জীবন মরণ
জীবন মরণ


মহিম তহমিনার ভালো বন্ধু সারা গ্রাম জানে, মহিমের মত ভালো ছেলে হয় না বলে তহমিনার বাবা-মাও তহমিনা কে মহিমের দায়িত্বে সব কাজ করিয়ে নেয়। কখনো কখনো তহমিনা মহিমের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলে, একসাথে ঘুরতে যায় শুধু তাই নয় যেখানেই মহিম সেখানেই তহমিনা। স্কুল-কলেজে শুধুই মহিম তহমিনার বন্ধুত্ব উজ্জ্বল উদাহরণ, এখনো ওরা তেমনই আছে দশটা বছর পার হয়ে গেছে একসাথে।
তহমিনা ছিলো মুসলিম মেয়ে তাই মহিমের মা-বাবা তহমিনা কে পছন্দ করতো না, কিন্তু সে কথা জানতে পেরেও মহিম এতোটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তহমিনার সেটা বলে বোঝাবার নয়, এক কথায় বলতে গেলে দুজন দুজনের প্রাণ এবং দুজনেই দুজনের শরীর; একে অপরের জন্য তৈরি যা কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না।
কিন্তু হঠাৎ একদিন তাদের মাঝে এই ধর্ম ও রীতিনীতি এক বিশাল পর্বত হয়ে দাঁড়াল। মহিম অজস্রবার সেই পাহাড় ভেঙ্গে ধুলোয় মিশিয়ে তহমিনাকে বুকে টেনে নিতে চেয়েছে, অসংখ্য রাত জেগে তহমিনার জন্য কেঁদেছে, ওর ভয় হয় যদি তহমিনা অন্য কারোর বন্ধু হয়ে যায়, যদি তহমিনা আর মহিমের সাথী না থাকে!
মহিম ব্রাহ্মণের ছেলে; ওদের গ্রামে একবার একটি মেয়ে দাসের ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে - গ্রামের লোক ও পরিবারের লোক সকলেই মান সম্মান হানি হওয়ার কথা ভেবে প্রথমে সকলের অজান্তে সম্পর্কটা মেনে নিলেও সপ্তাহখানেক পরেই দু'জনকেই ভীষণ নিশংসভাবে মেরে জঙ্গলের একটি গাছে তাদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। সেই সময় সে ঘটনা প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি করেছিল যার প্রভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণের উপর ভীষণ আঘাত এসেছিল কিন্তু সুইসাইড কেশ বলে সেদিন সেই ইতিহাস ধর্মের বেড়াজালের নিচে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছিলো । কিন্তু একটা মিথ্যা ঘটনা ও একটা ইতিহাসের মধ্যে ব্যবধান অনেক তাই বছর তিন পরেই কোন এক অজা
না কারণেই ওই ঘটনার আসল রূপ ও প্রমাণসহ সাক্ষী বের হয়ে যায় । তারপর যা হবার আর কি কয়েকদিন বিশাল প্রতিবাদ, সভা - সমিতি তারপর আর কিছুই হলো না । মেয়ের বাড়ির লোক মেয়ে হারালো; ছেলের বাড়ির লোক ছেলে ।
যাইহোক এইরকম একটা পরিবেশেও মহিম কিন্তু বেশ বীরের মতই তহমিনার সাথে সম্পর্কে মেতেছিল, যদিও জানত সব ঘটনাই।
দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর হঠাৎ মহিমের সাথে তহমিনার দেখা, দুজনে অনেকক্ষণ গ্রামের শেষ রাস্তায় বসে গল্প, আড্ডা । বহুদিন পর দুজনে কাছে এসেছে, দূরত্ব তাদের ভালোবাসাকে মারতে পারেনি; সেই ধর্মের মহাপর্বতও না। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো কিন্তু গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোন লোকই তাদের দিকে তাকায় না, কোন কথা বলে না, গা ঘেঁষে চলে যায়। অথচ কিছুদিন আগেও দুজনকে দেখে অনেকে বন্ধুত্বের প্রশংসা করত, দাঁড়িয়ে কথা বলতো, তবে এখন সকলের মধ্যে কি হলো ? তহমিনা ও মহিম সেই দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে বসে আছে এত হাসা হাসির শব্দ কেউ যেন ভ্রুক্ষেপই করছে না।
প্রথম দিকটা মহিম ও তহমিনা কিছুই বুঝতে পারলো না, কিন্তু তবুও তারা দুজন যেন এক প্রকার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত অনুভব করতে লাগলো। গ্রাম থেকে সন্ধ্যা আরতি ও শঙ্খধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে - ব্রাহ্মণ হয়েও যেন সেই শব্দ সহ্য করতে পারছে না মহিম। ওর কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম, তহমিনাও যেন অদৃশ্য হতে শুরু করছে মহিমের কাছ থেকে।
এবার দুজনেরই চমক লাগলো! মনে পড়ে গেল মহিম ও তহমিনার সাথে ঘটে যাওয়া সেই দাসের ছেলে ও ব্রাহ্মণ মেয়েটির ঘটনার কথা । প্রচন্ড ঘৃণা ও কষ্ট নিয়ে তবুও মহিম তহমিনার হাতটা চেপে ধরলো, তহমিনা নেতিয়ে পড়া পালকের মতো মহিমের হাতের পাতায় লুটিয়ে পরলো, তারপরই অন্ধকারে ঢেকে গেল দুজনে।