Sandip Chakraborty

Romance Classics

4  

Sandip Chakraborty

Romance Classics

হোরিখেলা

হোরিখেলা

7 mins
326



সাজিয়েগুছিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারি বলে পাড়ার বন্ধুদের কাছে আমার দারুণ সুনাম। উচ্চ মাধ্যমিকে চারটে সাবজেক্টে লেটার পেয়েছি, চেহারাটাও ভালো ছেলে টাইপ। তাই আমার ঢপগুলো পাড়ার লোকে চেটেপুটে খায়। আজ অবধি আমি কখনও ব্যর্থ হইনি।

 কিন্তু রাজার কেসটা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে এবার আমি পারব না। কেন মনে হচ্ছে জানি না। আমারই মনের ভেতর থেকে কে যেন বারবার বলছে, ভুল করো না সন্তু। সারা জীবন পস্তাবে।

যাই হোক, এবার আসল ঘটনাটা বলি। আমার ভালো নাম শান্তনু মিত্র। ইংলিশ অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। পড়াশোনার বাইরে একমাত্র আকর্ষণ তরুণ সংঘের ক্লাবঘরে ক্যারাম পেটানো। অথবা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। আমাদের একটা গ্রুপ আছে। আমি রাজা মিতান টুকাই টুবলু আর রনি। আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকি। পাঁচ মাথা একজায়গায় হলেই সময়টা হেসেখেলে কেটে যায়। কিন্তু ইদানীং একটা সমস্যা হয়েছে। যার জন্য আমরা সবাই চিন্তিত।

 রাজার টেনশন সব থেকে বেশি। ঘনঘন সিগারেট খাচ্ছে। ছিটিয়ালদের মতো আলটপকা পায়েচারি করছে। এসব দেখে রনি বলল, চাপ নিস না রাজা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

 রাজা বিমর্ষ মুখে বলল, তোরা তো জানিস মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও আমি কুল থাকি। কিন্তু ওই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে না পারছি খেতে না পারছি শুতে--একেবারে যা তা অবস্থা। আমার একমাত্র ভরসা সন্তু।

 আমিও তো তাই বলছি। সন্তু যখন আছে কোনও চিন্তা নেই।

 রাজা আমার হাত ধরে বলল, সন্তু তুই শুধু মেয়েটাকে দোলের দিন সন্ধ্যেবেলায় ক্লাবের ফিস্টে এনে দে। বাকি যা করার আমি করব।

 কী বলব বুঝতে পারলাম না। রাজা যে মেয়েটির কথা বলছে ওরা নির্মলকাকুর একতলার ভাড়াটে। মাত্র দু'মাস হল এসেছে। ছোট ফ্যামিলি। বাবা মা আর ওই মেয়েটা। নির্মলকাকুর বাড়ি আমাদের বাড়ির একদম লাগোয়া। এ বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ও বাড়িতে যাওয়া যায়। মেয়েটা রোজ বিকেলে ছাদে ওঠে। আমার ঘর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। আমি দেখি। মেয়েটাও আমায় দেখে। ষোলো-সতেরো বছরের কোনও মেয়ের যদি কাউকে ভালো লাগে তা হলে সে সেই অনুভূতি গোপন করতে পারে না। আমি জানি আমাকে ওর ভালো লাগে। মিথ্যে বলব না আমারও ওকে ভালো লাগে। সেটা অবশ্য বড়ো কথা নয়। রাজা চায় আমি মেয়েটাকে গুলগাপ্পি দিয়ে ক্লাবের ফিস্টে নিয়ে যাই। ও ওখানেই প্রপোজ করবে। কিন্তু যার সঙ্গে আলাপ নেই--নাম পর্যন্ত জানি না--তাকে কীভাবে রাজি করাব আমি সে কথাই ভাবছিলাম।

 রাজা অধৈর্য হয়ে বলল, কী রে সন্তু! চুপ করে গেলি কেন?

 না, মানে---

 আমি প্রমিস করছি সন্তু। তুই যদি আমার কাজটা করে দিস তা হলে ফোর্ট র‍্যাডিসনে পার্টি করার সব খরচ আমি দেব।

 টুবলু মুখে আঙুল ঢুকিয়ে কর্কশ ভঙ্গীতে সিটি দিল। টুকাই তো নাচতেই শুরু করল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওদের। হঠাৎ নিজেকে খুব ছোট মনে হল। রাজার বাবার প্রচুর টাকা। আমাদের গ্রুপের প্রতিটি ইভেন্ট রাজাই স্পনসর করে। কিন্তু ও কি আমাদের বন্ধু ভাবে? নাকি ক্রীতদাস মনে করে।

সম্বিত ফিরল রাজার ডাকে, সন্তু, অ্যাই সন্তু!

 কষ্টটা জোর করে গিলে নিয়ে বললাম, আসলে আমার সঙ্গে তো আলাপ নেই। তাই একটু টেনশন হচ্ছে।

 টুকাই বলল, আরে বস তুই হচ্ছিস এই মিলেনিয়ামের সেরা ঢপবাজ। হাড় কিপটে শশাঙ্কজেঠাকে গুজরাটে ফ্লাডের গল্প শুনিয়ে যে দেড়শো টাকা চাঁদা বের করতে পারে তার পক্ষে একটা মেয়েকে পটানো কোনও ব্যাপার নয়। আমি বলছি তোর দু'মিনিটও লাগবে না৷

 প্রশংসা শুনে খুব একটা খুশি হতে পারলাম না। শশাঙ্কজেঠা পাড়ার লোক। আমাকে জন্মাতে দেখেছেন। দুর্গাপুজোর চাঁদা থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমরা গুজরাটের ফ্লাড রিলিফ ফান্ডে পাঠাব শুনলে তিনি কনভিনসড হতেই পারেন। কিন্তু ওই মেয়েটা আমার মতো একজন অপরিচিত যুবকের কথায় ক্লাবের ফিস্টে যেতে রাজি হবে কেন?

 বাড়ি ফিরলাম মাথায় পাহাড়ের মতো ভারী বোঝা নিয়ে। কাল দোল। মাঝখানে একটা মাত্র রাত। এর মধ্যে আমাকে স্ট্র‍্যাটেজি ঠিক করতে হবে। সত্যি কথা বলার জন্য কোনও স্ট্র‍্যাটেজি লাগে না। মিথ্যের জন্য লাগে।

 সারারাত ঘুম হল না। সকালে বেরিয়ে রং কিনলাম। আর আবির। তারপর সোজা ছাদে। ঠিক স্ট্র‍্যাটেজি নয়। দুটো প্ল্যান করেছিলাম। মেয়েটা ছাদে থাকলে প্ল্যান#১। আর ছাদে না থাকলে প্ল্যান#২। ছাদে গিয়ে যা দেখলাম তাতে চোখ জুড়িয়ে গেল। মেয়েটা কার্নিশে ঝুঁকে রাস্তায় রঙের প্লাবন দেখছে।

 হঠাৎ আমার মনের সেই অচেনা কণ্ঠস্বর আমাকে সাবধান করে দিল, ভুল করো না সন্তু। সারা জীবন পস্তাতে হবে।

 ধুত্তোর! নিকুচি করেছে। পস্তালে পস্তাব। রাজা আমাকে বন্ধু ভাবে কি না জানি না। কিন্তু আমি ওকে বন্ধু ভাবি। আর ও মেয়েটাকে ভালোবাসে। সুতরাং যা হয় হোক, একটা চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।

 হাই! আমার নাম শান্তনু মিত্র। সন্তু। তুমি?

 ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। ওর চোখে বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই। বরং খুশিতে টলটল করছে চোখদুটো। আশ্চর্য! এরকম তো হওয়ার কথা নয়। মেয়েটা কি আমারই জন্য অপেক্ষা করছিল? হাওয়ায় বেসামাল ওড়না সামলে ও বলল, আমার নাম দোলনচাঁপা।

 নাইস নেম! দোলনচাঁপা তো ফুলের নাম। আমি অবশ্য কখনও দেখিনি। একদিন নেটে দেখে নেব। বাই দা ওয়ে, তুমি দোল খেল না?

 খুশি সরে গিয়ে দোলনচাঁপার চোখে কষ্ট ফুটল, আগে যেখানে ছিলাম সেখানে খেলতাম। এখানে তো আমার কোনও বন্ধু নেই।

 এতক্ষণে একটা লুজ বল পেলাম। স্টেপ আউট করে চালালেই সিক্সার! হেসে বললাম, বন্ধু নেই মানে? আমি তোমার বন্ধু। এ পাড়ার সব ছেলেমেয়ে তোমার বন্ধু। জানো তো, আমাদের একটা বিশাল গ্রুপ আছে। আমি রাজা টুকাই টুবলু রনি অহনা টুম্পা মিলি এটসেটরা এটসেটরা। সবার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব। সময় কোথা দিয়ে কেটে যাবে বুঝতেই পারবে না। নাউ লেটস সেলিব্রেট আওয়ার নিউ ফ্রেন্ডশিপ। আমি যদি রং দিই তুমি কিছু মনে করবে না তো?

 তা করব না। কিন্তু দেবে কীভাবে?

 দ্যাখোই না।

 ট্যাঙ্কের পিছন থেকে কাঠের পাটাতনটা বের করে চাপিয়ে দিলাম কার্নিশের ওপর। তারপর সেতু পেরিয়ে চলে গেলাম নির্মলকাকুর বাড়ির ছাদে। ঘটনাটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। দোলন রিঅ্যাক্ট করার সুযোগ পায়নি। কাছে গিয়ে দেখলাম ও ভয় মেশানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের ওপর হাত চাপা। স্বাভাবিক হতে সময় লাগল। বলল, এভাবে কেউ আসে! তিনতলার ছাদ। যদি পড়ে যেতে কী হত বুঝতে পারছ?

 মুহূর্তের জন্য সামান্য এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। মা ছাড়া আর কাউকে আমাকে নিয়ে এরকম টেনশন করতে দেখিনি। মায়ের মুখেই শুনেছি, কেউ যখন কাউকে খুব ভালোবাসে তখনই তাকে নিয়ে একটা চাপা টেনশন তৈরি হয়। সবসময় মনে হয় কোনও বিপদ-আপদ হল বুঝি! দোলনের রিঅ্যাকশন অনেকটা মায়ের মতো। একটা প্রশ্ন বিদ্যুতের মতো আমার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল। ও কি আমায় ভালোবাসে? কিন্তু তা কী করে হয়! ও তো আমাকে ভালো করে চেনেই না।

নিজের ওপর রাগ হল। এসব আমি কী ভাবছি! একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, টেক ইট ইজি দোলন। প্রত্যেক বছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এই ছাদে ঘুড়ি পড়লে আমি এভাবেই আসি। আমার অভ্যেস আছে।

 দোলনের আতঙ্ক এখনও পুরোপুরি কাটেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, প্রমিস করো আর কখনও এভাবে আসবে না। আমাকে ডাকবে। আমি এসে দিয়ে যাব।

 হঠাৎ রাস্তার দিক থেকে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার এসে কানে লাগল। রাজার গলা। রাজা দোলের দিন হোলি হ্যায় বলে গলা ফাটাচ্ছে। পেটে রঙিন জল পড়লে রাজা হিন্দি বলে। বুঝলাম সকাল দশটাতেই শুরু হয়ে গেছে। তবে একটা ভালো কাজ রাজা করেছে। দোলনের মনঃসংযোগ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমাকে আর প্রমিস করতে হবে না। বললাম, এসো তোমাকে একটু রং দিই।

 দোলন চোখ বুঝল। হাতে রং নিয়ে আমি ওর খুব কাছে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু দিতে পারলাম না। একটা জিজ্ঞাসা আমায় থামিয়ে দিল। আমার মতো একটা প্রায় অচেনা ছেলেকে চোখ বুজে বিশ্বাস করার জোর দোলন কোথা থেকে পাচ্ছে? ও কি জানে না ছাদের দরজা বন্ধ। ও কি জানে না আমার পকেটে রুমাল আছে আর সেই রুমাল দিয়ে আমি ওর মুখ বেঁধে ফেলতে পারি? তারপর ও যত চিৎকারই করুক, মাইক আর উন্মত্ত হোলি হ্যায়য়ের নীচে আজ সব চাপা পড়ে যাবে৷

মায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল। মা বলে, বিশ্বাস আর নির্ভরতা ভালোবাসার দুটি স্তম্ভ। মেয়েরা যাকে বিশ্বাস করতে পারে না, যার ওপর নির্ভর করতে পারে না--তাকে ভালোবাসতেও পারে না। বুকের ভেতরে তিরতিরে ঝর্নার মতো একটা আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। আমার আর রং দেওয়া হল না। মনে হল বাড়ির মেয়ে ছাদে গিয়ে রং মেখে এলে প্রশ্ন উঠবেই। নিষ্ঠুর সেইসব প্রশ্নের আঘাতে কুঁকড়ে যাবে দোলন। সেটা আমি হতে দিতে পারি না। আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় লাল আবিরের তিনটে সমান্তরাল রেখা টেনে দিলাম ওর কপালে। তারপর বললাম, সারাজীবন দোলের দিন তোমার কপালে এমনি করে আবির দিতে চাই দোলন। নেবে আমার রং?

 বলেই বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে। এ কথা আমার নয়। কিংবা বড্ড বেশি করে আমার। কিন্তু আমি রাজার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।

 দোলন চোখ খুলল। ওর দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক তন্ময়তা। যেন ও এই পৃথিবীতে নেই। স্বপ্নের জগতে ভেসে রয়েছে। আমি বিড়বিড় করে বললাম, আমার ভুল হয়েছে দোলন। আমি ও কথা বলতে চাইনি। কিন্তু ও শুনতে পেল না। বলল, সারা জীবন রং দেবার মানে বোঝো সন্তুদা?

 আমি রাজার কথা বলতে চাইলাম। মিথ্যে কথা বলে ওকে ফিস্টে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। ইচ্ছেই করল না। মনে হল রাজা তো দোলনকে ভালোবাসেনি। শুধু টাকার জোরে দখল করতে চেয়েছে। তাই দোলনের আরও কাছে গিয়ে বললাম, বুঝি।

 দোলন হাসল। তারপর আমার হাত থেকে আবির নিয়ে আমারই গালে লাগিয়ে বলল, তা হলে দিয়ো তোমার রং। আমি নেব। সারাজীবন ধরে নেব।

 সন্ধ্যেবেলায় ক্লাবে যাওয়া মাত্র রাজা জিজ্ঞাসা করল, কী রে! সকালে এলি না কেন?

 সারা দুপুর শুয়ে শুয়ে স্ট্র‍্যাটেজি বানিয়েছি। এই ঢপ অনেকদিন কেউ বুঝতে পারবে না। যখন বুঝবে তখন অন্য কিছু বলা যাবে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, তোর কাজেই তো গিয়েছিলাম।

 গিয়েছিলি! বললি ওকে আমার কথা?

 বলেছি। তবে হবে না। ওর একজন বয় ফ্রেন্ড আছে।

 রাজা হতাশ হয়ে বসে পড়ল। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সিগারেট ধরালাম।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance