Chirasree Bose

Abstract

3.3  

Chirasree Bose

Abstract

গৌরী - কিছু না বলা কথা...

গৌরী - কিছু না বলা কথা...

4 mins
10.8K


এই গল্পটি হল অতি সাধারণ একটি মেয়ের। কিন্তু জীবনটা তার ভারী অসাধারণ। হতে পারে সে আপনার ই মেয়ে, বা হয়তো পাশের বাড়ির ওই মেয়েটা যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হাজার প্রশ্ন চোখে নিয়ে।

ধরে নি, মেয়েটার নাম গৌরী; নামটায় কেমন জানি চারুত্ব আছে। যাই হোক, খুব কম বয়েসেই ও বুঝে গেছিল জীবনটা ওর সহজ হবেনা। কেন জানেন? কারণ ও আমার আপনার মতো মন খুলে কথা বলতে পারেনা। বোঝাতে পারেনা নিজের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ভালোলাগা বা না লাগাটাকে। ছেলেবেলার চাওয়া গুলো অতি সাধারণ হয়, কিন্তু না পাওয়ার ব্যাথাটা কিন্তু বড়-বেলা পর্যন্ত মনে দাগ কাটতে থাকে। সেটাই তো স্বাভাবিক, সেই বাচ্চাটা যে আমাদের ভিতরে কোথাও লুকিয়ে বসে থাকে সারাজীবন।

ভাবছেন, ঐটুকু মেয়ের আবার না পাওয়া, তাই না? নিজেকে ১০, ২০, ৩০ বা ৫০ বছর আগে নিয়ে গিয়ে ভাবুন তো। কি, কিছু না পাওয়ার কষ্টটা আছে তো এখনও?

গৌরীর বয়েস তখন মাত্র ১০ বছর। সরল মন, তাই যেমন ছিল তেমন ভাবেই নিজেকে ভালোবাসতো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপ করে থাকাটা দুর্বলতা মনে হত না, বরং অন্যের মুখের হাসিটা স্বর্গীয় লাগত। নিজের পছন্দের জিনিসটা না চাইতে পেরে আড়ালে কেঁদে নেওয়াটা সহজ ছিল ওর কাছে, কিন্তু ‘মা, আমার এটা চাই ‘ বলে বায়না করাটা ঠিক হয়ে উঠত না ওর।

বয়েস তখন তেরো, তার মধ্যেই জীবনের একটা অপ্রিয় সত্য সে বুঝতে শুরু করেছে - ওকে ওর মতো করে কেউ কখনও স্বীকার করবে না। কেমন যেন নিজের ওপরই রাগ হতে থাকল ওর - কি দোষ আমার? ওই নতুন একটা ইংরিজী শব্দ শিখেছি, কি যেন - ‘ইন্ট্রোভার্ট ‘ ...ওটা নাকি কোনো রোগ নয়। কিন্তু ওই ছোট্ট মেয়েটার নিজেকে অসুস্থ মনে হতো কেন তাহলে? তার না বলা শব্দগুলোকে এত বিশ্লেষণ করা হত কেন? কি ক্ষতি হত মেয়েটাকে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো বড় হতে দিলে?

ভাবছেন, এ আবার কি গল্প - অদ্ভুত, তাই না? অদ্ভুতই বটে। সত্যটা তো কারোর কখনও সরল মনে হয়নি। আচ্ছা, মানুষ কি চায় বলুন তো? ও যদি মুখের ওপর ভুল কে ভুল আর ঠিক কে ঠিক বলতে পারত, তাহলে সেটা সহজে গলাদ্ধঃকরন করার মতো ক্ষমতা তাদের ছিল কি? না, কিন্তু গৌরীর নিস্তব্ধতাকে হাসির পাত্র বানিয়ে নিজেদের অক্ষমতা আর নৈরাশ্য কে গিলে নেওয়াটা ভারী সোজা ছিল। সামান্য একটু সম্মান - সেটা ওই ১৫ বছরের মেয়েটারও প্রাপ্য ছিল।

দীর্ঘ ৭ টা বছর কেটে গেল। না, সম্মান সে পেলনা এখনও। প্রত্যেক মুহূর্তে তার দিকে আঙুল তুলে হাসার, তাকে অবহেলা করার, আর তার সামর্থ্য, যোগ্যতা, দক্ষতা কে অবমূল্যায়ন করার লোকের অভাব তখনও ছিলনা। ২২ বছরের গৌরী কিন্তু হার মানেনি। হ্যা, রোজ রাতে এখনও বালিশ ওর অশ্রুজলে ভেসে যেত, কিন্তু সেই জলে ও নিজের মনকে ভিজতে দেয়নি। পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছিলো ওর হৃৎপিণ্ড। চোখের জল প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু দৃষ্টি নিজের লক্ষে স্থির। মুখে সে এখনও প্রতিবাদ করতে পারতনা, কিন্তু জানত সময় একদিন বদলাবে।

হ্যাঁ, সময় বদলালো। আজ ২৫ বছরের গৌরী নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। ভালো চাকরি করছে সে। না, তার জন্য তাকে অতিরিক্ত কথা বলতে শিখতে হয়নি। কেন জানেন? কারণ যোগ্যতা, শিক্ষা আর দৃঢ় চরিত্র প্রকৃত দুনিয়ায় আমার আপনার থেকে অনেক বেশি কথা বলে। আর সেই আওয়াজ যেখানে পৌঁছানোর ঠিক পৌঁছে যায়।

আজ অনেকদিন হল বালিশ আর চক্ষুজলে ভেজেনা ওর। আগে যে মেয়ে মাথা নিচু করে চোখের জল আর মনের কষ্ট লুকিয়ে হাঁটতো, সে আজ মাথা উঁচু করে চলে। শুধু চাকরিই নয়, তার হাতে আঁকা ছবি এখন দেশে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। আর ওর সবথেকে গর্বের বিষয় কি জানেন? ও এখনও আগের মতোই আছে। সেই ১০ বছরের বাচ্চা মেয়েটা এখন আর কাঁদেনা ওর ভিতরে, সে এখন খিল-খিল করে হাসে। সে এখন পাখা মেলে উড়তে শিখেছে। আবার গুন-গুন করে গানও গায় মাঝেমাঝে। দুহাত মেলে সে উপরে তাকায়, আর আকাশের দিকে দেখে বলে, ধন্যবাদ আমাকে আমার মতো বানানোর জন্য, আমি আর কারোর মতো হতে চাইনা।

আজ ৩২ বছরের গৌরী রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে; তার আঙুল ধরে আছে তারই প্রতিচ্ছবি, ওর ৪ বছরের ছোট্ট মেয়ে, সর্বানী। হঠাৎই সে বলে উঠল, ‘মা জানো, কাল স্কুলে ‘যেমন ইচ্ছা তেমন সাজো ‘ প্রতিযোগিতা আছে।’

গৌরী মৃদু হাসল, ‘তুই কি সেজে যাবি?’

পুঁচকে মেয়েটা এক মুহূর্তও না থেমে বলল, ‘মা, আমি ‘তুমি‘ হতে চাই। সাজিয়ে দেবে?‘

গৌরী তার মেয়েকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে হেসে উঠল, ‘তাই? তুই যে অনেক বড় কথা বললি, মা। এটাই হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা। তবে থাক, তুই তোর মতোই হোস...আর কারোর মতো না। কাল আমি তোকে মা দুর্গা সাজিয়ে দেব। ঠিক আছে?’

গৌরীর গল্প তো আপাতত শেষ হল। আপনাদের একটা কথা বলব? এটা কিন্তু শুধু একটা মেয়ে, একটা নারী আর তার শক্তির কাহিনী নয়। এটা আমিও হতে পারি, আবার আপনিও। আবার আপনার অতি-শান্ত ছেলেটা বা মেয়েটাও হতে পারে। মানুষকে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, আর না পারলে ছেড়ে দিন। বাঁচতে দিন তাকে তার মতো করে। তার জীবনটা আপনার বিচার-বিবেচনার পাত্র নয়। সব যদি বুঝে যান তাহলে তো জীবনটাই বৃথা।

                                               


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract