ফাঁসি=======সৌম্য ঘোষ====
ফাঁসি=======সৌম্য ঘোষ====
চারজন তাস খেলছে, গোল হয়ে বসে। কয়েকদিন ধরে একসাথে আছে তারা, সবাই সবার সাথে পরিচিত হয়ে গেছে। চারজনের নাম সাগর, জয়ন্ত, আয়েনুদ্দিন এবং জয়নাল। সবচেয়ে বয়স্ক আয়েনুদ্দিন, তার বয়স ৫৫। সবচেয়ে কম বয়সের জয়নাল, মাত্র ২৫। সাধারণত তাস খেলে সমবয়সী লোকজন, কিন্তু তারা এই নিয়ম মানছে না। তারা চারজন যেখানে বসে আছে, সেটাকে ইংরেজীতে বলে কন্ডেমন্ড সেল। ফাঁসির আসামীদেরকে এখানে এনে রাখা হয়, ফাঁসির আগে পর্যন্ত। তারা একেকজন ভয়ংকর অপরাধী, চারজনেরই ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হয়েছে, সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড। তারা প্রত্যেকে এজলাস কক্ষ থেকে শেষ যে লাইনটা শুনেছে তা হল, “ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা মোতাবেক তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হল।”
প্রত্যেকটি বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন জজ হেমন্ত সরখেল। তাঁর বয়স অনেক, এই হাতে কতজনের মৃত্যুপরোয়ানায় সাক্ষর করেছেন, বুক একটুও কাঁপেনি। অপরাধী সাজা পাবে, এটাই তো নিয়ম। এদের চারজনের বিচার আলাদা আলাদাভাবে হয়েছে, হত্যার দায়ে চারজনেরই ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন তিনি, মামলায় কোন ফাঁকি নেই। তবে সেদিন হেমন্ত সরখেলের মন ছিল খারাপ, খুবই খারাপ। কপালের ফের এমনই যে, চারটি কেসই উঠেছিল একই দিনে, তিনি পরপর চারজনের বেলায় একই কথা বলেছেন, এটা মনে কিছুটা ধাক্কা দেয় বৈকি। পৃথিবীতে দুজন মানুষ কখনো এক হয় না। কাজেই এই কথা শুনে চার আসামীর অভিব্যক্তি ভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। সাগর মৃত্যুদণ্ডাদেশ শুনে বিকট চিৎকার দিয়ে কাঠগড়াতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। জয়ন্ত বেশ শক্ত মানুষ, সে কিছু বলল না, শার্টের হাতায় চোখের জল মুছল। জয়নাল তার পাশে দাঁড়ানো পুলিশ সেন্ট্রিকে বলল, জল খাওয়াতে পারেন? এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল? সবচেয়ে অদ্ভুত আচরণ করেছে আয়েনুদ্দিন। যখন জজসাহেব তার শাস্তির কথা জানিয়ে ফাইল বন্ধ করেছেন, তখন কী মনে করে তার দিকে তাকালেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, হাসি হাসি মুখ করে আয়েনুদ্দিন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, কোন বিকার নেই। শীতল সেই হাসি দেখে কেন যেন অস্বস্তি হল মতিউর রহমানের, তিনি অন্যদিনের চেয়ে দ্রুতগতিতে এজলাসকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
কী এক কারণে এই চারজনের স্থান হল একই ঘরে, তারা বেশ খুশীই হয়েছে মনে হল। মামলা চলাকালীন তাদেরকে খুব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, জেলের কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে এমন আচরণ করতো যেন তারা এক একটা শুঁয়োপোকা। সামান্য যে সেন্ট্রি, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে, সেও তুই তোকারি করে কথা বলত। কিন্তু সেদিনের পর কেমন যেন বদলে গেল সবকিছু, ফাঁসির আসামীর সাথে ভালো আচরণ করার একটা অলিখিত নিয়ম আছে। লোকগুলো তো পৃথিবী ছেড়ে চলেই যাবে, মিছিমিছি আর খারাপ ব্যবহার কেন? ব্যাপারটা উপভোগ করছে তারা। এখন চাইলে সিগারেট পাওয়া যায়, ন্যাতন্যাতা বাজে সিগারেট নয়, দামী সিগারেট, দিনের মধ্যে কয়েকবার চাইলেও কোন ক্ষতি নেই। আর তাদের চৌদ্দশিকের সামনে অষ্টপ্রহর দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট্রিটা কেন যেন তুই ছেড়ে আপনিতে চলে এসেছে। তাসের প্যাকেট জোগাড় করা গেছে, এখন এটা তাদের বিনোদন হিসেবে চলছে।
তাদের ফাঁসি কবে কার্যকর করা হবে, তা এখনো জানানো হয় নি, ভালোই তো এই অনিশ্চয়তা। এক একদিন পার হয়, আর মনে হয়, যাক, আরও একটা দিন তো পাওয়া গেল। ক্যান্সার রোগীকে যখন জানিয়ে দেয়া হয়, তার সময় আর একমাস, তখন সেও কি এমনধারাই চিন্তা করে? তারা শেষ ক’টা দিন প্রাণপণে উপভোগ করে নিচ্ছে, কেউ বাধা দিচ্ছে না। লোকগুলো এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে, মনে হচ্ছে, জেলখানা হাসিতামাশারই জায়গা। নিতান্ত ভেঙে পড়া সগির আশ্চর্য দ্রুততায় নিজেকে সামলে নিয়েছে, এখন সে বাপের বয়সী আয়েনুদ্দিনের পার্টনার হয়ে তাস পিটছে। গোলামের বাড়ি দিল সে, টাস করে আওয়াজ হল।চুপচাপ খেলে না তারা, সেই সাথে ধূমপান করে আর সুখদুঃখের আলাপ করে। কয়েকদিনের মধ্যেই সবকিছু বলা হয়ে গেছে সবার, কিন্তু সেগুলোই বারেবারে রোমন্থন করা।
না, কোন সন্দেহ নেই যে তারা অপরাধী। সাগর কাজ করতো স’মিলে, কাঠ চেরাইয়ের কাজ। রাতে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরল, তখন ঘরে দেখল এক অচেনা লোকের সাথে বউ খুব হেসে হেসে গল্প করছে। মুহূর্তে মাথায় আগুন ধরে গেল, ঘরে না ঢুকে সে গেল একটা কিছু নিয়ে আসতে। যখন ফিরল, তার হাতে একটা মোটা বাঁশের লাঠি, আর সেই লোক বিদায় নিয়েছে। এক বাড়িতে বউয়ের মাথা দু’ফাঁক করে দিল সে। যখন গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্তে ঘর ভেসে গেছে, তখন তার রাগ পড়ে গেছে, হাত পা শীতল হয়ে এলো ভয়ে। এ কী করেছে সে? মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবল কী করা যায়, বস্তায় ভরে পুঁতে রাখল লাশ। ঘর ধুয়েমুছে সাফ করে রাখল, কেউ যাতে জানতে না পারে। প্রতিবেশীরা জিজ্ঞাসা করলো, সে বলেছিল বউ বাপের বাড়ি গেছে। যখন সে প্রায় নিশ্চিন্ত হয়ে এসেছিল, তখন এক রাতে বাড়িতে হানা দিল পুলিশ। কে জানে, কে পুলিশকে কী জানিয়েছে, কোন কথা না শুনে সোজা ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। তারা আজকাল কথা বের করার খুব সহজ এবং কার্যকরী পথ জানে, এমন ধোলাই দিল যে বাপবাপ করে সব বলে দিল সাগর, নাভির ওপরে রুলের গুঁতো খেয়ে পৃথিবীর এমন কেউ নেই যে কথা পেটের ভেতর রাখতে পারে, বস্তাবন্দী গলিত লাশ বেরিয়ে এলো দুদিনের মধ্যে। বউকে খুব ভালোবাসতো সে, “ভুল” করে ফেলেছে, এসব অর্থহীন কথা পুলিশ শুনল না।
জয়ন্তর ঘটনাও দাম্পত্য কলহের । তবে সে নিশ্চিত যে সে নির্দোষ, সব দোষ বউয়েরই। বিয়ের সময় শ্বশুর কথা দিয়েছিল তিন লাখ টাকা দেবে। বিয়ের সময়ই পুরোটা দেবার কথা, এটা সেটা বলে বুড়ো কথা ঘুরিয়েছে, পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র ধরিয়ে দিয়েছিল, বাকীটা এক মাসের মধ্যে দেবার কথা। বেশ ধৈর্য ধরেছে জয়ন্ত, একমাস বউকে একটা কথাও বলেনি সে। কিন্তু একমাসের জায়গায় যখন তিনমাস হয়ে গেল, তখনো বুড়ো বলতে লাগলো, ব্যবসার মুনাফার টাকা এখনো উঠে আসেনি, তখন আর সে সহ্য করতে পারেনি, কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল বউয়ের গায়ে। পুড়ে মর বেটি, দেখি টাকা নিয়ে তোর বাপ কোথায় যায়। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিল যে কাজটা খুব বোকামি হয়েছে, শক্ত মারধোর করাই যথেষ্ট ছিল। সীমা ছাড়ানো উচিৎ হয় নি। সীমা লঙ্ঘন করে সে ভুল করেছে। এর ফলাফল ভালো হয় না, জয়ন্তর ক্ষেত্রেও হয়নি। তবে সে কসম খেয়ে বলতে পারে, টাকাটা ঠিকমতো দিলে বউয়ের গায়ে একটা টোকাও দিত না সে, মাথায় তুলে রাখতো।
জয়নাল তরুণ ছেলে, লেখাপড়ায় মন্দ ছিল না, কিন্তু তার মতো বয়সীদের ধৈর্য থাকে কম, কীভাবে কম সময়ে উপরে উঠে যাওয়া যায় সেটাই থাকে চিন্তা। সেজন্যেই সে গেল রাজনীতিতে, প্রথমে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে হবে, ভার্সিটি ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করতে হবে। পৃথিবীতে কম পুঁজিতে বেশি লাভের দুটি ব্যবসা আছে, রাজনীতি এবং ভিক্ষাবৃত্তি। কিন্তু শিক্ষিত ছেলের কি আর ভিক্ষা করা মানায়? কাজেই রাজনীতি, একটি দলের ধামা ধরে বেশ দু’পয়সা কামানো। চমৎকারভাবে সে এগুচ্ছিল, কোন ফাঁকফোকর ছিল না। কিন্তু যেখানে ফাঁকফোকর থাকে না, সেখানেও কেমন করে যেন তৈরি হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে সেদিন নিজের দলের ছেলেরা টাল্টুবাজি করাতে একটু রগড়ে দিয়েছিল সে, অন্য কয়েকজনকে নিয়ে, সেজন্যে মনটাও ছিল খারাপ। গলাপর্যন্ত “জিনিস” গিলে যখন নিজের “পাওনা-বখরা” আদায় করতে সে এলাকার এক দোকানে গেল, হারামী দোকানদার চাঁদা দিতে চাইলো না। সেখান থেকে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি, নিজেও জানে না কখন দোকানদারের ভুঁড়ি হাতের বাঁকানো ছুরি দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আর বজ্জাত এলাকাবাসী কি অকৃতজ্ঞ, সবাইকে নামেমাত্র কিছু “ফি”-র বিনিময়ে প্রোটেকশন দিত সে, এলাকার মেয়েগুলোর দিকে তার দলের ছেলেরা ছাড়া আর কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারতো না, সেই জনগণই কিনা সাক্ষী দিল তার বিরুদ্ধে। মানুষের ওপর বিশ্বাসটাই উঠে গেল সেদিন। পাবলিক মানেই হারামীর একশেষ।
আয়েনুদ্দিন খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, উঁচুস্বরে কথা বলতো না। সে পয়সাওয়ালা লোক ছিল। ঘরে ছিল দুই বউ, কিন্তু ছেলেপুলে নেই। তার এতবড় ব্যবসা কে দেখবে? একটা বংশধর চাই তো। তাছাড়া ফুলমতি মেয়েটা দেখতে বড় সুন্দর ছিল, বয়স কম, নজর পড়েছিল তার, বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করে সে। ফুলমতির বাবা পঙ্গু, মেয়েকে এই বুড়োর কাছে বেঁচে দিয়ে যে পরিমাণ টাকা পাবেন, সেটা দিয়ে জীবনের শেষ কটাদিন রাজার হালে থাকতে পারবেন। ফুলমতি আর তার মা মোটেই রাজী ছিল না, তাতে কী এসে যায়? মেয়েছেলের আবার কথা কী? বাপ রাজী, কাজেই বিয়ে হয়েই যেত। কিন্তু বাদ সাধল আয়েনুদ্দিনের ঘরের লোক। দুই বউয়ের মধ্যে ছোটজন রাজী, কিন্তু বড়বউ আমেনা একেবারে বেঁকে বসলো, কান্নাকাটি করে একাকার করলো। দু’দুটো বিয়ে করেছে, মিনসের এখনো খায়েশ মিটে নি? কিছুতেই মত দেবে না সে, আর স্ত্রীর মত ছাড়া আরেকটা বিয়ে করতে গেলে ঝামেলা করবে, বোঝাই যাচ্ছে। আজকাল নারী নির্যাতন প্রতিরোধের নামে কীসব সমিতি যেন হয়েছে, তাদের কানে একবার খবর গেলে টেকা মুশকিল হবে, ঘাঘু লোকের ব্যাপার স্যাপার। যেমন ঘাঘু তেমনি গর্দানের রগগুলো ত্যাড়া, কিচ্ছু শুনতে চাইবে না। আয়েনুদ্দিন চেঁচামেচি করেনি। লুঙ্গি তুলে হাঁটু চুলকোতে চুলকোতে বলেছে, শোন বড় বউ, আমি আয়েনুদ্দিন, আমি চাইলে একটা মেয়েকে ঘর থেইকা তুইলা নিয়া আসতে পারি। কিন্তু সেইটা তো করতেছি না, নিকাহ করতে চাইতেছি। শরিয়তে চাইর বিবি পর্যন্ত গ্রহণ করা জায়েজ আছে, তোমার সতীন পর্যন্ত রাজী হইছে, তুমি না করতেছ কেন? আমি কথা দিতেছি, তোমার কোন অযত্ন হবে না। আমেনার এক কথা, বিয়ে করা যাবে না। অগত্যা হার্ড লাইনে যেতে হয় তাকে। খাবারে সেঁকো বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু বুড়ির এমন জীবনীশক্তি, সে বেঁচে ফিরে এলো হাসপাতাল থেকে। আয়েনুদ্দিনের সাথে ধানাইপানাই করে কেউ টিকতে পারে নি, আমেনাও পারলো না। এক রাতে আমেনাকে সরিয়ে দিল সে, খুব পাকা হাতের কাজ ছিল, গলা কেটে ফেলার সময় কেউ টেরও পায় নি, লাশ গাপ করে ফেলা গেল নিজের লোকজনকে দিয়ে। জবেহ করার কাজটা নিজেকেই করতে হল, কারণ আয়েনুদ্দিন দেখেছে, এসব কাজ নিজের হাতে না করলে প্রচুর ঝামেলা হয়। নোংরা কাজ করতে বরাবরই খারাপ লাগে তার, কিন্তু কী আর করা? আয়েনুদ্দিন কোনকিছু চেয়েছে আর পায় নি, তা আগে কখনো হয় নি, এবারেও হবে না।
আয়েনুদ্দিনের কোন কাজে কখনো ফাঁক থাকে না, কিন্তু এই কাজে কীভাবে যেন ফাঁক থেকে গেল। পুলিশ কীভাবে আঁচ করলো যে সে বউকে খুন করেছে, সেটা সে বুঝতেই পারলো না। সন্দেহ হয়েছিল ছোটবউকে, কিন্তু সে তো বিয়েতে রাজী ছিল। কিন্তু তার সন্দেহই যে সত্যি, তা এজলাসেই প্রমাণ হয়ে গেল, খুনের সাক্ষী দিল ছোট বউ। জীবনটা হইল একটা খেলা, বুঝলা মিয়ারা, টেক্কাটা ছাড়তে ছাড়তে বলল আয়েনুদ্দিন। খেলায় হারজিত আছে, এতে মন খারাপ করার কিছু নাই। আমি জীবনে সব খেলাতে জিতছি, শুধু এইখানে আইসা হাইরা গেলাম, শুধু হারা না, এক্কেবারে ন্যাংটা কইরা ছাইড়া দিল, হা হা হা। খক খক করে কাশা শুরু করলো সে।
রাত ন’টা। কয়েকদিন ধরেই ভালো খাবারদাবার পাওয়া যাচ্ছে, জেলের সাধারণ কয়েদীরা এই খাবার পায় না। তার ওপরে রাতে এসে জেলার সাহেব বললেন, আপনাদের স্পেশাল কিছু খেতে কি ইচ্ছে করছে? বলেন তো আনিয়ে দিই। মুখ শুকিয়ে গেল তিনজনের, আয়েনুদ্দিন ছাড়া। আয়েনুদ্দিন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ, সে সেলের শিক ধরে দাঁড়িয়ে আনন্দিত মুখে জিজ্ঞেস করলো, আইজকেই কি ঘটনা?
জেলার সাহেব মাথা নিচু করলেন, কিছু বললেন না।
কেউ কিছু খেতে চাইলো না, শুধু আয়েনুদ্দিন বলল, আমার কাঁচকলার তরকারী দিয়া শিংমাছ খাইতে ইচ্ছা করতাছে। খাওয়াইতে পারবেন?
অবশ্যই, বললেন জেলার সাহেব। একটু দেরী হবে, কিন্তু পারবো।
তাইলে ব্যবস্থা করেন। আইজ রাইতেই যখন ঘটনা তখন সুযোগ নিতে হয়। সুযোগ না নিয়া কোন ফায়দা নাই। আমেনা, আমার পরিবার, চিনতে পারছেন? সে এই তরকারীটা খুব ভালো রানতো। বেহেশতে গেলে সব খানা পাওয়া যাইব, কিন্তু আমি তো খুনী, আমি কি আর যাইতে পারমু? কাজেই শেষবার একবার “টেস” কইরা লওয়া উচিৎ। কী কও তোমরা?
বাকী তিনজন নির্বাক হয়ে গেছে, কোন কথা বলছে না।
সে রাতে শুধু আয়েনুদ্দিন খাবার খেলো, পেটপুরে সে ভাত খেলো কাঁচকলার তরকারী দিয়ে শিংমাছ। বাকি তিনজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, খবর পাওয়ার পর থেকে তারা বিশেষ নড়াচড়া করছে না। মধ্যরাতে এক পন্ডিত ও এক মাওলানা এলেন তাদের সেলে। মাওলানা সাহেবের পাঞ্জাবিটা ধবধবে সাদা, হাতে তসবিহ। যখন মাওলানা সাহেব বিদায় নিতে যাচ্ছেন, তখন আয়েনুদ্দিন বলে উঠলো, একটা প্রশ্ন ছিল মাওলানা সাব।
ফিরে তাকালেন তিনি, বলুন।
তওবা তো করলাম, এখন কি বেহেশতে দাখিল হইতে পারবো? আমার পরিবার একটা তরকারী খুব ভাল রান্না করতো, সেইটা আরেকবার খাইতে মন চায়।
মাওলানা সাহেব কিছু বললেন না, তসবিহ টিপতে লাগলেন। সবাই দেখল, তাঁর কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
রাত শেষ হয়ে এসেছে, তখন একজন এসে বলল, চলেন, যেতে হবে। উচ্চস্বরে কান্না জুড়ে দিল সাগর, অস্থির হয়ে পড়লো। জয়ন্ত ও জয়নাল চোখ মুছছে, কিছু বলল না। শুধু আগ্রহ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আয়েনুদ্দিন, মনে হল, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে যাওয়া অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।
অজু করে নেন, বলল একজন সেন্ট্রি।
ক্যান, অজু করবো ক্যান? আমরা কি নামাজ পড়তে যাইতাছি? আমরা তো ফাঁসি নিতে যাইতাছি। পায়ের তলার জমিন ফাঁক হইয়া যাইব, ঝুইলা পরুম, ঘাড়টা মট কইরা ভাইঙ্গা যাইব, ঘটনা শ্যাষ।
পাশাপাশি চারটা ফাঁসিকাষ্ঠ, সবগুলো রেডি করে রাখা হয়েছে; সাধারণত একসাথে একাধিক ফাঁসি দেয়া হয় না, কিন্তু আজ ব্যতিক্রম, চারজনেরই একসাথে ফাঁসি হবে। ফজরের আজানের সময় হয়ে গেছে, সুবহে সাদেকের সাদা আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। চারজন এগিয়ে চলেছে নিজেদের শেষ গন্তব্যের দিকে। তিনজন চুপ হয়ে গেছে, একে একে মাথায় কালো কাপড় পরিয়ে দেয়া হল। এই অবস্থাতেও আয়েনুদ্দিন অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। আরে, এইসব আবার কীরকম তামাশা? মাথায় কালো কাপড় দেয়া লাগব ক্যান? আর এই জিনিসটায় কী বিটকেল গন্ধ! সস্তার তিন অবস্থা, বুঝলেন জেলার সাব। ঘাড়ের কাছে কুটকুট করতাছে, একটু চুলকাইয়া দিবেন কেউ? চুলকানি নিয়া মরা বড়ই আফসোসের বিষয়। কড়া ধমক দিতে যাচ্ছিলেন পুলিশ সুপার । হাত নেড়ে তাকে থামালেন জেলার । কী লাভ?
ভোর চারটা আট মিনিটে পুলিশ সুপারের হাত থেকে সাদা রুমালটা পড়ে গেল, কাঠের পাটাতন ফাঁক হয়ে নিচে চলে গেল চারজনের দেহ, পেন্ডুলামের মতো দুলছে। কেউ কোন শব্দ করলো না, তবে আয়েনুদ্দিন কথা বলে চলছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। “আমার অনেক সম্পত্তি ছিল, বুঝলেন জেলার সাহেব, সেইটা হাত করার জন্য ছোট বউ আমারে ফাঁসাইছে। আমি ওরে ছাড়তাছি না, আমার ভূত আইসা ওরে খাইবো। মচমচ কইরা চিবাইয়া খাইবো। আহারে, বড় বউটা বড় ভাল ছিল, ক্যান যে ঘটনাটা ঘটাইলাম। বড় বউয়ের সাথে ছোটবউয়ের কোন তুলনাই চলে না, শেখ সাদী আর ছাগলের নাদি। ফুলমতি মাইয়াটাও তো আসলে ভালা না, পাড়ার পোলাপাইনের লগে রংঢং করতো, আর সে কি আর ঐ তরকারী রানতে পারবো, আপনেই বিবেচনা কইরা কন? নারীজাতি সর্বনাশী, হক কথা কইছি না? পিশাব জমছে, দুই মিনিট কি সময় দেওয়া যায় জেলার সাব? যামু আর আসমু, কোন ধানাইপানাই না.. আয়েনুদ্দিনের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। পুলিশ সুপার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সবগুলো ফাঁসিই তাঁকে দেখতে হয়, তাঁর ভালো লাগে না। পুলিশের চাকরি, উপায় কী?
জজ হেমন্ত সরখেল সাহেবের ইনসমনিয়া আছে, রাতে ঘুম হয় না। প্রচুর ড্রিংক করলে শেষরাতের দিকে একটু ঝিমুনি আসে, সেটাই আনার চেষ্টা করছেন। ছাইপাশ খেতে মানা করে তাঁর মেয়ে, কিন্তু ড্রিংক না করলে নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে। আজকে কয় তারিখ? ক্যালেন্ডার দেখলেন, দশ তারিখ। আজ শেষরাতেই না ঐ চারজনের ফাঁসি কার্যকর করার কথা? হুইস্কির গ্লাসে বরফের টুকরো চামচ দিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন, ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছে। অনেকদিন পর আজ ঘুম পাচ্ছে। আইস কিউবটা গ্লাসে দেয়া হল না, ঘুমোনোর জন্য বিছানায় রওনা হলেন তিনি। ঘড়ি দেখলেন। চারটা বেজে আট মিনিট।
সকাল হয়েছে বহুক্ষণ, বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেন তিনি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ দেখছেন, আজ তাঁকে যেতে হবে না, আজ ছুটি। তাঁর মেয়ে মৌমিতা এসে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরল, একমাত্র সন্তান তাঁর। ভার্সিটিতে পড়ে, ওরও আজ ছুটি।
বাবা, আজ কিন্তু আমি রান্না করবো। প্রথম রান্না, কাজেই খেয়ে ওয়াক ওয়াক করতে পারবে না কিন্তু আগেই বলে রাখলাম।
বেশ তো, করবি। কী রান্না করছিস?
নতুন একটা কারির প্রিপারেশন শিখেছি, ওটা দিয়েই শুরু করছি। কাঁচকলা দিয়ে শিংমাছের কারি, চমৎকার হবে না?
