কুট্টুন ৩
কুট্টুন ৩
“থাকুল পাপ দিলে কি হয় মাম্মা?”, আবার জিজ্ঞাসা করলো কুট্টুন ঘরে এসে।
“জানিনা ...।” বলে ওকে ধপাস করে খাটে বসিয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো নির্মলা।
কমলবাবু বাইরের ঘরে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। কুট্টুন এসে ওনার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে কমলবাবু কুট্টুনকে দেখে একটু হাসলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “কি দাদু, মন খারাপ?”
“থাকুল পাপ দিলে কি হয় দাদু?”
“ঠাকুর পাপ দিলে? ম্... ম্... আসলে ঠাকুর যখন রেগে যায় তখনই তো পাপ দেয়...... ঠাকুরদের..., এই যেমন ধর মহাদেবের কপালে একটা থার্ড আই মানে তৃতীয় চক্ষু থাকে। তা, উনি যখন রেগে যান তখন উনি ওই থার্ডআইটা খোলেন আর সেই থার্ড আই দিয়ে আগুন বেরোয়। সেই আগুনে সব দুষ্টু লোকেরা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। “
কুট্টুন গুটি গুটি কমল বাবুর কোলের উপর উঠে বসলো। তারপর ওনার বুকের উপর মাথা রেখে, চিঁচিঁ স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কাউকে এমন পাপ দিতে দেখেছো?”
কমল বাবু একটু ভাবলেন তারপর বললেন, “না দেখিনি...... তবে শুনেছি।“
“কে সেটা?”
“সে ছিল একজন, তার নাম ছিল মদন।“
“আমি কি মদনের মত দুষ্টু?”
“নাঃ তুমি অতটা দুষ্টু নও।”
“মদন পুলে থাই হয়ে গিয়েছিল?”
“হুম... তা হয়েছিল বইকি।”
“তালে মদন পুলে মলে গেলো?” কুট্টুনের গলার স্বর কাঁদো কাঁদো।
“হল কি, মদনের যে বউ, তার নাম ছিল রতি। সে মহাদেবের কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে সরি বলল। মহাদেবের মনটা খুব নরম, তুমি যদি সত্যি করে সরি বল তাহলে ওনার মন গলে যায়। তখন উনি মদন কে আবার বাঁচিয়ে দিলেন।”
“হ্যালি পতালের ফিনিক্স পাখিল মত?”
“কি?... হ্যারি পটারের ফিনিক্স পাখি...হুম...তা বলতে পারো।“
“সকলে খেতে এসো”, ডাকলেন নমিতা দেবী।
“চলো দাদু আমরা খেতে যাই।“ বলে কুট্টুনকে কোলে নিয়ে কমলবাবু খাবার ঘরের দিকে রওয়ানা হলেন।
জলখাবার খেতে খেতে শেখর ওর মা কে বলল, “ মা, ভাবছি আজ কুট্টুন আর নির্মলাকে নিয়ে ওদের বাড়ী যাব বিকালবেলা। বিজয়াটাও সেরে আসবো। আমি রাতে চলে আসবো। নির্মলা আর কুট্টুন কদিন থেকে আসুক। কি বল?”
“দ্যাখো! তুমি যা ভালো বোঝো।” নমিতা দেবীর নির্লিপ্ত উত্তর।
খাওয়ার শেষে ঘরে ঢুকেই নির্মলা মাকে ফোন করলো, “মা! শোনো আজ বিকালে আমরা আসছি। শেখর আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে। আমরা থাকবো কদিন। তোমার কাছে।”
“রাতে খাবে তো শেখর ?” জিজ্ঞাসা করলেন নির্মলার মা স্বাতিলেখা দেবী।
“হ্যাঁ রাতে খাবে।”
বিকাল বেলায় ওরা গিয়ে পৌঁছল নির্মলার বাপের বাড়ী। ছোট্ট বাগানঘেরা বাড়ীটাতে নির্মলার মা স্বাতিলেখা আর বাবা অবনী বাবুর সংসার। স্বাতিলেখা খুব মিশুকে আর অবনী বাবু একটু রাশভারী। ওদের অপেক্ষায় দুজনেই বাইরের বারান্দায় বসে ছিলেন। ওরা ঢুকে ওনাদের প্রণাম করলো আর তারপরেই কুট্টুন চলে গেলো ওর দিদুনের কোলে। দিদুন ওকে এতদিন পর কোলে পেয়ে জড়িয়ে ধরে, চুমু খেয়ে খুব আদর করতে লাগলেন। কুট্টুন মানুষটা একটু স্বাধীনচেতা গোছের। কোলে চড়ে আদর খাওয়ার থেকে একা ছুটে বেড়ানই তার বেশি পছন্দ। খানিকক্ষণ আদর খাওয়ার পর সে হাঁপিয়ে উঠলো, কিন্তু দিদুন তাকে ছাড়তে নারাজ। তখন ভীষণ বিরক্ত হয়ে সে বলে উঠলো, “তুমি কি থব্বাইকে এভাবেই আদল কলো?”
দিদুন হেসে বলল, “করি তো।”
“দাদানকেও?............... দাদান তোমায় বতে না?”
হঠাৎ ঘরটা এতো নিঃশব্দ হয়ে গেলো যে পিন পড়লেও বোঝা যাবে । জামাইয়ের সামনে নাতির এই বকুনি শুনে লজ্জায় স্বাতিলেখা দেবীর কানের গোড়া অবধি লাল হয়ে গেলো। উনি মুহূর্তের মধ্যে কুট্টুনকে নিচে নামিয়ে রেখে রান্নাঘরে অদৃশ্য হলেন। ছাড়া পেয়ে কুট্টুন তীর বেগে ছুটে বাগানে চলে গেলো খেলতে। গলা খাঁকারি দিয়ে কিছুই হয়নি এমন একটা ভান করে শেখর আর অবনীবাবু ওদের আগের আলোচনায় ফিরে গেলেন। নির্মলা মাকে সাহায্য করার জন্যে ভিতরে চলে গেলো।
ভিতরে গিয়ে, “তোর ছেলে ......”, বলে হাসিতে ফেটে পড়লেন স্বাতিলেখা দেবী। সঙ্গে সঙ্গে নির্মলাও হেসে ফেললো।
“তোমলা এতো হাসচ কেন?” কোথা থেকে ছুটে এলো কুট্টুন।
ওকে কোলে টেনে নিয়ে স্বাতিলেখা জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই এখনি এতো দুষ্টু, বড় হয়ে কি হবি রে?”
“দাকাত হব। থাম্মি বলেছে।” গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলো কুট্টুন। স্বাতিলেখা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন নির্মলার দিকে। নির্মলা ওনাকে ঘটনাটা বলল। ওঁরা আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিলেন এমন সময় কুট্টুন বলে উঠলো, “বাবা বলেছে থাকুল আমায় পাপ দেবে। পাপ দিলে পুলে থাই হয়ে মলে দায়।“
“ওকি অলুক্ষুণে কথা, হ্যাঁ?” আঁতকে উঠলেন স্বাতিলেখা।
“তোকে এসব কে বলেছে?” জিজ্ঞাসা করলো নির্মলা।
“দাদু।”
“দাদু বলেছে ঠাকুর পাপ দিলে পুড়ে মরে যায়?” নির্মলা হতবাক।
“হ্যাঁ। “
“শুনছো? বলি শুনছো?” নির্মলা চেঁচিয়ে উঠলো। ডাক শুনে শেখর ভিতরে এলো। সব শুনে সেও অবাক হল, তারপর একটু ভেবে বলল, “দাঁড়াও, আগে বাবার সাথে কথা বলি। ব্যাপারটা কি হয়েছে বুঝি।”
মোবাইল-এ কমল বাবুর নম্বরটা ডায়াল করলো শেখর ওপার থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, “হ্যাঁ বল।”
“বাবা তোমার সাথে কুট্টুন এর কোন কথা হয়েছে পাপ দেওয়া নিয়ে।“
“আরে হ্যাঁ। সকাল বেলায় ও আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো পাপ দিলে কি হয় । তা আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে মদন আর রতির গল্পটা ওকে বললাম।”
“ওর মাথায় ঢুকেছে পাপ দিলে ও পুড়ে মরে যাবে।”
“আরে কি মুশকিল। আমি ওকে এটাও তো বললাম যে মন থেকে সরি বললে ঠাকুর মাফ করে দেয়। কি ব্যাপার বলতো? এনি প্রবলেম? “
“না না কিছু না। তুমি চিন্তা কোরোনা, আই উইল হ্যান্ডল।“ ফোন কেটে দিলো শেখর । তারপর কুট্টুন কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা, দাদু তোমায় আর কি বলেছিল? কি করলে ঠাকুর পাপ দেয় না?”
“দদি মন থেকে সলি বল তবে আবাল ছাই থেকে বেঁচে ওঠে, হ্যালি পতালের ফিনিক্সের মত।“ বলল কুট্টুন।
শেখর সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
রাত্তিরের খাবার খেয়ে শেখর চলে গেলো। নির্মলা ওকে এগিয়ে দিতে গেলো। কুট্টুন ছুটে এসে স্বাতিলেখাকে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো।
“আরে বাবা ছাড়। আমার শাড়ী খুলে যাবে। কি হয়েছে বল।“
কুট্টুন স্বাতিলেখার সামনে দাঁড়িয়ে, ওনাকে ইশারায় নিচু হতে বলল। স্বাতিলেখা ঝুঁকতেই ওঁর কানে কানে কুট্টুন জিজ্ঞাসা করলো, “দিদুন, তুমি জানো থাকুলকে সরি কি করে বলে?”
স্বাতিলেখা মুচকি হেসে বললেন, “ও, এই কথা? আয় তোর কানে কানে বলে দিচ্ছি।” তারপর ওর কানে ফিসফিস করে কিছু বললেন। কুট্টুন পুরোটা মন দিয়ে শুনল, তারপর বলল, “তুমি আমায় হেল্প কলবে তো?”
“নিশ্চয়ই! আমরা একটা টিম তাই না?”
কুট্টুনের মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।