জীবন জিগীষা ( পর্ব ৩ )
জীবন জিগীষা ( পর্ব ৩ )
আলাপের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আরও একটা ঘন্টা পেরিয়ে গেল , ঘড়ির পাখি জানান দিলো রাত নয়টা বাজলো । এবার চিন্তায় অস্থির হয়ে আলাপের মোবাইলে ফোন করতে শুরু করে, কিন্তু অনেকবার করে ফোন বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে অথচ আলাপ ফোন ধরছে না । এভাবে প্রায় বারো বার ফোন করার পর আলাপ ফোন না ধরায় ইন্দু মাকে ডেকে বলে , " মা , কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না , এতোবার আলাপকে ফোন করলাম কিন্তু ও কিছুতেই ফোন ধরছে না । " এই কথা বলতে বলতেই ইন্দুর ফোন বেজে উঠলো । ইন্দু ফোনটা ধরেই বলতে শুরু করলো , " কি ব্যাপার তোমার ? সেই কখন থেকে ফোন করছি, তুমি ফোন ধরছিলে না কেনো ? চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল " এই সময় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক অচেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসে , " আচ্ছা, আপনি ওনার কে হন ? আসলে ওনার ফোনে আপনার নামটা " Heartbeat " বলে লেখা , এছাড়া এতোবার এই নাম্বার থেকে ফোন আসায় আমি ফোন করলাম । " ইন্দু বলে , " আমি ওনার স্ত্রী , কিন্তু আপনি কে ? আর আলাপের ফোন আপনার কাছে কেনো ? " অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে ," আমি পার্কস্ট্রিট থানা থেকে বলছি , আপনার স্বামীর সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে । আপনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এক্ষুনি একবার পিয়ারলেস হাসপাতালে চলে আসুন । " এই বলে উনি ফোন কেটে দিতেই চীৎকার করে কেঁদে ওঠে ইন্দু । ইন্দুর চীৎকার করে কান্নার আওয়াজ শুনে ইন্দুর বাবা - মা দুজনেই ছুটে আসেন । ওনারা ইন্দুর ঘরে ঢুকে দ্যাখেন ইন্দু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অঝোরে কাঁদছে । ইন্দুর মা বলে , " কি হোলো ইন্দু , এমন ভাবে কাঁদছিস কেনো ? " মায়ের কোনো কথা যেনো কানেই ঢুকলো না ইন্দুর , শুধু ক্রমাগত কঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো , " মা, মা অ্যাক্সিডেন্ট , মা অ্যাক্সিডেন্ট । " ইন্দুর মা বুঝতে পারে বিশাল কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আলাপের সাথে, নয়তো ইন্দু এভাবে কাঁদতো না । ইন্দুর মা - বাবা অনেক কষ্টে নিজেদের সামলে নিলেন মেয়ের জন্য । ইন্দু বললো , " পুলিশ ফোন করেছিল , এক্ষুনি পিয়ারলেস হাসপাতালে যেতে বলেছে । " ইন্দুর কথা শুনে সাথে সাথেই একটা ট্যাক্সি ডেকে ইন্দুর মা - বাবা ইন্দুকে নিয়ে রওনা হন পিয়ারলেস এর দিকে । হাসপাতালে পৌঁছাতেই পুলিশ এসে জানায় সম্পূর্ণ দুর্ঘটনার বিবরণ । ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওনার । এই কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইন্দুর বাবা - মা , কিন্তু ইন্দু কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকে পাথরের মূর্তির মতো তারপর বলে , " না না, উনি মিথ্যে কথা বলছেন , ওটা আমার আলাপ হতেই পারে না । অন্য কোনো লোক হয়তো মারা গেছে, আমার আলাপ আমাকে ছেড়ে যেতেই পারে না । কোথায় সেই মৃত ব্যক্তি , আমি দেখতে চাই । আমি জানি ওটা আলাপ নয় , অন্য কেউ । " ইন্দুর কথামতো পুলিশ ইন্দুকে আলাপের মৃতদেহের কাছে নিয়ে যায় । একটা স্ট্রেচারের উপর সাদা চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা একটা মৃতদেহ । ইন্দু মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়াতে পুলিশ দেহটির মুখের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিতেই ইন্দু চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায় । আধ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরতেই ইন্দু মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে । আলাপের মুখটা দেখে একদমই চেনার উপায় ছিল না , মুখটা থেতলে গেছে একেবারে । জামাকাপড় , হাতের ঘড়ি , অফিসের ব্যাগ , অফিসের পরিচয় পত্র ইত্যাদি দ্বারা শনাক্তকরণ করা হয় আলাপের মৃতদেহের । কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল ইন্দু , তাই হাসপাতালে ইন্দুকে ভর্তি করা হয় । এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে সুস্থ হতে । "
সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েই গার্গীর কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইন্দু । কাঁদতে কাঁদতে বলে , " আলাপ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে প্রায় সাত মাস হয়ে গেছে কিন্তু আজও আমি যেন আমার আশেপাশে , আমার শরীরের আনাচেকানাচে ওর অস্তিত্ব অনুভব করি ।একটা খুব নতুন গান শুনছিলাম সেদিন , আমার খুব মনে ধরেছে গানটির কথাগুলো । আমার সাথে যেনো অনেক মিল গানের প্রত্যেকটি শব্দের সাথে । তার মধ্যে কয়েকটি লাইন এতো বার শুনেছি যে মুখস্থ হয়ে গেছে ।
" আগুন আগুন লাগে মনে
হাহাকারের শব্দ শুনে,
পাথর পাথর বুকের পাঁজর
আঁচড় কাটে সে কোন জনে।
শূণ্য সে তো, শূণ্য সে তো
হিসেব নেই যার নির্বাসনে। "
এখন এই স্কুল , স্কুলের ছাত্রীরা , সব
শিক্ষিকারা আর বিশেষ করে তুই তোদের নিয়ে মোটামুটি একরকম ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলো । নয়তো এতোদিনে হয়তো মরেই যেতাম , তবে আমার মা সবসময় ছায়ার মতো আমার পাশে থাকে । আমার জন্য বাবা - মা খুব কষ্ট পেয়েছে দিনের পর দিন তাই ওনাদের মুখের দিকে চেয়ে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি । এখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে । গার্গী বলে , " আর তোর শ্বশুর - শ্বাশুড়ীর কি খবর ? " ইন্দু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে , " আমি ওনাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখি নি আর ভবিষ্যতে রাখবো না । ওনারা কোনোদিনও আমাকে বাড়ির বৌ হিসেবে মেনেই নেন নি , উপরন্তু ওনাদের অভিশাপে আজ আমার কাছ থেকে আলাপ চিরদিনের মতো দূরে চলে গেছে । তবে পিসি শ্বাশুড়ী ও পিসতুতো ননদের সাথে কথা হয় মাঝেমধ্যে । " এখন শুধু বাবা - মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে । নয়তো একেবারেই ভালো লাগে না , খুব একা লাগে নিজেকে । জানি না বাবা - মায়ের অবর্তমানে আমি কি ভাবে বাঁচবো , একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো বড়ো দুস্কর । গার্গী বলে, " আর কেউ না থাকলেও সারাজীবন আমি তোর পাশে থাকবো । " এই বলে উঠে ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে । তারপর সেই দিনের মতো আড্ডা শেষ করে ইন্দু আর গার্গী যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় ।
এভাবে কেটে যায় আরও একটি বছর । এরই মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যায় গার্গীর জীবনেও । গার্গী সাথে প্রায় বছর তিনেকের সম্পর্ক ছিল পলাশ নামক একটি ছেলের সাথে । ছেলেটি আদতে খুব একটা ভালো ছিল না কিন্তু তা জেনেও গার্গী পিছিয়ে আসতে পারে নি । আসলে গার্গী ভীষণ ভালোবাসতো
পলাশকে ।ওদের তিন বছরের সম্পর্ক ছিল মন থেকে শরীর পর্যন্ত বিস্তারিত । গার্গীর বাড়ি থেকে ছেলেটিকে মেনে না নেওয়ায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সে ।আসলে ছেলেটি ছিল খ্রীষ্টান তাই গার্গীর বাবা - মা মেনে নিতে পারেন নি । একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গার্গী থাকতো আর মাঝেমধ্যে বয়ফ্রেন্ড রায়ানও এসে থাকতো গার্গীর সাথে । সম্পর্ক ভালোই ছিল দুজনের কিন্তু বিবাদ শুরু হোলো গার্গীর হঠাৎ প্রেগন্যান্সি ধরা পড়ায় । একদিন স্কুলে হঠাৎ করে শরীর খারাপ হওয়ায় ইন্দু গার্গীকে নিকটবর্তী একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যায় । সেখানেই বিভিন্ন পরীক্ষায় ধরা পড়ে গার্গী গর্ভবতী তখন প্রায় গর্ভাবস্থার এগারো সপ্তাহ চলছে । গার্গী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে , তারপরেই রায়ানকে ফোন করে বলে " Ryan I have a good news for you. I'm pregnant . Darling let's get married now . " একথা শুনে রায়ান বলে , " I'm in a meeting now so don't disturb me. " রায়ানের এইরকম প্রতিক্রিয়া শুনে খুব কষ্ট পায় গার্গী তবুও নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়, " রায়ান মিটিংয়ে ব্যস্ত আছে, অফিস থেকে বেরিয়ে হয়তো আনন্দে ছুটে আসবে আমার কাছে । " নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে ইন্দু গার্গীকে একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দেয় তারপর নিজে বাড়িতে ফিরে যায় । এরপর পরপর দিন চারেক গার্গী স্কুলে না আসায় ইন্দু গার্গীকে ফোন করে কিন্তু গার্গী একবারও ফোন না ধরায় স্কুল ছুটির পর ইন্দু ছুটে যায় গার্গীর ফ্ল্যাটে । অনেকবার কলিংবেল বাজানোর পর গার্গী এসে দরজা খুলতেই গার্গীকে দেখে শিউরে ওঠে ইন্দু । গার্গীর সারা শরীরে অসংখ্য কালশিটে দাগ , ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে আছে , কপালে একটা ব্যান্ডেট লাগানো । ইন্দু ঘরে ঢুকতেই গার্গী ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে , তারপর সব ঘটনা খুলে বলে ইন্দুকে । গার্গী বলে , " জানিস ইন্দ্রানী সেদিন নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে ফিরে রায়ানের পছন্দের সব রান্না করেছিলাম । রায়ান Thai Sizzlar খেতে খুব ভালোবাসে তাই ঐ রেসিপির সব উপকরণ আমার কাছে আগে থেকেই ছিল, তো সেদিন শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও আমি রায়ানের জন্য Thai Sizzlar বানাই । রায়ানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ি,ঠিক রাত এগারোটা নাগাদ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে উঠে দেখি রায়ান টলতে টলতে ঘরে ঢুকছে । রায়ান এমনিতে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া ড্রিংক করে না তাই আমি ভেবেছিলাম হয়তো বাবা হবার আনন্দে একটু বেশিই ড্রিংক করে ফেলেছে । ঘরে ঢুকতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল তাই আমি দৌড়ে তাড়াতাড়ি করে ওকে ধরতে যাই কিন্তু ও আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় । তারপর কোনোরকমে সোফায় বসে । আমি তখন বললাম Thai Sizzlar বানিয়েছি খেয়ে নাও কিন্তু ও মুখে কোনো কথা না বলে সব খাবারগুলো আমার গায়ে ঢেলে দেয় । আমি অবাক হয়ে বলি কি করছো রায়ান ? এতো ড্রিংক করেছো যে কি করছো কোনো হুঁশ নেই ? এই কথা শুনেই প্রথমে সজোরে একটা চড় মারে তারপর বলে , " U bloody whore . Who is the father of this child ? It's your fault, it's not my baby . " একথাগুলো শুনে আমার মাথায় যেন পুরো আকাশটা ভেঙে পড়ে , তবুও আমি নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললাম, " কেনো তুমি এতো বাজে কথা বলছো ? আমি তোমাকে ভালোবাসি , এই বাচ্চা আমাদের ভালোবাসার ফল রায়ান । ঠিক আছে এখন মাথা ঠান্ডা করে বসো । জানিস ইন্দ্রানী, সত্যিই রায়ান চুপ করে শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো , আমি ভাবলাম এবার সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি ওর মনে কি চলছিল । হঠাৎ করেই আমাকে বললো , " I'm very sorry darling . Please forgive me . please, please dear, please forgive me " এই বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে ভাবলাম যাক সব ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু না । রায়ান হঠাৎ কানে কানে বললো , Darling let's have an abortion . এই শুনে আমি ওকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই । আমি বললাম r u mad ? R u kidding me ? This is not a joke so let's get married . আমার এই কথা শোনার সাথে সাথে আমাকে বেধড়ক মারতে শুরু করলো । সেদিন খুব মারধর করার পর রায়ান আমার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায় , তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করে নি । সব শুনে ইন্দু বললো, " আর কোনো দরকার নেই যোগাযোগ রাখার । তুই আমাকে শুধু একটা কথা বল, তুই কি এই বেবীকে রাখতে চাস ? মানে তুই কি বাচ্চার বাবার পরিচয় ও সাহায্য ছাড়া একে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবি ? সমাজের নানা লোক নানা কথা বলবে তাই ভালো করে ভেবে দ্যাখ কি করবি ? " কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে থাকে তারপর হঠাৎ গার্গী বলে, " আমি ভালো করে ভেবে দেখলাম ইন্দ্রানী, আমি কিছুতেই আমার গর্ভজাত সন্তানকে হত্যা করতে পারবো না । লোকে যে যাই বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না । এই বেবীর তো কোনো দোষ নেই তাহলে শুধু শুধু আমি তার সাথে কোনো অন্যায় করতে পারবো না । আমার যতো কষ্টই হোক আমি ওকে পৃথিবীর আলো দেখাবোই । " গার্গীর কথা শুনে ইন্দু গার্গীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে , " তোর ভয় নেই গার্গী, আমি সবসময় তোর পাশে
থাকবো । তোর ছোট্ট রাজকুমার বা রাজকুমারী যেই আসুক তোর কোল জুড়ে আমরা দুজন মিলে তাকে বড়ো করে
তুলবো । তোর সন্তান তো আমারও সন্তান, কি তাইতো ? " গার্গী ইন্দুর কথা শুনে কাঁদতে শুরু করে তারপর কোনোরকমে চোখের জল মুছে বলে, " হ্যাঁ, এখন থেকে আমরা দুজনেই এই বেবীর মা । আমি জন্মদাত্রী মা দেবকী, আর তুই পালিকা মা যশোদা । আজকে আমি একদম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো । " প্রায় চার ঘন্টা গার্গীর সাথে কাটিয়ে ইন্দু বাড়িতে ফিরে যায় । বাড়িতে ফিরে ইন্দু কোনোরকমে খেয়েই শুয়ে পড়ে । সারাদিন খুব ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে সে । পরেরদিন স্কুলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে সেই সময় গার্গীর ফোন আসে । শাড়ি পড়তে পড়তে ইন্দু কোনোরকমে ফোনটা ধরতেই অবাক হয়ে যায় গার্গীর কান্না শুনে । ইন্দু বলে, " কি হোলো গার্গী এতো কাঁদছিস কেনো ? " গার্গী কোনো উওর না দিয়ে শুধুই কাঁদতে লাগলো তাই কোনো উপায় না দেখে ইন্দু গার্গীকে বলে , " আচ্ছা আর কাঁদিস না, আমি এক্ষুনি আসছি তোর কাছে । আজকে আমি সারাদিন তোর কাছে থাকবো স্কুলে যাবো না । ঠিক আছে আমি আসছি । " এই বলে ইন্দু ফোন রেখে দিয়ে মাকে ডেকে বলে , " মা আমি আজকে স্কুলে যাচ্ছি না একটু গার্গীর ফ্ল্যাটে যাবো । আজকে সারাদিন ওখানেই থাকবো আসলে ও খুব সমস্যার মধ্যে আছে । রাতে বাড়িতে ফিরে সব খুলে বলবো তোমাকে । এখন আসি " এই বলে ইন্দু তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় । কোনোরকমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যায় গার্গীর ফ্ল্যাটে । গার্গীর ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল টিপতেই গার্গী দরজা খুলে ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে । ইন্দু বললো, " তুই কি দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলি নাকি ? কলিংবেল দিতেই দরজা খুলে দিলি । যাইহোক এবার কান্না থামিয়ে একটু চুপ করে বসতো এখানে " এই বলে গার্গীকে সোফায় বসায় তারপর এক গ্লাস জল দিয়ে বলে ," এই নে আগে একটু জল খেয়ে নে , তারপর আমাকে বল এতো কাঁদছিস কেনো ? " ইন্দুর হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে একটু জল খায় গার্গী তারপর গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে চোখের জল মুছে চুপ করে বসে থাকে । মিনিট খানেক চুপ করে বসার পর গার্গী ইন্দুকে বলে, " আসলে কয়েকদিন রায়ান আমার সাথে কোনো যোগাযোগ না করায় আমি রায়ানকে ফোন করেছিলাম কিন্তু সমানে বলছে এই নাম্বারের কোনো অস্তিত্ব নেই । তাই বাধ্য হয়ে আমি আজকে খুব সকালে ওর এক খুব কাছের অফিস কলিগকে ফোন করে রায়ানের কথা বলতেই সে বলে, রায়ান চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । রায়ান গত পরশু অন্য কোনো এক কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে । কোথায় গেছে সেটা সে কিছুই জানে না । আর একটা অদ্ভুত কথা বললো, রায়ান বিবাহিত এবং একটা দেড় বছরের মেয়েও আছে । আমি এতোদিন কিছু টেরই পাই নি ইন্দ্রানী , এতোদিন ধরে রায়ান ভালোবাসার নাম করে শুধু আমার শরীরটাকে ভোগ করে গেছে । বিশ্বাস কর ইন্দ্রানী, আমি যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম রায়ানের আসল চরিত্রের তাহলে এতো বড়ো ভুল কিছুতেই করতাম না । এখন আমি কি করবো কিছু ভেবেই পাচ্ছি না । ঐ জানোয়ারটার জন্য আমি আমার বাবা - মাকে দুঃখ দিয়েছি, আজ তিন বছর ধরে আমার পরিবারের কেউ আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে নি । আমি সত্যিই খুব বোকা । এখন আমি কি করবো ইন্দ্রাণী ? কোথায় যাবো ? একা একা কি করে থাকবো কিছুই বুঝতে পারছি না । " সব শুনে, " What a rascal ! Are you shedding tears for a characterless beast ? Why ? " এই বলে চীৎকার করে ওঠে ইন্দু । ইন্দু রাগে চীৎকার করে উঠলে গার্গী একটু থমকে গিয়ে বলে, " না ইন্দ্রাণী আমি আমার জীবনে ওকে আর ঢুকতে দেবো না । তবে আমি একা কি করে কি করবো জানি না । " ইন্দু গার্গীর মাথায় হাত রেখে বলে, " আমি আছি তোর পাশে , সারাজীবন থাকবো । তুই অন্য কিছু চিন্তা না করে শুধু নিজের খেয়াল রাখবি আজকে থেকে । " এই বলতেই গার্গী ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে । সেদিন ইন্দু অনেক রান্না করে তারপর খেয়ে উঠে সারা দুপুর গল্প করে গার্গীর সাথে । আস্তে আস্তে গার্গী অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে যায় । রাতে ইন্দু বাড়িতে ফিরে যাবার কথা বলতেই গার্গী মুখটা গোমড়া করে বলে , " আমাকে একা ফেলে চলে যাবি ? আমার একা একা ভালো লাগছে না , please আমাকে একা ফেলে যাস না ইন্দ্রাণী । " ইন্দু বলে , " আসলে বাবা - মায়ের বয়স হয়েছে তার উপর আমার সাথে এতো অঘটন ঘটায় ওনারা সবসময় খুব চিন্তায় থাকেন । একটা কাজ কর , তুই আজকে আমার সাথে আমার বাড়িতে চল । কালকে দুজনে একসাথে স্কুলে চলে যাবো । " ইন্দুর কথা শুনে গার্গী বললো , " কিন্তু আমি ......... " । সাথে সাথে ইন্দু বলে ওঠে , " কোনো কিন্তু না , তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে । আর কালকে স্কুলে কি পড়ে যাবি সাথে গুছিয়ে নে , আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি । নে তাড়াতাড়ি কর, দেরী করিস না । " এই বলে ইন্দু ওয়াশরুমে চলে যেতেই গার্গী তাড়াতাড়ি করে তৈরী হয়ে ইন্দুকে চীৎকার করে বলে , " Madam I'm ready . Let's go . " ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ইন্দু বলে, " হ্যাঁ চল " । ভালো করে দরজা আর গেটে তালা দিয়ে একটা ক্যাব বুক করে দুজনে রওনা দেয় । বাড়িতে ফেরার পথে ইন্দু মাকে ফোন করে বলে , " মা আমি বাড়িতে ফিরছি , আমার সাথে গার্গী আছে । তুমি রাতে কিছু রান্না করতে যেও না , আমি খাবার কিনে আনছি । ঠিক আছে ফোন
রাখলাম । " এই বলে ফোন কেটে দেয় ইন্দু । কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার কিনে বাড়িতে ফিরে আসে ইন্দু ও গার্গী । গার্গীকে নিয়ে ইন্দু নিজের ঘরে চলে যায় এবং বলে , " গার্গী তুই নাইটি পড়ে নে , আমি দেখি মা কি করছে । মাকে একটু সাহায্য করি । এখনি ডিনারের ডাক পড়বে , তুই জামাকাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে নে । " এই বলে ইন্দু রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে যায় । ইন্দু মায়ের কাছে যেতেই তিনি বললেন , " হ্যাঁ রে ইন্দু , গার্গীকে এতো বিধ্বস্ত লাগছে কেনো ? আর তুই সকালে স্কুলে না গিয়ে পড়ি কি মরি করে ছুট দিলি গার্গীর ফ্ল্যাটে , ঠিক কি হয়েছিল বলতো ? " ইন্দু তখন মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে জানায় । সব শুনে ইন্দুর মা বলে, " তুই একবার গার্গীকে বল আমি ওর সাথে একটু কথা বলতে চাই । " ইন্দু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, " ও মা, তুমি কি বলবে গার্গীকে ? না থাক তুমি কিছু বলতে যেও না । " তখন ইন্দুর মা বলে, " তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেনো ? আমি কোনো খারাপ কথা কেনো বলবো । আমি একজন মা , তাই মা হিসেবে যেটুকু বলা উচিত তাই বলবো । তুই যা ওকে গিয়ে বল । " মায়ের কথা শুনে ইন্দু গার্গীর কাছে গিয়ে বলে, " গার্গী রাগ করিস না বোন, মা তোর কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় আমি সব ঘটনা খুলে বলেছি । মা বললো তোর সাথে একটু কথা বলবে । তুই আমার মায়ের সাথে নিজের মা মনে করে সব কষ্টের কথা খুলে বল । আমার মন বলছে সব ঠিক হয়ে যাবে । " ইন্দুর কথা শুনে গার্গী বলে, " তুই কাকিমাকে তোর ঘরে ডাক , ঐ ঘরে কাকু আছে । ওখানে কাকুর সামনে আমি কথা বলতে পারবো না । " একথা শুনে ইন্দু গার্গীকে জড়িয়ে ধরে তারপর ছুটে যায় মায়ের কাছে ।
রাতে খাওয়ার পর ইন্দুর মা ইন্দুর ঘরে যায় গার্গীর সাথে কথা বলতে । ইন্দুর মা গিয়ে বলে, " কি রে কি করছিস তোরা দুটিতে ? " ইন্দু বলে, " কিছু না মা, এই তোমার জন্য বসে আছি আমরা । আসো, বসো । " ইন্দুর মা গার্গীর পাশে বসে গার্গীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে , " মারে ! যা ঘটার তা ঘটে গেছে এখন সেই ভেবে কষ্ট পেয়ে তো কোনো লাভ নেই , বরং তাতে তোর ক্ষতিই হবে । এখনতো আর তুই একা না, তোর গর্ভে যে তোরই অংশ তিলে তিলে বাড়ছে । তোকে এখন শুধু তার কথাই ভাবতে হবে, বাকী সবকিছু ভুলে যা । আমার ইন্দু তো কোনোদিন গর্ভধারণ করতে পারবে না তাই তোরা দুটিতে মিলে এই চারাগাছকে আদরে - যত্নে আগলে রেখে একটা বিশাল বৃক্ষে পরিণত কর । জানিস তো মায়ের টানের কাছে ভগবানও হার মানতে বাধ্য হয় । তুই আর ইন্দু কালকে গিয়ে তোর যা আছে সব নিয়ে এখানে চলে আসবি । " গার্গী কথাগুলো শুনছিল আর কাঁদছিল ইন্দুর মায়ের কাঁধে মাথা রেখে । তারপর মাথাটা তুলে ইন্দুর মাকে বললো, " কাকিমা সব জিনিস নিয়ে আসবো মানে ? " ইন্দুর মা বলে, " আরে বোকা মেয়ে , এবার থেকে এটাই তোর বাড়ি, তোর চিরস্থায়ী ঠিকানা । দ্যাখ সত্যি কথা বলতে, আমি আর তোর কাকু কতোদিন বাঁচবো জানি না । আমাদের অবর্তমানে ইন্দু পুরোপুরি একা হয়ে যাবে তাই তুই আর ইন্দু এবার থেকে এখানে একসাথে থাকবি । তোরা দুটি মেয়েতে মিলে আমার ঘরটা ভরিয়ে তোল দেখি , তা দেখে আমরাও একটু শান্তিতে মরতে পারবো । " একথা শুনে ইন্দু আর গার্গী দুজনে মিলে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে । " আচ্ছা, আচ্ছা আমি আর চোখের জলে বানভাসি হতে চাই না , এবার থাম দেখি । নে তোরা দুটিতে একটু মন খুলে হাসতো দেখি, তোদের হাসিমুখটা দেখে আমি ঘুমাতে যাই ।" মায়ের কথা শুনে ইন্দু আর গার্গী দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠলো । তখন ইন্দুর মা ওদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর শুতে চলে যায় ।
ঘুমের ঘোরে চোখ খুলে জানলার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় ইন্দু , " কিরে গার্গী, এতো ভোরবেলায় জানলার দাঁড়িয়ে কি দেখছিস ? " গার্গী ছলছল চোখে ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে, " ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল তাই উঠে এসে দাঁড়ালাম জানলার ধারে । ভোর হতে অনেকবার দেখেছি কিন্তু আজকের ভোরটা যেন বেশ অন্যরকম । " একথা শুনতে শুনতে ততোক্ষণে গার্গীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দু । তারপর গার্গীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে , " আজকের ভোরের সূর্য তোর জীবনে নতুন আলোর সঞ্চার করুক । আজকে থেকে আমরা দুজনে নতুন করে আমাদের জীবনটা গুছিয়ে নেবো আর আমাদের নতুন আলোর পথ দেখাবে আমাদের ছোট্ট সোনা । আজকে থেকে আমরা দুই বোন আর পিছন ফিরে তাকাবো না শুধু সামনের দিকে হাঁটবো । আমি সবসময় থাকবো তোর পাশে আর আমার মাও থাকবে আমাদের দুজনেরই পাশে । "
ইন্দুর কথায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো গার্গী , ততোক্ষণে রান্নাঘর থেকে টুংটাং - খুটখাট শব্দ ভেসে আসতে শুরু করেছে । ইন্দু বললো, " চল গার্গী, মা এতোক্ষণে রান্নাঘরে কাজ শুরু করে দিয়েছে , আমরাও গিয়ে মায়ের কাজে হাত লাগাই । " এই বলে দুজনে চলে গেল রান্নাঘরে । সব কাজ সেরে দুজনে মিলে দুজনেরই ইমেইল আইডি থেকে দুটো ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করে দিল স্কুলের প্রিন্সিপালকে । দুজনের একসাথে ছুটি নেওয়ার একটাই কারণ, গার্গীর সমস্ত জিনিসপত্র ইন্দুর নিজের বাড়িতে আনা এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে দেওয়া ।
সেদিন দুপুর তিনটে নাগাদ বড়ো একটা ম্যাটাডোর এসে থামলো ইন্দুর বাড়ির নীচে । ম্যাটাডোর থেকে নামলো ইন্দু আর পিছনে একটা ট্যাক্সি থেকে নামলো গার্গী । ততোক্ষণে বাড়ির ভিতর থেকে ইন্দুর বাবা বেরিয়ে এসেছে গার্গীর সব জিনিসপত্র তদারকি করে বাড়ির ভিতরে পাঠাতে । গার্গী ইন্দুর বাবাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলে ইন্দু গার্গীর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, " বোকা মেয়ে, বাবাকে দেখে ঘাবড়ানোর দরকার নেই । কালকে রাতে মা বাবাকে সব ঘটনা খুলে জানানোর পর বাবা বলেছে আর একদিনও দেরী না করে তার ছোটো মেয়েকে যেন তাড়াতাড়ি বাড়িতে আনা হয় । বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার ছোটো মেয়ের জিনিসপত্র গুছিয়ে দেবেন । " গার্গী অবাক হয়ে বলে , " ছোটো মেয়ে ? " ইন্দু বলে, " হ্যাঁ, আমার বাবা তোকে ছোটো মেয়ে হিসেবে নিজের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে । আমি বড়ো মেয়ে আর তুই ছোটো মেয়ে । " ইন্দুর কথা শুনে গার্গী এক ছুটে গিয়ে ইন্দুর বাবার পায়ে প্রনাম করতেই ইন্দুর বাবা গার্গীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন , " ওরে পাগলী মেয়ে , আমার পা ধরবি না এখন । তোর ভিতরে যে আছে সে স্বয়ং ভগবান , এখন যে কারো পা ধরতে নেই । " একথা শুনে গার্গী বলে,
" আমার একটা ভুলের জন্য আজ তিন
বছরেরও বেশি আমার নিজের বাবা - মা আমার মুখ পর্যন্ত দ্যাখেনি আর তোমরা আমাকে এক লহমায় নিজের সন্তানের স্থান দিয়েছো । আমি কোনোদিনও তোমাদের এই অবদান ভুলতে পারবো না । আজ থেকে তুমি - কাকিমা আর ইন্দ্রানী আমার পরিবার । "
************* To Be Continued
