্মা! নাভিন লা থব চলে গেচে নিচে। আমি লেত।” চেঁচাতে চেঁচাতে বারান্দা থেকে ছুটে ঘরে ঢুকে এলো কুট্টুন। 

এতক্ষণ মন দিয়ে বারান্দা থেকে কট্টুন নিচের সব ব্যবস্থা দেখছিল। এই মাত্র বাড়ীর সব ছেলেরা সাদা পাজামা পাঞ্জাবী আর মেয়েরা সাদা সালওয়ার কামিজ পরে নেমেছে। তাই কুট্টুনের আর তর সইছে না।   

“তুমি একটু কুট্টুনকে তৈরি করে দাও না... ।” বলল নির্মলা।

“ওকে ডিয়ার...... এসো আমি তোমায় রেডি করে দিই।“ বলে শেখর কুট্টুনকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। তারপর মাথা থেকে পা অবধি তেল মাখিয়ে জামা-প্যান্ট পরিয়ে ছেলেকে তৈরি করে দিলো শেখর।

“ব্রেকফাস্ট না করে নামবে না...।“ বলল নির্মলা।

“মাম্মা! ওখানে কত খাবাল!”

“ সত্যি নির্মলা, ওকে যেতে দাও না ...!”

“ না! একবার খেলতে শুরু করলে ওর খাবার কথা মনেই থাকবে না।“ টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে বলল নির্মলা।

“মাম্মা ইস রাইট! চল জলদিসে আমরা খেয়ে নিই, কেমন?“

কোনোরকমে খাবার নাকে মুখে গুঁজে কুট্টুন নিজের রঙ পিচকারি নিয়ে ছুটল নিচে।

নির্মলাদেরও যাবার কথা কিন্তু ওরা এখানে হোলি খেলবে না। দুপুর বারোটা নাগাদ ওদের বন্ধুদের একটা ‘হোলি মিলন’ আছে। মুম্বাই শহরের কয়েকটি প্রবাসী বাঙালি পরিবার, এখন ওদের খুব কাছের বন্ধু। ওদের এক বন্ধু বিপাশার ফ্ল্যাটটা বেশ বড় আর তাতে একটা খোলা ছাদও আছে। সেখানেই দোল উপলক্ষে ওদের আসর বসবে আজ। নির্মলা একটা পাটভাঙা তাঁতের শাড়ী পরে সবে টিপটা লাগাতে যাবে, ভীষণ ভাবে কলিং বেলটা বেজে উঠলো। শেখর দরজাটা খুলে দিতেই ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে কুট্টুন ভিতরে ঢুকে এলো।

ওর সারা গায়ে রঙ, মুখটা গম্ভীর,” মাকে দাকো ......থিগগিল।“

“কি হয়েছে ? আমাকে বল না।“

“ না। মাকে দাকো।“

নির্মলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো,” কি হয়েছে রে?”

“তুমি এতা কি লং এনেচ? এতা তো হালবাল কালার না...... ওলা কেউ আমাল লং নিলো না...” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো কুট্টুন।

নির্মলা আর শেখর প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতেই পারলো না।

ওকে ভোলানোর জন্য শেখর বলল,“ নেয় নি তো বয়েই গেলো। ভালই তো , চল এই রঙটা নিয়ে আমরা বিপাশা আন্টির বাড়ী যাব আর ওখানে ......”

“ না......না, ওলা আমালতা কেন নেবে না? তালে আমি কেন নেব ওদের লং...... অ্যাঁ ...অ্যাঁ...“

ছেলেকে থামাতে না পেরে নির্মলা ফোন লাগাল পাশের ফ্ল্যাটের ডলি ভাবীকে,” হ্যালো, ভাবী? ম্যায় কুট্টুনকে মাম্মি, ইয়ে কালার লেকে কুছ হুয়া ক্যা?”

ফোনে ডলি ভাবীর গলা ভেসে এলো,” কুছ খাস নাহি ভাবী। হাম ইস বার সির্ফ হার্বাল কালার সে হি হোলি খেল রাহে হ্যাঁয়। Other colours are harmful for the children, you know. আপনে যো কালার ভেজা উও herbal colour নাহি হ্যায়। ইস লিয়ে হামনে বোলা কে তুমহারা কালার রাখ দো, আউর হামারে কালার সে হোলি খেলো । তো উও বুরা মান গয়া...।“

ফোন রেখে নির্মলা ছলছল চোখে কুটুনের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” সরি বাবা, আমি জানতাম না যে ওরা ......“

“ কেন দানতে না ...... কেন?” কুট্টুন কেঁদেই চলল।

“ চুপ একদম চুপ, আর একটাও কথা হবে না এই নিয়ে।“ ধমকে উঠলো শেখর।

“তুমি ওকে বকছ কেন? ওর কি দোষ? ওরা বড়রা যদি ওর হাত থেকে রঙটা নিয়ে লুকিয়ে রাখতো, তাহলে কি ওদের জাত যেত? একটা দুধের শিশু...... আমারই ভুল...” , নির্মলা কুটুনের চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল।

“ না কারুর ভুল না। তুমি কি জানতে যে ওরা হার্বাল রঙ ছাড়া কিছু ব্যবহার করবে না? সব দোষ নিজের কাঁধে নেওয়া বন্ধ কর। জীবনে এরকম ঘটনা হামেশাই ঘটবে, যেখানে সব কিছু ওর পছন্দ মত হবে না। ওকে এরকম সিচুয়েসন ফেস করতে শিখতে হবে। “

“ও এখনও বড্ড ছোট।“ গলাটা কেঁপে উঠলো নির্মলার।

“ যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝবে ততই ভালো। আমরা বাবা মা হিসাবে ওকে ভালোবাসা দেবো, সিকিউরিটি দেবো। কিন্তু negativity বা ne

gligence কি করে handle করতে হয় সেটা ওকে সমাজ শেখাবে । এখন যাও দেখি একটা পুরনো চাদর নিয়ে এসো। কুট্টুনকে superman এর ক্লোকটা পরিয়ে দিই । নইলে গাড়ীর সীটটা যাবে। কুট্টুন... আমরা কি সাজবো? “

“ থুপাল ম্যান! “ কান্না ভুলে, খিল খিল করে হেসে উঠলো কুট্টুন।

বাড়ী থেকে বেরোনোর সময় নির্মলা রঙের প্যাকেট গুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিলো,” শোন রাস্তার কোথাও থেকে আমরা কিছু হার্বাল কালার কিনে নেব কেমন?”

“ওকে!” বলে শেখর আর কুট্টুন লিফটের দিকে রওনা হল। পিছনের সিটে কুট্টুনকে বসিয়ে শেখর ড্রাইভিং সিটে বসে হাঁক দিলো,” we are getting late Mamma…..” সঙ্গে কুট্টনও গলা মেলাল।

ছুটতে ছুটতে নির্মলা এসে গাড়িতে বসতেই ওরা রওনা হল।

“আচ্ছা বলতো কুট্টুন সুপারম্যানের স্পেশালিটি কি?” জিজ্ঞাসা করল শেখর।

“ থুপাল ম্যান উলতে পারে...।“

“উঁহুঁ!”

“ওল চোখ দিয়ে ‘রে’ বেলোয় ।“

“উঁহুঁ!”

“তালে?”

“সুপারম্যান প্যান্টের ওপর দিয়ে আন্ডারওয়্যার পরে।“ বলে হোহো করে হেসে উঠলো শেখর সঙ্গে কুট্টুনও।

“তো জাঙ্গিয়া হল সুপারম্যানের পহচান, মানে প্রেস্টিজ। তাই কাউকে ওখানে হাত দিতে দেওয়া যাবে না, বুঝলে সুপারম্যান? আর তুমিও কারুর প্রেস্টিজে হাত দেবে না। তাহলে কোথায় রঙ মাখাবে? মুখে, হাতে, পায়ে...” বলতে লাগলো শেখর।

নির্মলার মোবাইলটা বেজে উঠলো, বিপাশার গলা,” কখন আসবি তোরা? আমরা সবাই ওয়েট করছি!“

“আরে আর বলিস না, হার্বাল কালার নিয়ে এখানে একটা হাঙ্গামা হয়ে গেলো, এসে বলছি। আমরা আর দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছব । কিছু কিনে আনতে হবে?”

“ না না, তোরা চলে আয়।“

বিপাশাদের বাড়ী গিয়ে ওরা দেখে ব্যবস্থা দারুণ। ছাদে খানিকটা জায়গায় শতরঞ্চি পেতে দেওয়া হয়েছে। তার মাঝে হারমোনিয়াম। বিপাশা গান গাইছে, “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান......”

সবার জন্য পলাশের মালা বানিয়ে এনেছে কল্পনা। কারুর গলায়, কারুর খোঁপায় সেই মালা। থালা ভরে ভরে মালপোয়া, গুজিয়া, লাড্ডু আর নানা রকমের নোনতা সাজানো রয়েছে। যারা পৌঁছে গেছে, আবির মেখে তারা সকলেই ভুত। ছাদের অন্য পাশে ছোটদের জন্য পিচকারি দিয়ে রঙ খেলার ব্যবস্থাও রয়েছে। 

কুট্টুন ছুটে চলে গেল হোলি খেলতে। শেখর বাকি ছেলেদের সঙ্গে পানীয় সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আর নির্মলা গিয়ে যোগ দিলো গানের আসরে। খানিকক্ষণ বাদে বাচ্ছারা এলো মিষ্টি খেতে। সবার সাথে কুট্টুনও এসে মিষ্টি খেতে খেতে বিপাশার গান শুনছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো,”আন্তি! তোমাল মালাতে ইল্লি! ইইইইইল্লি! ইইইইইইইল্লি!”

আর ব্যাস, মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশ শান্তিনিকেতন থেকে বদলে হয়ে গেলো কুম্ভমেলা। বিপাশা হারমোনিয়াম ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো। ওর গলার মালা থেকে একটা ইঞ্চি আধেক লম্বা ‘বিশা--ল’ শূককীট পাওয়া গেলো। তাই দেখে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুটের ‘ছোট ছোট’ মহিলারা প্রায় অজ্ঞান হবার জোগাড়। হুটোপাটি চেঁচামিচির মধ্যে দিয়ে সমস্ত পলাশ ফুলের মালা ডাস্টবিনে স্থান পেলো।

এরপর আর গানের আসর তেমন জমলো না। সবাই যে যার বাচ্চাকে স্নান করার জন্য নিয়ে গেলো। এইখানেই দেখা দিলো প্রবলেম নম্বর ২।

নির্মলা কুটুনের চেঞ্জ আনতে ভুলে গেছে।

বিপাশা বলল, “দ্যাখ ভিজে জামা পরে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুই বরং আমার ছোটমেয়ের টি শার্ট আর প্যান্ট পরিয়ে দে।”

নির্মলা বুঝলো ও ঠিকই বলছে। তাই বিপাশার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো। বিপাশা তাড়াতাড়ি একটা গোলাপি প্যান্ট আর সাদা টি শার্ট এনে দিলো। ওরা কেউই খেয়াল করেনি যে টি শার্ট টার ওপর লেখা আছে “Girl Power”.

 কুট্টুন চেঞ্জ করে বাইরে আসতেই ওদের বান্ধবী দিয়া, বলে উঠলো, “আরে কুট্টুন বাবুকে তো একদম টু ইন ওয়ান আইসক্রিমের মত দেখাচ্ছে!”

অনুপম ফট করে বলে উঠলো, “এটা কি লেখা রে তোর টি শার্টে ? Girl Power?”

শুনেই সব বাচ্চারা হাসতে শুরু করলো, “ কুট্টুন একটা গার্ল...... কুট্টুন একটা গার্ল!”

আর যায় কোথায়?

“আমি গার্ল নই। বাবা...আমি তো ......আমি তো...”

“না না তুমি তো সুপারম্যান।” বলে শেখর কুট্টুনকে কোলে তুলে নিলো। কুট্টুন আর শেখরের কোল থেকে নামবে না। শেখর ওকে নিয়ে কোন রকমে বিপাশার বেডরুমে ঢুকে গেলো। সেখানেই অনেক চেষ্টা চরিত্র করে নির্মলা ওকে অল্প কিছু খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

কুট্টুন ঘুমোতে নির্মলার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল,” শুনছো চলো এই বেলা ওকে নিয়ে আমরা বাড়ী চলে যাই। জেগে উঠলে, girl power নিয়ে আবার ঝামেলা শুরু হবে।”

ওর কথা শুনে মুচকি হেসে শেখর বলে উঠলো, “এখনও তো কিছুই দেখনি। আর কটা বছর যেতে দাও, তারপর বুঝবে girl power নিয়ে ঝামেলা কাকে বলে।”

সমাপ্ত

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama