Maheshwar Maji

Inspirational

2.1  

Maheshwar Maji

Inspirational

ঈশ্বর

ঈশ্বর

6 mins
1.1K


এলাকার সবাই তাকে রামুপাগল বলে ডাকে। অবশ্য তাতে রামুর কিছু যায়,আসে না।।

যে যাই বলুক না কেন।ভাল,মন্দ,মান,অপমান। কোনকিছুতেই তার গ্রাহ্য নেই।

সবসময় হাসে। কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে হো,হো শব্দে। কখনো বা মিটিমিটি। মুখভর্তি দাড়ির ফাঁকে সামনের দুটো দাঁতের অর্ধেকটা সবসময় দেখা যায়।

এক দৃষ্টিতে রামুর পানে চেয়ে থাকলে তাকে ঠিক পাগল বলে মনে হয় না।

মনে হয় সিদ্ধ কোন পুরুষ!

স্বচ্ছ দুচোখের তারা!

জগতে কোনকিছুর প্রতি কোনরকম আক্ষেপ নেই। কারু প্রতি কোন অভিযোগ নেই।

হিংসা,রাগ,দ্বেষ,লোভ সমস্তের উর্ধ্বে তার নজর।

শুধুমাত্র তার ব্যবহার,এলাকার বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ না। কারণ রামু মাঝে,মাঝে উদ্ভট সব আচরণ করে বসে। যেমন ধরুন,

বাজারে ঘুরতে,ঘুরতে হঠাৎ হয়তো মাছওয়ালা মাসির কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল।কিছুক্ষণ চুপচাপ সেদিকে নরমচোখে চেয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ বসে পড়ে একটা মরা মাছের গায়ে হাত বোলাতে শুরু করল। অমনি সব রে রে করে তাকে তেড়ে উঠলেন।

সেখান থেকে তাড়া খেয়ে রামু আবার চলতে শুরু করল।

কারো ঘরের খোলা দরজা দিয়ে নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর।

মানুষের নিয়ম, কানুনগুলো সে ঠিকমত ঠাওর করতে পারে না। তাই অধিকারের সীমারেখাটাও সে বুঝতে পারেনা।উঠোনে দাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে খোলা আকাশটার দিকে চেয়ে থাকে।

কোন,কোন সময় লজ্জা নিবারনের পোশাকটুকুও হয়তো থাকে না।

এ রকম অবস্থায় যার চোখেই পড়ুক না কেন, লাঠির কয়েকটা ঘাঁ দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হন।

পেটে যখন টান পড়ে। হাত পাতে। সবার কাছে। ছোট, বড়, ধনী, গরীব অন্ধ, বধীর। সে অত, শত বোঝে না।

হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে।

কেউ,কেউ দুটো পয়সা দিতে যান। সে বাঁধা দেয়। খাবার খোঁজে। কেউ আবার শুধু ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেন।

কেউ কিছু দিলে যেমন তাকে সে কাউকে আশির্বাদ দেয় না।

তেমনি কিছু না দিলেও কোন গালমন্দ করে না। যে কোন পরিস্থিতিই হোক না কেন,সে সদা নির্বিকার‌ থাকে।

সেবার তাপমাত্রা হঠাৎ করে খুব নিচে নেমে গেল। তাই ঠান্ডা একেবারে হাড়ের ভিতর ঢুকে যাওয়ার উপক্রম।

সকালে রোদ না উঠলে কোন মানুষ আর বিছানা ছেড়ে উঠতে চান না।

শৈত প্রবাহও শুরু হয়েছে।উত্তরে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, জানলার অল্প ফাঁকেও চোরের মত হানা দিয়ে যায়।

তাই অনেকে শুকনো গাছের গুড়ি জ্বালিয়ে জটলা বেঁধে বসে আছেন।

এসময় হঠাৎ একজন কথা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন, কদিন ধরে রামুকে চোখে পড়ছে না। শালা...আবার এলাকা বদল করল নাকি?

উত্তরে অন্যজন বলে উঠলেন, যা শীত পড়েছে!...আমার মনে হয় কোথাও জমে, টমে বরফ হয়ে পড়ে আছে।

আর একজন বললেন, ইস!...তাইতো।বেচারা ঠান্ডায় মরে, টরেই গেল নাকি?

একজন গলায় রাগ মিশিয়ে বলে উঠলেন, ওসব পাগল, ছাগলদের মরে যাওয়ায় ভাল। সারাক্ষণ নেংটো হয়ে ফ্যালফ্যাল করে ঘুরে বেড়ায়। মান,সম্মান পর্যন্ত ধুলোয় মিশে যেত।

আর একজন আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন, যাই হোক তবে রামু কারু কোনদিন ক্ষতি করেনি। পাগল বলেই কান্ডজ্ঞান ছিল না। তা না হলে ভালই ছিল। শত মার খেয়েও কোনদিন কাঁদেনি। সেবার মন্ডলদার মেয়ের বিয়েতে তার পিঠে যে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল। তার ঘাঁ তো আর সারলোই না। এতটা শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি বেচারাকে। ও তো একটা পাগল!..মেয়েটা বিদায় বেলায় সবাইকে ধরে,ধরে কাঁদছে দেখে রামুও নেংটো অবস্থায় হুট করে কোথা থেকে এসে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

মেয়েটার মানাও কেউ শোনেনি। ওর উপর এতবড় শাস্তি হচ্ছে দেখে, মেয়েটার মনটা আরো বেশি ভেঙে পড়েছিল।

একজন তার প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন, যা করেছে, ঠিক করেছে। পাগল বলেই কী যা ইচ্ছে তাই করবে?

সেবার দেখলি না...সারারাত ধরে কেমন মা বাসুলির মাথার উপর বসেছিল!সিঁদুর, টিঁদুর সব গায়ে, মুখে মেখে চাতালটায় মনের আনন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছিল!...এতসব পাগলামী মেনে নেওয়া যায় নাকি? ও না হয় পাগল। কিন্তু আমরা তা কী করে সহ্য করব? সারা গাঁয়ের আস্থা আছে মায়ের উপর। শালা কী এমনি,এমনি পাগল হয়েছে রে? সব ওর অপকর্মের ফল। তাই ওকে মারা কোন পাপ না। ওটাই ওর কর্মফল। ভোগ করুক।


এমন সময় একজন খবর দিয়ে গেলেন, রামু পাগল নাকি মারা যায়নি।এখন ও শ্মশানে ঘুরে বেড়ায়। এত ঠান্ডায় প্রতিদিন কারু না কারু একটা চিতা জ্বলছেই। ও সেখানে বসে,বসে চিতার আঁচ মাখে। চিতা ঠান্ডা হয়ে পড়লে ওই ভস্মে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

শ্মশানযাত্রীরা বুঁদে, মিষ্টি দিয়ে যান। ওই দিয়েই পেট চলে।


একমাস যাওয়ার পর আবহাওয়া যখন অনেকটা সুখের হল। এলাকায় একদিন হঠাৎ এক সাধু এসে উপস্থিত হলেন।

পরণে গেরুয়া বস্ত্র। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পায়ে খড়্ম। মাথায় জটা। হাতে ত্রিশূল।কপালে লাল টকটকে তিলক।আর মুখে সারাক্ষণ "বোম ভোলে" আর "জয় তারা" বুলি আওড়াচ্ছেন।

তার চোখের তেজ আর মুখের বুলি শুনে আশেপাশের সমস্ত গ্রাম, বাজার থেকে হাজার মানুষ দৌড়ে এলেন।

তিনি নাকি তারাপীঠের সিদ্ধ সাধক।যা বলেন,তাই হয়।

সংসারী মানুষের অনেক সমস্যা।তিনি সব সমস্যার সমাধান করতেই পা রেখেছেন।

এলাকার একজন মস্তবড় ব্যাবসায়ী সাধুবাবাকে তার একটা হলঘরটা ছেড়ে দিলেন।

সেখানে তিনি ভক্তদের উদ্দেশ্যে নানারকম উপদেশ দিতে শুরু করলেন।মহিলা ভক্তদের দিকে তার নজর বেশি ।কয়েকজন সেবাদাসীও জুটে গেল।

একদিন রাতের বেলায় এক ভ্যান পুলিশ এসে সেই সাধুকে পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন।

তিনি নাকি তলে,তলে মেয়ে পাচার চক্রের সাথে যুক্ত। এর আগে অনেক জায়গায় তিনি ঘুরে,ঘুরে বেড়িয়েছেন।কোথাও বেশিদিন থাকেন না।সব জায়গা থেকে তিন,চারজন মেয়েকে সেবাদাসীর নামে নিজের আশ্রমে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে পাচারকারীর হাতে তুলে দেন।

কিছুদিন আগে একটা মেয়ে কানপুরের মধুচক্র থেকে উদ্ধার হওয়াই, সাধুবাবার কুকীর্তি পুলিশের নজরে আসে। তখন থেকে তদন্তকারীর দল সাধুটির খোঁজে জোর তল্লাশি শুরু করেন। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ জানতে পারেন, এই গ্রামে সাধুটি ডেরা বেঁধেছেন। ভক্তদের ভিড় এড়াবার জন্যই পুলিশ, রাতেরবেলা‌ তাকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

ভোরের আলো ফুটতেই ভক্তদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। অনেকেই একটা প্রতিবাদী মিছিল বের করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। শেষ, মেষ বানচাল হয়ে যায়।

কারণ সাধুর যারা সেবাদাসীরূপে নিযুক্ত ছিলেন। পূন্যার্জনের লোভে। তারা নিজেই সাধুর লালসাপ্রবৃত্তির পর্দাফাঁস করে দিলেন।

সারা এলাকাজুড়ে ছিঃ ছিঃ রব পড়ে গেল। এইসব পাপী মানুষগুলো কী করে ঈশ্বরের নাম নিয়ে ধর্মপ্রেমী মানুষগুলোর হৃদয়ে আঘাত হানেন?

ঈশ্বর কেন এদেরকে ন্যায়ের চক্র দিয়ে শেষ করে দেন না?

এরকম নানা প্রশ্ন আসতে লাগলো।

মানুষের মনগুলো যখন এরকম হাজার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ব্যাকুল।

সেইসময় এলাকায় অন্য একজন মানুষ এসে উপস্থিত হলেন। শরীরজুড়ে ধবধবে সাদা পোশাক। তিনি নাকি একজন ধর্ম প্রচারক। এই সাইকেলে চড়েই অর্ধেক ভারত ভ্রমণ করে ফেলেছেন। তিনি এক সময় বিশ্ব হিন্দু পরিষদে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি স্বেচ্ছায় সরে এসেছেন। সাইকেলে করে মানুষের সাথে কথা বলে ধর্মের আসল তত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

কোন জায়গাতেই বারো ঘন্টার বেশি থাকেন না। তার ইচ্ছে আছে, পুরো ভারত ভ্রমণ করা। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে হিন্দু ধর্মের আসল সার জাগিয়ে তোলাই তার লক্ষ্য।

আজ মানুষ আসল, নকলের পার্থক্য বুঝতে পারেন না। বিচক্ষণ ক্ষমতা নেই।ধর্মগ্রন্থ না পড়ে, না শুনেই ধর্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ছেন। তাই পরখ করার শক্তি নেই। সেই সুযোগে কিছু ঢোঙি যোগী, সাধারণ মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাসের কালো ফিতে বেঁধে দেন। মানুষ তখন তার নির্দেশ মতো চলতে শুরু করেন। এটা একটা চরম ভুল।

ধর্ম প্রচারক মানুষটি আট,দশটি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন।পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ তিনি পড়ে ফেলেছেন। পেশায় সংস্কৃতের শিক্ষক।তবে পণ নিয়েছেন,কখনো চারদেওয়ালের মধ্যে ছাত্র,ছাত্রীদেরকে পড়াবেন না। এইভাবে ঘুরে, ঘুরেই তিনি মানুষের মধ্যে ধর্ম এবং সংস্কৃত ভাষায় গীতার শ্লোকগুলোকে সরলভাবে ছড়িয়ে দেবেন।

তিনি যেতে, যেতে বলে গেলেন, আসল যারা যোগী, সাধক বা অবতার। তাদের চিনতে আঁতশ কাঁচের দরকার হয় না। তারজন্য বিশাল কোন জ্ঞানের অধিকারী না হলেও চলে।

যিনি ঈশ্বরের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। তাকে চেনার সবথেকে সহজ পন্থা হল তার চোখ। সেই চোখে শিশুর সরলতা থাকবে। কারু প্রতি কোন রাগ,দ্বেষ অথবা আক্রোশের বিন্দুমাত্রও লেশ থাকবে না।

যে যাই খাবার তুলে দিক হাতে, তিনি বিচার না‌করে খেয়ে ফেলেন। খাবারের প্রতি তার মনযোগ কম। শত আঘাতেও চোখে অশ্রু ঝরে না তার। যে অবস্থাতেই তিনি থাকুন না কেন, মুখে হাসি থাকবেই।

তিনি কোন ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকবেন না। আর ধর্মের প্রচারও নিজে মুখে করে বেড়ান না।

তিনি বীতকাম, বীতরাগ এবং সংসারের সমস্ত দুঃখ,কষ্ট থেকে মুক্ত থাকবেন। তার মুখের দিকে চাইলে মায়া জাগবে। দয়া করতে ইচ্ছে হবে। মনের ভেতর সমস্ত অহংকারের অবসান ঘটে। নিজেকে এবং মানব জন্মের সার্থকতাকে চিনতে শেখান তার সরল ব্যবহার। তাকে দেখলে শ্রদ্ধায় চোখ ঝুঁকে আসে। আশির্বাদ পেতে মন চায়।অথচ তিনি চলবেন, নিজের খেয়ালে।


তিনিই একমাত্র ঈশ্বরের রূপ। আমরা যদি সেই রূপকে চিনতে না পারি। তাহলে বুঝে নেবেন, সকলেই ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের নেশায় চুর হয়ে পড়েছি।ওই চোখে আর যাই হোক কখনো ঈশ্বরকে দেখা যায় না।


পরের দিন এলাকার সবাই মিলে রামু পাগলের খোঁজে দৌড়ে ফিরতে লাগলেন। তাকে দেওয়া সমস্ত আঘাতের জন্য ক্ষমা চাওয়ার জন্য। এতদিন পর সকলেই বুঝতে পারছেন। ঈশ্বর তো তাদের মাঝে রাতদিন ঘুরে, ফিরছিলেন।শুধু অজ্ঞনতার কারণে চিনে উঠতে পারেননি কেউ। তাই ঢোঙি সাধু এসে তাদেরকে ধর্মের ভাং খাওয়াতে সক্ষম হয়েছেন।

এখন মানুষের চোখে রামুর দর্শণ তৃষ্ণা হুহু করে বাড়তে লাগল। কিন্তু তার দেখা পাওয়া গেল না কোথাও। তাই মানুষের চোখে আজ ঈশ্বরপ্রেমের আকুতি ভেসে উঠল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational