Mausumi Pramanik

Inspirational

2.5  

Mausumi Pramanik

Inspirational

একটি অসম বিয়ের গল্প

একটি অসম বিয়ের গল্প

9 mins
2.7K


আজ একটি অসম বিবাহের কাহিনী শোনাবো। সেটা ছিল ২০১২ সাল; আমি আমার নতুন ফ্ল্যাটে সদ্য সদ্য উঠে এসেছি। বিন্দু নামে একটি মেয়ে প্রথমবারের জন্যে বাসনমাজা, ঘরমোছার কাজে লেগেছিল। বিন্দুকে দেখলে ঠিক কাজের লোক বলে মনে হতো না। বিহারের অধিবাসী ওরা। বাবা-মা, দাদা, দিদি, বোন সহ সাতজনের বড় পরিবার। বাবা ও দাদা বানতলায় জুতোর কারখানায় কাজ করতে যায়। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মা, সে ও তার পরের বোন বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করে সংসার চালায়। বিন্দু যে খুব সাজগোজ করতো তা নয়; তবে বছর ষোল ঐ মেয়েটির গায়ের রঙে এক আলাদা ঔজ্জ্বল্য ছিল। এমনিতে চাঁপা ফুলের মত ওর গায়ের রঙ। চেহারাটিও বেশ ডাগর ডোগর। যখন ঘর মুছতো, কামিজের ভেতর দিয়ে ওর উন্নত বক্ষের অনেকটাই বন্ধন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইত; যা আমি মহিলা হলেও আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। বাংলা ভাল বলতেও পারতো না, তবে বুঝতো। হিন্দী ও ভোজপুরি ভাষা মিশিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতো। নিজের মনেই গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরের কাজগুলো একমনে সারত। যে কাজ ওর ছিল না, তাও সে করতো। “কাপড়া আভিতক বাহার...পড়া হ্যায়...দিদি...উঠায়া নেহী...” ব্যালকনি থেকে জামাকাপড় তুলে এনে আলনায় গুছিয়ে রাখত। “দিদি চায়ে পিওগী...” কাজের শেষে কখনো কখনো লেবু চা, কখনো দুধ চা করে আমাকে দিত। নিজেই বিস্কিট নিয়ে নিত। এমনিতে বেশ লাজুক ছিল; তবে আমিই তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম। তাই অকপট হতে পেরেছিল। “দিদি...ভুগ লেগেছে...ব্রেড লিব...কিংবা কেলা একটা লিবো...” আমি হুঁ বললাম কি বললাম না। ও জানতো যে আমি ওকে মানা করবো না। আমার কাছে দু চারটে করে বাংলা ভাষা পড়তে শিখছিল সে।

“হ্যারে তুই বাংলা পড়ে কি করবি? ভাল লাগে?”

“অ্যায়সেই...তুম ইতনা জো লিখতে হো...কেয়া লিখতে হো...”

ওকে বোঝাতে গিয়ে আমি গলদঘর্ম হয়ে গেছিলাম। ও নিয়ম করে হিন্দি সিনেমা দেখে, অন্য কাজের বাড়িতে সিরিয়ালও দেখে; অথচ সেগুলোর পিছনে যে একজন লেখকের গল্প লেখার ইতিহাস থাকে, সেটা সেদিন ওকে আমি কিভাবে বুঝিয়েছিলাম তা শুধু আমিই জানি।

আমার কম্পিউটারের সঙ্গে মিউজিক সিস্টেম লাগানো থাকে। লেখার সময় আমি রবিশঙ্করের সেতার কিংবা আমজাদ আলি খান সাহেবের শরোদ বাদন শুনতেই বেশী পছন্দ করি। অন্য সময় আর. ডি. বর্মন, সলিল চৌধুরী কিংবা রবীন্দ্র সঙ্গীত। বিন্দুর ভাল লাগত না।

“ইয়ে কেয়া সব শুনতে হো...রোনেআলা গানা...”

“জানি। তোদের তো ঐ সব শীলা কি জবানি টাইপ গানা পসন্দ...কিন্তু ওসব কুরুচিপূর্ণ গান আমার মেশিনে পাবি না...”

“আরে নেহী বাবা... আমি উসব শোনে না...আমি তো জিতের ঐ গানগুলো শুনতে ভালবাসে...ও বন্ধু, তুমি শুনতে কি পাও...”

“তুই বাংলা গান শুনিস?”

“নেহী উসদিন টিভিমে দেখা...উও গানা শুনকে মেরেমে কুছ কুছু হোতা হ্যায়...”

“অ্যা! তুই কি প্রেম টেম করছিস নাকিরে...?”

বিন্দু স্পিকটি নট; কিন্তু ওর হলুদ মাখানো গালের গোলাপী আভা আমার চোখ এড়িয়ে গেল না। এরপর থেকে প্রতিদিন ওর চাহিদা মত জিতের পার্টিকুলার ঐ সিনেমার গানগুলো আমাকে চালাতে হত; তাতে নাকি মহারাণী কাজে এনার্জি পেত। কিন্তু ওর মুখ থেকে একটা কথাও আমি খসাতে পারিনি। যদিও আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল। সেটা আরো তীব্র হল, যখন ওর মা একদিন আমার ফ্ল্যাটে ওর খোঁজ নিতে এল।

“ও কতক্ষন কাম করে গো তোমার ফেলাটে...”

“অনেকক্ষন ধরে করে। প্রায় দেড়ঘন্টা মত থাকে...”

“ইতনা ওয়াক্ত...কি করে...?”

“আমার সঙ্গে বসে গল্প করে, চাটা খায়...”

তারপর থেকে ওর মা চলে আসতে থাকল প্রায় দিনই। ওকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে কাজ করিয়ে বের করে নিয়ে যেত। ওরা নিজেদের ভাষায় মা মেয়েতে ঝগড়া করতো, আমি কান দিতাম না। কোন কোন দিন ওর মা বেশ কাঁদো কাঁদো স্বরে কিছু বলতো।

আমি একটু কৌতূহলী হয়েই জানতে চাইতাম।

“কি হয়েছে মাসী...কিছু সমস্যা...?”

“মেয়ে বলছে আমায় গলায় দড়ি দিবে...”

ওর মায়ের চোখ ছলছল করতে দেখে আমি বিন্দুকে বকা দিলাম। “ মা’কে এত কষ্ট দিস কেন রে? মায়ের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে?”

ও মাথানীচু করে সব শুনলো। কোন প্রত্যুত্তর করলো না।

এমনটাই চলছিল। তবে বেশীদিন নয়। একদিন ওর বোন ইন্দু কাজে এল।

ভাবলাম বুঝি বিন্দুর শরীর খারাপ। কিন্তু পরপর চারদিন সে কাজে না আসাতে আমি না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না।

“ইন্দু তোর দিদি কেন আসছে না...”

“ কেন? আমার কাজ কি তোমার ভাল লাগে না?”

এ আবার পরিষ্কার বাংলা বলে।

“ওর কি শরীর টরীর খারাপ হলো নাকি?”

“নটোঙ্কি সব...”

আমি বুঝলাম কিছু একটা ঘটেছে ওদের পরিবারে। কিন্তু এটা আমার বরাবরের স্বভাব যে অন্যের পার্সোনাল বিষয়ে কৌতূহল দেখাই না। তাই মাথা আর ঘামানো উচিত মনে করলাম না। আমার ঘরের কাজটা তো হয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাক। শীতের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে বিন্দুর মা এসে জানালো,

“ দিদি আমরা ক’দিনের জন্যে দেশে যাচ্ছি...”

“কতদিন আসবে না...?”

“একমাস মত....”

“সেকি? আমার চলবে কি করে গো...?”

“বিন্দুর বিয়ে...লড়কা ঠিক হয়ে গেছে...”

“অ্যাঁ! কবে? হঠাৎ...?”

আমি খুশি হলাম শুনে; আবার মন খারাপও হল। ওদের অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দেবার নিয়ম। দেশের আইনকে লবডংকা দেখিয়েই ওরা মেয়ের বিয়ে দেবে; কারণ ও বোঝা ঘাড় থেকে যত তাড়াতাড়ি নামে ততই ভাল। কিন্তু বিন্দু একবারও আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো না?

“আচানক...” মুখে বললাম।

“পেয়ে গেলোম...ভাল লড়কা মিলে না...”

“কি করে সে ছেলে...”

“গাঁও কি...খেতিবাড়ি, কামকাজ...”

বুঝলাম যে বেগার খাটাতে মেয়েকে জমা করে দেওয়া হচ্ছে। “তা মাসী...বিন্দুকে বলো, যাবার আগে যেন দেখা করে যায়...”

“বলবো...তবে সে আসবে?...দেমাক হয়েছে তার...কারোর সাথে বাতভি করছে না...”

বিশ্বাস হচ্ছিল না; এত তাড়াতাড়ি মেয়েটা এতখানি বদলে গেল? ক’দিন আগেও যে মেয়েটা দিদি দিদি করতো...সে তার জীবনের এতবড় খুশির খবরটা আমাকে জানাবে না?”

এরপরে আমি কাজের লোক বদলে ফেলেছিলাম। একমাস ধরে কাজে না এলে আমার খুব অসুবিধা হত। ওদের কোন খবর আমার আর নেওয়া হয় নি।

মাস ছয় পরের কথা। সন্ধ্যে সাতটার সময় আমি সবজী বাজার করে ফিরছিলাম। মাসীকে দেখলাম শুকনো মুখে কাজের বাড়ি থেকে ফিরছে। “কি গো? এমন চেহারা হয়েছে কেন তোমার...?”

“খুব ভুগলাম...জানো...?”

“ কি হয়েছিল...?”

“ঘরে শান্তি না আছে...দিদি...বিন্দু চলে এসেছে জানো....বদমাস!”

“মানে? শ্বশুড়বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে...”

“সে কি? কেন?”

“আমি যাব তুমার ঘরে...সব বুলবো...রাস্তায় কে কি বুলবে...”

মাসী এসেছিল; তার দুঃখের ডালি উজাড় করে দিয়েছিল। তার কাছথেকে যা শুনেছিলাম তা খুব যে আনকমন কিছু তা নয়। বিন্দু একটি মুসলিম ছেলের সঙ্গে প্রেম করতো। আমার বাড়িতে বেশীক্ষন থাকার কারণ এটাই ছিল যে আমাদের বাড়ির পিছনদিকের রাস্তায় ছেলেটি ওর জন্যে অপেক্ষা করতো। বিন্দু কোন কোন দিন হঠাৎ করেই সাবান ভিজিয়ে চলে যেত। বিকেলবেলা এসে কাচাকাচি করতো। সেদিন সে আমার কাজ সেরে আসলামের সঙ্গে মীট করতো। কিন্তু যেটা হবার সেটাই হল। এদের পরিবার হিন্দু; আসলামের সঙ্গে বিয়ে কিছুতেই দেবে না, তাই একপ্রকার জোর করে বিহারে নিয়ে গিয়ে ওর বিয়ে দেয়। বিন্দুর মা প্রায় আমার পায়ে পড়ে গেল।

“দিদি তুমি ওকে বোঝাও...ও তুমার কথা শুনে...উ যদি না ফিরে, তাহলে আমরা গাঁয়ে আর যেতে পারবো না...আমাদের লোকে একঘরে করে দিবে...”

“ও কি আমার কথা শুনবে? ঠিক আছে পাঠিয়ে দিও...”

আমি পড়লাম ধর্ম সংকটে। অসম ভালাবাসাকে প্রাধান্য দেব নাকি গরীব কাজের মাসীর পরিবারের মান সম্মানকে।

বিন্দু এল। আমি সব জানতে চাইলাম। ওকে বোঝালাম যে বিয়ে যখন হয়ে গিয়েছে, বাবা-মায়ের, শ্বশুরবাড়ির সম্মান, স্বামীর সম্মানের কথা তার ভাবা উচিত। “ওরকম প্রেম টেম ছোট বয়সে সকলের হয়। তুই ওসব ভুলে যা।”

যথারীতি সে মুখে কুলুপ এঁটেছিল। শুধু বললো,

“মায়ের কথায় তুমি আমাকে ফাসাতে চাইছো না...?”

বিন্দুর চোখে আগুন জ্বলছে যেন। কিসের আগুন ও?

“হ্যারে শ্বশুর বাড়ির লোক তোর ওপর অত্যাচার করেনি তো...? তোর স্বামী...?”

“না। উওলোগ আচ্ছা আদমী আছে...”

“তবে তুই পালিয়ে এলি কেন? তুকি কি রাজাবাজারের ছেলেটার সঙ্গে থাকতে চাস? বল আমাকে, তাহলে তোর মা-বাবাকে আমি বোঝাবো...”

এবারও সে মেঝের দিকে তাকিয়ে দুইপায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঘষতে থাকলো।

 এরপরে আমি ওর মাকে বুঝিয়ে বললাম। “তোমরা কিন্তু ওকে মারধোর করো না। ক’দিনে ওর যা চেহারা হয়েছে...”

“কুছু তো খায় না দিদি...কুছু বলেভি না...”

“যার সঙ্গে প্রেম করতো, তাকে এখনো বিন্দু ভুলতে পারে নি। বয়স কম ওর। ওকে একটু সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।” 

এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে নাক গলাতে আমার ভাল লাগছিল না। একদিকে চিরন্তন সমাজ ব্যবস্থা, অন্যদিকে একটি অবুঝ মন, আমি কার হয়ে কথা বলতাম? আমরা তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল মানুষরা লেখনীর দ্বারা রিভলিউশান আনি। আমরাই বা ক’জন পারি যা লিখি, তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে? আর ওরা তো অশিক্ষিত, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা একটা পরিবার। আমি কি ওদের বোঝাতে পারবো? তার চাইতে বরং ওদের সমস্যা ওরাই সমাধান করুক। এই মনে করে আমি বিন্দুর প্রেমের কথা, বিন্দুর অসহায়তার কথা প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছিলাম। জি ড্রাইভে জিতের সিনেমার গানের ফোল্ডারটাও ডিলিট করে দিলাম। ওটা দেখলেই বিন্দুর আগুন ঝরানো চোখ দুটো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। আর নিজের কাজে নিজেই লজ্জা পেতাম এই ভাবে যে আমি বিন্দুর পাশে না দাঁড়িয়ে সমাজের পাশে গিয়ে কেন দাঁড়ালাম? আমার বিবেক আমাকে দংশন করতো প্রতিনিয়ত।

 

তবে বিন্দু কিন্তু বেশ সাহসী মেয়ে। সে বাবা-মায়ের ওপর বোঝা হয়ে থাকে নি। দু বাড়িতে কাজ খুঁজে নিয়েছিল। বিয়ের সব চিহ্ন মুছে সে নিজেকে কুমারী মেয়েতে রূপান্তরিত করেছিল। সে সাহসী বলেই হয়তো ঈশ্বর তার সহায় হয়েছিলেন। বছর দুয়েক পরে মাসী হাসি হাসি মুখ করে আমায় বলল,

“বিন্দুর ছেলে হয়েছে।”

“ওমা! তাই নাকি? কবে হল? ও ফিরে গিয়েছিল?”

“না...তাকেই বিয়ে করেছিল রাজাবাজারের ছেলেটাকে...”

“তোমরা মেনে নিলে?”

“না মেনে কি করতাম। মেয়ের জিদ! তবে মেয়ে আমার খুব ভাল আছে গো...খুব সুখে আছে...”

আমি সামনের মিষ্টির দোকান থেকে এক বাক্স মিষ্টি কিনে মাসীর হাতে দিলাম। মাসী তখন মেয়ে জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

বিন্দু বিয়ের পর হিন্দু স্বামীকে তার শরীর স্পর্শ করতে পর্যন্ত্য দেয় নি। আমার কাছে প্রায়ই টাকা নিয়ে ফেরৎ দিত না বিন্দু; সেই টাকা নাকি আসলামকেই দিত সে। চাকরীর পরীক্ষার ফর্ম তোলা, যাতায়াতের খরচা এভাবেই দিত সে। ওর মা বোনকে আমি যখন জানিয়েছিলাম, ওরা কেউ ওকে চোর বলেছিল, কেউ বলেছিল যে ও গুটখার নেশা করে। আমিও মনে মনে বিরক্ত হয়েছিলাম। একদিন ওকে বকাও দিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা তার ‘বন্ধু’কে যে এতখানি ভালবেসেছিল, টের পাইনি ঘুনাক্ষরেও। এমনকি চাকরী না পাওয়া পর্যন্ত্য তার নাম, ঠিকানা তার পরিবারের কাউকে দেয়নি সে। আসলাম এখন সরকারী হাসপাতালে ডি গ্রুপের কর্মী। এমন সরকারী চাকরী করা জামাই পেয়ে বিহারী পরিবারটি ধন্য হয়ে গিয়েছে। আসলে আর্থিক স্বচ্ছলতার কাছে সমাজ, ধর্ম , রীতিনীতি পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হল। পেটে খিদে নিয়ে কি আর ধম্মো-কম্মো হয়? ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি কি দু মুঠো অন্ন জোগাড় করে দিতে পারে?

নারকেলডাঙ্গা মেইন রোডে খালের এপাড়ে আর ওপাড়ে হিন্দু, মুসলিম পরিবারেরা মিলেমিশে থাকে। বেশীর ভাগই নিম্নবিত্ত ও গরীব; দিন আনি দিন খাই; মাদ্রাসা, কর্পোরেশান স্কুল থাকলেও শিক্ষার অন্ধকার কুয়াশাছন্ন করে রেখেছে এলাকাটিকে। ওদের আমি হোলি খেলতেও দেখেছি আবার মিলেমিশে দুর্গাপুজোও করতে দেখেছি। ঈদের আগে জামাকাপড় আর সিমুইয়ের দোকানে হিন্দু মুসলিম উভয়কেই ভিড় করে জিনিষ কিনতে দেখেছি। রাজাবাজারে মার্কেটের ভিতরে সবচেয়ে বড় চাল, আটা ও মুদির দোকানটি একজন মাড়োয়াড়ীই চালান। দেখে অবাকও হয়েছি।

 

একটা নোংরা, কর্দমাক্ত খাল বিন্দু ও আসলামের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। ওরা না হিন্দু মতে বিয়ে করেছিল, না মুসলিম মতে। ওরা কোর্ট ম্যারেজ করেছিল। ওরা কেউ কারোর ধর্ম পরিবর্তন করেছিল বলেও আমার জানা নেই। বিন্দুকে আমি মাথায় গেরুয়া সিঁদুর লাগাতে দেখেছি। কোনদিন লাগায়, কোনদিন লাগায় না। ঝুপড়িতে থাকা একটি দুঃস্থ পরিবারের মেয়ে পাকা বাড়িতে স্বামী পুত্র নিয়ে চুটিয়ে সংসার করছে। এর জন্যে তাকে না স্বামীজী পড়তে হয়েছে, না গীতা, কিংবা কোরান ওদের বিয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তথাকথিত অশিক্ষিত পরিবারের দুটি ছেলে মেয়ে যে সাহস দেখাতে পেরেছে, আমরা শিক্ষিত হয়েও তা করতে গিয়ে চোদ্দবার ভাবি। আসলে আমরা নিজেরা যখন সাহসী হয়ে উঠতে পারি না তখন অন্য কেউ সেই সাহস দেখাতে দেখলে ধর্ম, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে আঁটকানোর বৃথা চেষ্টা করি। আর সেই সুযোগে রাজনৈতিক ধ্বজাধারীরা বিষাক্ত সর্পের ন্যায় বিষ ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়। দেশের আপামোর সাধারনকে তারা কম দামে খাদ্য দিতে পারে না, স্বাস্থ্য, শিক্ষা কোন কিছুরই সুরক্ষা দিতে পারে না, অল্প খরচে মাথার ওপর একটা ছাদ খুঁজে দিতে পারে না। এটা যে তাদের ব্যর্থতা, সেটা ঢাকতেই ধর্মের হুজুগ তোলা হয়। প্রান্তিক মানুষ এখনো প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত নয়। তাই কুসংস্কার মুক্তও নয়। আর সেই সুযোগে দুই গোষ্ঠির মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করতেও পিছপা হয় না। দেশভাগের জন্যে ইংরেজ অথবা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা নির্দিষ্ট মানুষকে যতোই দোষ দেওয়া হোক না কেন, আমাদের নিজেদের মধ্যেই তো একতা ছিল না। পারস্পরিক প্রেমও ছিল না। আজও যে আছে হলফ করে তা বলতে পারি না। বিন্দু-আসলাম জুটি নাইবা হলাম, একই বৃন্তে দুটি কুসুমও কি হয়ে উঠতে পেরেছি কখনো??


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational