Sayantani Palmal

Inspirational Others

3  

Sayantani Palmal

Inspirational Others

ঘর

ঘর

6 mins
196



 " পটা, আরেকটা বোতল দে।" হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল সুভাষ।

" তুই ঘর যা এবার।" হাত নেড়ে বলল পটা।

" ঘর? আমার তো ঘর নাই।" স্খলিত স্বরে বলল সুভাষ।

" ফালতু বকিসনি!"

" চারটা দেয়াল আর মাথার উপর ছাদ হলেই ঘর হয়? ফুহ! শালা তোর ঘর আছে তুই যা।" সুভাষ নিজের শরীরটাকে বেঞ্চের ওপর এলিয়ে দেয়।

" আমার ঘর আছে। আমি ঘর যাবো তাই জন্নে দকানটা বন্দ করতে হবে।"

সুভাষকে ঠেলে দোকান থেকে বের করে পটা। টলতে টলতে রাস্তায় নামা সুভাষের দিকে একবার তাকায় পটা। এমন বউ সোহাগী পুরুষ জীবনে দেখেনি সে। বউ অন্য লোকের সাথে পালালো আর সেই দুঃখে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। তার বউ এমনি করলে সে ঝট করে আরেকটা বউ ঘরে আনতো।





  " বর কই? আমার বর কই?" আপন মনেই বিড়বিড় করছে পাগলীটা। তার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি কারুর সন্ধান করছে। চোখের সামনে আবছা জলছবির মতো ভেসে উঠছে একটা বিস্তৃত রোমশ বুক, অনুভবে এখনও দুটো কালো বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোর, ঠোঁটে আজও ক্ষতবিক্ষত চুম্বনের অনুভূতি। রাতের অন্ধকারে তার জট পাকিয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক তো ঠিক করে মানুষটাকে চিনতে পারে নি। শুধু এটুকু মনে আছে, সে বলেছিল আমি তোর বর। কাছে আয় আমার।

 হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল পাগলীটা। তার এই কান্নার আওয়াজ বিপুল চেনে। 

" এই পিন্টু, পাগলীটাকে খেতে দে। খিদায় কাঁদচে।" বিপুলের খাবারের দোকান। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কাউকে ছাড়ে না। খাবারের আশায় দোকানের সামনে বসে থাকে পাগলীটা। বছর দুই আগে হঠাৎ করেই এই অল্প বয়সী পাগলীটা এখানে এসেছিল। দেখতে শুনতে বেশ ভালোই ছিল। অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে বিপুলের ধারণা হয়েছিল যে বাপ-মা মরা মেয়ে। কাকার সংসারে খুবই অত্যাচারিত হত। বিয়ে নিয়ে বোধহয় কিছু গন্ডগোল হয়েছিল। সবই বিপুলের অনুমান। পাগলীর কথা থেকে তো পরিস্কার কিছু বোঝা যায় না। বিপুলের খুব মায়া হয়েছিল মেয়েটার ওপর। তখন থেকেই ওকে খাবার দেয় সে। পিন্টু খাবারটা এনে সামনে রাখতেই হামলে পড়ল পাগলীটা। 

" আগে তাও শুধু নিজের পেটটা ছিল এখন আবার আরেকটা পেট। আদৌ বাঁচবে কিনা কে জানে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে বিপুল।







বারান্দা পেরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সুভাষের মনে হল জানালার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার গায়ে মেখে জানালার রড ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে সে।

 " ঝুমা! তুমি ফিরে এসছ ঝুমা! আমি জানতম তমাকে ফিরতেই হবে আমার কাছে। আমার ভালোবাসার টান তমাকে ফিরিয়ে লিয়ে আসবেই। "

অন্ধকার অগ্রাহ্য করেই সুভাষ ছুটে গেল জানালার দিকে। আলো জ্বালানোর কথা তার মনেও এল না কিন্তু হায় রে অবুঝ মন!! বৃথা আশায় ছুটে চলে মরীচিকার পানে। জানালার কাছে গিয়ে সুভাষ দুহাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল তার ভালোবাসার মানুষটাকে কিন্তু একরাশ অন্ধকার ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তার জন্য। নিজেকে সামলাতে দুহাত দিয়ে জানালার রডটা চেপে ধরল সুভাষ। কান্নার একটা প্রবল ঢেউ ধাক্কা মারছে তার বুকের বাম দিকটায়। আস্তে আস্তে সেখানেই বসে পড়ল সে। 

" ঝুমা আ আ...।" ডুকরে উঠলো সুভাষ।

তার হৃদয় ছেঁড়া কান্নার শব্দ পাক খেতে লাগলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে। জীবন দিয়ে সে ভালোবেসেছিল ঝুমাকে। তাকে নিয়ে তৈরী করতে চেয়েছিল সুখী গৃহকোণ। নিজের সর্বস্ব দিয়ে সে ঝুমাকে সুখী করার চেষ্টা করে যেত। তখন তো কোনও দিন সে মদের বোতল ছুঁয়েও দেখত না। কারখানায় ছুটি হলেই সে সোজা ঘর মুখো হত। দিন শেষে ঝুমাকে কাছে পাবার জন্য উতলা হয়ে উঠত তার প্রেমিক মন। পাড়া-পড়শীরা তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাবধান করার চেষ্টা করে গেছে কিন্তু সে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি তাদের কথায়। তার বিশ্বাসই হয়নি যে তার অনুপস্থিতিতে ঝুমার কোনও অবৈধ প্রেমিক আসে তার ঘরে। নির্জন দুপুরে তার বিছানা উত্তপ্ত হয় ঝুমা আর তার প্রেমিকের শরীরী খেলায়। সেইদিনটা আজও মনে পড়ে সুভাষের। তাদের কারখানার একটা কাজে তাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। কাজটা অপ্রত্যাশিত ভাবে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিল। হয়ত এটা ঈশ্বরেরই লীলা ছিল। কাজটা সুষ্ঠু ভাবে এত চট জলদি করে ফেলার পুরস্কার স্বরূপ দুপুর বেলা ছুটি পেয়ে গিয়েছিল সুভাষ। সে ঝুমাকে চমকে দিতে চেয়েছিল তাই নিঃশব্দে পেছনের কুয়ো পাড়ের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সে। এই দরজাটা সাধারণ ভেজানোই থাকে সারাদিন। সে ভাবতেও পারেনি চমকটা আসলে অপেক্ষা করছে তার জন্য। সম্পূর্ণ নগ্ন কামোন্মত্ত দুটো শরীর বিছানার ওপর রতি ক্রীড়ায় মগ্ন। ঝুমা, তার বিবাহিত স্ত্রী অন্য এক পুরুষের বুকের নীচে নিজের তৃপ্তি খুঁজে নিয়েছে। 

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সুভাষ। যখন অপর পক্ষ সুভাষের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হল তখনও তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র লজ্জারোধ কিংবা অপরাধবোধ ছিল না। ঝুমা সদর্পে ঘোষণা করেছিল যে সুভাষ যাকে পরপুরুষ বলছে তাকেই আপন করতে চায় ঝুমার শরীর-মন। তার মত সুন্দরী মেয়ে সুভাষের মত কারখানার কর্মীর ঘরে মানায় না। তার মত রূপসীর শখ-আল্হাদ পূরণ করার সামর্থ্যও নেই সুভাষের। সেদিনই ঘর ছেড়েছিল ঝুমা তার সেই নিষিদ্ধ প্রেমিকের সঙ্গে। সুভাষের কানে এসেছে সে ছোকরার নাকি অনেক টাকা-পয়সা। তার সঙ্গেই ঝুমা নতুন করে খেলাঘর বেঁধেছে। আজও সুভাষ একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়, " তার সমস্ত পরিস্থিতি জেনেও কেন ঝুমা তাকে বিয়ে করেছিল? করেছিল যখন তখন কেন তার ভালোবাসার মূল্য বুঝল না মেয়েটা?"







  

" বর, আমার বর।" 

" এক্ষুনি এখান থেকে দূর হ, অসভ্য মাগী। নিজের ঠিক নেই আবার পেট করেছে।" প্রবল আক্রোশে চিৎকার করে উঠলেন চাটুজ্জ্যে গিন্নী। 

" যা এখান থেকে নাহলে ঝাঁটা মেরে তাড়াবো।" রাগে ফুঁসছেন চাটুজ্জ্যে গিন্নী।

দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করতে করতে সবই কানে আসছিল বিপুলের। মাঝে মাঝে মানুষ গলার জোরে অনেক কিছু গোপন করতে চায়। বিপুলের মনে হল চাটুজ্জ্যে গিন্নীর ক্ষেত্রেও বোধহয় এটাই ঠিক। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে কোমর ভেঙ্গেছিলেন। ছেলে-মেয়ে দুজনেই হোস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে তাই বাড়িতে দেখাশোনার কেউ নেই সেজন্য বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। দুমাস পরে ফিরে এসে দেখলেন পাগলীটা তাঁর বাড়ির রোয়াকে নিজের স্বামীকে খুঁজছে। কিছুদিনের মধ্যেই পাগলীর শরীরে আর একটা অনাহুত প্রাণের সম্ভাবনা উঁকি দিতে থাকে। সেই সাথে বাতাসে ভেসে বেড়ায় নানা গুঞ্জন। ভূষণ চাটুজ্জ্যেকে দেখলেই পাগলীটা চোখ কুঁচকে কি যেন ভাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। 

" আউউ...।"

 চ্যাটুজ্যে গিন্নী একটা ঝাঁটা দিয়ে পাগলীটাকে নিষ্ফল আক্রোশে আক্রমণ করেছেন। ওনাদের রোয়াকে রাতের আশ্রয়টুকুর সংস্থান করছিল পাগলী। 


সুভাষ এসে দাঁড়িয়েছে বিপুলের দোকানের সামনে। আজ আর পটার মদের ঠেকে যাওয়া হয়নি তার। কারখানার কয়েকজন সহকর্মী বিজিতপুরের মেলায় গিয়েছিল। তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের পাল্লায় পড়ে কালী মায়ের মন্দিরে পুজোও দিতে হল তাকে যদিও তার ভগবানের ওপর খুব একটা ভরসা আর নেই। চেঁচামেচি শুনে এখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।

" অকে মাচ্ছে কেনে?" বিপুলকে জিজ্ঞেস করে সুভাষ। 

" সবই তো জানো আর কি বলব। এখন যদি আটকাতে যাই চাটুজ্জ্যে গিন্নী উল্টাপাল্টা বলতে থাকবে।" একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বিপুলের বুক থেকে। 

সুভাষ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চাটুজ্জ্যেদের রোয়াকে ঘটে চলা দৃশ্যটা নিরীক্ষণ করল। চাটুজ্জ্যে গিন্নী রণে ভঙ্গ দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। পাগলীটা মার খেয়ে কাঁদছে। কিছু একটা ভেবে হঠাৎ করেই সুভাষ এগিয়ে গেল সেদিকে। বুকের খাঁচায় ভর্তি করে অক্সিজেন টেনে নিয়ে ডাক দিল, " বউ, ও বউ।"

পাগলীটা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো সুভাষের দিকে। কি যেন ভাবার চেষ্টা করল তারপর খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, " বর এসেছিস।"

" হ্যাঁরে বউ। চল ঘর যাই।"

পাগলী হাঁচোড় পাঁচড় করে সুভাষের কাছে উঠে এল, " ঘর!"

" হ্যাঁ ঘর। তোর ঘর, আমার ঘর, আমাদের ঘর।"

 হাতে প্রসাদী ফুলের শাল পাতাটার দিকে একবার তাকালো সুভাষ। তারপর সিঁদুর লাগানো বেল পাতা থেকে আঙুল করে সিঁদুর তুলে রাঙ্গিয়ে দিল পাগলীর রুক্ষ চুলে ভরা মাথাটা।

" এবার তুই সত্যিই আমার বউ।"

" আমি বউ, আমার বর।" হাততালি দিয়ে উঠলো পাগলীটা তারপর একগাল হেসে নিজের স্ফীত উদরে হাত রেখে সুভাষের দিকে তাকালো।

" চল বউ।"

 আর কোনোদিন পটার মদের দোকানে যাবে না সুভাষ। কারখানায় তার কাজের সুনাম আছে। মালিক আর সহকর্মীরা তাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু কিছুদিন যাবৎ কাজকর্মে মন দেয়নি সে কিন্তু আর না এবার সে আবার আগের মত সব করবে। বাচ্চাটাকে মানুষ করতে হবে। পাগলীকেও ডাক্তার দেখাবে। সম্ভব হলে ওই পাগলদের চিকিৎসা করে যারা তেমন ডাক্তারও দেখাবে সে। পাগলীর একটা সুন্দর নাম দেবে সে। ওর নাম তো কেউ জানে না। রোজগার সে মন্দ করে না তাতে হয়ত ঝুমার চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম হয়েছে কিন্তু এবারে সে ঠিক গড়ে তুলবে তার স্বপ্নের ঘর। পাগলীর হাত ধরে এগিয়ে চলল সুভাষ তার ঘরের দিকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational