Manasi Ganguli

Romance Classics Inspirational

4  

Manasi Ganguli

Romance Classics Inspirational

গর্ব খর্ব

গর্ব খর্ব

4 mins
244



   আজ আবার সুমিতের অফিসের পার্টি। কি যে বাজে লাগে অঞ্জনার। এসব একদম ভাল লাগে না,ওর রুচির সাথে একেবারে মেলে না। কিন্তু যেতেই হয় বাধ্য হয়ে।কারো সাথে না মিললেও কথা বলতেই হয় সবার সাথে,না বললে আবার সবাই বলবে 'অহংকারী', তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে দেঁতো হাসি হেসে কথা বলতে হয় সবার সাথে। কিন্তু এদের সাথে কি কথা যে বলবে ভেবে পায় না,কারণ রুচিজ্ঞান বলে বস্তুটা এদের মধ্যে যদি একটুও থাকে। খালি রেষারেষি,সামনাসামনি এমন হাসাহাসি,দেখা হলেই জড়িয়ে ধরা,মনে হয় কতই ভালবাসাবাসি এদের মধ্যে,অথচ কিছু পরেই দেখা যাবে তারই বিরুদ্ধে অন্যের কানে বিষ ঢালছে এরা। এ এক বিচিত্র সমাজ।

    কার শাড়ীটা কত দামী,ঋতুকুমার না অগ্নিমিত্রা পল,নাকি সব্যসাচী,কে হাসব্যান্ডের জন্য পূজোয় শর্বরী দত্তের ডিজাইন করা পোশাক কিনেছে,কার কি গাড়ী, কে নতুন কি গাড়ী নিল,কে কি মোবাইল ব্যবহার করে শোনাতেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে জুতো,কারটা কোন ব্র‍্যান্ডের এসবই মুখ্য আলোচ্য বিষয়। এছাড়া পরনিন্দা,পরচর্চা হল এদের মুখোরোচক খাদ্য, যেন গোগ্রাসে গেলে সবাই,ভাবে না একবারও যে নিজেরাও ওরা চর্চার বিষয়বস্তু একেকজন।

   এবারের পার্টিতে মিসেস নন্দীর নতুন চমক,পূজোয় সাউথ আফ্রিকা ঘুরতে যাচ্ছেন সপরিবারে। প্রতি পার্টিতেই ওনার নতুন চমক থাকে,সবাই অধীর অপেক্ষায় থাকে ওনার চমকের জন্য। আর কোনো পার্টিতে গয়না রিপিট করেন না,নতুন গয়নায় গা সাজান। কত সেট হিরের গয়না যে ওনার আছে,শুধু হিরের,হিরে-চুনী মেলানো, হিরে পান্না,সলিটেয়ার ওয়ান লাইনার,টু লাইনার। অলংকারই ওনার অহংকার। ওনার সাথে পাল্লা দিতে চেষ্টা করেন মিসেস দত্ত কিন্তু ঠিক পেরে ওঠেন না।

   অঞ্জনা ভাবে,এত রয়েছে এদের তবু সন্তুষ্টি নেই,আরো চাই,আরো চাই,অন্যের আছে আমার নেই সে চলবে না,এই হল মানসিকতা। কারো একবারের জন্যও মনে হয় না,পথে কত দরিদ্র শিশু পুজোয় ছেঁড়া জামা পড়ে ঘুরে বেড়াবে,তাদের জন্য কিছু করি,বন্যায় কত মানুষ গৃহহারা,ঘরছাড়া,তাদের জন্য কিছু করি বা নিদেন পক্ষে কোনো ভাল বই পড়ে তার সমালোচনা বা ভাল গানের কথা। তা না,ইংলিশ গান না শুনলে এনাদের আবার জাত থাকে না। এরা বেশীর ভাগই কিন্তু অতিসাধারণ মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা,অর্থাৎ কিনা হঠাৎ করে পয়সা দেখা,আভিজাত্যের বালাই নেই।

   সুমিত জানে অঞ্জনা এসব ভালবাসে না,কেবল সুমিতের মুখ চেয়ে সে আসে। পার্টি থাকলে সুমিত অঞ্জনাকে শাড়ীর দোকানে নিয়ে যেতে চায় নতুন শাড়ী কিনতে,অঞ্জনা কিছুতেই নেবে না,ও আসলে একটু অন্যরকম,অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা,শাড়ী গয়না এসবে একদম লোভ নেই,তার থেকে একটা ভাল বই পেলে ও খুশী হয়। সুমিত জিজ্ঞেস করে,"তোমার নিজেকে হেয় মনে হয় না? সবাই কত নতুন নতুন সেজে আসে আর তুমি পুরনো শাড়ী পরে পরে যাও"।অঞ্জনা বলে,"এক দু'বার পরলেই কি শাড়ী পুরনো হয়ে যায় নাকি?" আর ভাবে মনে মনে,শাড়ী যে কার গায়ে কতক্ষণ থাকে! শুরু থেকেই তো হার্ড ড্রিংকস হাতে সব মহিলারা হা হা,হি হি করতে করতে আঁচল খসে পড়ে, অনেক পুরুষই নেশামাখা রঙিন চোখে তখন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়,আর সেইসব মহিলারাও তাদের দৈহিক সম্পদের জন্য অহংকার বোধ করে,ইচ্ছাকৃত প্রশ্রয়ে আঁচল আর জায়গামত ফেরে না। অঞ্জনা একটা সফট ড্রিংক হাতে বসে এসব দেখে আর ওর গা ঘিনঘিন করে।

  এইভাবে পার্টি জমতে থাকে। ডান্স ফ্লোরে গিয়ে কেউ ডাকলে তো যেতেই হয়,এদিন যে কোনো বাছবিচার থাকে না। কে কার বউ তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, প্রায় সবার মাঝেই ছোঁকছোঁকানি,একটু বেলেল্লাপনা করার জন্য। ডান্সের নামে কোমর জড়িয়ে ধরার সুযোগ, খামচে ধরছে কেউ কেউ,কেউ বা নেশার ঘোরে পরস্ত্রীর বুকের ওপর ঢলে পড়ছে,আর তিনিও সস্নেহে তাঁকে বলছেন,"ইউ নটি বয়", কারো ঠোঁট নেমে আসছে উন্মুখ ঠোঁটের পরে,ডান্স ফ্লোরের ডিম আলোয় যে যার মত উপভোগ করে নিচ্ছে। আপন জগত সংসার ভুলে সবাই তখন অন্য জগতে,অন্য নেশায় বুঁদ।

      সুমিত অবশ্য ড্রিংক করলেও মাতাল হয় না বা,ডান্স ফ্লোরেও যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে,পড়াশুনোয় ভাল ছিল বলে আজ MNC তে উচ্চপদে চাকরী করে,ওর নিজেরও রুচি একটু আলাদা যেটা অঞ্জনার সাথে ভালই মেলে। দু'জনেই ভাল বই পড়তে,গান শুনতে ভালবাসে আর অঞ্জনা তো কলেজে পড়ায়,পড়াশুনাই ওর ধ্যানজ্ঞান। অঞ্জনার বাবাও বিশিষ্ট অধ্যাপক ছিলেন,ইউনিভার্সিটি থেকে বহুবার ওনাকে বিদেশ পাঠানো হয়েছে সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে ওয়ার্কশপ করার জন্য,সে নিয়ে অঞ্জনা কখনো কারো সাথে গসিপ করে না,যতই এরা মেয়ে হানিমুনে লন্ডন গেল,ছেলে আমেরিকায় চাকরী নিয়ে গেল বলে অহংকার করুক। এদের সাথে রেষারেষি করতে ওর রুচিতে বাধে। এমনকি সুমিত বিদেশে বেড়াতে যাবার কথা তুললে অঞ্জনা বলে,"নিজের দেশকেই ভাল করে দেখা হল না,কত জায়গা যাওয়া হয়নি,আগে নিজের দেশটা পুরোপুরি দেখি ভাল করে,তারপর বিদেশ যাবার কথা ভাবব।"

   এবারের পার্টির আগে সুমিত অঞ্জনাকে জিজ্ঞেস করে,"তোমার ইচ্ছে করে না মিসেস নন্দীর মত হিরের আলোয় ঝলমলিয়ে,এক গা অহংকার মেখে পার্টিতে যেতে? অতটা দিতে না পারলেও একটু আধটু তো দিতে পারি,কিন্তু তুমি যে রাজীই হও না।" অঞ্জনা বলে,"তুমি শুধু এমনিভাবে ভালবেসে যেও সারাজীবন,আর আমি কিছু চাই না। মিসেস নন্দী হিরে ঝলমলিয়ে মি.দাসের গায়ে ঢলে পড়ছেন,মি.নন্দী মিসেস কুমারের বুকের ওপর ঢলে পড়ছেন,এই যদি ওনাদের খুশী হয় হোক, আমি এমন খুশী চাই না।" তারপর সুমিতের অন্তরঙ্গ হয়ে এসে হেসে হেসে বলে,"কিছু আমি চাই না,এ আমার অহংকার "।

   এর কিছুদিন পর অফিসের অডিট হলে প্রচুর টাকার গরমিল ধরা পড়ে,চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার মি.অমিত নন্দী যার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। অতবড় MNC তে CFO হিসাবে চাকুরীসূত্রে মি.নন্দীর মাইনে নেহাত কম নয় কিন্তু তাঁর স্ত্রীর অহংকারের চাহিদা মেটানোর পক্ষেও যথেষ্ট নয়,তাই এটাই তাঁর কাছে সহজ পথ ছিল। মিসেস নন্দী তাঁর অহংকার গায়ে জড়িয়ে স্বামীকে হাজতে পাঠালেন।

  সুমিত ভাবে, অঞ্জনার অহংকারই উৎকৃষ্ট, অনেক দামী,এমন অহংকার কটা মেয়ে করতে পারে!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance