কমলি বাঈ
কমলি বাঈ
তখন নতুন নতুন গিন্নী হয়েছি। নিজের বোধবুদ্ধি সম্পর্কে আমার নিজের খুবই উচ্চ ধারণা। সংসারের ব্যাপারে আমার স্বামী প্রকাশ কোনদিনই খুব একটা মাথা ঘামায় না। আর যদি ভুল করে কোনও মতামত পোষণ করার চেষ্টা করে কখনো আমি আমার বাস্তববাদী সাংসারিক যুক্তি দিয়ে তা নস্যাৎ করে দিই।
আপিস থেকে প্রকাশকে কিছুদিন কানপুরে বদলি করে দিয়েছিল। যেহেতু বদলি কিছুদিনের জন্য তাই ও একাই গিয়েছিল। আমি ছেলে নিয়ে কলকাতাতেই রয়ে গিয়েছিলাম।
গরমের ছুটিতে আমি আর ছেলে গেলাম কানপুর, ছুটি কাটাতে। এবং পৌঁছেই ওখানকার অবস্থা দেখে আমার ভিতরকার গিন্নী একেবারে শিউরে উঠলো। আমি কোমর বেঁধে লেগে পড়লাম । আশপাশের বাড়ীর মহিলাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাসন মাজা, ঝাড়ু-পোছার জন্য একটি কাজের মহিলা যোগাড় হল। কিন্তু সে কাপড় কাচতে নারাজ।
এদিকে বাড়ীর পর্দা চাদর থেকে শুরু করে গামছা তয়ালে অবধি ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত কমলি কে পেলাম। ছোটোখাটো চেহারার, গোল মুখ, বয়স তিরিশ কিন্তু দেখায় বাইশ- তেইশ।
“ সিরফ এক মাহিনা? উস্কে বাদ?” জিজ্ঞাসা করলো কমলি।
“ ওর পর আমি চলে যাবো কিন্তু দাদা তো থাকবে , তুই এসে কাপড় ধুয়ে যাস। “
শিউরে উঠলো কমলি, একলা মরদের বাড়ীর কাজ ো করবে না। ওর স্বামীর খুব সন্দেহ বাতিক। দুপুর বেলা এসে ো কাপড় ধুয়ে দিয়ে যাবে। একটা বড় বালতিতে যত কাপড় ধরবে সব ধবে আর একশ টাকা নেবে। আমার পয়সাটা বেশী মনে হলেও আমি সম্মত হলাম।
কমলি কাজে লেগে গেল। পর্দা চাদর সব ধুয়ে দেয় আর কাপড় মেলে টাকা নিয়ে বাড়ী চলে যায়। কোনও কোনও দিন খুচরো না থাকলে আমি পরের দিন একসাথে টাকা দিয়ে দিই। কাজের শেষে কখনো এক কাপ চা নিয়ে খানিক গল্প করে। ওর বাড়ীর কথা , ওর শাশুরির কথা ওর তিন মেয়ের কথা।
দেখতে দেখতে আমার ফেরার সময় হয়ে এলো। আমি ফেরার আগে সব গছাতে ব্যস্ত। কমলি এই প্রথম একদিন কাজে এলো না। যথারীতি আমার মাথা গরম। এক বালতি ভেজানো কাপড়জামা আমাকেই কোনোরকমে উদ্ধার করতে হয়েছে।
পরের দিন কমলি বেশ ভোর ভোর ই কাজে এলো। মুখটা শুকনো, চোখের তলায় কালি। আমি বিশেষ পাত্তা দিলাম না। আমার বাস্তববাদী মস্তিষ্ক আমাকে বলল, বেশী পাত্তা দিও না, এক্ষুনি এক ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলবে।
কমলি নিজেই কাপড় নিয়ে বালতিতে ভিজিয়ে কেচে মেলে দিল। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়ালো,” পয়সা।“
আমি ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম,” আজ ছুটটা নেই রে, কাল নিস।“
“ আজ বহুত জরুরত ছিল।“
“ তোর কাছে পাঁচশো টাকার খুচরো আছে?”
ও শুকনো হেসে মাথা নাড়ল,” কাল ধুলাই করওায়া। সারে পয়সে উসিমে চলা গায়া...আজ বহুত...... বাকি পয়সা কাল দে দুঙ্গি “
আমি মনে মনে হাসলাম তোমায় পাঁচশ দিই আর তুমি গায়েব হয়ে যাও আরকি, আমায় অত বোকা পাওনি, বললাম,” কাল দে দুঙ্গি বোলা না। আব দিমাগ মত চাট।“
মাথা নিচু করে পা টা ঘষতে ঘষতে ও বেরিয়ে গেল।
ওকে বেশ শিক্ষা দেওয়া গেছে ভেবে বেশ একটু আত্মপ্রসাদ ও লাভ করলাম।
পরেরদিন কমলি এলো না। আমি অবাক হলাম। আমার বাকি কাজ যে করে সেই মাসি কে জিজ্ঞাসা করে কোনও সদুত্তর পেলাম না। বললাম ওর বাড়ী গিয়ে খোঁজ নি
য়ে আসতে, কারণ আমি পরের দিন কোলকাতায় ফিরব।
পরের দিন মাসি কোনও খবর আনতে পারলো না, বলল,” উধার যানা নহি হুয়া। “
আমি মনে মনে ভাবছি তাহলে কম্লির পয়সাটা কি কর এদেব? মাসি বধ হয় আমার মন পড়তে পেরেছিল, বলল,” উস্কা পয়সা তুম মুঝে দে দো ম্যায় পহুচা দুঙ্গি।“
আমার বাস্তববাদী মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে উঠলো, উঁহু, তোমায় দেব না। তুমি টাকাটা ওকে না দিয়ে নিজের পকেটে ভরার মতলব করছ আমি খুব জানি, মুখে বললাম,” জিসকা প্যাইসা উসিক দেঙ্গে। উসকো লে আনা অউর ভাইয়া সে পাইসা লে জানা।“
কলকাতা রওনা হবার আগে আমার স্বামীকে ভালো করে বুঝিয়ে এলাম, যেন যার তার হাতে পয়সা না দেয়।
কলকাতা পৌঁছে যাবার পর আমি এক রবিবার দিন প্রকাশকে ফোন করেছি তখন ওই মাসি কাজ করছিল। আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলাম,” কমলির টাকাটা দিয়েছ?”
আমার স্বামী মাসিকে কমলির কথা জিজ্ঞাসা করতেই ও আমার সাথে কথা বলতে চাইল।
ও যা বলল তা এইরকম-
কমলির স্বামী মদ্যপ, পরিবারকে দেখে না, যা রোজগার করে তাই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়। কমলির শাশুড়ি এবং স্বামী চাইত ওর একটা ছেলে হোক। কিন্তু পরপর তিনবার ওর মেয়ে হয়। কমলি আর বাচ্ছা চাইত না। কিন্তু স্বামী আর শাশুড়ি মানতে নারাজ। ফলে ও চতুর্থ বার অন্তঃসত্ত্বা হয়। আমার কাছে যেদিন শেষ কাজ করতে আসে তার আগের দিন ও চুপি চুপি গিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করে দেয়। আমার বাড়ীর কাজ করে ও কিছু টাকা জমিয়েছিল তাই দিয়ে । পরেরদিন ওর স্বামী জানতে পেরে ওকে খুব মারে তারপর বাড়ী থেকে বার করে দেয়। কমলি সোজা আমাদের কাছে চলে এসেছিল কারণ ওর টাকার খুব দরকার ছিল। কিন্তু তারপর আর ও বাড়ী ফিরে যায় নি।
শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। একশোটা টাকার জন্য ওই শরীরের অবস্থা নিয়ে কমলি সেদিন এসেছিল। সেদিন মেয়েটার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখিনি। মনে পড়ে গেলো ও ঠিকমত হাঁটতেও পারছিল না।
এর কিছুদিন পর আমার স্বামী আবার কোলকাতায় বদলি হয়ে যাওয়ায় আমার আর কানপুর যাওয়া হয়নি। কমলিকে ওর টাকাটাও দেওয়া হয়নি।
এরপর কুড়ি বছর কেটে গেছে। আমি এখন পুরনো গিন্নী। মাঝে মাঝে কমলির কথা খুব মনে পড়ে। মনে হয় কত কাজে তো কত টাকা যায়, কি হত যদি ওকে টাকাটা দিয়ে দিতাম?
সেদিন বাজার গেছি, দেখি কোনের দিকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে একটা ছোট ঝুড়িতে অল্প কিছু নটে শাক আর কয়েকটা শুকনো শুকনো উচ্ছে নিয়ে বসে আছে। আগে কখনো মেয়েটিকে বাজারে দেখিনি। আমি যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন মেয়েটি আমার দিকে কেমন একটা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালও।
“ তোমায় আগে কখনো দেখিনি। তুমি নতুন নাকি ?”
“ হ্যাঁ দিদি, আমফানে আমাদের গায়ের ঘর ভেঙ্গে গেছে। ঘরে ছোট ছোট বাচ্ছা। টাকার খুব দরকার... তাই...”
হঠাৎ চোখের সামনে কমলির মুখটা ভেসে উঠলো, সেদিন ওরও খুব দরকার ছিল টাকার।
“ দাও দেখি দু আঁটি নটে শাক, আর আধ কিলো উচ্ছে।“
মেয়েটির কাছ থেকে জিনিষগুলো নিয়ে একটা একশো টাকার নোট দিলাম। মেয়েটি যথারীতি বলল ওর কাছে খুচরো নেই।
“ থাক ফেরত দিতে হবে না।“ মেয়েটার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে আমি বাড়ী ফিরে চললাম।