কন্যা তোর পথচলা
কন্যা তোর পথচলা


আমি মোহনা, মোহনা সেন। ছোটবেলা থেকেই মডেলিং ক্যারিয়ারের প্রতি একটা গভীর ভালোবাসা ছিলো, কিন্তু আমি খুব নিপাট ছিমছাম সাদামাটা ঘরের মেয়ে, আমাদের পরিবারে মেয়েদের ২২/২৩ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ এবং বাড়িতে এটাই ছিল এক অলিখিত নিয়ম।
বাবা আর জেঠু ছিলেন খুবই গম্ভীর প্রকৃতির, ঠাম্মাকেও দেখতুম কেমন মেপে মেপে কথা বলতেন নিজের ছেলেদের সাথেই, মা আর জেঠিমা তো যেন আওয়াজই বের করতেন না বাবা আর জেঠুর সামনে। আমার জেঠতুতো দাদাও ছিল বাবা জেঠুর মতোই গুরু গম্ভীর প্রকৃতির, মুখে হাসি নেই। সারাক্ষণ হয় কিছু লিখছে নাহয় পড়ছে, আসলে জেঠু দাদাকে ছোটবেলা থেকেই বলে আসছেন যে দাদাকে ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। আমাদেরকে বাবা আর জেঠুই ঠিক করে দিতেন আমরা বড় হয়ে কি হবো! দাদার জন্য ইঞ্জিনিরিং বরাদ্দ ছিল আর আমার ও দিদির জন্যে ছিল শিক্ষকতার পেশা বা ২২/২৩ বৎসর বয়সে বিয়ে, এর অন্যথা হওয়ার উপায় ছিল না।
সময় বয়ে চলে নিজ নিয়মে আর আমরাও বড় হতে থাকি, তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঝারা হাত-পা অবস্থা আমার, দিদি তখন কলেজে। দিদি কলেজের বান্ধবীদের থেকে নিয়ে আসতো বিভিন্ন ফিল্মি ম্যাগাজিন, কারণ বাড়িতে এইসব ফিল্মি ম্যাগাজিন কিছুই আসতো না... চুপি চুপি আমি আর দিদি মিলে ম্যাগাজিনগুলো পড়তাম, ম্যাগাজিনের তারকা ও মডেলদের দেখে দেখে আমার চোখেও তখন মডেলিং ক্যারিয়ের দ্বারা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন, যদিও আমার মনের এই কথাটি একমাত্র দিদিই জানতো।
এরকমই একদিন আমি ম্যাগাজিন পড়ছি, হঠাৎ দাদা এসে ধরে ফেললো আমায় লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু পড়তে দেখে। সে আরেক দাঙ্গা হাঙ্গামা বাড়িতে, দাদা গিয়ে বাবা ও জেঠুর সামনে ম্যাগাজিন নিয়ে গিয়ে দেখাতে লাগলো আমি এসব পড়ছিলাম। দাদার চিৎকার চেঁচামেচিতে ঠাম্মাও তখন ওখানে উপস্থিত, পেছন পেছন মা আর জেঠিমাও....
জেঠু খুব গম্ভীর হয়ে বললেন এইসব ম্যাগাজিন ছেড়ে যেন ভালো কিছু পড়ি, কিন্তু বাবা খুব ক্ষুব্ধ হয়ে বলে বসলেন আর একদিন যদি দেখেন এইসব ছাইপাশ পড়ছি তাহলে হাত পা ভেঙে দেবেন। বাবা গম্ভীর প্রকৃতির হলেও আমায় যথেষ্ট স্নেহ করতেন, জানতাম বাবার ইচ্ছেই হচ্ছে আমাকে ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া, মাকে যখন তখনই বলতেন মোহনাকে যেন ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারি, মেয়েটা যেন সুখী হয়। কিন্তু বাবা কখনো জানতে চাইতেন না আমি কি করতে চাই, বাবা কেন মা জেঠিমাও ভাবতেন, আমি আর দিদি তো বাড়ির অতিথি মাত্র, বিয়ে করে সংসার করতে পারলেই চরম সুখী হবো আমরা।
>
কিন্তু ওইদিন কেন জানিনা হঠাৎ মুখ ফস্কে বলে ফেললাম, "বাবা তুমি আমার হাত-পা ভাঙবে না, আমি জানি। তুমি আমায় অনেক বেশী ভালোবাসো বাবা, তবে আমি একটি নিজের পরিচিতি গড়ে তুলতে চাই। আমি মডেলিং ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই বাবা।"
বাবা আর জেঠু আমার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। বাবা বলে উঠলেন, "তুই কি বলছিস তুই নিজে জানিস? আমাদের পরিবারে এইসব হয় না, আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে, এইসব কাজে কোনোভাবেই নিজেকে যুক্ত করতে পারবিনা তুই।" বাবা নিজের রায় শুনিয়ে চলে গেলেন, আমার চোখ ফেটে জল আসছিল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব কেঁদেছিলাম ঠাম্মার কাছে।
কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। দিদির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো, দিদি বললো, "চল ড্রইং রুমে চল, দেখবি কত কি হচ্ছে"। আমি কিছুই না বুঝে গেলাম দিদির পিছু পিছু।
গিয়ে দেখি যে ঠাম্মি এত মেপে কথা বলতো নিজের ছেলেদের সাথে সেই ঠাম্মি একদম দেবীরূপে আবির্ভূতা হয়ে আমার পক্ষ নিয়ে লড়াই করছেন। ঠাম্মি নিজের যুক্তি দিচ্ছেন যে "এ কেমন পরিবার যেখানে নিজের ইচ্ছার বলি দিতে হয়?" আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হয়তো ঠাম্মা, কিন্তু হঠাৎ জেঠিমা আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠেন "তোমরা নিজেদের ঘরে যাও, এখানে বড়দের কথা হচ্ছে"।
ঠাম্মার চোখের ইশারায় আমি আর দিদি চলে আসি। সেদিন ঠিক কি বলেছিল ঠাম্মা বাবা আর জেঠুকে সেটা জানি না, কিন্তু পরদিন সকালে মা আমায় জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলেন... কিছুক্ষন পর বাবা এসে ধীর গম্ভীর ভাবে বললেন "তুই মডেলিং নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা শুরু করতে পারিস। মডেলিং কোর্সের জন্য কোথায় ভর্তি হতে হবে, কোন কোন এজেন্সি প্রফেশনাল ট্রেনিং দেবে সেসব খোঁজ-খবর করতে শুরু কর। শুধু একটা কথা মাথায় রাখবি, যা করবি সৎপথে থেকে করবি, পরিশ্রম করে করবি। সহসা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লোভে কোনো দুর্নীতির ফাঁদে পা দিবি না।"
বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছি আমার লক্ষ্যের প্রতি। ওইদিন ঠাম্মা যদি আমার জন্যে লড়াই না করতো, তবে হয়তো কোনোদিনও আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারতোনা। যদিও মডেল হওয়ার জন্যেও আমায় ধৈর্য্য, সাহস, অধ্যবসায়, পড়ালেখা আর ঠাম্মার উৎসাহের অনেক অনেক প্রয়োজন ছিল এবং আজ আমার মডেলিং জগতে প্রথম রেম্প ওয়াক। আমার পুরো পরিবার সর্বোপরি বাবা ও ঠাম্মা সবাই এসেছে আজ আমাকে উৎসাহ দিতে, সাহস জোগাতে। ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি আমি রেম্পের দিকে....