হোলি উৎসব তারুণ্য ও যৌবনের প্রতীক
হোলি উৎসব তারুণ্য ও যৌবনের প্রতীক
বাংলা নববর্ষ এ দেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে এতে সৃষ্টি করেছে এক নতুন আবহ, নতুন এক সাহিত্যধারা। নতুন আবির্ভূত, নবজীবন জাগরিত, সুন্দর সুস্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত। কালবৈশাখী এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ-সহচর, নবসৃষ্টির অগ্রদূত, সুন্দরের অগ্রপথিক ও নতুনের বিজয় কেতন। ছন্দের গীতিতে কাজী নজরুল ইসলাম কালবৈশাখী দেখে গেয়ে উঠেন—
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,
তোরা সব জয়ধ্বনি কর—
ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর। ’
বৈশাখ তার রুদ্ররূপ নিয়ে আবির্ভূত হলেও তার মধ্যে একটা প্রশান্ত মায়া আত্মগোপন করে থাকে, যা মানুষ দু’হাত প্রসারিত করে বিপুল বৈভবের আনন্দে জীবনের আনন্দের সঙ্গে মিশিয়ে নেয় একটি বছরের নতুন প্রত্যাশার আনন্দে।
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানুষের গ্রামীণ জীবনের যে রূপ-রস মাধুর্যতার ছবি ফুটে উঠেছে, তা সত্যিই অতুলনীয়। এ দেশের কৃষকের আঙিনা যখন বৈশাখে নতুন শস্যের সুগন্ধে ভরে যায়, তখন তার দোলাও লাগে মনের মধ্যে। কৃষকবধূ আঁটি বেঁধে দাহন সাজিয়ে রাখে আর সারা মুখে আনন্দ ছড়িয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানে দিন-রাত। নতুন চাল দিয়ে বাড়িতে তৈরি হয় পিঠে আর ক্ষীর। নতুন অন্নকে বছরের প্রথমে বরণ করার জন্যই জীবনের এই ছোট উৎসব। কৃষক আর কৃষকবধূ অপেক্ষা করে এ দিনের জন্য। সুগন্ধি তেল দিয়ে কৃষকবধূ তার খোঁপা বাঁধে। খোঁপায় রঙিন ফিতে জড়িয়ে হাতে পরে কাচের চুড়ি।
জীবনের এই টুকরো আনন্দের মধ্যে ধরা পড়ে রূপ-বৈভবের চেতনামিশ্রিত নতুন অনুভবের উল্লাস। এ রূপ চিরন্তন, এ রূপ জন্ম দেয় এ দেশের সংস্কৃতির, যা মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বর্ষ শেষে চৈত্র বিদায় নেয় আকাশে কালো পুঞ্জমেঘ বিস্তার করে। সে মেঘে কখনো আকাশ আবৃত হয়ে যায় মেঘলায়; কিন্তু মানুষের জীবনে প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না।
বাংলা কাব্যের মধ্যযুগে নববর্ষ পালন বলে তেমন কিছু নেই। মধ্যযুগের কাব্যে ঋতুর বর্ণনা আছে, বারমাসি আছে।
কবি টেনিসন যখন বলেন—
'‘Ring out the old, ring in the new
Ring, happy bells, across the snow:
The year is going, let him go,
Ring out the falls, ring in the to."
আর তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখি আরেক নান্দনিক উচ্চারণ—
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক। ’
ফাগুনের সুবাসিত মেদুরতায় নববর্ষ আসে বসন্তের হাত ধরে।
ফাল্গুনের মিঠে বাতাস গায়ে মেখে দোদুল্যমান পলাশ মনের ভেতর দিয়ে আপন সুরে গুন গুন করে ওঠে। এই অপার্থিব সৌন্দর্য, এই ফাল্গুনী হাওয়া বার্তা দিয়ে যায়, বসন্ত এসে গেছে। বসন্তের দেখা না পেয়ে কবি লেখেন , " ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।" কিম্বা " যাও উত্তরের হাওয়া, তাকে গিয়ে বলে এসো ----- আছে,/ বসন্তের সম্ভাবনা পত্রহীন বিশুষ্ক শাখায়।" বাস্তবিক বাঙালি জীবনে বসন্তের কোন ভূমিকা আছে , কি , ছিল কিনা তা নিয়ে আমার গভীর সংশয় আছে। পত্রহীন নিরস শাখায় যখন মধুরস আসে, তখন মধুমাস বিদায় নেয়। অথচ নীরদ সি চৌধুরী বলেন, ' বাঙালি আসলে প্রেম করতে জানতো না। তাদের প্রেমের জায়গা জুড়ে ছিল শরীর। দেহজ যৌনতা। বাঙালিকে প্রেম বা রোমান্টিকতার শিখিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র।' প্রায় একই রকম কথা পাই কবি বুদ্ধদেব বসুর লেখায় । তবে তিনি বলেছিলেন, বাঙালির প্রেম এসেছে রবীন্দ্রনাথকে ভর করে। এই যে আমরা বাঙালিরা বসন্ত নিয়ে আজ এত মাতামাতি করি, তার কারণ কবিরা লিখে লিখে এটাকে বিখ্যাত করে গিয়েছেন। বিশেষ করে ইংরেজ কবিরা আর সংস্কৃত কবিরা। একা রবীন্দ্রনাথ "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" বা "ওরে, গৃহবাসী" অথবা "রাঙিয়ে দিয়ে যাও..." বাঙালির মনে বাসন্তিক মেজাজ এনে দিয়েছেন। বসন্তের বিলাপ আছে, অনুতাপ নেই।
নববর্ষ, বসন্ত, হোলি উৎসব ফাল্গুনের বিকশিত রূপ-রসে মথিত করে বাঙ্গালীর হৃদয়ে প্রেমের বার্তার আগমনী সুর ধ্বনিত করে। দোল বা হোলি উৎসব যে নামেই আহ্বান জানাই, যৌবন ও তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে তার আগমন ঘটে।
দোল বা হোলি এমন একটি উৎসব যা সারা ভারতবর্ষে প্রচলিত। সারা দেশে প্রচলিত এমন উৎসবগুলি ------------ দশেরা, দেওয়ালি এবং হোলি। দশেরা ও দেওয়ালি উৎসবের মধ্যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ অনেক বেশি। সামাজিক দিক দিয়ে দেখলে হোলি একমাত্র সর্বজনীন এবং সর্বভারতীয় উৎসব। এই উৎসব সারা দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রচলিত আছে। বাংলায় দোলযাত্রা, উত্তর ও মধ্য ভারতে হোলি বা হোরি। উড়িষ্যায় দোলেৎসব। গোয়াতে শিমাগা। দক্ষিণ ভারতে এর নাম মদন-দহন বা কামায়ন। নামের পার্থক্য থাকলেও উৎসবের আঙ্গিক সর্বত্র এক।
বসন্তের এই ফাগুনি হাওয়ায় হাওয়ায় আসে দোল পূর্ণিমা। দোল বা হোলি এমন একটি উৎসব যার সারা ভারতে প্রচলিত। সারা দেশে প্রচলিত হয় এমন উৎসব ------ দশেরা, দেওয়ালি এবং হোলি বা দোল । দশেরা ও দেওয়ালির মধ্যে উৎসব মনস্কতার চেয়ে ধর্মীয় অনুষঙ্গ অনেক বেশি থাকে। কিন্তু দোলে ধর্মীয় ভাবনা খুবই গৌণ, বেশিটাই উৎসব। সামাজিক দিক থেকে দেখলে, এটি একমাত্র সর্বজনীন সর্বভারতীয় উৎসব যাতে জাতি- ধর্ম- বর্ণ- সম্প্রদায়ের বিভেদটা আবিরের রঙে ঢাকা পড়ে যায়।
বাংলায় দোলে রাধা-কৃষ্ণকে আবির -গুলালে স্নান করিয়ে দোলনায় চড়িয়ে দোলমঞ্চ আনা হয় এবং প্রতি প্রহরে সাতবার, অর্থাৎ মোট একশো বার দোলানো হয়। তাই বাংলার বসন্ত উৎসব 'দোল' নামে খ্যাত।
প্রধানতঃ দুটি রঙের আবিরের প্রচলন বেশি দেখা যায় ----- লাল ও সবুজ। লাল দুরন্ত যৌবনের প্রতীক, সবুজ তারুণ্যের বাসন্তিক প্রতীক। তাই হোলি উৎসব তারুণ্য ও যৌবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।।