কালো ছায়া
কালো ছায়া


তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার রেলিংটা ধরে। সন্ধ্যার আকাশ তারায় তারায় আলোকিত আজ। এক অদ্ভুত সুখ তন্ময়ের মনে। শুরু তে খুবই অসহজ ছিল সে, কিন্তু এখন তার মনে অনাবিল প্রশান্তি। তন্ময় যেমনটা ভেবেছিল পর্না ঠিক সেরকমই। এই তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা হলো তন্ময় সকল আচার-বিচার, নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা সিথি রাঙিয়ে অর্ধাঙ্গিনী করে নিয়ে আসে পর্নাকে।
তন্ময় আর পর্নার সমন্ধ করেই বিয়ে, তন্ময় বর্তমানে ব্যাংকে কর্মরত আর পর্না এক কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার যে তন্ময় ও পর্না দুজনেই খুব লাজুক প্রকৃতির। বিয়ের পাকা কথা হাওয়ার পরও তন্ময় সাহস করে উঠতে পারেনি পর্নাকে নিয়ে ডেটে যাবার। এদিকে পর্নাও নিজে থেকে তন্ময় কে কখনো জোর করেনি বিয়ের আগে দেখা করার বা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। যা টুকটাক কথা হতো তা হোয়াটসঅ্যাপ আর ফোন কল্ করেই হতো। তন্ময় এবং পর্না দুজনেই পরিবারের কথায় বিয়েতে রাজি হলেও কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা একটা ছিলই যে তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারবে কিনা! কিন্তু আজকের এই এক ছোট্ট ঘটনাটির পরে তন্ময়ের দৃঢ় বিশ্বাস পর্নার হাতে হাত রেখেই সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে পারবে জীবন সংগ্রামের দুর্গম পথ।
তন্ময় খুব ছোটবেলা থেকেই মা অন্তপ্রাণ। শুধু মায়ের ছায়ায় আবৃত হয়েই মানুষ হয়েছে সে সেই শৈশব থেকে। বাবার আদর থেকে তন্ময় বঞ্চিতই রয়ে গেছে সবসময়, কারণ তার যখন ২ বছর বয়স তখনই সেই মর্মান্তিক সংবাদটি বাড়ির সদস্যরা পান যে তন্ময়ের বাবা ইহলোক ছেড়ে পরলোকে গমন করেছেন। তন্ময়ের বাবা চাকরিসূত্রে বহিঃরাজ্যে কর্মরত ছিলেন এবং হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে সকলকে শোকাতুর করে মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই সংসারের মোহমায়া কাটিয়ে তিনি পাড়ি দেন অচীনপুরে। তারপর থেকেই শুরু হয় তন্ময়কে নিয়ে তার মা সুমনা দেবীর জীবন সংগ্রাম।
কিভাবে ছোট্ট তন্ময়কে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িত হয়ে সুমনা দেবীর একক প্রচেষ্টায় তন্ময়ের লালন পালন, পড়া লেখা, একা হাতে সাধারণ রোজগারপাতি করে মায়ে-পোয়ের সংসার চালানো এসব কথা সমস্তই পর্নাকে বলেছিল তন্ময়, পর্না তখন কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া না করলেও আজ যেটা করলো সেটা শুনে তন্ময় অভিভূত।
গতকাল রাতে বিয়ে সম্পন্ন হবার পর পর্না আর তন্ময় দুজনেই বাসর রাতটা গল্প করে কাটিয়েছে। কথায় কথায় বলেছিল তার জন্য সুমনা দেবীই সব, তিনিই তন্ময়ের ঈশ্বর আর তিনিই তন্ময়ের খুশির উৎস। সকালে কন্যা- বিদায়ের পর দুরুদুরু বক্ষে পর্নার আগমন স্বামী নিবাসে। খুব ঘটা করে আপ্যায়ন হয় পর্নার। পর্না আর তন্ময় তখন পাড়া প্রতিবেশী, মুষ্টিমেয় আত্মীয় পরিজন আর বন্ধু বান্ধবের বেষ্টনীতে আবদ্ধ। এয়ো স্ত্রীরা মিলে পর্নাকে দিয়ে সকল স্ত্রী-আচার করিয়ে তাকে নিয়ে যায় অন্য ঘরে আর তন্ময় যায় নিজের ঘরে, আজ যে কাল রাত্রি। আজ পর্না আর তন্ময় মুখ দেখবে না একে অপরের। পর্নাকে ঘিরে আছে মহিলা মন্ডলী, কিন্তু থেকে থেকে পর্নার চোখ খুঁজছে সুমনা দেবীকে, এ বাড়িতে এসে পর থেকে এখনও সুমনা দেবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়নি পর্নার, এমন কি বিয়ের সময়েও তিনি ছিলেন না বিবাহবাসরে। পর্নার চমক ভাঙ্গে এক আত্মীয়ার কথায় যখন তিনি পর্নার হাতে তুলে দেন ছোট্ট বাক্সটি।
পর্না চকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি খুলে দেখান বাক্সটি। রত্নখচিত দুটো সোনার বালা। পর্নাকে হতবাক দেখে তিনি আবার বলেন তোমার শাশুড়ি মায়ের আশীর্বাদ, সুমনাই পাঠালো এটা তোমাকে দেওয়ার জন্য। পর্না এবারে অত্যাধিক অবাক হয়ে ভাবছে যে ''শাশুড়ি মা নিজে আশীর্বাদ দিতে না এসে আত্মীয় দ্বারা বালা জোড়া পাঠিয়ে কর্তব্য শেষ করলেন, তার মানে কি আমাকে পছন্দ নয় মায়ের?'' | পর্না যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত তখন ঐ আত্মীয়া সহ বাকি সকলে পর্নার হাতে বালা জোড়া পড়াতে শুরু করবে তখুনি একজন বিকট চিৎকার করে ওঠেন, সবাই কে অবাক করে দিয়ে চেঁচাতে থাকেন "ও মা গো, এ কমন ধারা বউ গো, এর হাতে এটা কি বিচ্ছিরি দাগ?" পর্না আড়ষ্ট হয়ে পরে তাদের কথায়। এতক্ষণ কেউ লক্ষ্য করেনি সেই বিশ্রী দাগটা কিন্তু এখন আর এই দাগটা লুকায়িত নয়। সকলে হই হই করতে শুরু করলে চেঁচামেচি শুনে সেখানে আবির্ভূত হন সুমনা দেবী। সুমনা দেবী বালা দু গাছ হাতে নিয়ে সকলের সামনে পর্নার হাতে বালা দুটো পরাতে পরাতে বললেন," আমি আর তনু (তন্ময়) আগে থেকেই জানি পর্নার ডান হাতে পোড়া দাগ রয়েছে। সেটা নিয়ে এত হাঙ্গামা করার কিছুই নেই, কলেজে পড়ার দরুন কেমিস্ট্রি ল্যাবে প্রাকটিক্যাল চলাকালীন একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পর্নার হাতটি পুড়ে যায়, এই পোড়া দাগটি নির্মূল হয়নি বলেই সে ফুলস্লিভ ব্লাউজ পরে ছিল বিয়ে পরিপ্রেক্ষিতে। এটা শুধুই একটা দাগ মাত্র, কোনো কলঙ্ক নয়....", এই বলে সুমনা দেবী থামলেন।
পর্না একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুমনা দেবীর পানে, সুমনা দেবী পর্নার চিবুক ছুঁয়ে তাকে আশীর্বাদ করলে, সে জড়িয়ে ধরে সুমনা দেবীকে। অশ্রু সজল নয়নে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কোথায় ছিলে মা এতক্ষন ধরে? এসে পর থেকে তোমায় খুঁজছি..."। সুমনা দেবী ভারাক্রান্ত মনে বলেন, "আমার অপয়া ছায়া আমার বৌমার উপর পরুক সেটা চাইনি বলেই দূরে দূরে ছিলাম বৌমা। তুমি তো জানোনো যে তনুর বাবার মৃত্যুর পর আমাকে অপয়া অপবাদ দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল শ্বশুর বাড়ি থেকে, তন্ময়ের বাবার মৃত্যুর জন্য আমাকেই দায়ী করেছিল তখন সকলে। বলতে পারো কিছুটা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়েই কালরাত্রিতে নিজের বিধবার কালো অপয়া ছায়াটা তোমার উপর না পড়ুক সেটা ভেবেই...."।
পর্না আবেগপ্রবণ হয়ে সুমনা দেবীকে হাত দুখানা নিজের হাতে নিয়ে বলল, "যে মা তার সন্তানের হয়ে তার পক্ষে সরব হয়, সে মা কখনো অপয়া হতে পারে না, এই মাত্র তুমি আমাকে সকলের প্রশ্নবাণ থেকে যেভাবে বাঁচালে সেটা সত্যিই নজির বিহীন, তোমার ছায়া কালো নয় মা, তোমার ছায়া তোমার ব্যক্তিত্বের মতই উজ্জ্বল..."। তন্ময় এই মা মেয়ের একে অপরকে পক্ষাবলম্বনের মুহূর্তটি চাক্ষুষ করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু বন্ধুদের মুখে কিছু সময় পর যখন ঘটনাটি শুনলো তখন সে এই দৃঢ় বিশ্বাসে উপনীত হলো যে পর্নার সাথেই তার পারিবারিক ও বৈবাহিক জীবনের সুখের সূচনা হবে যেখানে থাকবে না ক্লেশ বা মনোমালিন্য শুধু থাকবে পরস্পরের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সেখানে স্থান নেবেনা শাশুড়ি বৌয়ের কলহ বা পারিবারিক অশান্তি, বিরাজ করবে শুধু একে অপরের প্রতি ভরসা, স্নেহ, মমতা ও সুহৃদয়তা। বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়, চেয়ে আছে আকাশপানে। কে বলে আজ কাল রাত্রি? তন্ময় আর পর্নার আকাশে যে কালোর কালিমা নেই, সেখানে যে বিরাজ করছে প্রেমের আলোকোজ্জ্বল দ্যুতি....