কলম
কলম


তখন কলেজের গণ্ডী পার হয়ে সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। ভর্তি হওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই গরমের ছুটি পড়ে গেল। ছুটি পড়লেই ছুটতাম বাবা মার কাছে। বাবা তখন পালামৌ জেলার জাপলার স্টেশন মাষ্টার। এখনকার জম্মু তাউই এক্সপ্রেসের এর তখন নাম ছিল পাঠানকোট এক্সপ্রেস। শেয়ালদা থেকে দশটা নাগাদ ট্রেনে উঠে, জিনিসপত্র সিটের তলায় গুঁজে দিয়ে, আরাম করে জানলার ধারে গিয়ে গুছিয়ে বসলাম। বাবার ফার্স্টক্লাস পাসের দৌলতে তখন রেল যাত্রাটা বড় সুখের ছিল। তখনকার ফার্স্ট ক্লাস গুলো ছিল টয়লেট সংযুক্ত এক কামরার ফ্ল্যাটের মত। এমন বিলাসিতা বিনা পয়সায় পেলে সুখ শতগুণে বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে এক আধ জন করে লোক ওঠানামা করছে। আচার আচরণ আর কথাবার্তায় আন্দাজ করলাম এদের অধিকাংশই আমার মত রেলের অনুগ্রহে এই যাত্রাসুখ ভোগ করছে। আমি ডেহরি-অন-সোন এ নেমে ওখান থেকে রাত দশটার আশেপাশে বরবাডিহ প্যাসেঞ্জার ধরে জাপলা যাব। জাপলা পৌঁছতে প্রায় রাত একটা বেজে যাবে। আমার কাছে ট্রেনে সময় কাটানর সব থেকে বড় উপায় হল ঘুম। দৃশ্য দেখে, বই পড়ে, যখন আর সময় কাটতে চাইছে না তখন পাটা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে জানলার দিকে শরীরটা একটু হেলিয়ে দিচ্ছি। ট্রেনের দুলুনিতে সঙ্গে সঙ্গে চোখ লেগে যাচ্ছে। কোন স্টেশন এলে লোকজনের হৈ চৈ এ কিছুক্ষণের জন্য চোখ খুলছি, স্টেশন ছাড়লেই আবার বন্ধ। এ আমার বহুকালের অভ্যাস, ট্রেনের ভেতরের পরিস্থিতি খুব প্রতিকূল না হলে এমনটাই চলে। ‘চায় গরম’ আওয়াজে চটকা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি ধানবাদে গাড়ি ঢুকছে। তখন প্রায় চারটে বাজে। যে দু একজন সহযাত্রী ছিল তারা সকলেই নামতে ব্যস্ত। ওরা নামার পর আমার কামরা একেবারেই খালি। এক ভাঁড় চা নিয়ে চুমুক দিচ্ছি হঠাৎ চোখ গেল দরজার দিকে। একটি মেয়ে আমার কামরায় উঠছে। একা, সাথে কেউ নেই। বয়েসে আমার থেকে একটু ছোটই হবে। পরনে সালোয়ার কামিজ, কাঁধে একটা মাঝারি ব্যাগ। ভেতরে এসে ব্যগটা পাশে রেখে আমার মুখোমুখি উল্টোদিকের জানলার ধারে গিয়ে বসল। ছিপছিপে সুন্দর চেহারা। একটু পরে ট্রেন ধানবাদ ছাড়ল, আর কেউ উঠল না। কামরাতে কেবল আমরা দুজন। ঘুম ছুটে গেল। বিমুঢ়তা কাটাতে একটা ম্যাগাজিন খুলে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। থেকে থেকেই মেয়েটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম মেয়েটাও বাইরে দৃশ্য দেখার ফাঁকে ফাঁকে একবার করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এইভাবে চলতে চলতে অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের টাইমিং এর গন্ডগোলে চোখাচুখি হয়ে গেল আর লজ্জা পেয়ে দুজনেই তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। কিন্তু বয়সের স্বাভাবিক ধর্মে আবার চোখাচুখি হল আর এবার চোখ না সরিয়ে দুজনেই হেসে ফেললাম। হয়ত পরস্পরের চোখের ভাষাটা পড়ে ফেলার আনন্দে। বড় মিষ্টি লাগছিল। কতদূর যাবে জানার জন্য ‘আপ’ বলে শুরু করতেই মেয়েটি জানাল, “আমি বাঙালি”। নামবে হাজারীবাগ রোড স্টেশনে। বলল, “আমার বাবা ওখানকার স্টেশন মাষ্টার”। একটু প্রগলভ হয়ে হঠাৎ বলে ফেললাম, “একেবারে পালটি ঘর দেখছি”। মেয়েটি একটু চমকে গিয়ে বলল, “আপনি আমার নাম জানেন না, পদবী জানেন না, এই প্রথম দেখছেন, কেবল বাবা কি করেন তাই শুনেই কি করে বলে দিলেন পালটি ঘর। আমি আপনার মন্তব্যের মানেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না”। বুঝতে পারলাম ফাউল হয়ে গেছে তাই বললাম, “কিছু মনে করবেন না, আমি এতকিছু ভেবে বলিনি। আমার বাবাও স্টেশন মাষ্টার, তাই মজা করে কথাটা বলেছি”। মেয়েটি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “এমা না না মনে করব কেন? আমি কথাটার মানে বুঝতে পারিনি তাই বললাম। আপনি কি আমার কথায় ব্যথা পেলেন?”। ব্যথা উপশমের এই লেনদেনের মাঝে জানলাম মেয়েটির নাম নিশিতা, নিশিতা চক্রবর্তী। ধানবাদের কোন এক কলেজে ইতিহাস নিয়ে বিএ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। রোজই এই ট্রেনে কলেজ থেকে ফেরে। আমারও নাম আর অনুরূপ কিছু তথ্য মেয়েটি জানল। জিজ্ঞেস করলাম, “রোজ একাই যাতায়াত করেন?”।
“না সাথে আমার এক বন্ধু থাকে, আজকে ও আসেনি। ও থাকলে ট্রেনের সময়টা গল্প করে কেটে যায়, একা খুব বোর লাগে। সময়টাতো কম নয়, যাতায়াতে প্রায় চার ঘন্টা”। একটু রঙ্গ করে বললাম, “আজকে তার মানে খুব বোর হচ্ছ?”। মিষ্টি হেসে বলল, “আজকে একা কোথায়? গল্প করার লোক তো একজন পেয়ে গেছি”। কথা যত গড়াতে থাকল মেয়েটি আচরণে তত সহজ আর আন্তরিক হয়ে উঠল। হঠাৎ আপন মনেই বলল, “এহে একদম ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরলে মা খুব বকা দেবে”। তারপরেই আমার দিকে চেয়ে বলল, “আমাকে একটু হেল্প করবেন?”
--কি হেল্প সেটা তো বলবে।
--আজ টিফিনের সময় কলেজের সামনে থেকে আলুকাবলি, ফুচকা, এইসব টুকটাক খেয়েছি ফলে টিফিন করার মত পেটে আর জায়গা ছিল না। সেই ভোরে উঠে কত কষ্ট করে টিফিন বানিয়ে দেয় আর সেটা না খেয়ে ফেরত নিয়ে গেলে মা খুব রাগ করবে। পরে খাব ভেবেছিলাম কিন্তু খেয়াল ছিল না। একা সবটা খেতে পারবো না, আমার সাথে একটু শেয়ার করুন প্লিজ।
নারীর কাতর আবেদনে মুনি ঋষিরা আত্মসমর্পণ করেছে আর আমি তো সেদিনের ছোকরা। আর তাছাড়া বেশ খিদেও পেয়েছে। অবশ্য টিফিন বাক্সর ভেতর থেকে যা বেরোবে তা কতটা সুখাদ্য হবে বলা মুশকিল।
--কি অত ভাবছেন? আমার মায়ের হাতের রান্না কিন্তু খুব ভাল, না খেলে ঠকবেন।
এরপর আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে টিফিন বাক্সর ঢাকাতে নিজে একটুখানি নিয়ে বাকি সবটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। দুটো পরোটা, বেগুন ভাজা, তরকারি, মিষ্টি, কত কি রয়েছে।
বললাম, “প্রায় সবটাই তো আমায় দিয়ে দিলে।তোমার তো পেট ভরবে না”
--পেট ভরা বলেই তো দিলাম। না হলে দিতাম নাকি! আবার সেই মন ভোলান সুরেলা হাসি।
খাসা রান্না। বেশ তৃপ্তি করে চেটেপুটে খেয়ে বললাম, “সত্যিই তোমার মায়ের রান্না খুব ভাল। দারুণ খেলাম। নিশিতা, আমি তুমি বলছি বলে কিছু মনে করছ না তো!”।
--আপনি আমার থেকে বড়, তুমিই তো বলবেন। এতে মনে করার কি আছে। খাওয়ার আগে কিন্তু কিন্তু করছিলেন, বলেছিলাম না যে না খেলে ঠকবেন।
আমি টিফিন কৌটোটা ধুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠতেই ও কেড়ে নিয়ে টয়লেটে চলে গেল।
কথা চলতেই থাকল। মনে পড়ে না আগে কখনো কোনো অচেনা মেয়ের সাথে এত কথা বলেছি।
--তোমরা কত সুন্দর জায়গায় থাক। চারিধারে পাহাড় জঙ্গল আর তার মাঝে ছোট ছোট জনবসতি, মুক্ত বাতাসে একেবারে প্রকৃতির কোলে রয়েছ।
--জঙ্গল খুব দূরে না হলেও আমি যেখানে থাকি সেটা একটা ছোট শহর। আর পাহাড় জঙ্গল দুদিন বেড়ানর জন্যে খুব ভাল, থাকার জন্যে নয়। বিশেষ করে আপনাদের মত শহুরে লোকেরা তো এসব জায়গায় টিকতেই পারবেন না।
--আমার ছোটবেলা তো পালামৌ এর ছোট্ট একটা রেল স্টেশন ‘মহম্মদগঞ্জ’ এ রেলের কোয়ার্টারে এই ধরণের জায়গাতেই কেটেছে, আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানেও তো প্রায় এই রকমেরই পরিবেশ।
--এখন তো যাচ্ছেন বাবা মায়ের কাছে বেড়াতে, পাকাপাকিভাবে থাকতে নয়। আর ছোটবেলায় হয়ত বড় শহরে তেমন থাকেননি। আমি বলতে চাইছি শহরের সুখ স্বাচ্ছন্দ, সুযোগ সুবিধে ছেড়ে ঠেকায় না পড়লে লোকে কোন আক্কেলে এসব জায়গায় বাস করতে আসবে। জঙ্গলের মাঝে ছোট ছোট স্টেশনগুলোতে গিয়ে থেকে দেখুন, মানুষের যা প্রয়োজন যেমন ডাক্তার, ওষুধ, ভাল দোকান বাজার, তার অধিকাংশই নেই। আছে গরম কালে প্রাণঘাতী লু, শীতে হাড় কাঁপান ঠান্ডা, আর সাথে পাবেন প্রচুর সাপ আর বিছে। শহর থেকে আসা কোন ট্যুরিস্টকে বেশি নয় বছর খানেক এইসব জায়গায় কাটাতে বলুন, দেখবেন প্রকৃতি প্রেম ঘুছে গেছে। দু একটা ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, জানিনা আপনি সেই দলে কিনা।
--তার মানে তোমার এইসব জায়গায় থাকতে মোটেই ভাল লাগে না।
--না ঠিক তা নয়। জন্ম থেকে রয়েছি, টান তো একটা আছেই। তবে কোলকাতা আমার দারুণ লাগে। চারিদিকে কত মজা, কত আনন্দ। দমদমে আমার মাসির বাড়িতে গেলে আর ফিরতেই ইচ্ছে করে না।
--তোমাদের নিজেদের বাড়ি কোথায়?
--নেই। রেল কোয়ার্টারই আমাদের বাড়ি। দাদু রেলে ছিল, তার একমাত্র ছেলে বাবাও রেলে, দুই প্রজন্ম কোয়ার্টারেই কাটিয়ে দিল। প্রয়োজন ছিল না আর তেমন তাগিদও ছিল না ফলে আমাদের নিজেদের বাড়ি হয়নি। যখন যেখানে থাকি তখন সেটাই আমাদের বাড়ি। এই তো আর কিছুদিনের মধ্যেই বাবার বদলি হবে, যেখানে যাব সেটাই তখন হবে আমাদের নতুন ঠিকানা।
আগ্রহ চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম—কাকু কোথায় বদলি হচ্ছেন?
--জানি না, এখনো অর্ডার আসেনি। এ এক বিচিত্র জীবন। কিছুদিন থাকার পর যখন কোন জায়গার সাথে নিজেকে একটু মানিয়ে নিয়েছি তখনই আসবে বদলির পরোয়ানা। লোটা কম্বল নিয়ে চল নতুন আস্তানায়।
সুন্দরী যখন সুন্দরভাবে কথা বলে তখন তার সৌন্দর্য সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। বেশ লাগছিল নিশিতার কথা শুনতে। হঠাৎ দেখি ও ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, “উঠলে কেন?”।
--বা, নামতে হবে না!
বাইরে তাকিয়ে দেখি ট্রেন হাজারিবাগ রোড ইস্ট কেবিন পার হয়ে স্টেশনে ঢুকছে। কোথা থেকে যে দু ঘন্টা কেটে গেল বুঝতেও পারলাম না। অথচ নিশিতা গাড়িতে ওঠার আগে পর্যন্ত সময় কাটছিল না বলে ঘুমকে আশ্রয় করেছিলাম। আমিও উঠে ওর পাশে দাঁড়ালাম। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে ট্রেনের গতি হঠাৎ কমে যাওয়ায় নিশিতা টাল খেয়ে পড়তে পড়তে আমাকে ধরে সামলে নিল। বিদায় লগ্নে পেলাম প্রথম স্পর্শ, বিশ্বাসের স্পর্শ, হয়ত বা ক্ষণিকের নির্ভরতার স্পর্শ। গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “আসি”।
আমি বললাম, “ আসি নয়, যাচ্ছি বল। আর তো কোনদিন আমাদের যোগাযোগ হবে না”।
--ও কথা বলছেন কেন?
--যোগাযোগের জন্য তো একটা ঠিকানা দরকার।
--তাই তো, একদম খেয়াল হয়নি।
তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে ওর কলেজের একটা খাতা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার তো কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই তাই দিতে পারলাম না। আপনার ঠিকানাটা চট করে এখানে লিখে দিন। আমি ঠিক যোগাযোগ রাখব। আজকের এই সুন্দর সফর অনেকদিন মনে থাকবে”।
কথার মাঝে ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে তার প্রস্থানের জন্য অপেক্ষা করছে। নিশিতা তাড়াতাড়ি নেমে জানলার সামনে এসে বলল—কই,লেখা হয়েছে!
আমি ব্যাজার মুখে বললাম—পেনটা খুঁজে পাচ্ছি না।
ও তাড়াতাড়ি ব্যাগ হাতড়ে নিজের কলমটা জানলা দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। দু মিনিট মাত্র স্টপেজ। ইতিমধ্যে গার্ড বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। লেখা শুরু করতেই ইঞ্জিনে ভোঁ দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। হতাশ হয়ে বাইরে নিশিতার দিকে তাকালাম। বড় করুণ লাগল ওর মুখটা। ছলছল চোখে তাকিয়ে রয়েছে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা মানুষটার দিকে। আমি হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। কলমটা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করিনি। সুখ স্মৃতি। নীল রঙের ‘ফ্লোরা’ কলম।