Moumita Das

Abstract Romance Others

4  

Moumita Das

Abstract Romance Others

কাউন্সেলিং

কাউন্সেলিং

4 mins
853


মাঝখানে অনেক দিন দেখিনি মৃদুলকে। আজ দেখলাম। ঝাঁকরা চুলগুলোতে পাক ধরেছে, কিন্তু চোখগুলো আগের মতোই উজ্জ্বল। যদিও কিছুটা নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে তাকে।

মৃদুল অনেক দিন আসেনি যেহেতু, ধরে নিয়েছিলাম তার রোগ অনেকটা ভাল হয়ে গেছে। আজ আবার কি হলো কে জানে! কাউন্সেলিং করাতে আমার কাছে আসত সে একসময়। দীর্ঘদিন ধরে, প্রায় ১০ বছর ধরে তার কাউন্সেলিং করছি আমি। এমন নয় যে সে মানসিক ভাবে ভয়াবহ রকম অসুস্থ। তাকে বেশ সুস্থই বলা যায়। জীবনে হতাশা, দুঃখের ভার বেশি হলেই সে চলে আসত আমার কাছে। বেশ আধুনিক মন মানসিকতা তার। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো মানেই যে পাগল হওয়া নয় বিষয়টা সে ভালোই বোঝে।

আমি মৃদুলকে শুয়ে পড়তে বললাম। সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে কথা সে বলতে শুরু করল।

"অনেক দিন পর এলাম ড. জিব্রান, আসলে আজ ক'দিন বলে খুব বিধ্বস্ত লাগছে বলেই এসেছি।"

"খুব ভাল করেছেন। কেন নিজেকে আপনার বিধ্বস্ত লাগছে বলবেন?"

মৃদুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল-

"আমার আর যুথীকে আগের মতো ভাল লাগছে না!"

আমি বেশ চমকে গেলাম। ডাক্তারিসুলভ শান্ত স্বভাব ভুলে অস্থির হয়ে বলে ফেললাম, "সে কি! হঠাৎ কি হলো? গত ১০ বছর ধরে আপনার জীবনে এত ফ্রাস্টেশনের কথা শুনলাম, কখনো শুনিনি যুথীর সাথে আপনার সম্পর্কে কোথাও ফাঁটল রয়েছে। সব হতাশা, কষ্টের মধ্যেও যুথীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে কাজের উদ্যম ফিরে পেতেন আপনি, আজ যুথীকে আপনার ভালো লাগছে না?"

"বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। যুথী খুব ভাল মেয়ে। আমার প্রতি তার আচরণ আগের মতোই আছে। সে আগের মতোই সহমর্মী, স্নেহময়ী এবং আবেদনময়ীও। তবুও কি যে হলো..."

"কি হলো?"

"গতকাল সন্ধ্যায় একটা বিয়ের প্রোগ্রামে যাবার কথা ছিল আমাদের। যুথী বেশ সাজল। একটা সবুজ রঙা শারী পড়ল সে। সাথে হাতাকাটা ব্লাঊজ। অসম্ভবরকম সুন্দরী লাগছিল তাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমি তার প্রতি আকর্ষণবোধহীনতায় ভুগলাম। হঠাৎ করেই!"

"সেটা কেমন? একটু বুঝিয়ে বলুন তো!"

"আমার মনে হলো, যুথীকে আমার ভাল লাগছে না আগের মতো। যুথীর চেয়ে অনেক স্বল্পসুন্দরী কোন অচেনা মেয়েকেও ওর চেয়ে আকর্ষণীয় লাগল। কোন কারণ নেই, যেন দীর্ঘদিনের পুরনো অভ্যাসের প্রতি হঠাৎ করে অনীহা চলে এলো। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! যত সময় গড়াল, দিন গেল, বেড়ে চলল অনীহাটুকু ততোই।"

আমি কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে বলে যেতে লাগল-

"আপনি নৈতিক দৃষ্টি দিয়ে ঘটনাটা বিচার করছেন নাকি ডাক্তার বাবু? যে মেয়েটা আমার কঠিন সময়ে পাশে থেকেছে, ভাল সময়ে এসে তার প্রতি আকর্ষণহীনতা অনুভব করছি। এটা তো এক ধরনের অন্যায়, অনৈতিক বিষয়। এমন কিছু ভাবছেন?"

আমি গলার স্বর ডাক্তার সুলভ গম্ভীর এবং শান্ত করে বললাম-"ডাক্তাররা রোগীর চারিত্রিক মূল্যায়ন করে না মৃদুল। রোগীর মানসিক সুস্থতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।"

"যাক, বাঁচালেন। যা বলছিলাম, এমন নয় যে আমি যুথীর সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না। শুধু আগের সেই উচ্ছ্বাস-মোহ খুঁজে পাচ্ছি না।"

"দীর্ঘদিন একসাথে থাকলে এমন হওয়াটা আসলে অস্বাভাবিক নয় মৃদুল। সম্পর্কও এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকে না। জীবন কোন সোজা গ্রাফ নয়, অনেক আঁকা বাঁকা, জটিল।"

"আপনি বুঝতে পারছেন না ডাক্তার। বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। এটা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসা কোন সম্পর্ক নয়। যেন হঠাৎ করে খেই হারিয়ে ফেলা।"

আমি আমার ডাক্তারি জীবনে প্রথম বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

*** *** ***

অনেক রাত। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে আমার স্ত্রী এখনো ঘুমায়নি। একটা বই পড়ছে বেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টে। মৃদুলের কথাগুলো নিয়ে বেশ ভাবছি! বোঝার চেষ্টা করছি আমি আমার স্ত্রীকে এখনো সেই চোখে দেখি কি না, যেমনটা দেখেছিলাম প্রথমবার। কিংবা বিয়ের ১ বছর পর যেমন করে দেখেছিলাম, ৫ বছর পর যেমন করে দেখেছিলাম, প্রথম সন্তান হবার সময় যেমন করে দেখেছিলাম, এখনের দেখা আর সেই সব দেখার মধ্যে কি কি তফাৎ আছে।

আমাকে এভাবে একাগ্র হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখের সামনে থেকে বইটা নামিয়ে রাখল সে, আমার চোখের দিকে তাকাল, তারপর বলল-

"এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি বই পড়ব কিভাবে বলো তো?"

"তা ঠিক। একটা কথা বলার ছিল তোমাকে।"

"কি কথা?"

"আমার এক পেশেন্টের কথা। লোকটা আমার কাছে ১০ বছর ধরে মাঝে মাঝে আসছে কাউন্সেলিং এর জন্য।"

"ও। কি সমস্যা তার?"

"নির্দিষ্ট কোন সমস্যা নেই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফ্রাস্টেশান নিয়ে আসত।"

"ও আচ্ছা।"

"তবে যখনই আসত, একটা মেয়ের কথা খুব বলত। তার স্ত্রী। তাকে খুব সাহস দিত, অনুপ্রেরণা দিত, ভালোবাসত।"

"বাহ। চমৎকার মেয়ে।"

"কিন্তু ব্যাপার কি জানো? আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, তার কোন স্ত্রী নেই।"

"মানে? সেটা কি রকম?"

"তার কথা শুনে বুঝতে পারতাম। স্ত্রী সংক্রান্ত আলোচনা ছিল অসংলগ্ন। কখনো বলে, তার স্ত্রী স্কুল টিচার, কখনো বলে গৃহিণী, কখনো বলে ব্যাংকার, আবার কখনো বলে তার স্ত্রী কখনো কোন চাকরী-বাকরী করেনি।"

"তার মানে কি? লোকটা একটা কাল্পনিক মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করে?"

"প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম, মেয়েটা কাল্পনিক নয়। মেয়েটাকে সে সত্যিই চিনত। তাদের একসাথে অনেক স্মৃতি রয়েছে। সে জন্য সে নিজের স্ত্রীর অতীতের কথা ঠিকঠাক ভাবে বলতে পারত, শুধু তার সাথে সংসার শুরু করার পর থেকে সে যা বর্ণনা দিয়েছে, তা কাল্পনিক। সহজ সিদ্ধান্ত, সে মেয়েটাকে ভালোবাসত, কিন্তু তার সাথে বিয়ে হয়নি বলে মানসিক ধাক্কা পেয়েছে। সেখান থেকে হ্যালিউসিনেশন।"

"সর্বনাশ, কি অদ্ভুত।"

"হ্যা, বেশ অদ্ভুত। তবে একটা বিষয় কি জানো, আমি কখনো তার এই হ্যালোসিনেশনটাকে সারাতে চাইনি। আমি চেয়েছি সে হ্যালুসিনেশন করতে থাক।"

"সে কি! এমন একটা কাজ কেন করতে গেলে তুমি?"

"কারণ, যে মেয়েটার কথা বলত সে, তার স্ত্রী, আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমি মেয়েটাকে চিনি। সে মেয়েটা আর কেউ নয়, তুমি যুথী।"

"কি!"

"হ্যা। তোমার সাথে আমার এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল। তোমার পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস-অনভ্যাস কিছুই জানতাম না। বিষয়গুলো আমি ধীরে ধীরে জানতে পারি সেই পেশেন্টের কাছ থেকে। সে জন্যই চাইনি সে হ্যালুসিনেশন করা বন্ধ করে দিক। ছেলেটাকে হয়তো তুমি চিনবে, মৃদুল।"

"মৃদুল?"

"হ্যা।"

কি আশ্চর্য, আমি অদ্ভুত এক সংশয় দেখতে পেলাম যুথীর চোখে। সাইকিয়াট্রিস্ট বলে বুঝতে পারলাম সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। দশ বছর কি এতই দীর্ঘ সময়?



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract