arijit bhattacharya

Romance

3  

arijit bhattacharya

Romance

গড়িয়াহাটের সেই মেয়েটা

গড়িয়াহাটের সেই মেয়েটা

4 mins
900


সেদিনের দিনটা আজও চোখের পাতায় ভাসে। অমূল্য রত্ন হিসাবে সঞ্চিত আছে মনের মণিকোঠায়। তেরো বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। মামার বিয়ে ছিল গড়িয়াহাটে। আগের দিন থেকেই তোড়জোড়,আয়োজন ,উত্তেজনা। প্রথম থেকেই আমার যাওয়ায় বাধ সাধছিলেন মা। পনেরো দিন পরেই পরীক্ষা ছিল। তার জন্যই এতো বাধানিষেধ,কোথাও বেরনো যাবে না,কিছু করা যাবে না,মশলাদার কিছু খাওয়া যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু,দাদুও অনড় ছিলেন। দাদু বললেন,পরীক্ষা তো কি হয়েছে,ও জয় ঠিক সামলে নেবে! কোনো অসুবিধা হবে না। একদিনের তো ব্যাপার। আমি না হয় জয়কে নিয়ে সেই রাতেই ফিরে আসব। যাই হোক,মামাবাড়িতে দাদুর কথাতেই সব হত। তিনিই ছিলেন বলতে গেলে সর্বময় কর্তা। তাই তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস কারোর হয় নি।

যাই হোক,তখন সময়টাই বিয়ের সিজন। চারদিকেই সানাই বাজছে। সকালেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বারাসতের নবপল্লীতে মামার বাড়িতে। গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতিতে মামাকে সত্যিই অপূর্ব লাগছে। দাদুর সাথে ফোনে নিয়মিত কথা হলেও অনেকদিন পরে সাক্ষাৎ হল। প্রথমেই দাদু একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,"কি দাদুভাই,কেমন আছিস বল! কতো বড়ো হয়ে গেছিস!" আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই উনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

তখন দাদুর আটান্নো-উনষাট। এককালে মিলিটারিতে কাজ করতেন,দেরাদুন আর খাডাকসালাতে পোস্টিং ছিলেন অনেকটা সময়। দাদুর সাথে দেখতে দেখতেই শুরু হয়ে গেল আর্মির অভিজ্ঞতা শেয়ারিং আর গল্প।

আমার বয়স তখন আট-নয়,তখন থেকেই আমি পাহাড় প্রেমিক। দুর্গম পাহাড় আর গিরিপথের কতো শত গল্প। কতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।তখনই ঠিক হয়ে গেল দাদুর সাথে পরের বছর আমি দেরাদুন আর নৈনিতাল যাচ্ছি। যদিও সেই আশা এখনোও পূর্ণ হয় নি।

গল্প করতে করতেই দুপুরের খাবারের সময় এসে গেল। একদিকে চিংড়ির মালাইকারি ,বেনারসী চালের ভাত আর খাসির মাংস কষা খেয়ে দাদুর সাথে এসে বসলাম উত্তরের ছাদে। তখন সময়টা শীতকাল। বরযাত্রীর বাস আসবে বিকালে।।জোরে উত্তুরে হাওয়া বইছে। মাথার ওপর নীলাকাশ। দাদু শোনাতে শুরু করলেন খারদুংলা আর রোটাং পাসের গল্প। তারপর অরুণাচলের কতো অভিজ্ঞতা। অরুণাচলের ক্যাম্পে দাদু যখন পোস্টেড ছিলেন ,তখনই নাকি মামার জন্ম হয়েছিল। দাদু বলছিলেন,সাঙ্গেতসার লেকের অপূর্ব সৌন্দর্য একবার যে দেখেছে,সে ঐ অনুপম অপার্থিব সৌন্দর্যকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। পৃথিবীর বুকে যেন একচিলতে স্বর্গ নেমে এসেছে।যাই হোক,গল্প করতে করতে কখন আর কিভাবে যে বিকেল হয়ে গেল বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। 

আমরা নীচে নেমে আসলাম। সুন্দর সাজপোষাকে অতিথি ও আত্মীয়-আত্মীয়া এবং প্রতিবেশী-প্রতিবেশিনীদের আগমনে সারা বাড়ি জমজমাট। হইচই,হট্টগোল, বাদ্যযন্ত্র বাজছে,কোথাও কফি পরিবেশন করা হচ্ছে। কোথাও বা তত্ত্বের আয়োজনে সবাই ব্যস্ত!

যাই হোক,বরযাত্রীদের বাস এল। আমি আর দাদু পাশাপাশি বসলাম। মধ্যমগ্রাম চৌমাথা পার হতেই জ্যাম আর জ্যাম। চারদিকে বিয়ের গাড়ি।কোথাও বাস,কোথাও ফুল দিয়ে সাজানো দুধরঙা অ্যাম্বাসাডর। কোনোরকমে হেলতে দুলতে দোলতলা , বিরাটি,এয়ারপোর্ট পার করে গাড়ি এসে পড়ল ভি আই পি রোডে। সেখানে গতি বাড়ার সাথে আমরাও স্বাচ্ছন্দ্য ফিল করলাম । জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে,শীতকাল। আমার আবার জানলার ধারে বসে চলন্ত বাস বা ট্রেনে হাওয়া খেতে খুব ইচ্ছে করে। দাদু যতবারই দরজা বা জানলার কাঁচ বন্ধ করে দেবার আকুতি করছে,আমার একটাই উত্তর-"না!" আর দাদু আমাকে এমনিই বকেন না,আমিও পেয়ে বসেছি। ছোটবেলার মজাই আলাদা। তারপর সবে বয়ঃসন্ধিকাল দরজায় কড়া নাড়ছে। অ্যাড্রিনালিন ক্ষরিত হব হব করছে! মন এমনিতেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ। গতি নিয়ে বাস ছুটছে ভি আই পি রোড দিয়ে। আমিও কিশোরের নতুন চোখে দেখছি কোলকাতা মহানগরীকে।

যাই হোক,আটটা নাগাদ পৌঁছলাম গড়িয়াহাট। নানাবিধ পুষ্পে আর আলোকসজ্জা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে মন্ডপ। আর সামনেই বরযাত্রীদের আপ্যায়নরত কন্যাযাত্রীদের মধ্যেই দেখেছিলাম আমার কিশোরী হৃদয়হারিণীকে। মাথায় একরাশ কালো কোঁকড়ানো চুল, শুভ্রধবল দন্তবিকাশে সুহাস্য মুখমণ্ডলে পূর্ণচন্দ্রের শোভা বিরাজিত, নীলরঙা শাড়িতে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে কোনো অপ্সরা নেমে এসেছে। 

বরযাত্রীরা কন্যাযাত্রীদের গোলাপ দিয়ে আপ্যায়ন করছিল।একগাল মন কেড়ে নেওয়া হাসি হেসে আমাকে একটা লালরঙা গোলাপ দিতেই এক অসাধারণ অনুভূতি জেগে উঠল আমার মনে। গোলাপ মানেই মৈত্রী,গোলাপ মানেই ভালোবাসা, আর গোলাপ মানেই প্রেম। ওর হাতের নরম পরশেই হোক,বা ওর মন কেড়ে নেওয়া হাসির জন্যই হোক বা প্রেমের প্রতীক গোলাপের জন্যই হোক , আমার হৃদয়ে বেজে উঠেছিল জলতরঙ্গের মূর্ছনা,কতো নাম না জানা সুরলহরী।

পরে কফি আর পকোড়া খাওয়ার পর ছোটমামা আলাপ করে দিয়েছিলেন ওর সাথে। আমার হবু মামীর ভাইঝি। একগাল হেসে ও বলেছিল,"আমার নাম নীলাঞ্জনা। তুই 'নীলু' বলে ডাকতেই পারিস।"  


নীলাঞ্জনা। নচিকেতার কবিতার মতো না হলেও,মহানগরের বুকে সেদিন আমার কৈশোরকে একরাশ ভালোলাগা,একরাশ মুক্তির স্বাদ,হৃদয়ে জেগে ওঠা সুরলহরীর অনুভূতি দিয়ে গেছিল একজন কিশোরী। 

আমি চিরকালই খেতে ভালোবাসি। সেদিন যেমন জিভে জল আনা নানাবিধ আইটেম দিয়ে পেট পুরে খেয়েছিলাম,তেমনই নীলাঞ্জনার সাথে বন্ধুত্ব ছিল বাড়তি পাওনা। সেদিন বিয়ের মন্ডপে পরিচয় আর আলাপ থেকে শুরু করে অনেক কথা হয়েছিল দুই সদ্য কিশোর আর সদ্য কিশোরীর মধ্যে। কবিরা বলেন,অনেক সময়ে প্রথম দর্শনেই ভালোবাসা হয়। এই কথাটি নিয়ে অনেকে সন্দিহান হলেও সেদিনকে কিছুটা তো মন দেওয়া নেওয়া হয়েইছিল। ওর বলা প্রত্যেকটা শব্দ,ওর কন্ঠস্বর আমার মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় ও বলে উঠেছিল,"আবার আসিস কিন্তু আমাদের বাড়ি।"


এরপর কেটে গেছে অনেক দিন। মহানগরের বুকে কেটে গেছে অনেক বছর। এখন আমিও মহানগরের বাসিন্দা। কিন্তু ওর আর আমার বন্ধুত্ব,অন্তরঙ্গতা,প্রেম আজও অটুট। এটাই তো 'লাভ অ্যাট দ্য ফার্স্ট সাইট!"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance