একটু উষ্ণতার জন্য
একটু উষ্ণতার জন্য


শীতটা এবার বেশ জমিয়ে পড়েছে এই শহরে। তার সাথে রয়েছে উত্তরে হাওয়া। গতকাল থেকে আবার একটা ঝড়বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিয়েছে অঞ্চলটাকে।
রেল ব্রিজের নিচে পকাইয়ের ছোট্ট সংসার, দু টো ছেড়া তোষক আর কয়েকটা প্লাস্টিকের বোতল। জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে এই শহরে বেঁচে থাকতে হলে নিজের মাথার ছাদ আর পেটের ভাত নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে বুঝেছিল পকাই। কখনো প্লাষ্টিক আর কাগজ কুড়িয়ে কখনো চায়ের দোকানের কয়লা ভেঙ্গে আর বাসন মেজেই দশটা বছর ও কাটিয়ে দিয়েছে । ছোটবেলায় একটা পাগলী বুড়ি থাকত এই ব্রিজের নিচটায়। শীতের দিন গুলো ঐ বুড়ির কম্বল ভাগাভাগি করেই কাটিয়ে দিত পকাই। সে বুড়িও আজ বহুবছর নেই। ব্রীজের নিচের আরেক দখলদার ঐ ববিতা। বাপটাকে চোখেই দেখেনি ও। মা টাও গত বছর ভেগে গেছে। তেরো বছরের ববিতা ব্রিজের নিচে প্লাষ্টিক খাটিয়ে সংসার সামলায়। ওর হাতে সর্বদা একটা ছুরি থাকে, আর কোমরের কাছে গোঁঁজা থাকে এক পোটলা লঙ্কার গুঁঁড়ো। ওর ঐ গুটানো তোষকের নিচে একটা হাসুয়াও আছে জানে পকাই। মেয়েটার খুব তেজ। অনেকের লোভী নজর বাঁচিয়ে চলতে চলতে মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। স্টেশনে ভিক্ষা করে, আর পকাইয়ের মতই প্লাস্টিক কুড়িয়ে বেড়ায় সারাদিন।
দু দিন হল আবার একটা পাগলী কোথা থেকে যেন এসে জুটেছে এই চত্বরে। পেটটা দেখেই ববিতা বুঝেছিল ও একা নয়। তাই নিজের জায়গা একটু ছেড়ে দিয়েছিল। পাগলীটার হাঁঁটা চলার ক্ষমতা নেই। বিরক্ত ববিতা কাল পাউরুটি কিনে খাইয়েছে। আজ সকালেও একটা বিস্কুটের প্যাকেট ও কিনে দিয়েছিল পেটেরটার কথা ভেবে। পকাই আড় চোখে দেখে বলেছিল -''ঝামেলা বাড়াস না, নিজেদের ভাগেই কিছু জোটে না, ওটাকে তাড়া । বসে বসে খেতে পেলে ও এখানেই থেকে যাবে। ''
ববিতা উত্তর দেয়নি।
বৃষ্টিতে সব কিছু ভিজে একসা, এই ঠান্ডায় আজ রাতটা কি ভাবে কাটাবে ভাবছিল ববিতা, একটা শুকনো রঙ চটা ছেড়া পুরীর চাদর ছিল, ওটা দিয়েই কান মাথা ঢেকে বসেছিল রেল লাইনে। রোদ ওঠেনি। ঠাণ্ডা হাওয়ায় খিদেটা আরো জোরে জানান দিচ্ছে। ছেড়া ওড়নার গিটে কুড়িটা টাকা রয়েছে শেষ সম্বল। বৃষ্টিতে কাল কাজেও বার হতে পারেনি।
পকাইকে হন্তদন্ত হয়ে মাঠকলের দিকে যেতে দেখেই ববিতার মনে পড়ল আজ ঐ মিলনসঙ্গে বিবেকানন্দ উৎসব না কি যেন আছে। দুপুরে খাওয়াবে বলেছিল। আর ওরা তো প্রতি বছর দুস্থদের কম্বলও দেয়। বড্ড দেরি করে ফেলল বোধহয়, চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে ববিতাও ছোটে মাঠকলের পথে।
কিন্তু ক্লাবের বলাইদা ওর শরীরটা চোখ দিয়ে গিলে খেতে খেতে বলল -''শক্ত সমর্থ শরীর তোর। খেটে খেতে পারিস না। কম্বল তো বুড়ো বুড়িদের জন্য। ''
ও পাশ থেকে জগাদা বলল -''ওকে আমার বাড়ি বাসন মাজতে বলেছিলাম, থাকার জায়গাও দিতাম, ওর পছন্দ হয়নি। ব্রিজের নিচে কি করে সবাই জানে। ছেনালি মেয়েছেলে তৈরি হচ্ছে। ''
রাগে ববিতার গা জ্বলে ওঠে। জগার মা পঙ্গু, দু দিন বাসন মাজতে গিয়েই বুঝেছিল জগার নজর খারাপ। ওর বাড়িতে থাকার চেয়ে খোলা আকাশের নিচ অনেক ভালো।
মাঠে সবাইকে খিচুরি খাওয়াচ্ছে উৎসব কমিটি। পকাই একটা কম্বল বগলদাবা করে খিচুরি খাচ্ছিল। গা টা জ্বলে যায় ববিতার। জোয়ান ছেলেটাকে দিয়েছে, ওকে দিল না। ক্লাবের পেছনে বোল্ডারের ঢিপিতে গোঁজ হয়ে বসে থাকে ববিতা। ঐ খিচুরি খেতেও ইচ্ছা করে না। কিন্তু পেটের রাক্ষসটা যে এসব বোঝে না। পাশের টিউবওয়েল থেকে পেট ভরে জল খায় ববিতা। নগনকাকা ডেকে বলেন -''এই ছেমড়ি , খেয়েছিস ? এটাই লাষ্ট ব্যাচ। বসে যা। ''
ববিতা হাঁটা লাগায়। কত লোক কম্বল পেলো, ওকে একটা দিল না ওরা। ব্রিজের নিচে পৌঁছে মাথাটা আরো গরম হয়ে গেলো ববিতার। ভেজা তোষকটা লাইনের ধারে পেতে দিয়ে গেছিল যদি গাড়ির হাওয়ায় একটু শুকায়। ওটা কি করে যেন ঐ বিলের জলে গিয়ে পড়েছে। আজ এই শীতের রাতটা কি করে কাটাবে ও?
বৃষ্টিতে সব ভিজে গেছে । শুকনো কাগজ খড়কুটো বা গাছের ডাল কিছুই নেই। পাগলীটা ফুটপাতেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে। কোন চিন্তাই নেই ওর। পেটেরটা বেরিয়ে বাঁচবে কি করে কে জানে ?
স্টেশন চত্বরের দোকানদার গুলোর কাছ থেকে দুটো পিচবোর্ডের বাক্স আর কয়েকটা ডিমের ট্রে কিনে আনে ববিতা দশটাকা দিয়ে। ওগুলো জ্বালিয়েই আজ রাতটা পার করবে। খিদায় পেটটা কচলাচ্ছে। রাগ না দেখিয়ে তখন খিচুরিটা খেলেই হত । নিজের বোকামিতে নিজের উপর রাগ হয়। ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁঁকছিন পানু। ওকে দেখে একটা বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বলে -''যাবি নাকি, শীতের রাতটা গরম করে দেবো মাইরি।'' একটা কড়কড়ে দু শো টাকার নোট নাচায় ওর চোখের সামনে।
ববিতা একদলা থুথু ফেলে চলে যায়। এই অঞ্চলের মেয়েদের নষ্ট করা পানুর বহুদিনের কাজ। ছুরিটা দুবার পানুর গায়ে বসিয়েছে ববিতা। তাও শকুনটার শিক্ষা হয়নি।
পাগলীটা ঠাণ্ডায় কাঁপছে, কিন্তু এখনি আগুনটা ধরালে মাঝ রাত ও কাটবে না। পকাই কম্বল নিয়ে কোথায় গেছে কে জানে, ফেরার নাম নেই।
বাকি দশটাকাটা দিয়ে খাবার আনবে কি না ভাবছিল ববিতা।
-''এই নে, তোর জন্য । '' প্লাস্টিকের প্যাকেট হলুদ রঙের ঠাণ্ডা খিচুরি ও দুটো আলু দেখে পেটটা মোচর দিয়ে উঠল। মুখটা ভরে গেলো টক জলে।
-''রাগ দেখিয়ে চলে এসেছিস শুনলাম। ওদের যা বেচেছিল একটু আগে প্যাকেট করে সবাইকে দিয়ে দিল। এটা আমার ভাগের। ''
ববিতা হাত বাড়াবার আগেই এক টানে ছিনিয়ে নিল পাগলিটা। প্যাকেট ছিড়েই গপাগপ খেতে শুরু করল। সে দিকে তাকিয়ে রাগ করতে গিয়েও পারল না ও। করুণ চোখে দেখল পাগলীর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
-''এটাকে তুই তাড়াবি, নাকি আমি ?'' রাগে গড়গড় করে ওঠে পকাই।
-''ছাড়, ওর খিদেটা আমাদের থেকে বেশি। আমার আজ খিদে নেই। '' বোতলের তলানি জলটুকু খেয়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে কয়েকটা শুকনো ইট পেতে আগুনটা জ্বালাবার ব্যবস্থা করে ববিতা। মনে পড়ে মা থাকতে এমন করে আগুন জ্বালিয়ে বসে কত রাত পার করেছে।
খেয়ে মাটিতেই কুকড়ে শুয়ে পড়েছিল পাগলীটা। ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁঁপছে মাঝে মাঝে।
পকাই নতুন কম্বলটা জড়িয়ে শোওয়ার ব্যবস্থা করছে। কম্বলটা দেখেই রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ববিতার। রাগলে বোধহয় ঠাণ্ডাটা কম লাগে। চোখ বন্ধ করে আপন মনে গজগজ করে ববিতা।
হঠাৎ পকাই এসে বসে ওর পাশে।
আগুনে হাত পা সেকতে সেকতে হাসে। নিভন্ত আগুনে নিজের কুড়িয়ে আনা কয়েকটা পিচবোর্ড গুঁজে দেয় ছেলেটা।
-''এখানে কি করছিস? তোর কম্বল কি হলো ?'' ববিতা ওকে এভাবে দেখে প্রশ্ন করে।
-''কম্বলটা ওদের বেশি দরকার। আর কম্বলের থেকেও বেশি তাপ এখন এখানে। '' এক স্বর্গীয় হাসি পকাইয়ের চোখে মুখে।
এই শীতের রাতে কম্বলের উষ্ণতায় পাগলী আর তার অনাগত সন্তানকে মুড়ে দিয়েছে দশ বছরের ছেলেটা। একটু উষ্ণতার জন্য এখন এসে বসেছে আগুনের পাশে।