গোপালের মা
গোপালের মা
প্রতি বারের মতো এবারেও জন্মাষ্টমীর পুজো হচ্ছে মৈত্রবাড়িতে। মৈত্র গিন্নী বড় ব্যস্ত আজ। ভোগ রান্না এইমাত্র শেষ হল। পুজোর কাজ বাকি এখনও। খিচুড়ি, ভাজা, আলুরদম, পায়েস, মালপোয়া, অনেককিছুই করেছেন ।তবুও একটু খুঁতখুঁত করছেন মৈত্রগিন্নী। তালের বড়াটা তো হলো না ।সুমি বলে, "ছাড়ো তো মা। অতই যদি খারাপ লাগে, দোকান থেকে আনিয়ে নাও না।" আঁতকে ওঠেন মৈত্র গিন্নী, "ওরে, না রে না। দোকানের ওই ঢিলের মতো ময়দার বড়া, তাল, নারকোলের নাম গন্ধ নেই। ও আমি দিতে পারব না গোপালের ভোগে। অন্যান্য বার বৌমা অনেক সাহায্য করে দেয়। এবারে আর পারেনি। ভরা মাস চলছে বৌটার ।যখন তখন ব্যথা উঠবে। ওকে দিয়ে কোনো কাজই করানো যাবে না। কি আর হবে! থাক না হয় এবারটা। "
হাত পা ধুয়ে পুজোর ঘরে এলেন মৈত্র গিন্নী। এখনও আলপনা দেওয়া বাকি।" ওরে ও সুমি, আলপনা টা একটু দিয়ে দে না মা "। সুমি কে আলপনা দেওয়ার কথা বলে নিজে ফল কাটতে বসলেন মৈত্র গিন্নী। সময় আর বেশি নেই। ঠাকুরমশাই এলেন বলে।
নৈবেদ্য সাজানো প্রায় শেষ। দরজায় একটা আওয়াজ হল। ওই, ঠাকুরমশাই এলেন বোধহয় ।মুখ তুলে তাকালেন মৈত্র গিন্নী।
"কই গো! গোপালের পুজো করছো নাকি তোমরা"?
কোথায় ঠাকুরমশাই! পুজোর ঘরে অচেনা বৌটাকে দেখে বেশ অবাক হলেন মৈত্র গিন্নী । "তুমি কে মা? তোমায় তো চিনলাম না"!
"আমি গোপালের মা গো। টুসুদের বাড়িতে নতুন ভাড়া এসেছি । শুনলাম তোমাদের বাড়িতে গোপালের পুজো হচ্ছে। তাই ভাবলাম, যাই, একটু পুজো দিয়ে আসি। এই নাও, কটা তালের বড়া ভেজেছিলাম । নৈবেদ্যের থালায় সাজিয়ে দাও দেখি "। একটা জামবাটি নৈবেদ্যের থালার পাশে রাখল বৌটা। মুখে মিটিমিটি হাসি । হঠাৎ একটা বছর দশকের ছেলে লাফাতে লাফাতে ঢুকল ঘরে," ওমা, তুমি এখানে! আমি তো তোমায় খুঁজছি। চলো, খিদে পেয়েছে তো। খেতে দেবে না! " কথা বলতে বলতে তালের বড়ার বাটিতে নজর পড়ল ছেলেটার। লোভাতুর দৃষ্টি তে বাটি টা দেখতে দেখতে বলল, "তা আ লের বড়াআ! আমার জন্যে!" চটপট হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। মৈত্র গিন্নী অবাক হয়ে দেখছিলেন ছেলেটাকে। গায়ের রং বেশ কালো। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। মুখখানা খুব মিষ্টি। দেখলেই মনে হয়, কাছে ডেকে একটু আদর করি। মায়ের ধমক খেয়ে ততক্ষণে উঠে পড়েছে ছেলেটা। মৈত্র গিন্নী সস্নেহে বললেন," পুজো হোক। তার পরে প্রসাদ খেও। তা হ্যাঁ গো গোপালের মা! এই বুঝি তোমার গোপাল! ভারি মিষ্টি ছেলে কিন্তু"।
"হ্যাঁ দিদি। ওই তো আমার সব। তবে ওকে আমি জন্ম দিইনি। আমি ছিলাম মৃত বৎসা। প্রতিবার মরা বাচ্চা জন্মাত আমার। তারপর গোপালকে দত্তক নিই আমরা" । অবাক হয়ে শুনছিলেন মৈত্র গিন্নী।
পুজো শুরু হল। মায়ে পোয়ে সারাক্ষণ বসে পুজো দেখল। পুজো শেষ হতে চলে গেল ওরা। যাবার সময় বৌটা বলে গেল," ও দিদি, আমি আসছি গো। একটু পরে এসে প্রসাদ নিয়ে যাব।"
সবাই প্রসাদ নিয়ে গেল। কই! গোপালের মা তো এল না এখনও । দুটো থালায় যত্ন করে ভোগ প্রসাদ সাজালেন মৈত্রগিন্নী । থালা দুটো নিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লেন। এখনও জলটুকু মুখে দেননি। খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না তাতে।
টুসুদের বাড়িতে গিয়ে ডাকলেন মৈত্র গিন্নী। দরজা খুলল টুসুর মা। "এই নাও বৌ, একটু প্রসাদ নিয়ে এলাম তোমাদের জন্যে। আর গোপালের মা কে একটু ডেকে দাও তো। ওদের জন্যেও একটু প্রসাদ এনেছি।" টুসুর মা অবাক। "কোন গোপালের মায়ের কথা বলছেন মাসিমা?"
"আরে, তোমাদের নতুন ভাড়টে গো"।
"কই! কেউ ভাড়া আসেনি তো আমাদের বাড়িতে!"
প্রসাদ দিতে গিয়ে ফিরে এলেন মৈত্র গিন্নী । এই ঘটনার কথা জানালেন না কারোকে । বাড়ির সকলকে প্রসাদ খেতে দিয়ে নিজেও এইবার একটু জল খেলেন। সারাদিন উপোষের পর ভারি কিছু আর খাওয়া যাবে না। ওই জল মিষ্টি খেয়েই রাতটা কাটিয়ে দেবেন ভাবলেন। রাত দশটা নাগাদ আচমকা ব্যথা উঠল বৌমার ।ছুটোছুটি পড়ে গেল বাড়িতে। হাসপাতালে নিয়ে যাবার ঘন্টা চারেকের মধ্যেই খবর এল, এবাড়িতে গোপাল এসেছে । গায়ের রংটা বেশ কালো ।এ বাড়ির সবার মতো অত ফরসা নয়। তবে মায়ে পোয়ে দিব্য আছে। মৈত্রগিন্নী দুহাত জোড় করে প্রণাম জানালেন গোপালের উদ্দেশ্যে।