Mitali Chakraborty

Inspirational

3  

Mitali Chakraborty

Inspirational

কালো ডি. পি:-

কালো ডি. পি:-

7 mins
667


"এই সোনাই, স্নান সেরে তৈরী হয়ে নে, ১০ টা বাজতে চললো কিন্তু! তোর ড্রইং স্যার এলেন বলে...", পূজোর ঘর থেকে হাঁক দিয়ে সোনাই কে ডেকে কথা গুলো বললেন মমতা দেবী। মমতা দেবী হলেন সোনাই এর আদরের ঠামুন, ছোট থেকেই সোনাই খুব ঠাম্মা ন্যাওটা, হবে নাই বা কেনো কুন্তল আর পারমিতা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে এই মমতা দেবীই পরম মমতায় সিক্ত করেন তার আদরের নাতনি সোনাই কে। আজ রবিবার, ছুটির দিনে রান্নাঘর পারমিতার দখলেই থাকে; যদিও মনা দি আছেন রোজের রান্না করার জন্য কিন্তু ছুটির দিনে মনা দির সাথে পারমিতাও হাতা-খুন্তি নিয়ে সকাল থেকেই ব্যাস্ত হয়ে পরে। মমতা দেবী তখনও নিত্য পুজোয় ব্যাস্ত, এদিকে ছোট্ট ১০ বছরের সোনাই টিভি চালিয়ে হাঁ করে বসে ডোরেমন কার্টুন গিলছে। ডোরেমন অতি প্রিয় কার্টুন কেরেক্টার তার, ঠামুনের কথা গুলো কানেই গেলো না তার, সে টিভি নিয়েই ব্যাস্ত। এবারে পারমিতা ডেকে বললো,"যা না সোনা, স্নান টা সেরে নিয়ে বসে দেখিস, তোর ড্রইং টিচার এসে পড়বেন, ড্রইং করা হলে গেলে আবার আবৃত্তির ক্লাস, দুপুরে নাচের ক্লাস আর নাচ সেরে আসার পথে বিকেলে আবার খেলতে যাবি না পার্কে?" মায়ের কথায় একটু বিরক্ত হয়েই পছন্দের ডোরেমন কে ছেড়ে উঠতে হলো সোনাই কে।


সোনাই নিজের স্টাডি রুমে বসে আঁকা শিখছে। পারমিতা চা দিয়ে এলো আঁকার শিক্ষক কে। এদিকে কুন্তল, মমতা দেবী বসে কথা বলছেন আগামীকাল সন্ধ্যায় বিয়ে বাড়ীর যাওয়ার কথা নিয়ে, পারমিতা রান্নাঘর থেকেই মমতা দেবী আর কুন্তলের সাথে কথা বলছে, তখুনি টিভি তে খবর টা বার বার প্রকাশিত হচ্ছে 'এক ২৬ বর্ষীয়া যুবতীর সাথে দুষ্কর্ম তথা হত্যা....' মুহূর্তে কুন্তল,পারমিতা, মমতা দেবী খবর টা শুনে একদম থমকে যান, কুন্তলের মুখ টা দেখে মনে হচ্ছে রক্তশুন্য। পারমিতার নজর এখনও টিভির পর্দায়, তখুনি আঁকার শিক্ষকের সঙ্গে সোনাই এসে পারমিতা কে বললো যে আজকের মত ক্লাস শেষ, পারমিতার চমক ভাঙ্গে তখন। আঁকার শিক্ষক চলে গেলে পর সোনাই কে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে পারমিতা, অন্যমনস্ক হয়ে আছে সে। সোনাই মায়ের মুখে হাত রেখে মা কে ডেকে দেখায় আজকে সে কি আঁকলো। পারমিতা আঁকা দেখে বললো," খুব সুন্দর হয়েছে মামনি। তোর ভালো লাগে আঁকতে?" সোনাই বলে,"হ্যাঁ মা, আর স্যারও ভালো শেখায়..."। পারমিতা আঁতকে ওঠে স্যার ভালো আঁকা শেখান কথাটা শুনে, সে জিজ্ঞেস করে,"হ্যাঁ রে মামনি তোর স্যার তোর সাথে ভালো ভাবে কথা বলে তো? মানে তোর বাপি যেমন তোর....." 


পারমিতাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তাকে মাঝ পথে থামিয়েই সোনাই বলে," হ্যাঁ মা। স্যার ভালো... আমার সাথে ভালো করে কথা বলে। তুমি আমায় শিখিয়েছ না মা যে গুড টাচ আর বেড টাচ কি, আমাদের স্কুলেও শেখায়। স্যার ঐসব কিছু করে না মা..."। মেয়ের কথায় একটু আশ্বস্ত হয় পারমিতা। ওইদিকে রান্নাঘর থেকে আসা প্রেসারের সিটি তে চমক ভাঙ্গে তার, মেয়েকে এখন কুন্তল নিয়ে যাবে আবৃত্তি ক্লাসে। ক্লাস খুব বেশি দূরে নয় বাড়ির পাশেই। তাড়াতাড়ি তৈরী করিয়ে সোনাই কে পাঠায়। পারমিতার ফোনে টুং টাং শব্দ করে মেসেজ ঢোকে। তার অফিসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজ। সেই দুষ্কর্ম সংক্রান্ত ঘটনাটি নিয়েই ছবি সহ দুটো মেসেজ। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায় পারমিতার। এদিকে মমতা দেবী তেনার ঘরে বসে আছেন চুপটি করে, টিভিতে খবরটা দেখার পর থেকেই খুব মনমরা হয়ে আছেন, চোখে মুখে ভীতির রেশ। কিছুদিন পর পরই ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো মনে দাগ কাটছে খুব। নিজের কৈশোর বয়সের কথা মনে করছেন, তার সময়ে সমাজটা কি এত কলুষিত হয়ে গেছিলো? না তো... হেঁসে খেলে বাড়ি ফিরতেন বিকেলে স্কুল ছুটি হলে, কখনো একাই ফিরতেন কিন্তু কেউ এসব নষ্টামি করবে সেকথা ভাবতেনও না। কিন্তু আজকাল যা শুরু হয়েছে সেখানে কি যুবতী, কি কিশোরী, কি বৃদ্ধা, এমন কি মাটির সাথে কথা বলা শিশুটিও রেহাই পায় না, অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ে তেনার চোখ দিয়ে। 


পারমিতার ফোনে আবার মেসেজ ঢোকে। ফোন টা অন করে দেখলো ঘটে যাওয়া ঘটনাটির প্রতিবাদে তার অফিসের হুয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের বেশ কয়েকজন বলাবলি করছে নিজেদের প্রোফাইলের ছবি টা কালো করে দিতে। পারমিতা ভাবছে এভাবে ডি.পি র ফটো কালো রঙ্গের করলেই কি প্রতিবাদ করা হলে গেলো? এতেই দোষীরা শাস্তি পেয়ে যাবে? এখন সবাই মোমবাতি জ্বালিয়ে মিছিল বের করে নীরব প্রতিবাদ জানাবেন, কিন্তু এটা তো নির্ভয়ার সময়ও হয়েছিল কিন্তু দুষ্কর্ম বন্ধ হচ্ছে কি আদৌ? আমরা সুরক্ষিত আছি কি আদৌ? আমরা মেয়েরা ছোট থেকেই শিখে আসছি রাত হলে একা পথে ঘাটে চলতে নেই, আমরা শিখেছি মুখ বন্ধ রাখতে তা যতই কুরুচিকর মন্তব্য বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে যাই না কেনো? আমরা শিখেছি সকল কে সম্মান করতে, সকল কে মান্যি-গণ্যি করতে। কিন্তু গর্জে উঠে প্রতিবাদ করতে আমরা শিখিনি। আমরা শিখেছি রাত হলে বাবা বা ভাই বা স্বামীকে খবর দিতে হবে, তারা কেউ এসে আমাদের সঙ্গ দেবে তবেই আমরা নিশ্চিন্তে আর সুরক্ষার সাথে গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হবো। কেনো আত্মনির্ভরতা শিখি না আমরা মেয়েরা? কেনো নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব নিজেরা নেই না? কেনো সর্বদা পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচার মন্ত্র শিখি, আত্মরক্ষার বিষয়ে আমরা কেনো আত্মমগ্ন হই না যেখানে রক্ষকই ভক্ষকে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত?


হটাৎ মমতা দেবীর ডাকে সম্বিৎ ফেরে পারমিতার। মমতা দেবী বসে আছেন বিছানায়, পারমিতা কে বসতে বললেন পরে সে জিজ্ঞেস করলো,"মা আপনি ঠিক আছেন? ক্লান্ত লাগছে আপনাকে...", মমতা দেবী একটু স্ফিত হেসে বললেন,"বৌমা, তোমার মনে আছে সোনাই হাওয়ার পর আমি কি বলেছিলাম?" পারমিতা বলে,"মনে আছে মা, আপনি বলেছিলেন ছোট থেকেই আপনার বড় সখ ছিল নৃত্য কলার প্রতি। আপনার খুব ইচ্ছে সোনাই নাচ শিখুক, আর দেখুন আপনার সোহাগী সোনাইও নাচ করতে কত ভালবাসে"। মমতা দেবী বললেন,"তা ঠিকই বলেছো, তোমার মনে আছে বৌমা তোমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই যখন তোমায় দেখতে গেছিলেন বিয়ের পাকাকথা হওয়ার আগে তিনি জানতে চেয়েছিলেন তুমি পড়াশোনার বাইরে আর কি জানতে? তুমি বলেছিলে গান গাইতে জানো, গেয়ে শুনিয়েও ছিলে, সোনাইকেও অফিস থেকে ফেরার পর রেওয়াজ করাতে বসো, কি মিষ্টি গানের গলা সোনাইয়েরও তোমার মত...."। পারমিতা একটু আশ্চর্য হয়ে বললো,"তা মা আপনি সে সব পুরনো কথা মনে করছেন যে হঠাৎ..." মমতা দেবী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "তোমার মনে আছে বৌমা তোমার পিসিশাশুড়ি ওইদিন কি বলেছিলেন তোমায়?" পারমিতা বললো," কিন্তু মা..."


মমতা দেবী বললেন,"বলোই না বৌমা, তোমার পিসি শাশুড়ি ওইদিন কি জিজ্ঞেস করেছিলেন তোমায় বিয়ের জন্যে যখন দেখতে গেছিলেন?"


পারমিতা বললো,"পিসিমা বলেছিলেন চাকরি বাকরি করছি তা ঠিক আছে কিন্তু আমি রান্নাবান্না কিছু জানি কিনা?" মমতা দেবী বললেন,"হ্যাঁ বৌমা ঠিক বললে...."। মমতা দেবী আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হয়ত কিন্তু পারমিতা মাঝখানে বলে উঠলো,"কিন্তু মা আপনি আমায় কোনোদিনও জোর করেননি রান্নাবান্না সহ সংসারের যাবতীয় কাজের জন্য, আমি আর কুন্তল অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে সোনাই এবং এই সংসারটা কে গুছিয়ে রেখেছেন আপনিই মা...."। মমতা দেবী পারমিতার মাথায় হাত ছু্ইঁয়ে বললেন,"বৌমা ওইদিন আমি তোমায় কোনো প্রশ্ন করিনি সংসার সমবন্ধীয়, কিন্তু আজ একটা প্রশ্ন করছি তোমায়... বলো বৌমা নিজের আত্মরক্ষা কিভাবে করতে হয়?" পারমিতা অবাক হয়ে মমতা দেবীর পানে চেয়ে আছে। মমতা দেবী বলে চলেছেন," আমি তোমার স্বর্গীয় শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশাইয়ের মত এত পড়ালেখা করিনি বৌমা, এত পাস-ও দেইনি, কিন্তু একটা কথা আজকের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব বুঝতে পারছি যে মেয়েদের রান্নাবান্না, ঘরকন্নার কাজ, গান নাচ আঁকা সব কিছুর পাশে নিজের আত্মরক্ষার শিক্ষাটাও প্রাপ্ত করা খুব দরকার। বৌমা সকালের খবরটা আমায় বাধ্য করছে চিরাচরিত গতবাধা পদ্ধতিটাকে ভাঙতে, আমরা মেয়েরা যদি না শিখি আত্মরক্ষার কৌশল তবে বারে বারে শিকার হতেই থাকবো অপ্রীতিকর ঘটনা গুলির। তাই এই বুড়িটার একটা কথা রাখ বৌমা..."। পারমিতা বললো," বলুন মা,আমি চেষ্টা করবো..."। মমতা দেবী বললেন,"পাশের বাড়ির বাসন্তী দির নাতি নাকি ক্যারাটে শিখতে যায়, একদিন বাসন্তী দিই বলেছিল কথাটা, আমি বলি কি বৌমা আমাদের সোনাইকেও ভর্তি করিয়ে দিলে কেমন হয়, আমরা মেয়ে হয়ে যদি অন্য একটা মেয়েকে উৎসাহ না দেই আত্মরক্ষার জন্য তাহলে বুনিয়াদটা গড়ে উঠবে কি করে বৌমা....?" পারমিতা বিস্ময়ে তাকিয়ে শুনছে মমতা দেবীর কথা গুলো, ওনার বলা শেষ হলে সে বললো, " ঠিক বলেছেন মা, আমাদের নিজের সুরক্ষার জন্য নিজেদেরই দায়বদ্ধ হতে হবে। মা আমি সোনাইকেও ক্যারাটে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করবো, গান নাচ নাহয় পরবর্তীতেও শিখতে পারবে, কিন্তু স্বয়ংকে রক্ষা করার গুঢ় যে তাকে শিখতেই হবে...।" মমতা দেবী স্মিত হেঁসে বললেন,"শুধু সোনাই নয় সোনাইয়ের মা কেও যে শিখতে হবে। শেখার তো কোনো বয়স হয় না, তুমিও শিখবে বৌমা, আত্মরক্ষা তথা মুখরা হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দীক্ষায় দিক্ষীত হতে হবে তুমি, আমি, সোনাই সহ প্রত্যেককে, ঠিক বললাম কিনা বলো?" পারমিতা বললো," মা প্রত্যেক ঘরে ঘরে যেনো আপনার মত সুচিন্তা করার মতন একজন পারদর্শী মানুষ থাকেন...."।


পারমিতার ফোনে আবার কয়েক টা মেসেজ ঢুকলো, তাকে বিমর্ষ দেখে মমতা দেবী জিজ্ঞেস করলেন "কি হলো বৌমা?" সে বলল," মা আজকের ঘটনার প্রতিবাদে মোমবাতি মিছিল হবে।" মমতা দেবী বললেন,"তা হৌক কিন্তু মিছিলের পর আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে নিজের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের..."। পারমিতা বললো,"হ্যাঁ মা,ঠিক বললেন, প্রয়োজনের সময়ে আমরা হাত পা চালাতে পারবো কি পারবো না? আমরাই কেনো নিজেরা নিজেদের রক্ষার জন্য লড়াই করবো? পুরুষেরা কেনো সেই শিক্ষা পাবে না যে কি করে নারী-সম্মান করতে হয় সে সব কথা যেমন ঠিক, তেমনি সম্মুখে বিপদ ধেঁয়ে এলে যে নিজের অস্তিত্বের রক্ষার লড়াই নিজেকেই করতে হবে এ কথাটাও ঠিক... আপনি ঠিক বলেছেন মা।" মমতা দেবীর সাথে কথা বলে সে নিজের ঘরে এলো, তার শ্বাশুড়ি মায়ের অনেক গুণের মধ্যে আজ খুঁজে পেলো এক নতুন গুন, মনে মনে ঠিক করলো সে প্রোফাইল ছবি কালো করে নীরব প্রতিবাদ করবে না বরং মশাল হাতে ভারত-মাতার রণং দেহি মূর্তির ছবি লাগিয়ে নিজের ভেতরকার প্রতিবাদী রূপ আর আত্মরক্ষার স্পৃহা টাকে জীবন্ত রাখবে....."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational