ক্রিস্টমাসের প্রোপোজাল
ক্রিস্টমাসের প্রোপোজাল


এগারো বছর আগের কথা। সেদিন ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর,সালটা ছিল 2007। জিঙ্গল বেল,জিঙ্গল বেল,জিঙ্গল অল দ্য ওয়ে!
সকাল বেলা থেকেই সোনালী সূর্যকিরণে ঝিকিমিকি করে উঠেছিল চারদিক। পাখির কূজনে মুখর হয়ে উঠেছিল পৃথিবী। মরশুমী ফুল আর রঙ বেরঙের পরিযায়ী পাখির সৌন্দর্যে প্রকৃতিরাণী সত্যিই নিজেকে এক মোহময়ী নারীতে পরিণত করে সাজিয়ে তুলেছিলেন। ঝিরঝির করে বয়ে চলা হিমেল হাওয়া যেন প্রেমের গান গাইছিল,প্রেমের কথা বলছিল।রৌদ্রোজ্জ্বল এক সোনালী সকাল। ডিসেম্বর শেষ হতে চলল। আকাশে বাতাসে নববর্ষের আগমনবার্তা ধ্বনিত হচ্ছিল। বাগানে গাঁদা,টিউলিপ আর চন্দ্রমল্লিকার বর্ণ ও গন্ধে ধ্বনিত হয়ে চলেছিল সৌন্দর্যের বাহার। আজকে 25শে ডিসেম্বর। এই দিনটির বিশেষ এক গুরুত্ব রয়েছে। এই দিনটিতেই জেরুজালেমের Nazareth শহরে কুমারী মা মেরীর কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বা মেসিহা জেসাস অব নাজারেথ,যিনি জেসাস ক্রাইস্ট বা যিশু খ্রীষ্ট রূপেই সুপরিচিত। কারোর মতে তিনি আবার ঈশ্বরের সন্তান। ইনি মানবসেবাকে ও মানবপ্রেমকে তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রতিফলিত করেছিলেন। চার্চ প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে আর্তের সেবা করা, যিশুর কর্মে মুখর হয়ে গিয়েছিল সমগ্র ইউরোপ। তিনি এসেছিলেন মানুষকে পাপমুক্ত করতে। তাই তো তিনি তাঁর অনুগামীদের বলেছিলেন যে, পাপ কে ঘৃণা করতে,পাপীকে নয়। রোম সম্রাট যখন তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন তিনি দুঃখিত বা ক্রোধিত কোনোটাই হন নি। বরং, সমাজের লোকের পাপের জন্য পরমপিতা পরমেশ্বরের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে প্রভু,এরা জানে না,এরা কি করছে! যিশুর অনুগামী খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের মতে,মৃত্যুর পরেও তিনি আবার বেঁচে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন মানুষকে হিংসা ও বৈরিতা ভুলে গিয়ে প্রেম ,সততা আর ভালোবাসার পথে চলতে। সেইদিন ছিল 25শে ডিসেম্বর,এই মহান পুরুষের জন্মদিন। ক্রিস্টমাস,বা যেটা বড়দিন বলেই সুপরিচিত। আমাদের কাছে ক্রিস্টমাস মানেই জেসাস ক্রাইস্ট,ক্রিস্টমাস মানেই ফুলফল ,চকোলেট ও আকর্ষণীয় আলোকসজ্জা দ্বারা সজ্জিত ক্রিস্টমাস ট্রি ,ক্রিস্টমাস মানেই সান্তাক্লজ, ক্রিস্টমাস মানেই কেক খাওয়া,ক্রিস্টমাস মানেই গান বাজনা ও খেলাধূলার মাধ্যমে দিনটাকে উদযাপিত করা, ক্রিস্টমাস মানেই প্রেম।
আমার তখন ক্লাস নাইন। বয়ঃসন্ধিকাল। ধীরে ধীরে যৌবনের রোম্যান্স শরীর আর মননে প্রবেশ করছে। অ্যাডভেঞ্চারকে ভালোবাসতে শুরু করেছি,সাসপেন্স থ্রিলার পড়তে রীতিমতো পছন্দ করি তখন। ঠিক করেই ফেলেছি টুয়েলভে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ট্রেকিং করতে যাব। যাই হোক, সকাল থেকেই রীতিমতো খোশ মেজাজে। কতোদিন পর একটা ছুটি পাব,পড়ার চাপ রীতিমতো পাহাড়ের বোঝার মতো মাথায় আর পিঠে চেপে বসেছিল। রোজ রোজ এক স্কুল ,এক টিউশন,জীবনের একঘেয়েমিতে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম । এমনিতেই কৈশোর বয়সে টিউশনে পড়তে যাবার আলাদা উত্তেজনা থাকে, গোবিন্দস্যারের ভূগোল ব্যাচই হোক আর তপনস্যারের বিজ্ঞান আর অঙ্কের টিউশন ব্যাচই হোক, স্যারদের বোঝানো যতো আকর্ষণীয় ছিল,আমার কাছে ততোধিক আকর্ষণীয় আর অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল পৌলমীর দেখা পাওয়া। পৌলমী যদি কোনোদিন কোচিং এ না আসত তাহলে আমার দিনটাই যেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে যেত, তেমনই একঝলক পৌলমীর সাথে নয়নে নয়নে মিলন বা একটু কথা বলার মধ্যেই একরাশ ভালোলাগা মনে কোথা থেকে তৈরি হয়ে যেত,নিজেই বুঝতে পারতাম না। পৌলমী আমার দিকে তাকিয়ে যখন একটু মুচকি হাসত,তখন মনের মধ্যে বেজে উঠত কতো অজানা রাগ রাগিণী। যাই হোক, ধীরে ধীরে পৌলমীর প্রেমে পড়ে গেছিলাম। আর সামনেই নববর্ষ। তখন তো এতো ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের চল ছিল না, তো আমাদের মতো কিশোর কিশোরীদের কাছে নিজের পছন্দের বা ভালোবাসার মানুষকে গ্রিটিংস কার্ড দেবার আলাদা মাহাত্ম্য ছিল। চাইতাম ভালোবাসার মানুষকে সবচেয়ে সুদৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর মেসেজ লেখা কার্ডটাই উপহার দিতে। তো নিউ ইয়ারে পৌলমীকে কি গ্রিটিংস কার্ড দেব ,ভেবে ভেবেই হিমশিম খাচ্ছিলাম। চাইছিলাম প্রেমের বার্তা লেখা বা রোম্যান্স বইয়ে দেওয়া ছবির কার্ড উপহার দিয়ে সেদিনই নিজের ভালোবাসাকে ব্যক্ত করতে। পৌলমীর উত্তর বা প্রতিক্রিয়া কিরকম হয়,সেটা জানার জন্য অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলাম, সব কিশোর প্রেমিকই যেমন করে। পরিণত যৌবনে যারা প্রেম করে, তাদের কাছে কৈশোরের প্রেম সত্যিই কিছুটা অপরিণত,কিছুটা অস্থির,কিছুটা চঞ্চল,কিছুটা বাস্তবিকতা থেকে দূরে রঙিন ফ্যান্টাসি দিয়ে ঘেরা। কিন্তু তাদের কে বোঝাবে, এটাই কৈশোরের উন্মাদনা,কৈশোরের আবেগ,কৈশোরের প্যাশন।
যাই হোক, সকাল থেকে বাড়িঘর সাজানো, পোষা ল্যাব্রাডর লিজার সাথে খেলা করা, ক্রিস্টমাস ট্রি নিয়ে আসা,সেলিব্রেশনের প্ল্যান পোগ্রাম করা, কেক খাওয়া,দাদুর সাথে গল্প করা,অনেকদিন পরে বাড়িতে আত্মীয়দের আগমন, বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানিং-এই একরাশ ভালোলাগার মধ্যে কোথাও খারাপ লাগা কাজ করছিল। ইশ,পৌলমীর সাথে আজ আর দেখা হবে না। আজ এই সোনালী দিনটায় যদি সেই হৃদয়হারিণী প্রিয়ার সাথে দেখা হত,কতোই না ভালো হত। সত্যিই পুরো দিনটা ফাটাফাটি কাটত! ছোটবেলায় বড়োরা বলতেন সান্তা ক্লজের কাছে কেউ যদি মন থেকে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে সান্তা তার এই চাওয়া পূরণ করেন। আমি মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম , আজকে দেখা নাই বা হল,নিউ ইয়ারস ইভে তো ওকে প্রপোজ করছিই।তাও মনে মনে সান্তার কাছে প্রার্থনা করলাম আজ যেন ওর সাথে দেখা হয়।
কে জানত,অপেক্ষা করছে আমার জন্য এক বিস্ময়!হয় তো এটাও ঈশ্বরের এক উপহার।
বিকালে শান্তিনগরের মাঠে গেছিলাম লিজাকে নিয়ে। মাঠ থেকে যখন ফিরে আসছিলাম দিনের আলো পড়ে আসছে,মাঠটা গ্রামের দিকে। চাষীরা ক্ষেত থেকে ফিরছে,চারিদিকে হালকা কুয়াশা । পশ্চিম দিগন্তকে নানা রঙে রাঙিয়ে অস্তাচলে চলেছেন রবি। বইছে ফুরফুরে হাওয়া। মাঠ থেকে ফিরছিলাম লিজাকে নিয়ে,পেছন থেকে শুনতে পেলাম ,"আরে,জিৎ না!" বলা বাহুল্য,এক শিহরণ খেলে গেল আমার শরীরে,হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠল।এই স্বর যে আমার অতি পরিচিত,এই গলার স্বর আর কেউ নয়, পৌলমীর।
পৌলমীর কাছেই শুনলাম শান্তিনগরে ও এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। ফেরার পথে আমার সাথে দেখা। একসাথে পৌলমীর সাথে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম,বুক ধুকপুক ধুকপুক তো করছিলই,আগে কখনো ওর সাথে এতোটা সময় একসাথে কাটাই নি।
সেদিন প্রথমবারের জন্য ছুঁলাম পৌলমীর নরম হাত, আর অপেক্ষা করে ছিল আরোও বিস্ময়। যখন কিছুটা এসে পৌলমী নিজেই আমায় বলল যে, আমাকে ওর ভালো লাগে!
আমার অবস্থা আর কি বলব। এ তো ডাবল সারপ্রাইজ। যাই হোক,কোনোমতে আমতা আমতা করে নিজের মনের কথাটা ওকে জানিয়েছিলাম। God's Gift বলে একটা ব্যাপার আছে , আর পৌলমীর ভালোবাসা ,পৌলমীর প্রেম সত্যিই আমার জীবনের God's Gift। এগারো বছর কেটে গেছে,আমরা কৈশোর থেকে যৌবনে উপনীত হয়েছি,কিন্তু আমাদের ভালোবাসা সত্যিই অটুট। এখনো জীবনের কঠিন সময় আসলে ও আমার পাশে থাকে,আমাকে প্রেরণা যোগায়,আমাকে সাপোর্ট করে,কখনো আমাকে ভেঙে পড়তে দেয় না।
জীবনে অনেক ক্রিস্টমাস এসেছে। কিন্তু 2007 সালের 25শে ডিসেম্বরের স্মৃতি ভুলবার নয়। সেটাই ছিল আমার জীবনের সেরা ক্রিস্টমাস। কারণ ক্রিস্টমাস ট্রি আর কেকের পাশাপাশি সেদিন আমি পেয়েছিলাম সান্তা ক্লজের দেওয়া এক অমূল্য উপহার-পৌলমীর প্রেমের প্রোপোজাল!