নন্দা মুখার্জী

Inspirational

2  

নন্দা মুখার্জী

Inspirational

জীবনতরী এক তারেতেই বাঁধা

জীবনতরী এক তারেতেই বাঁধা

9 mins
539


   শহরের নামকরা বৃদ্ধাআশ্রম। এখানে বয়স্ক নারী পুরুষ একই ছাদের তলায় শুধু রুমগুলিই যা আলাদা। সুবিধা সর্বরকম। খাওয়াদাওয়া, নানান স্থানে তাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানো; যারফলে অন্যান্য বৃদ্ধাআশ্রমগুলি থেকে এখানে খরচটা একটু বেশিই। এখনকার বয়স্ক বয়স্করা তাদের ছেলেমেয়েদের এতো বড় মানুষ তৈরী করেছেন যে তারা তাদের পিতামাতাকে বেশ আদরযত্ন পাওয়ার জন্য অর্থের কথা মোটেই ভাবেননি!


এখানে আশ্রিতদের ছেলেমেয়েরা সকলেই অর্থের বিনিময়ে সংসারে সুখ শান্তি কিনেছেন। খেয়ে না খেয়ে, নিজেদের শখআহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের সন্তানকে মোটা অংকের টাকা উপার্জনক্ষম করে বড় করেছেন কিন্তু এদের কাউকেই মানুষের মত মানুষ করতে পারেননি!


  চন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। এই আশ্রমের প্রধান।বয়স মাত্র আটান্ন বৎসর। চাকরী জীবন থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন। চাকুরী করতেন বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর উচ্চপদে। সংসার তার জীবনে আর হয়নি। বলা ভালো জীবনে একজনকে ভালোবেসে তাকে না পেয়ে আর কাউকেই সেই জায়গাটা দিতে পারেননি।


   গ্রামের স্কুল জীবন শেষ করে কলকাতায় কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে কলেজে যখন ভর্তি হয় চন্দ্রনাথ তখনও তার গ্রাম্য সরলতার কারনে অধিকাংশ সময় মানুষ চিনতে ভুল করেছে ও নানান কারনে অন্যের দ্বারা অপমানিত ও অসম্মাননিত হয়েছে। পড়াশুনায় তুখোড় চন্দ্রনাথ কলেজের প্রত্যেক অধ্যাপকের ছিলো প্রিয়পাত্র। কিন্তু হোষ্টেলের ছাত্রদের সাথে কখনোই তার সরলতা দিয়ে তাদের ছলচাতুরীকে জয় করতে পারেনি। একই রুমে ছিলো চারজন।অধিকাংশ দিনই তার বিছানার চাদর থাকতো মেঝেতে,বই থাকতো অন্যের টেবিলে,তার কলম সে খুঁজে পেতোনা।কিন্তু মুখ ফুটে কোনদিনই সে কাউকেই কিছু বলেনি। পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটাতে তারা ছিলো ওস্তাদ। একবার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়ে বাবাকে সবকথা জানাতেই স্কুল শিক্ষক বাবা কলকাতায় তার এক বাল্যবন্ধুআর বাড়িতে তাকে পেয়িংগেষ্ট রাখেন।


  বাদল চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে অনুরাধা। রূপে গুণে জুড়ি মেলা ভার।তখন সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। চন্দ্রনাথ তাকে দেখলেই কেমন জড়সড় হয়ে যেতো। অনুরাধা কিছু জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগ সময় মাথা নাড়িয়ে বা হ্যাঁ না তেই উত্তর দিতো। দোতলা বাড়ির উপর তলাতে থাকতেন ব্যাঙ্ককর্মী বাদল চৌধুরী,তার স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে অনুরাধা। শুধু খাবার সময়েই বাদলবাবুর স্ত্রী মনোরমা একটি বেল বাজিয়ে চন্দ্রনাথকে ডাকতেন।মনোরমাদেবী চন্দ্রনাথকে খুবই ভালোবাসতেন। উনি নিজেও ছিলেন গ্রামের মেয়ে। চন্দ্রনাথের সরলতায় মনোরমাদেবী মুগ্ধ হয়েছিলেন। সময় পেলেই গ্রামের সবুজ ধানক্ষেত,আমবাগান,লিচু পেয়ারা বাগান নিয়ে পুত্রসম চন্দ্রের সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা গল্প করে চলতেন। মাঝে মাঝে অনুরাধা এসে হাজির হলে চন্দ্রনাথ তখন শ্রোতার ভূমিকা গ্রহণ করতো।অনুরাধাকে দেখলেই চন্দ্রনাথ কেমন খোলসের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে নিতো। কিছুতেই সে অনুরাধার সামনে ফ্রী হতে পারতোনা। কিন্তু বাদলবাবু চন্দ্রকে আটকে তার স্ত্রীর এই গল্প করাটাকে কিছুতেই মানতে পারতেন না।তার অবশ্য অন্য কারন আছে। এখানে থেকে বাল্যবন্ধুর ছেলের পড়াশুনার ক্ষতি হোক তিনি তা কিছুতেই চাইতেননা। চন্দ্রনাথের বাবা যখন ফোন করে বন্ধুকে এই ব্যপারে সাহায্য করতে বলেন বন্ধু বাদলবাবু বলেন,


--আরে তোর ছেলে কি আমারও ছেলে নয়? তুই নিশ্চিন্ত মনে ওকে পাঠিয়ে দে আমার কাছেই ও থাকবে। আর শোন, টাকাপয়সার কথা একদম বলবিনা। গ্রামে যখন আমরা একসাথে থাকতাম তখন তোর আমার দু'বাড়িতেই আমাদের জন্য রান্না হোত। যেদিন যে বাড়ি ইচ্ছা হোত স্কুল থেকে ফিরে সেই বাড়িতেই খেতাম। কথাগুলো বলেই হা হা করে হাসতে থাকেন বাদলবাবু।


   চন্দ্রনাথের যখন লাষ্ট ইয়ার তখন ক্যাম্পাস থেকেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরী হয়ে যায়। কলেজ থেকে ফেরার আগেই বাবাকে স্কুলে ফোন করে জানায়। অনুরাধাদের বাড়িতে ফিরেই সেই জামা কাপড় পরেই দৌড়ে উপরে উঠতে গিয়ে অনুরাধার সাথে একদম সামনাসামনি ধাক্কা। অনুরাধা তাল সামলাতে না পেরে পিছনের দেওয়ালের দিকে পড়ে যেতে গেলে চন্দ্রনাথ খপ করে অনুরাধার একটি হাত ধরে টান দেয়। পিছন ঘূরেই অনুরাধা একদম চন্দ্রনাথের বুকের উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় দু'জনে কিছুটা সময় ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর নিজেদের মুক্ত করে চন্দ্র মাথা নীচু করে বেরিয়ে যেতে যায়। তখন তার বুকের মধ্যে ঠকঠক করে কাঁপছে। পা দুটো যেন অসার।অনুরাধার কথায় পিছন ফেরে--


---কিছু না বলেই চলে যাচ্ছেন যে? কি বলতে এসেছিলেন বললেন না তো? তবে মা,বাবা এখন বাড়িতে নেই। আমাকে বললে হবে?


---আচ্ছা আমি পড়ে আসবো।


--কিন্তু আমার যে একটা কথা বলার ছিলো।


চন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখটা নীচুর দিকেই থাকে।


--এই দেখুন আপনার সাথে কথা বলছি আর আপনি মুখটা নীচু করেই আছেন। আমার মুখের দিকে তাকান।


চন্দ্র আস্তে আস্তে মুখ তুলে অনুরাধার দিকে তাকায়।


---আমার চোখে চোখ রেখে দেখুন তো আমি যা বলতে চাই তা আপনি বুঝতে পারেন কিনা।


চন্দ্রনাথ লাজুক হেসে বলে,'পারি।'


  পরীক্ষা শেষে দিনসাতেকের জন্য চন্দ্রনাথ গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।যাওয়ার আগে অনুরাধার সাথে আলাদাভাবে কোন কথা আর হয়না।অনুরাধার তখনও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি। বাদলবাবু ও তার স্ত্রী চন্দ্রনাথকে যাওয়ার সময় বারবার করে বলে দেন,অফিসে প্রথমদিন যাতে সে এই বাড়ি থেকেই যায়। সেও সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে আসে। গেটের বাইরে এসে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে অনুরাধা হাত নাড়ছে। অনুরাধা ইশারায় তাকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু শতচেষ্টা করেও চন্দ্রনাথ অনুরাধার ইশারা বুঝতে পারেনা।


  বাড়িতে কয়েকটা দিন খুব আনন্দ,উল্লাসের মধ্যে কেটে যায়। কিন্তু এর ভিতরেও বারবার তার অনুরাধার কথা মনে হয়েছে। কলকাতা ফেরার আগেরদিন রাতে বাবা বললেন, 'এবার একটা ছোটখাটো ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে উঠে যেতে। বাল্যবন্ধু বাদল যা করেছেন তার ঋণ এ জীবনে শোধ হবার নয়। আর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে কাজ নেই। যেভাবে হোক একটা ঘর ভাড়া করে উঠে যেও।'


  দু , একদিন অনুরাধাদের বাড়ির থেকে অফিস করে কলিগদের সহায়তায় একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে চন্দ্রনাথ সেখানে উঠে যায়। চলে যাওয়ার সময় একটু সুযোগ করে অনুরাধাকে কথা দিয়ে যায় একটু গুছিয়ে নিয়েই বাবা, মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।ছলছল চোখে অনুরাধা চন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, অনেককিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও কিছুই বলতে পারেনা।


  চন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর এই আশ্রমের নাম 'রাধানাথ আশ্রম'। প্রায় রোজই কেউ না কেউ এই আশ্রমের বাসিন্দা হন সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্বে। যারা তাদের দিতে আসেন সকলের মুখেই থাকে হাসি আর যে বয়স্ক মানুষটা বাসিন্দা হতে আসেন তার চোখে থাকে অবিরাম জলধারা। এদের ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ মাঝে মধ্যে কারও কারও সাথে দেখা করতে আসেন। আবার অনেকে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর নিজ সন্তানের মুখ দেখতেই পাননা। এইসব সন্তানদের প্রভাব প্রতিপত্তি আরও কয়েকধাপ উঁচুতে। কিন্তু টাকার কার্পণ্য তারা করেননা। ধনী ব্যক্তির বাড়িতে পুরনো আসবাবপত্র যেমন রাখেনা অধিকাংশ ধনী পরিবারে এইসব বয়স্ক মানুষগুলো ওই পুরনো আসবাবপত্রের মতই।


  একদিন দুপুর বারোটা। সাতাশ আঠাশ বছরের সুন্দর, সুপুরুষ একটি ছেলে একজন বয়স্ক মহিলার হাত ধরে অফিস রুমে প্রবেশ করে। আজ প্রায় দুদিন ধরে এই যুবকটির সাথে চন্দ্রনাথ বাবুর বার দশেক কথা হয়েছে। যুবকটি পরিচয় দেয় মহিলার মাসতুতো ভাই হিসাবে।চন্দ্রনাথবাবুর সামনে বসেই মহিলা প্রাথমিক টাকার চেকটা লিখে দেন।যুবকটি সমস্ত কাগজপত্র লিখে দিদির স্বাক্ষর করিয়ে সবকিছু চন্দ্রনাথ বাবুর হাতে তুলে দেয়। তিনি অন্য লোক মারফৎ মহিলাকে তারজন্য বরাদ্দ নিদৃষ্ট রুমে পাঠিয়ে দেন। বয়স্কমহিলা চন্দ্রনাথবাবুর দেওয়া লোকটিকে অনুসরণ করেন। যুবকটির কাছে তখন চন্দ্রবাবু মহিলার সম্পর্কে জানতে চান,


---কেন উনি নিজ ইচ্ছায় এই আশ্রমে এলেন? উনার কি কেউই নেই এই পৃথিবীতে?


---আপন বলতে যা বোঝায় সেই অর্থে উনার কেউ নেই। আমিও উনার নিজের কেউ নই। কোন একটি ঘটনার সূত্র ধরে বেশ কয়েকবছর উনার সাথে আমার পরিচয়। দিদি বিয়ে করেননি। একাই থাকতেন। এখন বয়স হয়েছে নানান রোগে ধরেছে। সম্ভবত বছর ত্রিশ আগে দিদির ক্যান্সার হয়েছিলো। তখন মাসিমা,মেসোমশাই বেঁচে ছিলেন। প্রায় ন'মাসের মত চেন্নাই গিয়ে থেকে চিকিৎসা করিয়ে আস্তে আস্তে দিদি সুস্থ্য হন। বর্তমানে ওই রোগ থেকে দিদি সম্পূর্ণ মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু প্রচুর ওষুধ খেতে হয়। তাছাড়া আছে হাইপ্রেসার,সুগার, নার্ভের সমস্যা। এই আশ্রমটার কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি। আমিই দিদিকে বললাম এখানে এসে থাকলে দিদি ভালো থাকবেন অনেকের মাঝে। অন্তত দুটো কথা তো বলতে পারবেন সকলের সাথে।টাকাপয়সা দিদির যা আছে তাতে তার ভালোভাবেই চলে যাবে। আমি মাঝে মাঝে এসে দিদিকে দেখে যাবো।

 যুবকটি বেরিয়ে গেলে চন্দ্রনাথবাবু মহিলার চেকটি হাতে নিয়ে নামটা দেখে চমকে উঠেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফর্মটি হাতে নিয়ে ঠিকানাটা দেখে নেন। কিন্তু কি আশ্চর্য তিনি তো অনুরাধাকে দেখে চিনতেই পারেননি। অবশ্য চিনবেনই বা কেমন করে? তিনযুগ আগের দেখা সেই কিশোরী অনুরাধাই যে তার মনের ক্যানভাসে রয়েছে। আর তাছাড়া তিনি তো ভালোভাবে তার মুখের দিকেও তাকিয়ে দেখেননি। সেই বহুকাল আগে যেদিন তিনি বাদলকাকুর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নিজের ভাড়া বাড়িতে চলে আসেন সেদিন অনুরাধা সামনে আসেনি। এমন কি যে কটাদিন তিনি ওই বাড়িতে থেকে অফিস করেছেন অনুরাধা কোন সুযোগই দেয়নি কথা বলার। খুব অভিমান হয়েছিলো তখন। সেই অভিমান নিয়েই প্রায় দু'মাস বাদে যখন আবার অনুরাধাদের বাড়িতে সে গেছিলো তখন বাড়িটা তালাবন্ধ ছিলো।তারপর বহুবার সে ওই বাড়িতে গেছে কিন্তু প্রতিবারই সে তালা দেওয়া দেখেছে। এর মাঝেই অফিস থেকে সুযোগ আসে আমেরিকা যাওয়ার পাঁচ বছরের জন্য। ব্যস,জীবন থেকেই হারিয়ে যায় অনুরাধা। শুধু হৃদয়ে থেকে যায় ভালোবাসাটুকু।

  বিকালে এই আশ্রমে চা খাওয়ার পর্বটা চলে সবুজে ঘেরা বিশাল এক বাগানে।সেখানে সিমেন্টে বাঁধানো সারিসারি বসার জায়গা। যারা সেখানে আসতে পারেননা তাদের অবশ্য যার যার ঘরেই চা দিয়ে আসা হয়। চন্দ্রনাথবাবু একবার বাগানে ঢু মেরে সোজা চলে আসেন অনুরাধার রুমে। অনুরাধা তখন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বিশাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে হয়তো হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজছে।চন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে গিয়ে অনুরাধার পিছনে দাঁড়ান। অনুরাধা টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে,


---আমি সকলের সাথে যাইনি কারন আমি জানতাম চন্দ্রদা তুমি আসবে।


---তুমি আমায় চিনতে পেরেছিলে?


---কেন চিনবো না? তোমার তো কোন পরিবর্তন হয়নি।


---আমি কিন্তু তোমায় চিনতে পারিনি।


ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি এনে অনুরাধা বলে,


---তুমি তো ঠিক সেই আগের মত লাজুকই থেকে গেছো! তুমি তো আমার মুখের দিকে একটিবারের জন্যও তাকাওনি। তাকালে দেখতে পেতে আমি তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। সেই মুহূর্তে পরিচয় দিইনি কারন বিমল ছিলো। বিমল খুব ভালো ছেলে। আমার একটা কঠিন অসুখ হয়েছিলো।বেশ কয়েকমাস আমরা চেন্নাই ছিলাম।সেই সময় ওর বাবাও চেন্নাই এ চিকিৎসা করাতে যেতো। ও তখন খুব ছোট। আমরা একটা বাড়িতে পাশপাশি দুটো ঘরে ভাড়া থাকতাম। সেই থেকে ওর সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।আমি জানতাম কাগজপত্র দেখা হলে তুমি আসবে। আমি ভাবতে পারিনি জানো এখানে এসে তোমার দেখা পাবো। সত্যি বলতে কি এ জীবনে তোমার সাথে আর দেখা হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। পরীক্ষার পর তুমি যখন গ্রামের বাড়িতে চলে গেলে তার দুদিন পরেই সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ডাক্তারের কাছে গিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় ধরা পড়ে ব্রেস্ট ক্যান্সার। বাবা মোটেই সময় নষ্ট না করে আমায় নিয়ে চেন্নাই চলে এলেন। সাথে মা। এক নাগারে ন'মাস চেন্নাই।এদিকে বাবাও রিটায়ার করলেন। সারাজীবন ধরে সঞ্চিত অর্থ শেষ হয়ে গেলো। বাড়ির নীচের অংশটাও বিক্রি করে দিলেন।এতগুলো মাস পড়ে যখন কলকাতা ফিরে এলাম তখন বাবা আর্থিক দিক থেকে শূন্য। তারপর কখনও তিনমাস কখনো বা ছ'মাস পরে পরে চেকআপে পূনরায় চেন্নাই যেতে হয়। সে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতি। এখন পুরোপুরি সুস্থ্য। আস্তে আস্তে মা,বাবা দু'জনেই আমায় ছেড়ে চলে গেলেন। অতো বড় বাড়িতে একা একা একদম ভালো লাগতো না। বিমলই এই আশ্রমটার কথা বললো। ভাগ্যিস ওর কথা শুনে রাজি হয়ে বাড়িটা বিক্রি করে এখানে চলে এসেছি তাই তো তোমার সাথে দেখা হোল। হাসতে থাকে অনুরাধা। এবার তোমার কথা বলো।


---অনেকবার গেছি তোমাদের খোঁজে ওই বাড়িতে। কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছি। অফিস থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। সেখান থেকে ফিরে বাবা,মাকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকতে লাগলাম।দু'বছরের ব্যবধানে মা,বাবা দু'জনেই চলে গেলেন। গ্রামের বাড়িঘর,ধানীজমি,পুকুর সব বিক্রি করে কলকাতা থেকে একটু দূরে কোলাহলহীন এই নির্জনে আমি এই আশ্রম তৈরী করলাম সম্পূর্ণ নিজের টাকায়। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনিই সংসার সামলেছেন। আমার তো কোন খরচই ছিলোনা। তাই সবকিছু দিয়ে আমার এই আশ্রম। এখানে প্রায় পঞ্চাশজনের মত মানুষ সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাদের নিরলস শ্রম দিয়ে সংসার থেকে বিতাড়িত এই বয়স্ক মানুষগুলিকে সেবাযত্ন দিয়ে ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রতিবছর এঁদের সামান্য একটু আনন্দ দিতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করে থাকি। এঁরা প্রত্যেকেই কি উৎসাহ,উদ্দীপনা নিয়ে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন। এঁদের এই আনন্দ দেখে খুশিতে আমার চোখে জল এসে যায়। আবার কেউ কেউ পুজোর কটাদিন সকলের অলক্ষ্যে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেন। তখন হয়তো বাড়ির কথা মনে পরে । আমি এইসব নিয়ে বেশ আছি।


কিন্তু অনুরাধা,তোমার তো এই আশ্রমে থাকা হবেনা।


--মানে?আমাকে তুমি আশ্রমে জায়গা দেবেনা?


--এখান থেকে একটু দূরে আমার ছোট্ট একটা বাড়ি আছে। একাই থাকি। তুমি কি পারবে আমার কাছে থাকতে?


--তোমার বৌ,বাচ্চারা এখানে থাকেনা?


 এবার চন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠে বললেন,


---সে সুযোগ আর পেলাম কোথায়?যাকে বৌ করবো ভেবেছিলাম সে তো হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো। তাই আর ওপথ মাড়ায়নি। বলে আবারও হেসে উঠলেন।


 তাহলে তুমি রেডি হয়ে নাও, আমি হাতের কাজগুলো সেরে নিই। সন্ধ্যার আগেই আমরা রওনা দেবো।


  জীবন থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু বিধাতাপুরুষ যাদের জীবনতরী এক তারেতেই বেঁধে রেখেছেন শেষ বয়সে হলেও দেখা তো তাদের হবেই আর জীবনের বাকি পথটুকুও একসাথেই তারা হাঁটবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational