Barun Biswas

Romance Others

4.8  

Barun Biswas

Romance Others

কবিতার সমাপ্তি

কবিতার সমাপ্তি

2 mins
503


অনেকদিন পর লাবণ্য শিলঙ এসেছে। তার আসার ইচ্ছা ছিল না। সে আগেই ভেবে রেখেছিল এখানে আর আসবে না। কিন্তু ভাগ্য যাকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই তার গন্তব্য হয়। তার কোনো এক আত্মীয় অসুস্থ। তাকে দেখার জন্য আসতে হয়েছে। তবে এখানে এসে অতীত যে তার পিছু নেবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

 সকালে হাসপাতালে গিয়েছিল যার জন্য আসা তাকে দেখতে। দুপুর পর্যন্ত সেখানে ছিল সে। অনেকদিন পর দেখা হলে যা হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অতীত থেকে বর্তমান সব ধরনের কথাবার্তা চালাতে লাগলেন তিনি। তার পাশে বসেছিল মেয়ে আর লাবণ্য। যত তাকে তার মেয়ে চুপ করতে বলে তিনি তত বেশি কথা বলতে থাকেন। লাবণ্য মনে মনে ভাবে সব মানুষের ধর্মই একই। তাকে যেটা নিষেধ করা হবে সেটা করার জন্য সে যেন মুখিয়ে থাকে। এটা ভেবে সে মনে মনে হাসলো।

 লাবণ্য পাশে বসে যখন লোকটার কথা শুনছিলো সে খেয়াল করল সে যখন লোকটার কথার উত্তরে কোন সাড়া দিচ্ছিলো না লোকটা তার কথার শেষে বলছিল,'শুনছো?' বাধ্য হয়েই লাবণ্য তখন বারবার 'হুম হুম' বলছিল। এর মানে এই নয় তার কথা লাবণ্য শুনছেনা তা নয়। শুনছে কিন্তু বিরক্ত বোধও যে হচ্ছে নিজেই সেটা বুঝতে পারছে। 


 তবু লোকটাকে খুশি রাখার প্রয়াসে লাবণ্য তার বিরক্তি যাতে প্রকাশ না পায় সে চেষ্টা করছিল। লোকটার মেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চুপ করে তার বাবাকে বিশ্রাম নেবার জন্য যেন আদেশ দিল। বাধ্য ছেলের মতো তখন চুপ করে গেলেন তিনি। লাবণ্য এই পরিস্থিতি সামাল দিতে একটু হাসল। শব্দহীন হাসিটা মুখে ফুটে উঠলো শুধু। 

 তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিল লাবণ্য। বেরিয়ে পড়ল হাসপাতাল থেকে। 

 এখনকার যুগে নিজেদের লোকেরাই কেউ কারো খবর রাখে না সেখানে লাবণ্য দূর সম্পর্কের কারো সঙ্গে দেখা করার জন্য এতদূর ছুটে এসেছে।  নতুন যুগে এসে পড়লেও সে যেন আগেকার ভাবধারার মানুষ রয়ে গেছে। 

 লাবণ্য তার জীবনের বেশিরভাগ সময় যেখানে কাটিয়েছে সেখানে দু একদিন থাকার কথা ভাবল হঠাৎ করে। মানুষের মন বড়োই বিচিত্র। কখন কি খেয়াল হয় কে জানে? যে লাবণ্য এখানে আসতেই চাইছিল না এতদিন এক মুহূর্তের জন্য সেই কিনা এখন-

 রাস্তায় এসে ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে ডানে বাঁয়ে তাকালো লাবণ্য। কাঁধে ঝোলানো লেডিস ব্যাগটা কাঁধ বদল করে নিল। সেই সঙ্গে চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বসিয়ে নিল চোখের উপর। বেশ কিছু চুলে পাক ধরেছে, সেটা অবশ্য লাবণ্যের চোখেও ধরা পড়ে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একটা টোটো এসে দাঁড়ালো তার সামনে। তার গন্তব্যস্থলের কথা জানাতেই চালক যেতে রাজী হয়ে গেল। উঠে বসল লাবণ্য। 


 টোটো পৌঁছে গেল লাবণ্যের বলা জায়গায়। তবে তার পরিচিত জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেই গাছের সারি আর নেই অনেক কমে গেছে। এখন আবার বসার জন্য অনেক জায়গায় বেঞ্চ বসানো হয়েছে। কোনটা কাঠের কোনটা সিমেন্টের। তবে এতে বসে কি আগের মতো মজা পাওয়া যাবে যা পাওয়া যেত মাটিতে সবুজ কোমল ঘাসের উপর বসে? ভাবতে ভাবতে একটা বেঞ্চের উপর সে বসল পাশে ব্যাগটা রেখে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে  অতি পরিচিত একটা গাছ- একটা ইউক্যালিপটাস গাছ।

এই জায়গার সঙ্গে জড়িত পুরাতন সব স্মৃতি আবার ফিরে এলো এক এক করে। দিনের পর দিন নানা ধরনের কথাবার্তা আর আলোচনা হতো কবিতার মাধ্যমে। একটা কবিতার পিঠে আর একটা কবিতা দিয়ে মনের ভাবের আদান-প্রদান হত। আর এখন? কোথায় সে সব কবিতার ছন্দ? জীবনের ছন্দ ধরতে গিয়ে কখন সেই স্রোত থেকে বেরিয়ে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।

 আচ্ছা এখনকার যুবক যুবতীরা কি ওদের মতো চিঠি লেখে? কবিতার মাধ্যমে ওদের মনের ভাব একে অপরকে জানায়? নিজেকেই যেন নিজে প্রশ্ন করে লাবণ্য। ব্যস্ততার এই যুগে সেই সময় হয়তো কারো হাতে নেই। তাই চিঠির পালা তো উঠেই গেছে কবে। এখনতো মোবাইল এসে গেছে। ইমেইল,মেসেঞ্জারে মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এসবই চলছে। তাতে তো শর্টকাটেই সবকিছু লিখলে হয়ে যায়। অত দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা লিখে মনের ভাব প্রকাশ করার সময় আর কারো নেই। তার সঙ্গে তো বিভিন্ন ধরনের প্রতীক ছবি রয়েছে। সেগুলো দিলে আর কোন কিছু লেখার দরকারই পড়েনা। সবাই বুঝে নেয় সেই ছবি দেখে কে এখন খুশি, কার মনে দুঃখ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে কে এতো সুর তাল ছন্দ খুঁজে কবিতা লিখবে?

 লাবণ্য তার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। সেও একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন নিয়েছে । তারও আর এখন চিঠি লেখা হয় না। কাকে লিখবে আর? কে পড়বে? তাই সেও এখনকার যুগের স্রোতের সঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে।

 লাবণ্য খেয়াল করল প্রকৃতির সৌন্দর্য এখন আর নেই। কেউ তার দিকে খেয়াল করে না বলেই হয়তো সে তার কঙ্কালসার কদাকার রূপ বের করে রেখেছে এখন। মানুষ এখন এতটাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় বা মানসিকতা কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে তাতে মেসেজ করে ওর না যাবার কথাটা বাড়িতে জানিয়ে দিল।

 সময় যত এগিয়ে যাচ্ছিল এখানকার লোকের ভিড় তত বাড়ছিল। বিকাল হলে হয়তো প্রতিদিনই এরকম লোকজন হয়। নিজের চিন্তার ঘোর কাটিয়ে লাবণ্য তার আশেপাশে দেখলো। যে বেঞ্চগুলো এতক্ষণ ফাঁকা ছিল সেগুলো ভরে গেছে।

 কিন্তু লাবণ্যের কাছে পরিবেশটা কৃত্রিম মনে হল। ও কি আজ একা বসে আছে বলে এমন ভাবনা মাথায় এলো? বাকি সবাই তো বেশ আনন্দে ফুরফুরে মেজাজেই বসে আছে। তবে তার কেন এমন মনে হচ্ছে? হয়তো সে নিজেই এই পরিবেশের সঙ্গে বেমানান।

 লাবণ্য ভাবলো হোক সে বেমানান। তার কবিতার স্মৃতি তার কাছেই থাক। বেঞ্চ থেকে উঠে পড়লে লাবণ্য। ব্যাগটা আবার কাঁধে তুলে নিল। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলে আবার সে দিকে হাঁটতে শুরু করল। কোলাহলপূর্ণ এই জায়গা থেকে বেরিয়ে কোন এক নীরব শান্তির জায়গার খোঁজে নিজেকে নিয়ে চলল। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। আকাশের লাল রঙের আভার দিকে কারো দৃষ্টি নেই। শুধু একজনের ছিল। হেঁটে চলার সময় বাতাসে উড়ছিল তার শাড়ির আঁচল।

 রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য এইভাবেই হারিয়ে গেল শেষের কবিতার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance