ক্ষুধার্ত নন্দিনী
ক্ষুধার্ত নন্দিনী
কলেজের নাইট গার্ড পাঁচু কাকার কথা সেদিন আমরা একচুলও বিশ্বাস করিনি, বিশেষ করে আমি তো নই'ই। কি একটা প্রসঙ্গে সেদিন পান চেবাতে চেবাতে চাপা গলায় উনি বলে বসলেন, "তোমরা... শান্তাপুরের ভাঙা পোড়ো বাড়িটা দেখেছো? আশা করি দেখেছো। তা..বলি কি...ও বাড়ির কোনো ইতিহাস-টিতিহাস কানে গেছে নাকি?”
আমরা চার জন'ই ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট, সবেমাত্র মাস দুয়েক হলো এই নতুন কলেজে । এখানকার ইতিহাস- ভূগোল-বিজ্ঞান কোনকিছু সম্পর্কেই আমরা অবগত নই। আমরা প্রায় একসাথে বলে উঠলাম, "কই! না তো। কি ইতিহাস? আমরা তো কিছুই শুনিনি"। পাঁচুকাকা তার মুখটা আমাদের দিকে এগিয়ে লাল চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বললেন, "ওবাড়ির চারদেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে নন্দিনী নামে এক সুন্দরী ললনার অতৃপ্ত আত্মা। গেঁজাখুরি গপ্পো নয় হে বাপু; বেশ কয়েকজন যুবক ওবাড়িতে রাত কাটাতে গিয়েছিল; আর ফিরে আসেনি। আর যারা ফিরে আসতে পেরেছে তারা সবাই হয়ে গেছে বদ্ধ-উন্মাদ। শুনেছি আগে নাকি নন্দিনীর ভুত গ্রামের অল্পবয়সী ছেলেছোকরাদের মোহের জালে জড়িয়ে টেনে নিয়ে যেত ঐ বাড়িতে। তারপর............. .।"
একটু দুষ্টু হাসি হেসে নিয়ে পাঁচুকাকা আবার বলতে শুরু করলেন,-
— কত বড়ো বড়ো গুনীন এলো, ওঝারা এলো... কেউই নন্দিনীকে শায়েস্তা করতে পারলোনা। ওদের মধ্যেই কেউ একজন নাকি বাড়ির চারপাশে একটা গন্ডি টেনে গিয়েছিলো। আর এই কারণেই নাকি নন্দিনী বাড়ির বাইরে আর পা রাখতে পারেনি। তোমরা খবরদার ওবাড়ির ত্রিসীমার মধ্যে যেও না। নন্দিনীর কবলে পড়লে জীবন যৌবন সব শেষ।
নন্দিনীর গল্প শুনে আমরা চার বন্ধুই অট্টহাসি হেসেছিলাম সেদিন। আমরা আগে বুঝতেই পারিনি পাঁচুকাকা একজন চরম আফিমখোর। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। পরে তিনি আরও যে কাহিনী আমাদের শুনিয়েছিলেন তা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বেড়া টপকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের উৎসাহ আর কৌতূহলকে। বেয়াড়া করেছিল আমাদের তরুণ উদ্যমকে।
এইযে আজ যে রাক্ষুসে বাড়িটায় কৌতূহলবশত রাত কাটাতে এসেছি... এটাই সেই বাড়ি,-নন্দিনীর মামাবাড়ি। ছোটবেলা থেকে নন্দিনী বুড়ো দাদু দিদিমার কাছেই মানুষ। দেখতে নাকি অপূর্ব সুন্দরী ছিল মেয়েটা। কিন্তু বয়েস যত বাড়তে থাকে তার চরিত্রের নানান খারাপ দিক ফুটে ওঠে। গাঁয়ের বেশ কয়েকজন যুবকের সাথে তার নোংরা সম্পর্কও ধরা পড়ে। বুড়ো দাদু যখন লোকমুখে নাতনির ব্যাপারে কানাঘুষো শুনলেন তখন তিনি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অবশেষে তিনি নন্দিনীর বিয়ে দেওয়ার পথ বেছে নেন।
বিয়েটা হয়ে গেল। কিন্তু কলকাতার বেসরকারি অফিসের কর্মচারী স্বামী বিনয় চাটুজো নন্দিনীকে রেখে গেল বৃদ্ধ দাদু দিদিমার কাছে। শনিবার রাতে সে শাস্তাপুর ফিরত আবার সোমবার পাড়ি দিত কলকাতা। এভাবেই চললো কয়েকমাস। ইতিমধ্যে হঠাৎই দাদু মারা গেলে অন্ধ দিদিমার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়লো। ব্যাস.... তারপর আবার শুরু হলো নন্দিনীর অবাধ লীলাখেলা।
সেদিন ছিল শুক্রবার। রাত্রে বিনয় নন্দিনীকে না জানিয়েই শান্তাপুর ফিরে এলো। আর পৌঁচ্ছেই দেখে ফেললো তার স্ত্রীর নোংরা সম্পর্ক। চরিত্রহীনা স্ত্রীর উপর ক্রুদ্ধ হয়ে বিনয় নন্দিনীর গালে কষিয়ে মারলো এক থাপ্পড়। ব্যাস, সব শেষ। সেই এক আঘাতে সেদিন মারা যায় নন্দিনী। তারপর বিনয় উধাও। দিন দুয়েক বাদে নাকি কলকাতার মেসবাড়ি থেকে বিনয়কে পাওয়া যায় ফাঁসিতে লটকানো অবস্থায়।।
এ বাড়ির কাঠের সদর দরজা থেকে ছাদের সিঁড়ি পর্যন্ত লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একটা সরু বারান্দা। সেই বারান্দার'ই ডানদিকের ঘরটায় ধুলো-ধালা ঝেড়ে বড়ো একখান মাদুর পেতে শুয়ে আছি আমরা চারবন্ধু। নন্দিনীকে নিয়ে পাঁচুকাকার শোনানো আজগুবি কাহিনীটা মনে পড়ে যাচ্ছে বারেবারে। মিথ্যে বলবনা, হালকা ভয়ও লাগছে আমার। যদিও অদ্ভুত কিছুই এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। মোবাইলের ডিজিটাল ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে বাজে। মিনিট তিরিশেক হলো আমাদের তাশের আসরটা ভেঙেছে। ওরা তিনজন খানিক আগেই ঘুমিয়ে কাঠ। রবির নাকের ঘরঘোরানী আওয়াজ ঘরটা ভরিয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে আমারও চোখের পাতা ভার হয়ে এলো।
রাত কটা হবে তখন জানিনা, আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। দেখি পলেস্তারা খসে পড়া, মলিন ফাঁকা কামরাটা অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে। দেখলাম রুমটা দামি দামি আসবাবপত্রে ঠাসাই আর আমরা শুয়ে আছি নরম চকচকে পালঙ্কে। আশেপাশে কোথাও থেকে একটা তীব্র সুরভি ভেসে আসছে। ধরপর করে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। এদিক ওদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ খাটের পায়ের দিকে নজর পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। দেখলাম.... সুসজ্জিত সুন্দরী এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে খাটের পাশে। সেই নিস্তব্ধ রাতে তাকে দেখামাত্রই তার রূপ-যৌবন আমার পেশিতে পেশিতে তীব্র টান জাগাতে শুরু করলো, আমি উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলাম। মূর্তিটা প্রথমে শরীরে দোলা জাগানো একটা মৃদু কামুক হাসি হাসলো। তারপর নারীমূর্তিটা ইশারা ইঙ্গিতে আমাকে ডাকতে ডাকতে ঢেউ খেলিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো। আর আমি... তার যৌবনের টানে লোলুপ-ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো পিছু নিলাম।
এখন আমরা সরু বারান্দার বামদিকের বড়ো ঘরটায় এসে পড়েছি। নীরব কামরাটা আমার উন্মত্ত হৃদস্পন্দনে ডুবে আছে। আমার নিজের বাস্তব জগৎটা ফেকাসে হতে হতে কোথায় হারিয়ে গেল, আমি শুধু তার সুগঠিত শরীরের আকৃষ্টে আবদ্ধ হয়ে রইলাম। এটাই যে পাঁচুকাকার সেই দুষ্টু সিনেমার নায়িকা নন্দিনী, তা বুঝেও বুঝতে চাইলাম না। প্রেত নন্দিনীর সংস্পর্শে আসা পুরুষদের হালের ব্যপারেও আমি অবগত ছিলাম; কিন্তু সেসব কিছুকে পাত্তা দিলো না আমার ক্ষুধার্ত শরীর। নন্দিনী প্রথমে এলোমেলো পোশাকে কোমল গদিতে গা এলিয়ে দিলো, তারপর আঙ্গুল নাড়িয়ে সুক্ষ স্বরে আমাকে আমন্ত্রণ পাঠালো,-
-"এসো। কাছে এসো। লজ্জা কিসের গো। বহুদিন ধরে আমি অতৃপ্ত-অভুক্ত। দেহের প্রতিটা কোষে কোষে আমার ক্ষুধা। এসো, কাছে এসো....। আহা!... তোমার শরীরেও তো দেখছি ঝড় উঠেছে! এসো..... এসো শাস্ত হও”।
সে একে একে পায়ের নুপুর, হাতের চুড়ি খুলে রাখলো খাটের পাশের টেবিলটার ওপর। আদিম রিপু আমাকে আপাদমস্তক গ্রাস করে খচখচ করে চিবিয়ে খাচ্ছিল। আমি হামলে পড়লাম তার ওপর। প্রথমে তার শরীর স্পর্শ করলাম, তারপর ধীরে ধীরে চড়ে বসলাম শুভ্র কোমল দেহেটার উপর। এমন অপরুমা, এমন চোখের চাহনি আমি আগে দেখিনি। উত্তেজনা আর দেহত্তাপ যখন সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে হাজির...... তখনই হঠাৎ চোখ পড়ল ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার উপর। আয়নার কাচে যে দৃশ্য দেখলাম তা আমার ফুটন্ত রক্তকে এক ঝটকায় হিম করে দিল। সাথে সারা শরীর গুলিয়ে উঠলো। দেখলাম আয়নার ভেতর আমি শুয়ে আছি একটা ভয়ংকর বীভৎস পচা-গলা নারীর নগ্ন শরীরের উপর। এতক্ষণে আমি নিজ হুঁশ ফিরে পেয়ে আতঙ্কে ছিটকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লাম। আমার বড্ড বমি বমি পাচ্ছে। হৃৎপিন্ডটা সজোরে ধাক্কা দিতে দিতে যেনো বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার চোখের সামনে সুসজ্জিত কামরার সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে আবার আগের মতো ধুলো নোংরায় ভরে গেল।
আমি খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে, তারপর দুহাতে ভর দিয়ে কোনোরকম উঠে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎবেগে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম বাইরে থেকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নন্দিনী মোটা কাঠের দরজা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমার গলা চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মেলানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি আমার সর্বশক্তি একত্র করে দুহাত দিয়ে তার গলা ধরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। তারপর আমি বোধবুদ্ধি হারিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পালাতে লাগলাম। দুজনের ধস্তাধস্তিতে ভারী লকেটযুক্ত তার গলার চেনটা ছিঁড়ে আমার হাতে চলে এসেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি বাড়ির ন্যাড়া ছাদে এসে পড়লাম। এবার আমার পালানোর পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ। নন্দিনীও ছাদে এসে হাজির, শাড়ির আঁচলটা মেঝেতে লুটছে। সে আমার দিকে ক্রুদ্ধ- ভস্ম করা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
আমি ধক-ধক বুক নিয়ে পিছতে থাকলাম। নন্দিনীও এগিয়ে আসতে থাকলো আমার দিকে।
পিছতে পিছতে আমি একেবারে শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি। নন্দিনী এখন আমার থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। সে আমাকে ধরার জন্য সাদা ফর্সা দুটো হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি প্রায় জ্ঞানশূন্য হয় প্রাণভয়ে ছাদ থেকে টলে পড়লাম। আমার নাক মুখ দেওয়ালে ঘষা খেয়ে ছিঁড়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল। শুধু কোনো রকম বাম হাত দিয়ে ছাদের প্রান্তটা আকড়ে ধরে রাখলাম। আমি এখন ঝুলছি। নীচের বাগানে সদর দরজার বাইরে বড়ো করে জ্বালানো কাঠের আগুনটা এখনো জ্বলছে। ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপছে। হঠাৎ আমার কম্পমান ডান হাত থেকে নন্দিনীর গলার লকেটটা খসে পড়ে গেলো সেই অগ্নিকুন্ডের মধ্যে। আর পড়ামাত্রই এক জোরালো বোমা বিস্ফোরণের শব্দে আগুনটা লাল বর্ণে ফেটে উঠলো। কি ঘটছে আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না।
নিচ থেকে ঝলসানো চোখ নিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই দেখলাম আর এক বীভৎস কান্ড। দেখলাম যে নন্দিনীকে দেখে আমার শরীরে উত্তেজনা ভর করেছিল, এ নন্দিনী আর সে নন্দিনী নেই। তার সুন্দর সুগঠিত চেহারাটা আয়নার মধ্যে দেখা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। আর তারই সাথে এক কান ফাটানো যন্ত্রণাসূচক আর্তনাদ করে সেই বিভৎস শরীরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধুলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে।


