একতারা
একতারা
লাঞ্চ ব্রেকের পরে নিজের ডেস্কে বসেই একটু ঘুম ঘুম এসে যায় মঞ্জুলের, বিশেষ করে এই গ্রীষ্মের দীর্ঘ প্রহরে। এই সময়টা কাজ বিশেষ থাকেনা এক একদিন। আজও একটা দ্বিপ্রহরীয় দোদুল্যমান অবস্থা শুরু হয়েছিল কি হঠাৎই দুদ্দাড় করে এক ভদ্রমহিলার প্রবেশ।
-- " মজুমদার পাব্লিকেশনেরই অফিস তো এটা?"
মঞ্জুলের দিবানিদ্রার ঘোর টা কেটে গেল। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানানোর সময়েই দেখল মধ্য-পঞ্চাশের, খড়কে-ডুরে শাড়ি পরিহিতা মহিলা, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগ, তীব্র গরমে হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে চলেন তিনি ,
--" আসলে আপনাদের অফিসের সামনে কোনো বোর্ড দেখলাম না, জায়গাটা খুঁজে পেতে খুব দেরি হলো। একটা বিশেষ প্রয়োজনেই আসা। "
বলে একটু থামলেন ভদ্রমহিলা, মঞ্জুল সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললো, " বসুন, একটু জল খাবেন? "
--" না, না ধন্যবাদ ", আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে একটু হাসি ফুটিয়ে তুললেন ভদ্রমহিলা।
আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভদ্রমহিলা নিজেই বলতে শুরু করলেন,
--" আমার নাম কমলিকা স্যান্যাল, লেখক অশ্বিন স্যান্যালের স্ত্রী। সম্পাদক রাজশেখর মজুমদার আমার স্বামীর বিশেষ পরিচিত ছিলেন, ওনার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল, একবার দেখা করা যাবে? "
--" লেখক অশ্বিন স্যান্যাল!! মানে সেই বিখ্যাত "পত্রপাঠ" উপন্যাস..... "
বিস্মিত মঞ্জুলকে থামিয়ে দিয়ে কমলিকা বলে উঠলেন,
--"হ্যাঁ, তিনিই আমার স্বামী, এই মজুমদার পাব্লিকেশন থেকেই 'পত্রপাঠ ' প্রকাশ পায়।"
--" কিন্তু, আমি তো শুনেছিলাম উনি আর লেখালিখি করেন না, সম্ভবত অসুস্থ... "
--" হ্যাঁ, বছর ছয়েক আগে ওনার প্রথম সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়, বলতে পারেন তারপর থেকেই ঘরবন্দী।
এখন অবস্থা এমনই যে কখনো কখনো চেনা মানুষকেও চিনতে পারেন না, কোনো কথাও মনে রাখতে পারেন না, এখন তো দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। "
একটু থেমে ব্যাগ থেকে এক গোছা কাগজ বের করলেন কমলিকা ;আবার বলতে শুরু করলেন ,
--" এগুলো আমার স্বামীর কিছু অপ্রকাশিত লেখা, অনেক আগেরই লেখা, কিন্তু তখন কোনোদিন এই লেখাটি প্রকাশ করতে চাননি, যখন সুস্থ ছিলেন তখন বলতেন কোনোদিন যদি উনি আত্মজীবনী লেখেন তবে এই লেখা তার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকবে।"
কাগজগুলো এগিয়ে ডেস্কের উপর রেখে উনি বলে চলেন, " কিন্তু এখন তো মানুষটার জীবনটাই সংকটে। ওষুধপত্র, চিকিৎসার খরচ আর চালানো খুবই অনিশ্চিত এখন, তাও একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে.. মানে যদি এই লেখাগুলো দিয়ে কিছু ব্যাবস্থা করা যেত, এই ব্যাপারেই রাজশেখর বাবুর কাছে অনুরোধ করতাম। "
মঞ্জুল এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল, কাগজ গুলো হাতে তুলে নিয়ে এবার বললো,
--" কিন্তু আজ তো রাজশেখর বাবু অফিসে নেই, আপনি বরং অফিসের ফোন নম্বরটা নিয়ে যান, উনি কবে থাকবেন সেটা বরং ফোনে জেনে নিয়ে আসবেন।"
লেখাটা ফিরিয়ে দিতে গিয়েও মঞ্জুল জিজ্ঞেস করল, " আমি কি একবার লেখাগুলো দেখতে পারি?"
--"হ্যাঁ নিশ্চয়ই "
কাগজের পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে মঞ্জুলের আঙুল একদম শেষ পৃষ্ঠায় থেমে গেল, কয়েক ছত্র কবিতা বুঝি উপসংহার টেনেছে...
যে সুর ছিঁড়েছে, যে স্বর ভেঙেছে
সেইটুকু দানে দাও
দাতা, সেইটুকু দানে দাও।
শতছিন্ন আসনে বিরাজিলে তুমি,
শত শুষ্ক কমলে সাজলে
না জানি কত শত কৌশলে
বৈরাগে মিত জাগালে
যে তার ছিঁড়েছে, যে সাধন ভেঙেছে
সেইটুকু দানে দাও
দাতা, সেইটুকু দানে দাও।।
বার দুয়েক লেখাটা পড়ে, মঞ্জুল কাগজগুলো এগিয়ে দিল, তারপর কমলিকা দেবীকে জিজ্ঞেস করল, "অশ্বিনবাবু এই লেখা নিয়ে আর কিছু বলেননি? "
কমলিকা একটু ভাবলেন, লেখার উপর আলতো আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বললেন, " ক'দিন আগে পুরাতন এক কাঠের বাক্সে পেলাম লেখাগুলো, ওনার হাতে দিয়ে বললাম, দেখো তো কিছু মনে পড়ে? , মজার কথা কি জানো, যে মানুষটা আজকাল আর কোনো কথাই মনে রাখতে পারেন না, ঠিক করে কথাও বলতে পারেন না, সেই মানুষটাই এই কাগজের গোছাটা হাতে নিয়ে কত কি বলে গেলেন সেদিন।"
--" কি বললেন? " মঞ্জুল কৌতুহলী।
--" ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি আওড়াচ্ছিলেন বুঝতে পারলাম , কাগজগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলছিলেন,
' তিনুদাদা আর খেলার মাঠে আসতো না, যেদিন বল কুড়োতে বাউলদের আখড়ায় গেল, তার পরদিন থেকে আর খেলতে আসতো না। বিকেল হলেই ও যেত সেই বাউলদের আসরে, একদিন দেখলুম ছোট্ট একটা একতারা নিয়ে সুর সাধছে, মনে হলো সে সুর এক এক টানে ঈথরে অনুরনন তুলছে। তিনুদাদা কে দেখলুম, তার চোখ বন্ধ, মুখে অপার মুক্তির হাসি, একটা হাত আকাশপানে তুলে যেন মেঘসায়রে ঢেউ খেলাচ্ছে। মনে হলো এই কি তবে সদাশিবের আনন্দতান্ডব? খুব হিংসা হলো, মনে মনে ভাবলুম ওই একতারা টাই এসবের মূলে, ওই একতারাই আমার খেলার সঙ্গীকে কেড়ে নিয়েছে,ওই একতারাই আমার তিনুদাদা কে আমাদের চেয়েও বেশি আনন্দ দিচ্ছে।
ভাবলুম ওই অপার্থিব সুর ওকে ভুলিয়ে দিতে হবে, কেড়ে নিতে হবে ওই একতারা'। "
এতদুর বলে একটু থামলেন কমলিকা। মঞ্জুলের তর সইল না, জিজ্ঞেস করল, "তারপর! "
--"সেই ভেবেই না কি উনি এক দুপুরে, তিনুদাদার একতারাটা চুরি করে লুকিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু তারপরও তিনুদাদা মাঠমুখো হয়নি। উনি তিনুদাদাকে বলেছিলেন,
' যা হারিয়েছে তা ভুলে যাও' ;
চোখের জল মুছতে মুছতে তিনুদাদা না কি বলেছিলেন,
'ভুলতে চাইছি বলেই তো ভুলতে পারছি না, যতদিন ভোলার চেষ্টা করব ততদিন আরও স্পষ্ট ভাবে মনে পড়বে ওই একতারার কথা। একটাই তার, শত সুর, সহস্র কথা....। জানিস, বাউলরা কখনো গান লিখে রাখে না, ওদের কাছে শুনেছি যে জীবনের কথা ওরা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা রোজ করে, সেই কথাই ওদের গান বেঁধে দিয়ে যায়।
একটাই জীবন, শত অনুভব, সহস্র কতকথা।'
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে মঞ্জুল জিজ্ঞেস করে,
" আর সেই একতারাটা? ওটা কি এখনো আছে অশ্বিনবাবুর কাছে?"
কাগজের গোছাটা ব্যাগে ভরে কমলিকা দেবী বললেন, " হ্যাঁ, ওই কাঠের বাক্সেই আছে একতারাটা এখনো, শুধু তার টা ছিঁড়ে গিয়েছে। "
