জীবন যেরকম
জীবন যেরকম
"কি রে ছোটো হলো তোর ..?কড়াইতে তেল গরম হয়ে গেলো তো..?"
রান্নাঘর থেকে সুরমার গলা পাওয়া গেলো। ঘোষ বাড়ির বড় বউ সুরমা।
ওদিকে সুরমার জা দীপান্বিতা বললো, "আসছি ! আসছি! দাড়াও আরটু ...লঙ্কাটা কাটলেই হয়ে যাবে।"
দোতালা থেকে চিৎকার এলো "মিনুর মা... মিনু র মা...
দীপান্বিতা লঙ্কা কাটতে কাটতে বললো, "কি হয়েছে? ইশানী.., এমন জোরে জোরে চেঁচাচ্ছো কেন?"
ঈশানী হলো এই ঘোষ বাড়ির মেয়ে। ডিভোর্সী , দুবছর হতে চললো, নাচের শিক্ষিকা।
ইশানীর সঙ্গে তার বউদিদের সম্পর্ক এখন খুব ভালো নয়। প্রায়ই এটা সেটা খিটিমিটি লেগে যায়।
সুরমার বর নীহার বাবু মানে ইশানীর বড়দা ইশানীকে খুবই স্নেহ করেন। আর সব ব্যপারে সাপোর্ট ও করেন।
দীপান্বিতা আবার বললো, "মিনুর মা এখনো ও আসেনি।"
ইশানী কথাটা শুনে সিঁড়ি থেকে ঘরে চলে গেলো।
দীপান্বিতা রান্না ঘরে গিয়ে বললো, "জানো দিদি ইশানী মিনুর মাকে খুঁজছিলো , কি জন্য বলতো?"
সুরমা -- "জানি না , ওর আজ আবার কি দরকার?.., তা মিনুর মাকে নিয়ে না আর পারা যায় না, এত দেরি করে আসে আজকাল। উহ্.."
দীপান্বিতা-" দ্যাখো গিয়ে বিশ্বাসদের বাড়িতে টিভি দেখছে। কতবার মোনালীকে বলি ও যখন আসবে টিভি দেখবিনা তো কে কার কথা শোনে।"
সুরমা--" সত্যি টিভি পেলেই হা.. করে দাঁড়িয়ে গেলো, ওর জন্য কেউ কিছু দেখতে পারবে না।"
দীপান্বিতা -- "আর ইশানীতো বেশি বেশি আশকারা দেয় ।কাজের মেয়ের সঙ্গে এত কথা কিসের, বলোতো।"
সুরমা--" কিছু বলা যাবে না আবার, বলতে গেলেই তোর দাদা..
দীপান্বিতা--" ইশানীকে তো দাদাই মাথায় তুলেছে ।ওর কোনো দোষ দেখতে পান না দাদা। ওই মেয়েই অশান্তি করে বেরিয়ে এসেছিল, অজিতকে আমি দোষ দেবো না।"
রান্নাঘর এ রান্না চলছে। সঙ্গে কথা ও...
হঠাৎ মিনুর মা ঢুকলো... চেঁচিয়ে উঠলো, বউদি ...
সুরমা দীপান্বিতা বেরিয়ে এলো রান্না ঘর থেকে।
সুরমা বলে উঠলো, "এই যে.. তোমার কি আক্কেল বলতো, এত দেরি ! নিশ্চয়ই বিশ্বাস দের বাড়িতে টিভি দেখছিলে..?"
মিনুর মা বলে উঠলো,
"না না বউদি.. বিশ্বাস যাও.. এই মা কালির দিব্যি. বলছি... টিভি নয় গো, এই এত বাসন ছিলো।ওদের কাল বাড়িতে অনেক লোক এসছিলো তাই .. নইলে কক্কোন চলে আসতাম গো।"
মিনুর মা গলার আওয়াজ শুনে
ইশানী এসে বললো, --" মিনুর মা.. আমার ঘরটা আগে মুছে দাও.. বুঝলে"
দীপান্বিতা বলে উঠলো, "আজ আবার তোমার কি দরকার ?কতবেলা হয়েছে... বাসন গুলো না মাজলে দেরি হবে , তোমার দাদারা বেরোবে।"
ইশানী-- " আমার ছাত্রীরা আসবে । ঘরটা না মুছলে হবে না।"
দীপান্বিতা আবার বললো সুরমার মার দিকে তাকিয়ে,
"এই তো কালই এলো.. না, দিদি ..! তুমি কিছু বলবে না ?.."
ইশানী বললো, "আজ অন্য দুজন আসবে সামনেই একটা প্রোগ্রাম আছে।"
সুরমা বললো, "তোমাকে কিছু বললেই তো আবার বড়দাদার কাছে নালিশ ঠুকবে।"
ইশানী--
"দেখো বড়বউদি তোমারা সবসময় আমার কিছু না কিছু নিয়ে সমালোচনা করে চলেছো। ঘরটা পরিস্কার না হলে নাচটা শেখাবো কি করে , তা তোমাদের তো সব কিছুতেই সমস্যা।"
মিনুর মা বলে উঠলো," তা.. কি করবো তাহলে.. "
সুরমা বললো, "যা পারো করো..."
মিনুর মা বললো, ইশানিদি র ঘরটা মুছে দিয়ে বাসন টা মেজে দিচ্ছি গো বউদি, তুমি চিন্তা করুনি এখ্খুনি হয়ে যাবে"।
দীপান্বিতা বললো, "দ্যাখো দিদি, মিনুর মাকে কেমন নিজের দিকে টানলো। "
সুরমা চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,-- "জানি না কখন কি হবে অফিসে বেরোনোর তাড়া, একজনের আবার কলেজ, আরেক জন নেচে বাড়ি মাথায় করছে।
কেটে গেলো অনেকটা সময় ...
বাড়ির কর্তারা একে একে অফিস বেরিয়ে গেছে।
মিনুর মা এর সব কাজ শেষ হলো এবার ঘোষদের বাড়ি থেকে বের হবে , তার আগে ছুটি চাইতে এলো সুরমার কাছে।
সুরমা শুনেই রেগে আগুন...।
ওদিকে ইশানী নাচ শেখাচ্ছে ছাত্রীরা এসছে।
সুরমা -- "দ্যাখো মিনুর মা কি ব্যাপার বলতো! এইতো গতমাসে ছুটি নিলে এখন আবার কি হলো..?"
মিনুর মা একটু হাসি হাসি মুখ করে বললো,
"আমি কাল সিনেমা যাবো । একটা হেব্বি বই এসছে জানতো বউদি , নইলে কি . ..এখন ছুটি নিতাম বলো।"
দীপান্বিতা সেই কথা শুনে -- "হে ভগবান সিনেমা দেখতে যাবে... দিদি ওকে একদম ছুটি দেবে না।"
মিনুর মা-- " দেকো বউদি আমি কোথায় যাই বলো..? শুধু মাঝেমধ্যে একটু মেয়ের বাড়ি আর অসুক.. করলে তখন ..তা বলে কি আমার কোনো শখ থাকতে পারবেনি ।"
দীপান্বিতা বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো! কই আমাদের এত শখ হয় না তো। "
নানান কথা কাটাকাটি শুনে ইশানী বেরিয়ে এলো। তারপর মিনুর মার ছুটিটা মঞ্জুর করে ওকে যেতে বললো।
এই ব্যাপারটা হয়ে যাবার পর ইশানীর বউদিরা রেগে আগুন।
দীপান্বিতা বললো,
"এই যে ওকে তুমি ছুটিটা দিলে ।কোনো কাজইতো করো না ।কাল রাজ্যের কাজ কে করবে ভেবেছো?
তুমি শুধু নাচ করেই সারাজীবন বাড়ি মাথায় করলে।
ইশানী বিরক্ত হয়ে বললো, " দেখো ছোট বউদি মিনুর মা সব কাজ করে। আর তোমরা খালি রান্নাটুকু, আমি কতবার তোমাদের সাহায্য করতে চেয়েছি তোমরা নিজেরাই আমাকে করতে দাওনি আর এখন এসব বলছো। আর দিনরাত খোটা দিয়ে চলো আমি নাকি সংসার ভেঙে দাদাদের বোঝা হয়েছি।
কিন্তু এইবাড়িটা আমার বাবার তাই আমার ও অধিকার আছে। আর নাচ শিখিয়ে রোজকার যা করি তাতে আমার নিজের চলে ।তারপরেও এত কথা শুনবো কেন আমি..?"
দীপান্বিতা ইশানীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
"নাচ নিয়ে ছিলে সেখানেই থাকতে ফস করে এসে ছুটি দেবার কি দরকার ছিল আর এইসব রামায়ণ শোনাচ্ছো।"
সুরমা--" ওহ্ তোরা থামবি। ছোটো চুপকর, ইশানী ঘরে যাও তুমি।
ইশানী ঘরে চলে গেলো।
ঘোষদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনুর মা র বাড়ির ফেরার সময় তাকে গলির মধ্যে টেনে নিয়ে গেলো নরেশ। নরেশ এর সাথে মিনুর মার অনেক দিন ধরেই মেলামেশা। নরেশ অটো চালায়। নরেশ বললো, "চাঁপা , এই চাঁপা.. কি রে.. ছুটি পেলি? "
মিনুর মার নাম চাঁপা।
মিনুর মা নরেশের সঙ্গে মজা করবে বলে বললো, "না গো পায়নি , ।"
নরেশ ওমনি রেগে গিয়ে, "তুই বললি মন্ডলরা বেড়াতে গেছে। আর তাই এসময় কাজ ফাঁকা আছে। বিশ্বাস আর ঘোষদের তুই যে বললি ম্যানেজ দিবি । কি হলো..? । কতদিন পরে ভাবলাম একটু তোর সাথে ...
বলেছিলাম আগেই তোকে, এমনি কমাই দিতে। তারপর পরের দিন গিয়ে একটা ঢপ দিতিশ, তা না কি আমার সত্যবাদী যুদিষ্ঠির এলেন .. বলেই মুখটা নরেশ উপরে দিকে করে দাড়িয়ে আছে।
মিনুর মা মৃদু হেসে বললো, --" কি ঢপ দিতাম শুনি..?
নরেশ -- কেন।..বলতিস কিছু একটা বানিয়ে...এ. এই... বলতিস তোর পেট খারাপ হয়েছিল তাই...
মিনুর মা ওমনি খিলখিল করে হেসে উঠলো তারপর বললো, "ছোটো বেলায় শুনেছিলাম অসুক নিয়ে ঢপ মারলে সত্যি করে হয়ে যায়। না বাবা ওসব ঢপ আমি দিই না।"
নরেশের মনখারাপ হয়ে গেছে দেখে মিনুর মা সত্যিটা বলেই দিলো ।নরেশ খুশিতে চাঁপা বলে জড়িয়ে ধরলো মিনুর মাকে । তারপরই গলির মধ্যে লোক আসার আওয়াজ পেয়ে ওরা হাসতে হাসতে হাঁটতে শুরু করলো।
পরেরদিন সকালে ....
মিনুর মা যথারীতি এলো না।
ঘোষ বাড়িতে কাজ করা নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়ে দিনটা পেরিয়ে গেলো।
তারপরের দিন সকালে...
টেবিলে মোনালী আর সুদীপ্ত খাচ্ছে । মোনালী দীপান্বিতার মেয়ে। আর সুদীপ্ত সুরমার ছেলে ।
মোনালী বলছে, " এই দাদা জানিস! ...কাল না ম্যাগাজিনে দেখছিলাম নতুন যে সিনেমাটা রিলিজ করলো না ওটার রিভিউ।
সুদীপ্ত বলে উঠলো,
"তোর পড়াশোনা নেই , সামনে বার না তোর উচ্চমাধ্যমিক আর খালি সিনেমা। আর নিশ্চয়ই পিসির ঘর থেকে ম্যাগাজিনটা ঝেঁপেছিস।
দ্যাখো কাকিমা মোনালীটা কিন্তু দিন দিন অমনোযোগি হচ্ছে ওর রেজাল্ট খারাপ হবে কিন্তু।"
মোনালী ফিসফিস করে সুদীপ্ত কে বলছে, " আমার পিছনে লাগছিস তো আমি ও বলে দেবো জ্যাঠিমাকে যে তুই সারারাত জেগে পড়ার নাম করে বান্ধবীর সাথে চ্যাট করিস।"
সুদীপ্ত---" তুই দিন দিন শয়তান হয়ে উঠচ্ছিস..! আচ্ছা কে তোকে ফুচকা খাওয়ায়, তারপর আইসক্রীম আর সেই তুই আমার সঙ্গে, "
মানালী ---"দ্যাখ দাদা ! আমি তোকে কত প্ল্যান দিই গার্লফ্রেন্ড এর জন্য, তাই ওগুলো তুই আমায় খাওয়াস । আর তুই এখন আমার নামে মাকে ...
সঙ্গে সঙ্গে
সুরমা এলো বললো, " কি এতো চুপিচুপি হচ্ছে শুনি? তোদের তাড়াতাড়ি খাবারটা মুখে উঠবে নাকি , খালি দু'জন এর ঝগড়া। "
ইশানী এসে সুদীপ্ত আর মোনালীর সাথে একটু কথা বললো, তারপর বললো, বউদি আমি বেরোচ্ছি দরজাটা দিয়ে দাও।
দীপান্বিতা-- "আচ্ছা তুমি যাও.. পরে দিয়ে দিচ্ছি।
সুরমা বলে উঠলো," দুপুরে ফিরবে তো ..!"
ইশানী-- "না না আজ বিকেল হবে তোমরা খেয়ে নিও।"
দীপান্বিতা সুরমাকে বললো, --" আচ্ছা ইশানী আগে বলতে পারতো ওর জন্য ভেবেইতো দাদা চিংড়িটা নিয়ে আসলো। রান্নাটা ও হলো , কোনো মানে হয়। বিরক্তি কর..!
সুরমা বললো, "আচ্ছা ছাড় আর রাগ করিস না।"
কিছুক্ষন পর.....
মিনুর মা পরনে নতুন শাড়ি আর বিনুনির
চুল ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকলো মুখে গান গাইতে গাইতে।
মোনালী বলে উঠলো, " এই দাদা নতুন সিনেমাটার গান বুঝলি। দ্যাখ মিনুর মা রোও মুখস্থ।"
দীপান্বিতা --"দেখো দিদি পটের বিবি ঢুকলেন।"
মোনালী বলে উঠলো, "আচ্ছা মিনুর মা সিনেমাটা কেমন দেখলে!"
মিনুর মা "হেব্বি গো , নায়কটাকে দারুন দেখতে..ছিলো।"
দীপান্বিতা রেগে বলে উঠলো, "এই মোনালী ঘরে যা তোরকাজ নেই ..."
সুদীপ্ত মোনালীকে ফিসফিস করে--" হলো তো ! ঝাড় খেলি তারপর জোরে বললো আমি কলেজ বেরোচ্ছি কাকিমা, মা এলাম ..."
দীপান্বিতা --"হ্যাঁ সাবধানে যাস।"
মোনালীর স্কুল আজ নেই । হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার পর ছুটি চলছে।
মোনালী উঠে গেলো ঘরের দিকে।
মিনুর মা বললো, " ওকে বকচ্ছো কেন বউদি? বাচ্চা মেয়ে একটু আরঠু সিনেমা দেখবে না।"
সুরমা রান্না করতে করতে এসে " ঠিক আছে তুমি কাজ শুরু করো অনেক তো সিনেমা হলো উহঃ।"
এই ভাবে দিন পেরিয়ে যাচ্ছে।
তবে গলি ভেতর নরেশ আর মিনুর মায়ের প্রেম আজকাল সবার চোখে পড়ছে।
কিছু দিনের মধ্যেই এই নিয়ে মন্ডল বাড়িতে একটা অশান্তি হলো। আর মিনুর মায়ের ওই বাড়ির কাজটা গেলো।
কয়েকটা দিন পর ...
পাড়ার বিশ্বাস বাড়ি থেকে এক মহিলা ঘোষ বাড়িতে এলেন----
"কই সুরমা আছো ?.... বাড়ির সবাই কোথায়।"
সুরমা এলো বেরিয়ে। বসার ঘরে ঢুকলো মহিলা ।
সুরমা---" বিশ্বাসকাকিমা আসুন... বসুন ..."
দীপান্বিতা বেরিয়ে এলো
দুএক কথা কেমন আছেন ?
তারপর বিশ্বাস কাকিমা বললো, " আমার নাতির অন্নপ্রাশন তোমরা সবাই আসবে কিন্তু ! নিমন্ত্রণ কার্ডটা টেবিলে রেখে বললো
ছেলেমেয়ে কে দেখছিনা। সবাইকে নিয়ে যেও।"
সুরমা বলে উঠলো, -- " ওমা ..!;এইতো সেদিনের কথা এরমধ্যে ছমাস হয়ে গেলো।"
বিশ্বাস কাকিমা আবার বললো, --
"হ্যাঁ সময় কেমন হু হু করে বেরিয়ে যায়।
তা ইশানীকেও দেখছি না ।"
দীপান্বিতা -- "ও বেরিয়েছে..।"
বিশ্বাস কাকিমা --"ও...।
একটা কথা বলি তোমাদের , অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম আসব তা নানান ঝামেলায় আর হয় না। আজ বলেই যাব।"
সুরমা - -"কি কথা কাকিমা?"
বিশ্বাস কাকিমা, ---
"তোমাদের বাড়িতে তো ওই মিনুর মা কাজ করে তার স্বভাব চরিত্র এর খোঁজ কি রাখো তোমরা ? তোমরা দুই বউই তো পাড়ার মহিলা ক্লাবের সাথে যুক্ত, কত কিছু অনুষ্ঠানে তোমাদের দেখি, পাড়ার আরো মেয়ে বউ ও আছে জানি, গতবছরের আবার মহিলা চালিত দুর্গাপূজা করে তো তোমরা পাড়ার নাম বাড়িয়েছো।
কিন্তু এই ব্যাপারটা কি তোমরা জানো না? পাড়াতে এই যে এই অসভ্যতা চলছে তার একটা বিহিত করা তো দরকার। "
সুরমা , দীপান্বিতা একে অপরকে দেখালো অবাক হলো তারপর বললো, ---"কেন? কাকিমা... ওতো অনেক দিন হলো কাজ করছে। আপনাদের বাড়ি তারপর মন্ডল দা দের বাড়ি , এই পাড়াতে তো ও অনেক দিনের ।
অল্প বয়সে স্বামী মারা যায়। তারপর মেয়েকে আর বেশি লেখা পড়া শেখাতে পারেনি ।বিয়ে দিয়েছে। একটু বেশি সাজগোজ, বেশি বকবক করে আর মাঝেমধ্যে এদিক সেদিক যায়..তবে খুব একটা খারাপ তো নয়।"
বিশ্বাসকাকিমা ---"ওই তো এদিকে সেদিকে যায় বলছো, খোঁজ নিয়েছো ? কোথায় যায়? কার সাথে যায়?.
দীপান্বিতা --
"বলে তো মেয়ের বাড়ি নয়তো সিনেমা দেখতে যাচ্ছি।"
বিশ্বাস কাকিমা, " মিথ্যে মিথ্যে কথা, ভারি বদমাইশ মেয়ে।
একটা ছেলের সঙ্গে প্রায়ই দেখা যায়। সে কথা জানো কি?
ছেলেটা ইয়ং, আর এর বয়সটা দেখছো ! ছিঃ ছিঃ..
ওই যে মন্ডল দের বাড়ির সামনে যে গাছটা আছে ওর তলায় টিফিন বক্সে করে খাবার রাখে আর ওই ছেলেটা নাকি নিয়ে যায়। তারপর সারাদিন ফোনের মধ্যে কথা বলে। গলির মাঝখানে দাড়িয়ে দুজনের, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, সবাই দেখেছে ...,
মন্ডলদের বাড়িতে এই নিয়ে তুমুল ঝামেলা হয়েছে। তোমরা দেখছি কিছুই জানো না।
ওই ছেলেটার মা এসেছিল। কি সব কথা কাটাকাটি হয়েছে।
আর মিনুর মা কে তারপর কাজ আর নেয়নি মন্ডলরা। কি হয়েছে অতো সবটা জানি না তবে মিনুর মার স্বভাব মোটেও ভালো না। আমারও গত সপ্তাহে ছাড়িয়ে দিয়েছি।
কি অবস্থা চিন্তা করো! বিধবা মানুষ, একটা মেয়ে বড় তারপরেও মাগো.. ছিঃ ছিঃ এসব করে বেড়াচ্ছে।"
সুরমা, দীপান্বিতা কি বলবে জানে না একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তারপর দুজনে একসাথে বলে উঠল, "এতোকিছু হয়েছে আমরাতো কিছুই জানি।"
বিশ্বাস কাকিমা--"আচ্ছা উঠি তাহলে.. ."
সুরমা --"চা খাবেন না কাকিমা ? একটু বসে যান চা করে দি, এই ছোট যা. .. কাকিমার জন্য..
বিশ্বাস কাকিমা--"না না আরো নেমতন্ন করতে হবে আমি উঠি, তোমরা সবাই এসো কিন্ত।"
ইশানী বাইরে থেকে ঢুকতেই বিশ্বাস কাকিমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।
বিশ্বাস কাকিমা আবার কথা বলতে শুরু করল।
তারপর কেমন আছো ? জিগাসা করার পরই,
মিনুর মা কথাটা আবার করে ইশানীকে জানাতে শুরু করলো।
ইশানী বলে উঠল,
"এটা নিয়ে এত ভাবার কি আছে !, ও এ বাড়ি সে বাড়ি কাজ করে বলে কি ওর কোনো পার্সোনাল লাইফ থাকবে না।"
বিশ্বাস কাকিমা সুরমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, " তোমাদের ননদের কথা শোনো, কাজের লোকের আবার পার্সোনাল লাইভ ... তোমাদের ভালোর জন্যই বললাম বাড়িতে যখন উটকো অশন্তি হবে ওই মন্ডলদের মতো তখন বুঝবে ।আমরা বাবা আগেই ছাড়িয়ে দিয়েছি। ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘর করতে হয়। ওই অসভ্যতা আমার বাড়িতে চলে না।"
সুরমা--
"ওর কথায় কিছু মনে করবেন না কাকিমা, কি বলতে কি..."
বিশ্বাস কাকিমা--
"হ্যাঁ বুঝি বুঝি ওর তো সংসারটা ভেঙেছে তাই ভালোমন্দ জ্ঞানটাই নেই। "
ইশানী বিরক্ত হয়ে বলল,
"কি সব বলছো তোমরা? সংসার ভেঙেছে তাতে কি..! তার সাথে এটার কি সম্পর্ক আর যেটা সমর্থন করা উচিত নয় সেটা কেন করবো?"
বিশ্বাসকাকিমা আবার বললো,
"তোমাদের ভালোর জন্য সাবধান করা বাড়িতে ছোট ছেলে মেয়ে আছে তাদের এসব কথা না জানাই ভালো। তাই মিনুর মা কে কাজে না রাখাই ভালো, তাছাড়া পাড়াতে এই সব...।"
দীপান্বিতা বললো,
"সেই তো ঠিকই বলেছেন কাকিমা, আপনারা মন্ডলরা তো ছাড়িয়ে দিয়েছেন ।"
বিশ্বাস কাকিমা চলে যাবার পর...
সুরমা--" আচ্ছা ইশানী মিনুর মার এই কাজটা কি এত তো ভালো মনে হলো যে সমর্থন করছো ?"
ইশানী--"দেখো বড়বউদি বিধবা বলে সে কোনো মানুষ কে যদি বন্ধু মনে করে , তার বিপদে আপদে পাশে রাখে, তাতে বাঁকা চোখে দেখার কি আছে বলতো?"
দীপান্বিতা --"সবাই তো তোমার কাছে বাঁকা তুমি আর তোমার ভাবনা একমাত্র সেগুলো সোজা। "
ধীরে ধীরে বাড়ি কর্তারা ফিরছে।
এই কথাকাটাকাটি মধ্যে তারাও ঢুকে পড়লো।
নীহারবাবু মানে সুরমার হাজবেন্ড বললেন , "মিনুর মা কাজে তো গোলমাল করেনি তাহলে ওকে হঠাৎ ছাড়ানো না টা কি ঠিক হবে।"
নীহার বাবুর ভাই অসীম( দীপান্বিতা র হাজব্যান্ড) বলে উঠলো," আহ্ দাদা , শুনলে তো বিশ্বাস ,মন্ডলরা ছাড়িয়ে দিয়েছে শুনলেতো ওদের বাড়িতে গোলমাল হয়েছিল । এখনে হতে কতক্ষন বলতো। তাছাড়া পাড়াতে আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছে। বউদি, দীপান্বিতারা মহিলা ক্লাবের সদস্য ওদের ও তো একটা সম্মান আছে। পরে যদি পাড়া থেকে সবাই বলে আমরা এই মিনুর মা এর অসভ্যতা কে সমর্থন করেছি। তখন কি হবে ভেবে দেখেছো!"
ইশানী বললো, , "ছোটদা এভাবে একজনকে কাজ থেকে বার করা ঠিক নয়। তাছাড়া এইটাকে অসভ্যতা কেন বলছিস তোরা।"
অসীম -" দেখো দাদা এই ইশানীকে কেউ বোঝাতে পারবেননা।
দীপান্বিতা--"ইশানী তো সেই তখন থেকে তর্ক করে যাচ্ছে।
ইশানী--
"এটা কে আমি খারাপ ভাবতে পারছি না।
অসীম বলে উঠলো, -"তা তো বলবেই তুমি , ইশানী দ্যাখ অজিতের সঙ্গে সংসারটা এমনি এমনি ভাঙেনি তোর । তোর বন্ধু ওই দেবদীপ, তারপর তোর নাচ ।তাই জন্যই তো ভাঙলো। ভালো মন্দের জ্ঞান তোর বরাবরই কম।"
ইশানী বললো, "দ্যাখ ছোড়দা , দেবদীপ আমি একি কলেজের খুব ভালো বন্ধু ছিলাম, তুই তো সবই জানিস।
কিন্তু অজিতকে বিয়ের পর বহু বছর দেবদীপের সাথে কোনো যোগাযোগই ছিলো না। পরে হঠাৎ একদিন দেখা হয়।
সেটাকে অজিত সহজ ভাবে নিতে না পারলে আমি কি করতে পারি। তাছাড়া অজিত চাইতো আমি নাচ ছেড়ে বাড়িতে থাকি। আমার নাচের ক্যারিয়ার সেটা ও সহ্য করতে পারেনি।। "
দীপান্বিতা- --" দ্যাখো ইশানী তখন তুমি নাচটা ছেড়ে দিলে আজ অজিতের সাথে সংসারটা ভাঙতো না। কি হতো যদি একটু কম্প্রোমাইজ করতে।"
সুরমা- --" হ্যাঁ ছোটোতো ঠিকিই বলেছে। মেয়েদের তো কত কি সহ্য করতে হয়, কত শখ বাদ দিতে হয়।"
ইশানী---" অজিত আমার নাচ করাটাকে বন্ধ করতে চেয়েছিলো। তারপর দেবদীপকে জড়িয়ে যে ভাষায় আমার সাথে কথা বলে ছিলো তাই আমি চলে এসেছিলাম। জানি তোমরা ও সেই একিই ভাবো দিনরাত আমায় দোষারোপ করো। অপমান সহ্য করতে করতে বিরক্ত হয়ে চলে এসেছিলাম। অজিত আসলে আমার ক্যারিয়ারের সাইনটাই সহ্য করতে পারত না। স্বার্থপর একটা মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন থাকা যায় না ।
আর বৌদি তোমরা না পাড়ার মহিলা ক্লাব চালাও নারী মুক্তি নিয়ে বড়ো বড়ো কথা বলো ।তবে আমাকে কেন মুখ বুজে সহ্য করার যুক্তির কথাটা বলছো।"
নীহার বাবু এতক্ষন পরে এবার কথা বললেন---"তোমরা ইশানীকে নিয়ে পড়লে, আচ্ছা তোমরা তো জানো অজিতের কথার কোনো মাত্রা জ্ঞান নেই , আমি নিজে গেছিলাম তার কাছে আমার সাথেও তো খারাপ আচরণ করছে। ইশানীকে দোষ দেওয়াটা বন্ধ করো। ... হচ্ছে কথা মিনুর মা সেখানে সত্যি , তোমরা না আর বদলাবে না কোনো দিন। "
অসীম---" তা দাদা ইশানীতো বৌদি দের কেমন ভাবে কথা বলছে আর মিনুর মাকে সমর্থন করার মানে কি?
বেহায়া মতো কাজ করে বেড়াচ্ছে। আর বললেই দোষ।"
নীহার বাবু বলে উঠলো,--
"সেটা মিনুর মার ব্যাক্তিগত ব্যপার অসীম.. , তাই নিয়ে আমাদের ভাবার কি কোনো দরকার আছে?"
অসীম -- "এসব ব্যপার আর ব্যক্তিগত নেই দাদা, শুনলে তো মন্ডল দের বাড়িতে..., তাছাড়া ছেলে মেয়েরা বড়ো হচ্ছে দাদা, মোনালী, সুদীপ্ত ওরা এই সব কেচ্ছা জানলে...।"
সুরমা-- "ঠিকিই তো..
কথাকাটাকাটি করে সময় এগিয়ে গেলো।
রাতটা পেরোলো।
পরেরদিন সকালে...
মিনুর মা কাজ এ ঢুকলে প্রশ্নের মুখে পড়লো সঙ্গে একগাদা ভৎসনা।
মিনুর মা জানালো, আর স্বীকার ও করলো তার একজনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে।
তাই শুনে সবাই এর মুখে চোখে বিরক্তি।
মিনুর মা বললো,
"সমাজের কথা জানি না বৌদি, মিনু ছোটো ছিলো তখন , ওর বাপ মরলো, আমি একলা মেয়েমানুষ কি করবো জানি না। আমার ভাসুর তাড়িয়ে দিলো পথে এসে পড়লাম। তারপর কোনও রকমে লোকের বাড়ি কাজ করে পেট চলে। মিনুর অসুক করলো,
কেউ ছিলো না , তখন ওই নরেশের অটোতে সেদিন হাসপাতালে গেছি, সেখান থেকে আলাপ ।
মিনুর বে.. হলো ।
নরেশের দেখা পাত্র র সাথে মিনুর বে হলো।
মিনু শ্বশুরবাড়ি তে ভালো আছে , সুখে আছে, তা একদিন তারপর নরেশ আমায় বে করতে চাইলো ..
কিন্তু ওর বাড়িতে আমায় মানেনি । কলোনি তে থাকি বৌদি, সেখানে গিয়ে নরেশের মা আমায় কত্ত বাজে বাজে কথা শুনিয়েছে,
বিশ্বাস করো দাদা, বিশ্বাস করো বউদি আমি ওকে কতবার বলেছি এক সম্পক্ক ভাঙতে, কিন্তু ও ছাড়েনি, বললো, " দ্যাখ চাঁপা তোর আমার এ সম্পক্ক কেউ পারবেনি ভাঙতে।
আমি বেধবা বলে ওর মা রাজি নয়। মন্ডলদের বাড়িতে ওর মা গিয়ে ঝামেলা করে . । আমার কাজটা গেলো। মন্ডলরা লোকে ভালো না তোমরা তো পাড়ার খবর সবই জানো দাদা।
মিনুর মা কথা বলতে বলতে নীহার বাবু তারপর সুরমা পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, "আমার ছাড়িয়ে দিয়ো না গো বৌদি , এই কাজটা চলে গেলে আমার খুব অসুবিধা হবে। ও দাদা আমায় কাজে রাখো। কোনো গোলমাল হবে না, বিশ্বাস যাও তোমরা।"
নীহার বাবু মিনুর মা কে কাজে রাখতে বললো, বাকিরা বিরক্ত হলেও নীহার বাবুর কথা কেউ ফেলতে পারলো না।
সেদিন ইশানী বাড়িতে ছিলো না।
পরে ফিরে সবটা জানলো।
মিনুর মা কে বললো, "নরেশ যখন রাজি তোমরা বিয়েটা করে ফেলো। এতে কোনো অন্যায় নেই।
মিনুর মা বললো, "আচ্ছা দিদি এটা এতো সহজ নয় গো তোমার মতো কেউ বলেনি আমায়। তুমি পারবে আজ আবার নতুন করে সবটা শুরু করতে। তোমার বউদিরা মানবে। আমি কাজের মেয়ে, গরীব, তাই সবাই সামনে বলে আর তুমি বড় বাড়ির বলে আড়ালে বলে , তোমার বিয়েটা ভেঙে গেছে তাই নিয়ে ....., এসব ব্যাপারে সবাই সমান গো দিদি , নরেশের মা আর এই বৌদিরা , সবাই এক রকম। " দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিনুর মা।
ইশানী মিনুর মার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, মিনুর মার যে জ্ঞান তা বোধহয় শিক্ষিত সমাজের মানুষের মধ্যে অনেকেরই নেই।
কয়েকটা দিন পর_______
মিনুর মা কাজ করে বাড়ি ফিরছে রাস্তায় নরেশ এসে মিনুর মাকে গলির মাঝে নিয়ে গেলো। নরেশ মিনুর মা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর বলে উঠলো, "চল চাঁপা আজই আমরা পালিয়ে যাই, তুই জানিস মা কি করেছে! আমার বে পাকা করে বসে আছে। এই হপ্তাতে .."
মিনুর মা নরেশের থেকে নিজে ছাড়িয়ে , " তুমি বে টা করে নাও , তাতে সব চাইতে ভালো গো, এ সম্পক্ক হলে সারা কলোনি তে ছিঃ ছিঃ করবে। আমার সব কাজ গুলো একটা একটা করে চলে যাচ্ছে । তোমার মা সব জায়গায় গিয়ে... আমার চরিত্র নিয়ে,..
বলেই মিনুর মা কাঁদতে শুরু করলো।
নরেশ বলে উঠলো," সেই জন্যই তো বলেছি এখান থেকে অন্য জায়গায় চল, "
মিনুর মা, " কোথায় যাবে তুমি আমায় নিয়ে, এই শহরে আমার মিনু আছে, আমার মেয়ে , আমার জন্য যদি ওর শ্বশুর বাড়িতে ঝামেলা হয়। ওকে যদি কথা শোনায়
না না না আমি পারবো না। বলেই কাঁদতে কাদতে মিনুর মা ছুটে চলে গেলো।
নরেশ-- চাঁপা চাঁপা বলে ডাকলেও
মিনুর মা পিছন ফিরলো না।
মিনুর মার এখন শুধু ঘোষ বাড়ির কাজটা আছে , আর ওদিকে পাড়ায় একটা নতুন কাজের কথা চলছে। বাকি সব জায়গায় নরেশের মা এমন ঝগড়া করে এসেছে যে মিনুর মা কে কেউ কাজে নিচ্ছে না। সবার মুখে একটাই কথা বিধবা এক মেয়ের মা সে কি করে এই রকম কাজ করলো। মিনুর মা যে কলোনিতে থাকে সেখান এও নরেশের মা, দাদা গিয়ে ঝগড়া করে এসেছে ।
মিনুর মা রাতের অন্ধকারে একলা বসে বিছানায় কাঁদে। আর ভগবান কে ডাকে।
কোকিল ডাকা দুপুর সেদিন নরেশে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, চাঁপা মা আমার বে র দিন ঠিক করে ফেলেছে। এই মাসেই হবে, পুরুত ঠাকুর বলেছে, এই মাসের শেষ নাকি দিন আছে।"
মিনুর মা, "ভালোই তো তুমি বিয়ে করে নাও।"
নরেশ চাঁপাকে ধরে চাঁপা দ্যাখ তুই কেনো মায়ের জন্য আমার সাথে এমন করছিস বলতো, আমি তো তোকেই চাই তুইতো জানিস সে কথা! আগের দিনও চলে গেলি আজও কেমন একটা ব্যবহার তোর ..."
মিনুর মা শান্ত গলায় বলে, ---" সবার সব চাওয়া কি মেটে, তুমি বাড়ি যাও ...
তোমার সাথে আমার এ জীবনে এটা হওয়া সম্ভব নয়। পাড়ায় সবাই এ সম্পক্কটা নোংরা চোখে দেখে। কলোনি র লোকেরা কেমন একটা আচরণ করে আজকাল।
তোমার মা , দাদা আমায় দিন রাত শাসিয়ে যাচ্ছে।
নরেশ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ---- "আমি তো বলছি..! তোকে এখান থেকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাবো , আমি তোকে ছাড়া বাঁচবুনি চাঁপা , বলেই চাঁপাকে জড়িয়ে ধরে।
চাঁপা ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে আর চলে যায়। নরেশ আবার জোরে জোরে ডাকে চাঁপা বলে।
নরেশের সাথে মিনুর মায়ের এই দেখা হওয়াটা নরেশের পাড়ার একজন দেখে নেয় আর নরেশের মার কানে খবরটা যেতেই পরেরদিন সকালে নরেশের মা ঘোষ বাড়িতে সোজা ঢুকে, চিৎকার করে বলে উঠলো, "চাঁপা ..চাঁপা.. বলে মিনুর মাকে ডেকে একগাদা গালাগালি , অপমান করতে শুরু করে।
ঘোষ বাড়িতে তখন শুধু সুরমা আর দীপান্বিতা । মোনালী সুদীপ্ত ও বাড়ি ছিলো সেদিন। চিৎকার শুনে ওরা সবাই বেরিয়ে এলো।
দীপান্বিতা এসব কিছু দেখে বললো, --- মোনালী ভেতরে যাও, সুদীপ্ত বোন কে নিয়ে যা ।
ওরা যাবার পর সুরমাকে বলল,
"দিদি এদের যেতে বলো এটা কি মাছের বাজার ছিঃছিঃ কি ভাষা, ছিঃ..."
সুরমা বলে উঠলো, -- "আচ্ছা মিনুর মা এসব কি হচ্ছে ?
তারপর নরেশ এর মা কে উদ্দেশ্য করে বলে ওকে যদি কিছু বলার হয় আপনি এই বাড়িতে থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলুন ।"
ভিতরের ঘরে মোনালী এবং সুদীপ্ত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।
মোনালী -- "আচ্ছা দাদা তোর কি মনে হয় মিনুর মা এই যে কাজটা এটা ঠিক করছে। বিধবা হলে কি ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারবে না।"
সুদীপ্ত--" বিদ্যাসাগরের সমস্ত পরিশ্রম বৃথাই হলো । বুঝলি! সে যুগ আর আজও আমরা নিয়ম , সংস্কারের বেড়া জালে আবদ্ধ।"
মোনালী-- "তুই একদম জ্যাঠুর মতো কথা বলিস রে দাদা.." দ্যাখ না মা , জ্যাঠিমা এমনকি বাবাও অবধি পিসির বিয়ে ভাঙার জন্য পিসিকেই দায়ী করে আর আজ এই মিনুর মা কেই গোটা পাড়ার লোক দায়ী করছে। কি অদ্ভুত!"
সুদীপ্ত-- "হুম... আমরা নামেই শিক্ষিত, মনের মধ্যে অন্ধকার থাকলে কি শিক্ষার আলো পৌঁছায়। "
কিছুক্ষন পর ঝগড়া চিৎকার থেমে গেলো।
সেদিনের পর থেকে মিনুর মা আর কাজে এলো না।
ঘোষ বাড়ি ,
সকাল সেদিন ছুটির দিন সবাই বাড়িতে ।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে....
ইশানী -- " দাদা আমাদের উচিত নয় একবার মিনুর মা র একটা খোঁজ নেওয়া।
সুরমা -- "ওই দিনের পর থেকে ও আর আসছে না।"
ইশানী-- "তোমারা সেদিন ওকে সাপোর্ট করলে এরকম হতো না। "
দীপান্বিতা-- "এইসব উটকো অশন্তি কোনো মানে হয়। সেদিন বাড়িতে শুধু মোনালী, সুদীপ্ত ছিলো। তোমরা তো কেউ ছিলে না। কি জঘন্য ভাষায় ওই মহিলা কথা বলছিলো।"
ইশানী -- "ছোট বউদি উনি তো বলবেই তোমরা সবাই তো ওই মহিলার কথা শুনেই তো একের পর এক বাড়ি থেকে মিনুর মার কাজ গুলো গেলো। মিনুর মা যদি আজ এই সব বাড়ি থেকে সাপোর্ট পেতো তবে কি এরকম হতো। আর বউদি মোনালী , সুদীপ্ত ওরা তো আর ছোট নেই। ওদের ও জানা দরকার সমাজের ভালো মন্দ।"
নীহার বাবু--- "আমাদের সমাজের মানুষ গুলো এখনও সেই পুরোনো চিন্তা ভাবনা নিয়ে পড়ে আছে।"
অসীম -- "আচ্ছা দাদা! শোভনীয় বলে একটা ব্যাপার আছে সেটা স্বীকার করবে তো।"
সুরমা -- " ঠিকই তো, শোভন অশোভন বলে তো একটা ব্যাপার থেকেই যায়।"
নীহার বাবু-- "তোমরা কি বলতে চাইছো মিনুর মা অন্যায় করেছে? তাই পাড়ার প্রত্যকটা বাড়ি থেকে ওর কাজ চলে গেলো। "
দীপান্বিতা-- "দেখুন দাদা এটা মানবেন তো! মিনুর মার একটা বয়স হয়েছে আর কিছু দিন আগেই ওর মেয়ের বিয়ে দিলো। এই বয়সে এটা কি মানায়। নিজের মেয়ে জামাই এর সামনে দিয়ে ওর এভাবে বিয়ে করাটা আপনি কোন যুক্তিতে ভালো বলছেন দাদা?"
নীহার বাবু-- "মানুষের মন সেটা কি এভাবে বেঁধে রাখা যায় বলতো।। তাছাড়া ওর মেয়ে জামাই হয়েছে বলে ও কি কাউকে পাশে চাইতে পারে না।"
ঈশানী-- "আমি এই কথাটাই বলতে চাইছি? কিন্তু বৌদিরা , ছোড়দা কেউ তোমরা বুঝলে না
মিনুর মা কাজের লোক বলে, তার কি একটা মন থাকতে নেই।
ইশানী আবার বললো, - মুখেই বলো তোমরা সমাজটা বদলেছে। আসলে তো সেই একি।
বিদ্যাসাগর অনেক বছর আগে যে আইনটা পাশ করেছিলেন সেটা ওই কাগজেই তোমাদের মতো মানুষরা তা ঠিকমতো কার্যকর করতে কোনোদিন দেবে না, আর দিলেও একগাদা ভৎসনা। "
অসীম বলে উঠলো, -- "না কথাটা তুই ঠিকিই বলেছিস ইশানী আসলে আমদের সমাজ ব্যবস্থাটা আজোও মেয়েদের খুব একটা স্বাধীনতা দিতে পারেনি।"
সুরমা বলে উঠলো,-- "আচ্ছা অসীম তোমরা পারবে ইশানীর আরেকটা বিয়ে দিতে তোমার দাদা পারবে।"
নীহার বাবু সুরমা র দিকে তাকিয়ে বললো, -- "আমরা হয়তো পারতাম কিন্তু তোমরা ওর বৌদি হয়ে কতটুকু ওকে বুঝেছো বলতো?"
দীপান্বিতা বলে উঠলো, -- "পাড়ার লোকে ব্যপারটা কেমন ভাবে নিতো ভাবুন একবার, জানেন তো দাদা পাড়ার ক্লাবে কোনো অনুষ্ঠানে সবাই এলেই ইশানীর কথা খোঁজ করে এত অস্বস্তি হয়। বারবার সেইসব পুরোনো কথা । আমরা হয়তো মাঝেমধ্যে ইশানীকে দু এক কথা শুনিয়েছি। তা বলে ওর কোনো খারাপ হোক তা কিন্তু কোনো দিনই চায়নি।"
সুরমাও মাথা নাড়লো।
নীহার বাবু-- "জানি সেটা। আসলে সারাজীবন শুধু লোকে কি বলবে এই ভেবেই আমরা কতটা সময় নষ্ট করি। আর তোমরা এত অস্বস্তি তে না ভুগে একটা যোগ্য জবাব দিলেই তো পারো। তাই না!"
এভাবে পারিবারিক আলোচনা চলতে থাকলো।
অনেক গুলো দিন পর ----...............
সেদিন সকালে নীহার বাবু, অসীম অফিসে বেরিয়ে যাবার পর।
ঘোষ বাড়িতে হঠাৎ মিনুর মা এলো । বললো, বৌদি ...
সুরমা দীপান্বিতা বেরিয়ে এলো,
মিনুর মায়ের গলা শুনে ইশানীর নাচের স্টুডেন্ট দের বললো, তোমরা প্র্যাকটিস করো আমি আসছি,
ইশানী বেরিয়ে এলো।
মোনালী-- "এই দাদা মিনুর মায়ের গলা না?"
সুদীপ্ত-- "হ্যাঁ তাইতো , চলতো দেখি। "
ওরাও নেমে এলো।
সুরমা-- "তুমি এত দিন আসোনি যে! "
দীপান্বিতা-- "সেদিনের পর থেকে তুমি, আর এলেই না তো। কেন? "
মিনুর মা --" আমি আর এখানে থাকবুনি গো বৌদি! ওই দিকে একটা ইটভাটায় কাজ পেয়েছি ওখানেই চলে যাচ্ছি।
ইশানী বলে উঠলো, -- সেকি..! আর নরেশ?
মিনুর মা -- "নরেশের মা গত পরশু জোর করে ওর বিয়ে দেছে, আর নরেশের দাদা , মা আমায় শাসিয়ে গেছে, বলেছে যদি নরেশের সাথে কোনো যোগাযোগ থাকে, ওরা আমার মিনু র ক্ষতি করবে বলেছে গো দিদি।
নরেশের মাথার কোনো ঠিকনি গো দিদি! কোতায় কি করে বসে, তাই ওর চোখের সামুন থেকে চলে যাচ্ছি গো দিদি। তাছাড়া নরেশের মা কে কোনো বিশ্বাসনি আমার মিনুর যদি কোনো বিপদ হয়। তাই আর থাকবো না এখানে। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
মোনালী বলে উঠলো, "তুমি চলে যাচ্ছো, আর কখনো ফিরবে না। তোমার বয়ফ্রেন্ড এর জন্য মন কেমন করবে না?"
মিনু মা মৃদু হেসে বলল, "তুমি ছোটো তাই এরম বলছো? যেদিন এই ইশানীদির মতো বড় হবে বুঝতে পারবে।
সুদীপ্ত--" আমরা এতটাও আর ছোটো নই। মা , কাকিমা যতই বলুক। আচ্ছা তুমি কি ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছো? "
ইশানী বললো--" আমি ভেবেছিলাম তুমি অনন্ত সবাইকে দেখিয়ে দেবে। মিথ্যে নিয়মের থেকে বেরিয়ে নরেশের সাথে সংসার করবে। তুমি ও এই বৌদিদের কথায় , পাড়ার কথায় হার শিকার করলে।"
সুরমা বলে উঠলো, দ্যাখো প্রথমে তোমায় অনেক বাজে কথা বলেছি। কিন্তু তুমি চলে যাও সেটা চাই না।"
দীপান্বিতা--- হ্যাঁ মিনুর মা তোমাকে আমি , দিদি ভুল বুঝেছি। আমাদের কথাগুলো মনে রেখো না। যদি কোনো সময় কোনো দরকার লাগে আমাদের বাড়িতে এসো। আমারা নিশ্চিয়ই তোমায় সাহায্য করবো।
সুরমা বললো, হ্যাঁ....
ইশানী ভিতরে গেলো আর কিছু টাকা নিয়ে এসে মিনুর মায়ের হাতে দিয়ে বললো এটা রাখো আর যখন যা দরকার হবে জানিয়ো কিন্তু।
মিনুর মা চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, -- না গো বউদি একানে কে আর আচে বলো তোমাদের সাথেই তো কত কথা বলতাম , আমি কিছু মনে করিনি গো বউদি। জীবন যেরকম চালাবে তেমনি চলত হবে গো।
আমি ইটভাটা থেকে যকন যকন ফিরবো তোমাদের সাথে দ্যাকা করে যাবো।
আমি আসছি তাহলে।
ঘোষ বাড়িতে সবাই এই মিনুর মা র এভাবে চলে যাওয়াটা মানতে পারলো না।
দেখতে দেখতে পেরোলো কিছু দিন।
সুরমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে বললো, "আজ ওই বিশ্বাস বাড়ির নেমন্তন্ন টা আছে ইশানী তুমি যাবে আমাদের সাথে। প্রতি বার তুমি নেমন্তন্ন বাড়ি এলে যেতে না করো। আমাদের ও দোষ ছিলো স্বীকার করছি। তোমায় জোর করিনি। "
ইশানী বললো-- " আমি কি দরকার , পাড়ার সবাই আসবে। হাজারটা কথা।"
দীপান্বিতা বললো, " তাতে কি তুমি যাবে , আমরা তো আছি নাকি ! বউদি হিসেবে আমরা কি খুব খারাপ ইশানী। জানি তোমায় অনেক বাজে কথা বলেছি। তবু ...
ইশানী-- "আরে ছোট বউদি তুমি না, আচ্ছা ঠিক আছে যাবো।"
নীহার বাবু অফিসে বেরোবে কথাগুলো কানে এলো আর বললো, "মিনুর মা এই ঘটনাটা বুঝলি ইশানী তোর বউদির পরিবর্তন করে দিয়েছে একেবারে। অনেক দিন বাদে পরিবারে একতা ফিরে এসেছে।
দুপুর বেলা...
নিমন্ত্রণ বাড়ি যাবার আগে দীপান্বিতা, সুরমা, ইশানী তিনজনে কে কি পরবে তাই নিয়ে খুব মজা ইয়ার্কি চলল।
তারপর
বিশ্বাসদের বাড়ির অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন তে দীপান্বিতা, সুরমা আর ইশানী একসাথে গেলো।
নিমন্ত্রণ বাড়ি গোটা পাড়ার লোক এসেছে। সেখানে বেশ কিছু কৌতুহলী মহিলা যাদের কাজ অন্য দের নিয়ে চর্চা করা তাদের মধ্যে একজন ইশানী নিয়ে কথা বলতে এলে সুরমা ইশানীকে সাপোর্ট করে কথা বলে আর কিছু ক্ষনের মধ্যে মন্ডল বাড়ি এবং বিশ্বাস বাড়ির সেই কাকিমাকে আচ্ছা করে দীপান্বিতা সুরমা শুনিয়ে দেয় সেই মিনুর মায়ের বিষয় টা নিয়ে।
মিনুর মায়ের সাথে এই রকম হওয়া একদমই ঠিক হয়নি।
পাড়ার মহিলা ক্লাবের আরো কিছু সদস্য ছিলো তারাও ওই পাড়াই বউ, তাদের কেউ কেউ বলে উঠে, "সত্যি তো একজন মেয়ের স্বামী নেই বলে সে কি অন্য কাউকে তার বন্ধু ভাবতে পারে না। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবে না।
তারজন্য আপনারা তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলেন। এটা ঠিক করেননি।"
মন্ডল বাড়ির এক মহিলা বলে, " আসলে এত কিছু ভাবিনি, শুধু ঝামেলা হচ্ছে বলে ওকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সত্যি ওর পাশে থাকা সেদিন হয়তো উচিত ছিলো।
বেশ কিছু টা সময় এই নিয়ে কথা আলোচনা চলতে থাকে।
এক দু মাস পরে...
দুপুরের রোদ পড়েছে বিকেল ...
সোফায় বসল দীপান্বিতা, সুরমা
সুরমা বললো, " এই ছোটো
আমাদের জন্যই তো মিনুর মা চলে গেছে। তাছাড়া বেচারি নরেশকে বিয়ে করলে হয়তো একটা ভালো সংসার হতো। এখন তো আর কিছু করার নেই।"
দীপান্বিতা বললো, "সেদিন ওকে সাপোর্ট করা উচিত ছিলো। পাড়ার সবাই যদি এক থাকতাম তাহলে নরেশের মা কিচ্ছু করতে পারতো না।
দাদা ঠিকই বলেছিলো মানুষের মন ...
সঙ্গে সঙ্গে সুরমার বললো, -- "আচ্ছা এবার দুর্গাপুজোর সময় ওকে আমাদের এখানে ডাকলে হয় না। আমাদের সাথে এক সাথে ক্লাবে পুজোতে থাকলে ওর নিশ্চয়ই ভালো লাগবে কি বল?"
দীপান্বিতা বললো," হ্যাঁ ঠিক বলেছো। সত্যি সেদিন এর পর থেকে আমার ও নিজেকে অপরাধী লাগে। ইশানীর কাছে ওর ফোন নাম্বার আছে। আর শোনো দিদি এবার না একদিন দেবদীপকে ও বাড়িতে ডাকো বুঝলে, দাদার সাথে তুমি কথা বলো।
সুরমা -- "ঠিক বলেছিস ইশানীর জন্য এবার আমাদের ই ভাবতে হবে। সত্যি মেয়েটা এত গুনী তবু অজিত ওকে কদরই দেয়নি। মিথ্যে অজুহাতে ডির্ভোস দিলো।"
দীপান্বিতা--" আমরাই খালি বলতাম ওকে নাচ বন্ধ করতে অথচ সত্যি ই তো একটা মেয়ে কেন তার শখ আশাকে এভাবে বিয়ে হয়েছে বলে থামিয়ে রাখবে।
হঠাৎ কলিং বেল বাজলো...
সুরমা-- "মোনালীটা স্কুল থেকে ফিরলো বোধহয়। দাঁড়া দরজাটা খুলি,
দীপান্বিতা-- "তুমি বসো আমি যাচ্ছি!"
ওদিক থেকে বিকেলে লালচে সূর্যের আলো জানলা দিয়ে আর পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে
ইশানীর নাচের শব্দ...