নন্দা মুখার্জী

Drama Tragedy

3  

নন্দা মুখার্জী

Drama Tragedy

জীবন নিয়ে খেলা

জীবন নিয়ে খেলা

1 min
537



      অনিন্দ্যকে ভালোবেসে বাড়ির সকলের অমতে গিয়ে বিয়ে করেছিল পিয়াঙ্কা | ডাক নাম তার পিয়া | একমাত্র মেয়ের এই ভালোবাসাকে মন থেকে মানতে পারেননি সমরেশ চক্রবর্তী | বাংলায় এমএ করা মেয়ে তার | সে কিনা ভালোবাসলো গুনিন বংশজাত মাধ্যমিক পাশ করা পাইকারি মুদিখানার দোকানের মালিক একটি ছেলেকে | কিন্তু অনিন্দ্যর বাবা ভালো সরকারি চাকুরে | প্রচুর অর্থের মালিক ও নিজস্ব বিশাল বাড়ি | ছেলের পড়াশুনায় তেমন আগ্রহ না থাকাই তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তিনি এ ব্যবস্থা করেন | অনিন্দ্য খুবই শান্ত স্বভাবের ছেলে | পিয়াকে সে তার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে | পিয়াও ঠিক তাই | বাড়িতে নিত্য অশান্তি এই নিয়ে একদিকে পিয়া আর অন্য দিকে তার বাবা মা | একমাত্র কন্যার জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতেই হয় সমরেশবাবু ও শালিনীদেবীর | তারা বেশ ধুমধাম করেই মেয়ের বিয়ে দেন | তবে মনের কষ্টটা তাদের থেকেই যায় | 

 কিছু কর্মচারীই অনিন্দ্যর দোকান দেখাশুনা করে | একমাত্র রাত আটটার দিকে সে কিছু সময়ের জন্য দোকানে যায় | চুরি চামারি করেও যে টাকা তারা অনিন্দ্যর হাতে তুলে দেয় তাও নেহাৎ কম নয় | অনিন্দ্যর নেশা বলতে দিনে পাঁচ সাতবার লাল চা | মাথার উপরে বাবা আছেন , তিনি মোটা টাকা মাইনে পান সুতরাং অনিন্দ্য সংসার নিয়ে মোটেই ভাবেনা | সে তার পিয়াকে নিয়েই আত্মহারা | বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পিয়া সুখবর দেয় | শুধু অনিন্দ্যই নয় পিয়াকে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুজনেই খুব ভালোবাসেন | মাঝে মাঝে শ্বাশুড়ির সাথে যে ঝামেলা হয়না তা কিন্তু নয় | তবে বেশিদূর গড়ানোর আগেই দুপক্ষই সেটা মিটিয়ে নেয় | পিয়ার শ্বশুরমশাই বিয়ের পর থেকেই পিয়াকে একটা হাতখরচ দিয়ে যান | আর তার আদরের বৌমাকে বলেও রেখেছেন ," তোমার যা দরকার লাগবে আমায় বলবে আমি টাকা দেবো | আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমাদের সকলের দায়িত্ব আমার | তারপর যা রেখে যাবো গুছিয়ে খেতে পারলে কোন কষ্ট হবেনা | পিয়া তার এই অবস্থাতেও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে আসেনি কারণ অনিন্দ্যর কষ্ট হবে | যেটুকু পারে সে এখনো সংসারের কাজ করে যায় | তবে তাকে সকলেই নিষেধ করে | কিন্তু সে কাজ করতেই ভালোবাসে |

 দেখতে দেখতে অনিন্দ্য ও পিয়ার জীবনে সেই শুভক্ষণটি আসে | তারা একটি ফুটফুটে ছেলের বাবা মা হয় | বাড়িতে খুশির জোয়ার বইতে থাকে | সমরেশবাবু ও শালিনীদেবীরও মন খারাপ অনেকটাই চলে যায় নাতির মুখ দেখে |

তবুও এখনো যখন পিয়ার নামের পরে গুনিন শব্দটা দেখেন একটা কষ্ট যেন বুকের মাঝে তারা অনুভব করেন | ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান গুনীনকে বিয়ে করেছে --- কোথায় যেন একটা আঘাত বাজে তাদের | তবে পিয়া সুখী আছে এটা ভাবলেই অনেকটা হাল্কা হয়ে যান তারা | 

  দিনগুলি বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো | ছেলের বয়স এখন প্রায় পনের বছর | পড়াশুনায় সে খুবই ভালো | সবকিছু তার দাদুই দেখাশুনা করে | কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সংসারে একটা কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে | অনিন্দ্যর মাসতুত দাদা বহুবছর পরে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে অনিন্দ্যদের বাড়িতে ওঠে | খুব মিশুকে ও গল্পবাজ ছেলে পিয়াস | অনিন্দ্য চুপচাপ আর সারাজীবনই অল্প কথা বলে | পিয়াস ঠিক তার উল্টো | পিয়ার মনের কোন এক জায়গায় পিয়াস একটা হিল্লোর তোলে | ভালো লাগে তার সাথে কথা বলতে , গল্প করতে সময় কাটাতে | 

 মানুষের মন কখন পরিবর্তিত  হবে , কখন কাকে ভালো লেগে যাবে তা বোধকরি সে নিজেও বুঝতে পারেনা | অনিন্দ্যকে পিয়া খুবই ভালোবাসে কিন্তু পিয়াসকেও কেন জানিনা এড়িয়ে যেতে পারেনা | পিয়াসের দিক থেকে একটা চুম্বকীয় শক্তি যেন পিয়াকে প্রতিমুহূর্তে টানে | পিয়া চেষ্টা করেও সেই শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারেনা | অনিন্দ্য সরল প্রকৃতির মানুষ হলেও পিয়াসের প্রতি পিয়ার এই টানকে সেও যেন উপলব্ধি করতে পারে | পিয়ার কাছাকাছি থেকে সে তাকে প্রতিমুহূর্তে জরিপ করার চেষ্টা করে | কিন্তু তার প্রতি পিয়ার ভালোবাসার কোন খাদ সে দেখতে পায়না যদিও ---- পিয়াসের প্রতি পিয়ার দুর্বলতাটা সে বেশ বুঝতে পারে | পিয়াসও পিয়ার প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে | আর ঠিক তখনই পিয়াস সিদ্ধান্ত নেয় সে আর এ বাড়িতে থাকবেনা | সে যাওয়ার দিন ঠিক করে | একদিন অনিন্দ্য যখন ঘরে ছিলোনা তখন সে পিয়াসের ঘরে ঢুকে তাকে অনুরোধ করে আর কটা দিন থেকে যেতে | পিয়াস রাজি হয় | কিন্তু সেই মুহূর্তে যে ঘটনাটা ঘটে পিয়াস বা পিয়া কেউই তারজন্য প্রস্তুত ছিলোনা | পিয়া বেরিয়েই যাচ্ছিলো কিন্তু পিয়াস আচমকা পিয়ার হাতটা ধরে টান দেয় | টাল সামলাতে পারেনা পিয়া | হুট করে গিয়ে পিয়াসের বুকের উপর পরে | আর অনিন্দ্য ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে ঢোকে | সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই পিয়া নিজেকে সামলে নেয় | অনিন্দ্যকে দেখতে পেয়ে বলে ,

--- একটু হলেই পরে যাচ্ছিলাম ভাগ্যিস পিয়াসদা  ধরে ফেললো |

 অনিন্দ্য মুখে বাঁকা হাসি এনে বললো ,

--- হুম দেখলাম |

 কিন্তু তারপর থেকেই চুপচাপ অনিন্দ্য আরও যেন  চুপচাপ হয়ে গেলো | পিয়া অনেকক্ষণ ধরে পিয়াসের ঘরে বসে গল্প করলেও অনিন্দ্য তাকে ডাকেনা বা কোন কৈফিয়তও চায়না | নিজের মধ্যে নিজেই গুমরে মরে | 

 পিয়াস চলে গেছে আজ প্রায় পনেরদিন | মাঝে মাঝে ফোন করে পিয়া ছাড়াও বাড়ির সকলের সাথে কথা বলে | হঠাৎ একদিন অনিন্দ্য তাকে বলে ,

--- আমার কিছু হয়ে গেলে ওদের দেখিস |

---- কি উল্টোপাল্টা কথা বলিস বলতো | কি ভাবিস তুই সবসময় ? হ্যা পিয়া  বলছিলো সেদিন , তুই এমনিতেই কম কথা বলিস আর এখন নাকি পুরো বোবা হয়ে গেছিস |

 অনিন্দ্য একটু হেসে সেদিন ফোনটা কেটে দিয়েছিলো |

 অনিন্দ্যর চেহারা দিনকে দিন খারাপ হতে থাকে | সারাটা রাত ছটফট করতে থাকে , খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে | বাড়ির সকলেই জানতে চায় তার কি হয়েছে --- সে বলে " কিছুনা "| ডাক্তার দেখাতেও বললে বলে " রোগ নেই খামোখা ডাক্তার দেখাবো কেন ?" অনিন্দ্য কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা যে পিয়াকে সে তার প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসে সেই পিয়া কি করে অন্যের প্রতি অনুরক্ত হতে পারে ? আস্তে আস্তে সে ফ্রাস্টেশনে চলে যেতে থাকে | চুপচাপ নরম স্বভাবের অনিন্দ্য একথা কারও সাথে শেয়ারও করতে পারেনা | কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতেও পারেনা | প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা |

 নিজের মনের মধ্যে গুমরে গুমরে শেষ পর্যন্ত সে হার মেনে যায় | একরাতে সে তার পিয়াকে ভীষণভাবে আদর করে তার পাশেই স্লিপিংপিল খেয়ে সারাজীবনের মত সকলকে ছেড়ে চলে যায় | না , কোন পুলিশ কেস হয়না | কারণ সে একটি সুইসাইড নোট লিখে গেছিলো " আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় "

  সবকিছু মিটে যাওয়ার পর পিয়া একদিন আলমারির ভিতর একটি বাক্সে অনিন্দ্যর লেখা একটি চিঠি পায় |

 পিয়া ,

  খুব ভালোবাসি তোমায় | কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি পিয়াসের সাথে তোমার মেলামেশা | তুমি তো জানো আমি প্রতিবাদ করতে পারিনা | খুব কষ্ট পেতাম | তোমায় আমি কোন দোষ দিইনা হয়তো অনেককিছুই আমার মধ্যে নেই যা পিয়াসের মধ্যে আছে | দোষটা আমার কপালের | বিধাতা কেন যে আমায় প্রতিবাদহীন একটি মানুষ করে তৈরী করলেন ? এটা যদি তোমার ক্ষণিকের দুর্বলতা না হয় জীবনটাকে নিয়ে নূতনভাবে ভাবতে পারো | আমি সরে যাচ্ছি | পাপনকে মানুষের মত মানুষ কোরো |

             ইতি  

                  অনি


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama