Debdutta Banerjee

Inspirational

0.8  

Debdutta Banerjee

Inspirational

ঝরা ফুলের দল

ঝরা ফুলের দল

4 mins
16.9K


নীল সাদা আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়ছে। নিচে একটা নদীর পার ঘেঁসে কাশ বন। সরু পায়ে চলা পথ ক্যানভাসের উপর রঙ তুলির আচরে এক অপূর্ব চিত্র ফুটিয়ে চলেছে কুর্চি। অবাক হয়ে দেখছিলাম ওর ধৈর্য্য। কি অসীম দক্ষতায় ও এঁকে চলেছে ওর ছবি।

 -" এ ছবি তুই কোথায় দেখলি ? কে শেখাল ? " অবাক হয়ে প্রশ্ন করি। আসলে ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, ওর বয়সের সাথে বোধ বুদ্ধি বাড়েনি। চোদ্দবছর বয়স ওর এখনো আধো আধো কথা আর খেলে বেড়ায় সর্বদা। পড়া ওর মাথায় কম ঢোকে। তবুও আমরা প্রচুর দৌড়েছি ওকে নিয়ে। একটা স্পেশাল স্কুলে পড়ে ও। 

হাল্কা হেসে কুর্চি যা বলল ও টিভিতে দেখেছে। কুর্চিকে চারবছর বয়সে এই হোমের বাইরে ফেলে গেছিল ওর আপনজনেরা। তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি আর। এই হোমের সাতাশটা বাচ্চার মধ্যে কুর্চি ভীষণ ট‍্যালেন্টেড। ভগবান একদিক দেয়নি অন্য দিকে দিয়েছে।  

সরকারি হোমের বিরুদ্ধে যখন নানারকম অভিযোগ, আমরা এই হোম খুব সুন্দর ভাবে চালাই। আলোর দিশা হোম বহু পুরস্কার পেয়েছে। এর পাশাপাশি আমাদের একটা স্কুল রয়েছে। বাংলা মাধ্যমের নাম করা স্কুল ছিল এক সময়। আজ স্টুডেন্ট হয় না। সমাজের যে স্তরের মেয়েরা আজ এখানে পড়ে তাদের মধ্যে সামাজিক শিক্ষার অভাব। যে সব ভাষা তারা বলে তা আমাদের কল্পনার বাইরে। অথচ কিছু বলা যাবে না, সরকারি স্কুল । কিছু বললেই অভিভাবকরা চড়াও হবে। রাজনৈতিক দাদা দিদিরা চোখ রাঙ্গাবে। এদের কিছু শেখাতে গিয়ে আমরাই প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছি। কষ্ট হয় মেয়েগুলোর কথা ভেবে!! বাবা মা রা জানে না কি ক্ষতি করে দিচ্ছে নিজেদের সন্তানদের। এজন্য কিছু টিচার পড়াতেই চায় না। আসে আর যায়। কিন্তু ক্ষতি তো এই ছাত্রী গুলোর।

একেক সময় মনে হয় কুর্চি স্বাভাবিক নয় এটাই ভালো। ওর মনটা পবিত্র কোমল। এই বিষাক্ত পৃথিবীর বুকে ও হয়তো ক্ষণিকের অতিথি।এটাই হয়তো আশির্বাদ।

হোমের এই বাচ্চা গুলোকে আমরা খুঁজে আনি কখনো ট্র্যাফিক সিগন্যাল থেকে, কখনো রেললাইনের ধার থেকে। এনজিও গুলো কোথাও বাচ্চা পেলে রেখে যায়।

 অতসী এসেছিল সারা গায়ে পোড়া দাগ নিয়ে। বাবা ছিল মিস্ত্রির জোগাড়ে, দশ তলা থেকে পড়ে একদিন সব শেষ।মা ও লেবারের কাজ করতো, একদিন আর ফেরেনি। পরে একটা ডোবায় ক্ষতবিক্ষত দেহটা পাওয়া গেছিল। গ্ৰামের এক মাতব্বর ওকে কলকাতায় কাজ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বিক্রি করে দিয়েছিল। সারাদিন রাত একটা বাড়ির সব কাজ করতে হতো। ভুল হলেই মারধোর। খুন্তির ছেঁকা তো ছিলই। ইস্ত্রি করতে গিয়ে শার্ট পুড়ে গেছিল বলে গরম ইস্ত্রি চেপে ধরেছিল ওর পিঠে। নয় বছরের মেয়েটা পালিয়েছিল। অনেক পথ ঘুরে অবশেষে আমাদের এখানে এসেছিল। খুব ভালো গান গায় মেয়েটা।

পুতুলের পড়াশোনা ভালো লাগতো না। মাথায় থাকতো না কিছু। তাই রোজ মারধোর, ওকে কেউ বোঝেইনি। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল এগারো বছরের পুতুল। আড়কাঠির হাতে পরে চালান হয়ে গেছিল বিহারে। উদ্ধার হয় ছয় মাস পর। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেনি। আপাতত ওর বাড়ি এখানেই। 

মা বাপ মরা মধুকে ওর মামা বিক্রি করেছিল ঐ অন্ধকারেই। পুতুলের সাথেই ও উদ্ধার হয়ে এসেছিল। ওরা আবার স্কুলে যাচ্ছে। মধু পুতুলকে পড়ার দিকে টেনে নিয়েছে। আমাদের স্কুলে ওদের কেউ বকে না। নেই কোনও চাপ।

মালতীর খুব মন খারাপ। মাত্র চোদ্দ বছরেই ওর বিয়ে দিচ্ছিল বাবা মা। বিয়ে আটকানোর জন‍্য থানা পুলিশ করতে হয়েছিল ওকে। তাই তাড়িয়ে দিয়েছে বাপ মা। অনেক কষ্টে এই হোমে জায়গা পেয়েছে। সামনের বার মাধ্যমিক দেবে ও। দারুণ পড়াশোনায় মেয়েটা। ওর ইচ্ছা ও ডাক্তার হবে।

অন্তরা কে টিভি সিরিয়ালে সুযোগ দেবে বলে নিয়ে এসেছিল কেউ , তারপর অন্ধকার অধ্যায় পার করে ও আমাদের কাছে এসেছে। দারুণ নাচে ও। এবার টিভির একটা রিয়েলিটিশো'তে সুযোগ পেয়েছে। খুব খাটছে মেয়েটা সমাজের মুল স্রোতে ফেরার জন্য। 

ছয় বছরের পিউ এই বয়সেই পারিবারিক ধর্ষণের শিকার। ছোট্ট মেয়েটা এখনো পুরুষ দেখলেই অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে। ওকে স্বাভাবিক করতে, ঐ দুঃস্বপ্ন ভোলাতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি আমরা। 

পাঁচ বছরের আরুহি ছিল বাবা মায়ের অতি আদরের। সম্পত্তির জন‍্য বাবা মা ওর চোখের সামনে আত্মীয় র হাতে খুন হতে দেখে ট্রমার মধ‍্যে ছিল। এখনো ভয় পায় মাঝে মাঝে। আদরের মেয়ের শত্রু ঐ সম্পত্তি। আর এতো কিছু থেকেও ওর বাড়ি এখন এই আলোর দিশা!!

বনি আর মনাকে এনেছিল পুলিশ ইন্সপেক্টর আনন্দদা। ছিঁঁচকে চুরি করে বেড়াত পাড়াতে। কাগজ কুড়ুনি সেজে ঢুকত। পাকা চোর হয়ে উঠেছিল। আনন্দদা বলেছিল কোর্টে কেস উঠলে সরকারী হোমে যাবে। সে সব জায়গায় গেলে দাগী আসামী হয়ে উঠবে কালে দিনে। আমরা থাকতে দিয়েছিলাম। এখন ওরা মুল স্রোতে ফিরছে ধীরে ধীরে। পড়াশোনাও শুরু করেছে।

যত এদের দেখি অবাক হই। এই সব ছোট্ট ছোট্ট ফুলের মধ্যে কতো প্রতিভা লুকিয়ে আছে। ঠিকঠাক সুযোগ পেলে এরা সবাই কিছু না কিছু করে দেখাতেই পারে। অথচ এদের নিজের লোকেরা এসব বোঝেনি কখনো। সমাজের নোংরা দিকটা এরা এই বয়সেই দেখে ফেলেছে। তবুও ওরা লড়াই করছে বেঁচে থাকার জন্য।

দু দিনের গুড্ডুকে ডাস্টবিনে ফেলে গেছিল কেউ। কুকুরের পাহারায় ছিল সারা রাত। তারপর বহু জায়গা ঘুরে এই হোমে এসেছে। মেয়ে বলেই কি ওর এই পরিণতি?

ফুলি থ‍্যালাসেমিয়ায় ভুগছে। রক্ত দিতে হয় মাসে মাসে। এই অপরাধেই ওকে ছেড়ে গেছিল ওর পরিবার। মেয়েটার দারুণ হাতের কাজ । কত কি বানায় আপন মনে।ওর বানানো জিনিসের প্রদর্শনী করেছিলাম আমরা। পেপারে ওর ছবি বেরিয়েছিল।

আমি এদের নিয়েই থাকি। এই কুর্চি , ফুলি এরা আমায় প্রেরণা দেয়। লড়াই করার সাহস পাই। আমার সাত বছরের একমাত্র মেয়ে ঋদ্ধিমা ব্লাড ক্যানসারে ভুগছে। এরা সবাই ওর বন্ধু। ওর মনের খবর রাখে এরা। আমার মেয়ে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত ভাগ করে নিয়েছে এদের সাথে। এরা জানে না, না পাওয়ার দুঃখ, জানে না বাবা মায়ের ভালবাসা, জানে না সংসারের মারপ্যাঁচ। নেচে গেয়ে হেসে খেলেই কাটছে এদের শৈশব। খুব অল্পেই এরা খুশি। এভাবেই সবাই এগিয়ে চলছে হাতে হাত রেখে। এদের মনে নেই বিদ্বেষ , হিংসা। সবার দুঃখে এরা সবাই দুখি হয়, ছোট ছোট আনন্দ ভাগ করে নিতে জানে নিজেরাই। ওদের পবিত্রতা, ওদের সততা, ওদের হাসি এই দেখেই আমাদের মন ভরে ওঠে প্রতিনিয়ত।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational