Debdutta Banerjee

Drama

3  

Debdutta Banerjee

Drama

জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে....

জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে....

5 mins
1.9K


গঙ্গার ধারে লোকালয়ের শেষে ঝোপ জঙ্গল আর বেশ কিছু বড় বড় গাছের আড়ালে ভগ্ন প্রায় তিনমহলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায় ঈশান। লোহার মরচে ধরা গেটের একটা পাল্লা উধাও হয়েছে বহুদিন আগে। বাগানের মাঝে ডানাভাঙা পরীটা এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ্বেত পাথরের ফোয়ারার নিচে সবজে শ‍্যাঁঁওলা, কিছু ব‍্যাঙ্গাচির দল অবাক হয়ে ঈশানকে দেখে। সরু একটা পায়ে চলা পথ এগিয়ে গেছে ভগ্ন প্রায় বাড়িটার দিকে। ঈশানের পায়ের আওয়াজে শুকনো পাতায় সরসর আওয়াজ তুলে চলে যায় কোনো সরীসৃপ।


বড় কাঠের দরজার গায়ে বিশাল তালাটা জুড়ে মাকড়সার ঝুল। শব্দ করে দরজাটা খুলতেই এক ঝলক ভ‍্যাপসা গন্ধ যুক্ত বাতাস ছুটে আসে। ধুলা মলিন হল ঘরের বদ্ধ বাতাসে যেন কিসের হাহাকার। ঈশান চারপাশে তাকিয়ে দেখে। বিশাল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই সারি সারি বন্ধ ঘর। দক্ষিণের কোনের ঘরটা যেন ডাকছে ওকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ঈশান। ঘরটার তিনদিকে কাচের জানালা দিয়ে আলো ঢুকছে, ঘরের মাঝখানে একটা বোর্ড, ইজেল, প‍্যালেট, রঙ, তুলি ছড়ানো। সারা ঘরে বেশ কিছু সমাপ্ত অর্ধসমাপ্ত অসমাপ্ত ছবি রয়েছে। ধীরে ধীরে ঈশান সবটা ঘুরে ঘুরে দেখে। বোর্ডের গায়ের পাতলা আবরণটা সরিয়ে চমকে ওঠে ঈশান। সেই ছবি... যা বিগত কিছু মাস ধরে তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। অসমাপ্ত ছবিটা আঁকতে আঁকতে যেন শিল্পী উঠে গেছে। এখনি ফিরে আঁকা শেষ করবে। একটু ধুলো জমেনি এই পঁচিশ বছরে। প্রতিটা আঁচড় যেন জীবন্ত। 


কতক্ষণ ছবিটার সামনে ঈশান দাঁড়িয়েছিল নিজেও জানে না। হঠাৎ দরজার মরমর শব্দে চমকে ওঠে ও। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে একটি তরুণী। শ‍্যামলা গড়ন, রোগা, মলিন বেশ, দু চোখে হাজার প্রশ্ন। 


পঁচিশ বছর শতশত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাঁচ বছরের ছোট্ট ঈশান এ বাড়ি ছেড়েছিল মায়ের হাত ধরে। বাবাকে ওর মনে পড়ে না সেভাবে। দক্ষিণের এই ঘরে রঙ তুলি আর ক‍্যানভাসেই বন্দী ছিল বাবা। সংসারের কোন দায়িত্ব কর্তব‍্য পালন করতে চায়নি শিল্পী মানুষটা। ছবিই ছিল জীবন। 

রাগ করে মা ঈশানকে নিয়ে চলে গেছিল একদিন।কয়েক মাস পর উকিলের লোক চাবিটা দিয়ে গেছিল মা কে।

একটা কেয়ারটেকার ছিল শুধু, মা আর কখনো ফিরে আসেনি। ঈশানকে রঙ তুলি নিয়ে বসতে দেখলেই ক্ষেপে উঠত মা। অথচ ছবি আঁকতে ছোট্ট ঈশানের খুব ভালো লাগত। মায়ের জেদের কাছে হার মেনে নিজের ইচ্ছার ঘরে তালা মেরেছিল ও ছোটবেলায়। কলেজে উঠতেই মা চলে গেছিল। তারপর একাকিত্ব কাটাতে আবার রঙ তুলি হয়ে উঠেছিল ঈশানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। 

বারবার ঘুমের মধ‍্যে ও দেখেছে এই অসমাপ্ত ছবিটা। এক ভগ্ন প্রায় দালানের শেষ প্রান্তে বসে আছে এক অবয়ব, আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে এক স্বর্গের অপ্সরার ছবি, সে যেন নিতে এসেছে ঐ হতভাগ‍্যকে, কিন্তু অসমাপ্ত ছবিটা দেখে ঠিক কি নেই বুঝতে পারে না ঈশান। তিন মাস ধরে এই ছবিটা ওর সমস্ত স্বত্তাকে ধীরে ধীরে গ্ৰাস করেছে। কেন জানি ওর মনে হয়েছিল এখানে এলেই মিলবে সকল প্রশ্নর উত্তর। অবশেষে ঈশান আজ এসেছে নিজের শেকড়ের টানে। 


কেয়ারটেকারের মেয়ে সুরভী এই বাড়িটা খুলতে দেখে উঠে এসেছিল। পিছনের ভেঙ্গে পড়া আউট হাউসে থাকে বাবা আর মেয়ে। বহুদিন আর এ বাড়িতে ঢোকে না কেউ। ভয় পায় ওরা !!নেহাত যাওয়ার জায়গা নেই ওদের। কি এক মন খারাপ যেন লুকিয়ে আছে বাড়িটায়। বাতাসে কান পাতলে দ্বীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। রাতের দিকে এক ছায়া শরীর ঘুরে বেড়ায় ছাদে। গুমরে কাঁদে কেউ। গঙ্গায় যখন মাঝ রাতে জোয়ার আসে, ঢেউ ভাঙ্গে এবাড়ির লাগোয়া সিঁড়িতে কুয়াশার চাদর গায়ে বাগানের পরীটা নাকি উঠে আসে ছাদে। সুরভী উদাস হয়ে যায় ঈশানকে এসব বলতে গিয়ে। ঈশান শোনে। সার সার বন্ধ ঘরে লুকিয়ে আছে কত ছবি, কত গল্প। ঈশানের মা এবাড়ির গল্প বলত না ঈশানকে। ঘটির জল গড়িয়ে খেলেও শেষ হয় একদিন। ভগ্ন প্রায় বাড়ি মেরামতের ক্ষমতা ছিল না ওর বাবার। মা চেয়েছিল বিক্রি করে শহরে ফিরে যেতে। কিন্তু বাবা তাতেও রাজি ছিল না। আঁকা ছাড়া আর কিছুই জানত না মানুষটা। কিন্তু কোনো আঁকাই নাকি মনের মত হত না। মা চেয়েছিল কিছু আঁকা বিক্রি করতে। বাবা জমিদার বংশের সন্তান, সৃষ্টিকে বিক্রি করতে চায়নি কখনো। 


ঈশান অবাক হয়ে দেখে বাবার ছবিগুলো। অসাধারণ সব ছবি। কিন্তু ক‍্যানভাসে আটকানো ছবিটা সবচেয়ে জীবন্ত। যেন এক্ষনি ঐ দেবদূতের হাত ধরে উড়ে যাবে লোকটা। শিল্পী ঠিক কি বলতে চেয়েছে বুঝতে চায় ঈশান। এক দমকা হাওয়ায় ঝাড়বাতিটা কেঁপে ওঠে, কাঁচের গ্লাসের রিনি রিনি আওয়াজ ...। 


আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, কিন্তু চারপাশে এক বিষন্নতা। জোৎস্নার হাসিও ম্লান। হাওয়া আজ বড্ড শান্ত। ক‍্যানভাসটা নিয়ে আজ ছাদে এসেছিল ঈশান। ছাদের কোনায় ভেঙ্গে পড়া পাঁচিলের গায়ে আলোছায়ার এক নিবিড় প্রেমের গল্প লেখা হয় যেন। ঈশান স্তব্ধ বাতাসের কাছে খুঁজে ফেরে তার অজানা প্রশ্নর উত্তর। 

কিন্তু থমকে যাওয়া বাতাস নিজেই জানে না সে উত্তর।

 সুরভী আসে রাতের খাবার নিয়ে, অসমাপ্ত ছবির দিকে তাকিয়ে বলে -''কবে শেষ হবে ?''

উত্তর নেই ঈশানের কাছে।শুধু মনে হয় এ দৃশ‍্য সে দেখেছে, বহুবছর আগে। এই একই দৃশ‍্যপট রচিত হয়েছিল এখানেই। এক শিল্পী বুঁদ হয়েছিল নিজের সৃষ্টিতে, প্রেরণা ছিল আর ভালোবাসা। সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছিল শিল্পী, সমাজ সংসার সব ভুলে। ভুলে গেছিল ভালোবাসার মানুষটাকে। আস্তে আস্তে দূরে সরে গেছিল ভালোবাসা, আর তখনি শিল্পী বুঝেছিল একা সে অসম্পূর্ণ। ছবিটা প্রাণ ঢেলে এঁকেও কি যেন একটা খুঁত থেকে গেছিল। ছবিটার মধ‍্যেই বাঁধা পড়েছিল সে। কিছুতেই শেষ হয় না এ ছবি। শিল্পী বোঝে একা সে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় অপারগ। 


গঙ্গার উপর দিয়ে ভেসে আসা ভেজা বাতাস কাঁপন ধরায় ঈশানের বুকে। ছবিটা যেন কথা বলছে। মৃদু সে আওয়াজ শুনতে পায় ঈশান। আচ্ছন্নের মত প‍্যালেটটা টেনে নেয় এক তরুন শিল্পী। আর সময় নেই, ছবিটা শেষ করতেই হবে। মুক্তি দিতে হবে তাকে। ছবিটা অসমাপ্ত থাকলে সে মুক্তি পাবে না। বাগানের মাঝে ডানা ভাঙা পরীটা আস্তে আস্তে কি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে? ডানাটা কি নড়ছে!!

না, ওতো সুরভী, ফিরে যাচ্ছে নিজের ঘরে। বাতাসে উড়ছে ওর সাদা ওড়না। ধীরে ধীরে কুয়াশা তার সাদা চাদর বিছিয়ে দেয় চরাচর জুড়ে। ঈশানের হাতে একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পায় ছবিটা। দেবদূতের ডানায় রঙ লেগেছে, হাত বাড়িয়ে সে আহ্বান করছে লোকটাকে, এ আহ্বান উপেক্ষা করে কার সাধ‍্য। 

ঈশান এক মনে এঁঁকে চলে।

শিশির ভেজা ভোরের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে চা নিয়ে ছাদে আসে সুরভী। পাগল ছেলেটা বোধহয় সারা রাত ছাদেই ছিল। ঘরে যায়নি। ক‍্যানভাসের ছবিটা দেখে স্তব্ধ সুরভী। 

লোকটায় ছায়া শরীরে ভেসে চলেছে দেবদূতের পানে, যেন এখনি স্বর্গরথে করে তারা পারি দেবে এক অচেনা দেশে। 

আর ক‍্যানভাসের নিচে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে এক তরুন শিল্পী। তার ঠোঁঁটের কোনে লেগে রয়েছে এক তৃপ্তির হাসি।

ছবিটা সে শেষ করেছে অবশেষে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama