কুঁড়ের বাদশা
কুঁড়ের বাদশা


এক দেশে এক রাজা ছিল। মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব খেয়াল চাপতো তার মাথায়। কোনোদিন মনে হল আকাশে ক’টা তারা আছে গুণে দেখতে হবে। কোনোদিন মনে হতো, সেই মন্ত্রগুলো খুঁজে খুঁজে বার করতে হবে, আগেকার দিনে যে মন্ত্র পড়ে হাত বোলালেই অন্ধলোকে দৃষ্টি ফিরে পেতো। খোঁড়া লোকে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারতো। বোবা লোক কথা বলতে পারতো আর পাঁচটা মানুষের মতো। আবার কোনোদিন মনে হতো মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়, পিছু পিছু গিয়ে একদিন দেখে আসতে হবে।
তখনকার দিনে রাজার ইচ্ছে মানেই রাজার হুকুম। সেই হুকুম মুখ থেকে বেরোনো মাত্রেই রাজ্যের লোক বেরিয়ে পড়তো এমন লোকের সন্ধানে, যে তেমন কাজ করতে পারবে। যদিও বেশীরভাগ সময়েই এমন উদ্ভট কাজের জন্য লোক পাওয়া যেতো না। তখন সকাল-বিকাল-রাতে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকতো পুরস্কারের টাকার অংক।
তবু লোক পাওয়া যেতো না। কারণ, রাজার কাজ হাতে নিয়ে শেষ করতে না পারলে গর্দান যেতো। কেউ কেউ অবশ্য লোভে পড়ে সেই কাজ করতে এগিয়েও আসতো। তারপর ‘কাজ চলছে’, ‘এই তো হয়ে এলো’, ‘আর ক’টা দিন লাগবে’ –বলে সময় পার করতো। এই করতে গিয়ে কিশোর হয়ে যেতো যুবক, যুবক হতো বৃদ্ধ আর বৃদ্ধ ঢলে পড়তো মৃত্যুর কোলে।
এসব দেখে শুনে রাজামশাই ঠিক করলেন, আর কাউকে এমন অনন্ত সময় দেওয়া যাবে না। সব কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হবে। কখনও রাজা নিজেই দিনক্ষণ বেঁধে দিতেন। কখনও বলতেন, “এই গাছে ফুল ফোটার আগে কাজ শেষ করতে হবে।”
এভাবেই চলছিল। হঠাৎ রাজার একদিন খেয়াল হল, রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে কুঁড়ে কে আছে খুঁজে বার করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে রাজার নির্দেশ জারি হয়ে গেল। আর চোখের পলক পড়ার আগেই রাজ্যের লোক-লস্কর-পেয়াদা পড়িমরি করে ছুট লাগালো। এ শহর থেকে সে শহর, এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম। কী, না দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় কুঁড়েকে রাজা ইনাম দেবেন। অতএব তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। সারা রাজ্যে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হল।
অনেক খোঁজ করবার পর কুঁড়ে পাওয়া গেল বটে, তবে একজন নয়, একসঙ্গে দু’-দু’জন! তারা দু’জনেই দাবী করতে লাগলো, রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় কুঁড়ে সেই-ই। কিন্তু সে কথা মুখে বললে তো হবে না, প্রমাণ চাই। মন্ত্রীমশাই বললেন, তাহলে পরীক্ষা নেওয়া হোক। এই বলে একটা খুপরি বানিয়ে দু’জনকেই তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। তারপর বাইর থেকে সেই খুইরিতে আগুন লাগিয়ে সবাই এদিক ওদিক লুকিয়ে পড়লো তাদের কাণ্ড-কারখানা দেখার জন্য।
খানিক পরেই আগুনের তাত লাগতে একজন আরেকজনকে ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলো, “সূর্য কোন দিকে জ্বলছে রে?”
ঠেলা খেয়ে দ্বিতীয়জন বললো, “কে চোখ খুলতে যাবে!”
ব্যাস, আর কোনও সন্দেহের অবকাশ রইল না। একটা মাত্র বাক্য শুনেই মন্ত্রীমশাই সেই দ্বিতীয় লোকটাকে ‘কুঁড়ের বাদশা’ খেতাব দিয়ে দিলেন।ঘর আগুনে পুড়ছে টের পেয়েও যে লোক কুঁড়েমির জন্য চোখ খুলে দেখতে রাজি নয়, তার চেয়ে বড় কুঁড়ে আর কে হতে পারে?