নন্দা মুখার্জী

Drama Inspirational

3  

নন্দা মুখার্জী

Drama Inspirational

একতাই শক্তি

একতাই শক্তি

1 min
327



  শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই মানবী বুঝতে পেরেছিলো এ বাড়িতে ভালোভাবে  থাকতে গেলে শ্বাশুড়ির মন জুগিয়ে চলতে হবে | তাছাড়া তার গ্রাজুয়েশনটাও শেষ হয়নি | যদিও বিয়ের আগেই বাবা বলেছিলেন ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার পর বিয়েটা হোক | কিন্তু বিমানের ঠাকুমার শরীর খারাপ তিনি নাতবৌকে দেখে যেতে চান তাই তারা কথা দিয়েছিলো বিয়ের পর বৌয়ের পড়াশুনায় তারা কোন বাঁধা দেবেননা | কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এ বাড়ির বৌ হয়ে ঢুকেই মানবী বুঝতে পারে তার শ্বাশুড়ির ইচ্ছা নয় বৌ আর পড়াশুনা করুক | বিমানকে সে জানিয়েছিল | সে বলেছিলো মায়ের সাথে কথা বলবে | রোজই রাতে শুতে গিয়ে মানবী বিমানের কাছে কথাটা জানতে চায় | বিমান উদাসভাবে প্রতিদিনই উত্তর দেয় সুযোগ হয়নি | নূতন বৌ স্বামীর সাথে অশান্তিও করতে পারেনা | প্রথমে সে তার দেওরকে হাত করে | তাকে বলে সে তার সমস্যার কথা | দেওর বিধান একটি বেসরকারি ফান্ডে ভালো মাইনের কর্মচারী | বিমান একজন সরকারি কর্মী | দুই ভাইই মাইনে পেয়েই সংসার খরচের টাকা মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয় | বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের টিচার | এখন অবসর নিয়েছেন | প্রয়োজন না হলে অন্নদাদেবী ওই টাকা তোলেননা | কিন্তু সংসারের তিনি যেটা বলবেন তার অন্যথা করার সাহস কারও নেই | তাহলেই তিনি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবেন | 


  দেওরের সাথে পরামর্শ করে মানবী রান্নাঘরে ঢোকে | শ্বাশুড়ির হাতে হাতে কাজ করতে থাকে | সেখানে পরিবারের  সর্বক্ষণের হেলপিংহান্ড অপলাও আছে | একটু পরে বিধানও সেখানে আসে | 

--- বৌদি তুমি এখানে কি করছো ? তোমার না সামনে ফাইনাল পরীক্ষা ?

--- ওই আর কি মাকে একটু কাজে সাহায্য করছি | সন্ধ্যায় পড়তে বসবো | 

 অন্নদাদেবী ঘাড় বেঁকিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন ,

--- মেয়েদের যেজন্য পড়াশুনা দরকার সেটা তো হয়েই গেছে | এখন আর পড়াশুনা করে কি লাভ ?

 চোখের ইশারায় বিধান বৌদিকে  চুপ করতে বলে নিজেই মাকে বললো ,

--- মেয়েরা কিজন্য পড়াশুনা করে মা ?

--- ওই একটা ভালো চাকরি করা ছেলে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য |

--- হাসালে মা -- সে যুগ চলে গেছে | এখন প্রতিটা মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় | পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাইরে কাজ করছে | সংসারের চাহিদা বেড়েছে | একজনের উপার্জনে এখন আর সংসার চলেনা | তাই দুজনকেই এখন রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে হয় | আমি তো বাবা চাকরি করা মেয়ে ছাড়া বিয়েই করবোনা | বৌদিও পড়াশুনাটা শেষ করে কম্পিউটারের কোন একটা কোর্স করে নাও | ঠিক কিছু একটা পেয়ে যাবে |

--- আর সংসারটা আমি এক ঠেলবো ?

--- তাই বলো এটাই তোমার অসুবিধা ? দুজনে মিলে রোজগার করলে একটার কাছে দুটো কাজের লোক রাখতেও কোন অসুবিধা হবেনা | একটা কাজ করলে হয়না মা ? পরীক্ষার কটাদিন বৌদি বাপের বাড়ি চলে যাক | ওখান থেকেই পরীক্ষাটা দিক |

--- আমার মত নেই |

--- কিন্তু মা তুমি তো বিয়ের আগে বৌদির বাপের বাড়িতে কথা দিয়েছিলে বিয়ের পরেও তুমি তার পড়াশুনায় কোন বাধা দেবেনা | তবে এখন যদি তুমি সেই কথা অমান্য করো তাহলে সেই বাড়িতে তুমি মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হবে | না এটা শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগবেনা |

  অন্নদাদেবী মুখ ভার করে কাজ করে চলেছেন ছোটছেলের কথার কোন উত্তরই তিনি দিলেন না | 

--- কি হল মা কিছু বলো ?

 কিছুটা রুক্ষস্বরে বলে উঠলেন ,

_--- আমি আর কি বলবো ? বিমানের যদি আপত্তি না থাকে চলে যাক কাল বাপের বাড়িতে | পরীক্ষা আর যা যা কাজ আছে সব মিটিয়ে তারপর যেন ফেরে | এরপর কিন্তু আমি আর কোন কথা শুনবোনা |

 পরদিন স্বামী অফিস যাওয়ার পথেই মানবীকে তার বাপেরবাড়ি  পৌঁছে দিয়ে যায় | তখনও পরীক্ষার দিন পনের বাকি | বিয়ের ঝামেলায় বেশকিছুদিন বইয়ের সাথে কোন সম্পর্ক নেই | এবার বাড়িতে ফিরেই দিনরাত এক করে মানবী পড়াশুনা শুরু করলো | পরীক্ষা শেষে বিমান একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তাকে নিয়ে আসে | পুরোদমে সংসারে ঢুকে পরে মানবী | কিন্তু সংসারে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকেই সে পেপার দেখে নানান জায়গায় এপ্লিকেশন করতে শুরু করে তার দেওরের মাধ্যমে | বিধানও চায় বৌদি একটা চাকরি খুঁজে নিক | মানবীর  রেজাল্ট আউট হলে দেখা গেলো সে ফাস্টক্লাস পেয়েছে  | ইংলিশে অনার্স করেছে শুনে দু একটা টিউশনি বাড়িতেই আসতে থাকে | অন্নদাদেবী সেগুলো সবই ভাগিয়ে দেন | সংসারে অর্থের অভাব নেই অথচ ঘরের পাখা লাইট জ্বালিয়ে টিউশনি করে দুটো পয়সা ইনকাম করার পক্ষপাতী তিনি নন | মানবী ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকে কিন্তু অশান্তির ভয়ে চুপ করেই থাকে | দেওর কিন্তু চাকরির ব্যাপারে বৌদিকে উৎসাহিত করেই যায় প্রতিনিয়ত | কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিমান নিশ্চুপ | মনেমনে হয়তো সেও চায়না তার সুন্দরী বৌ বাইরে বেরিয়ে আর পাঁচটা পুরুষের সাথে মিশুক | মানবী ঠিক বুঝতে পারেনা বিমান আসলে কি চায় ?

 একদিন বিধান অফিস থেকে ফেরার পর বৌদির ঘরে আসে | তখন তার দাদাও সেখানে রয়েছে | পেপারের একটা কাটিং বৌদির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে ,

--- আজ রাতেই একটা সাদা কাগজের উপরে তোমার সম্পূর্ণ বায়োটা লিখবে | প্রত্যেকটা সার্টিফিকেট আর মার্কশিটের জেরক্স দেবে | যদি জেরক্স না থাকে আমাকে অরিজিনাল দিও আমি ওগুলো করিয়ে নেবো | 

 তারপর দাদার দিকে ফিরে বলে ,

-- বুঝলি দাদা বিবেকানন্দ কলেজে পার্টটাইম ইংলিশে একজন প্রফেসর খুঁজছে | কলেজ থেকে এখনো কোন বিজ্ঞাপন দেয়নি কিন্তু আমার বন্ধু তো ওই কলেজেই কর্মরত | ও বিয়ের সময় এসেই জেনেছিলো বৌদি ইংলিশ নিয়ে অনার্স করছে | মার্কসটাও বেশ ভালো বৌদির | আমার মনেহয় চাকরিটা হয়ে যাবে |

 বিমান ভায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ,

--- বাড়িতে আগুন জ্বলবে | অশান্তি আমার একদম পছন্দ নয় | 

--- দেখ দাদা এই ব্যাপারে আমি , তুই আর বাবা যদি বৌদির সাথে থাকি তাহলে মাকে ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবো | তোকে কোন ঝামেলা করতে হবেনা তুই শুধু আমাদের একটু সমর্থন করিস |


 যথাসময়ে ইন্টারভিউয়ে হাজির হল মানবী | সেখানে যেতেও ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলতে হল শ্বাশুড়ীকে | বিধানের সাথে একপ্রস্ত ঝামেলাও হল তার মায়ের | হাতে হাতেই চাকরির কনফার্মেশন লেটার নিয়ে মানবী বাড়ি এলো | বিধান এক বড় প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে বৌদিকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই হৈচৈ লাগিয়ে দিলো | দাদাকে অফিসে আগেই ফোন করে জানিয়েদিয়েছিলো | সেও হাজির | সবাই ড্রয়িংরুমে | বিধানই বোমটা ফাটালো | সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দাদেবী বলে উঠলেন ,

--- এটা আমি কিছুতেই মেনে নেবোনা | রোজ রোজ ঘরের বৌ সেজেগুজে চাকরি করতে বেরোবে আর আমি একা সংসার ঠেলবো --- ওসব চাকরি করার ধান্দা মাথা থেকে বের করে দাও |

 স্বামী আর দুইছেলে মিলে তাকে আপ্রাণ বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু কে শোনে কার কথা ? যেন গো ধরে বসে আছেন | শেষে বিধান বললো , 

--- তুমি যদি এ বাড়ির বৌদের চাকরি করা মেনে নিতে না পারো তাহলে আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে | কারণ আমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসি সে আমার কলিগ | আর তাকেই আমি বিয়ে করবো | বৌদি যদি মনেকরে সে এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তোমার সংসার নিয়ে পরে থাকবে --- সেটা সে করতে পারে কিন্তু আমি এ বাড়ি থাকবোনা |

--- যার যেখানে খুশি সে চলে যাক | বাপেরবাড়ির দরজা তো খোলা আছে | আমার এখান থেকে নয় বাপেরবাড়ি থেকে চাকরি করুক |

 সবকিছু শোনার পর বিমান বলে ,

--- তাহলে তো মা আমাকেও ওর সাথে বেরিয়ে যেতে হবে | আমিও চাই ও চাকরিটা করুক | আস্তে আস্তে এখানেই ওর পার্মানেন্ট হবে আশাকরি | দুজনের ইনকামে অতি সহজেই আমরা একটা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে পারবো |

 অন্নদাদেবী বিস্ফারিত চোখে তার বড় ছেলের দিকে তাকান | তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেননি তার বড়ছেলে তার মুখের উপর এ ধরণের কথা বলতে পারে | এবার মোহনবাবু ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে বললেন ,

--- তোদের তো উপায় আছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবি | কিন্তু আমি তো ত্রিশবছর আগেই সে পথ বন্ধ করেছি | যা তোরা এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু শান্তিতে থাক | কথাটা বললেন বটে কিন্তু বুকটা তার দুরুদুরু করতে লাগলো এই বুঝি তার স্ত্রী তার দিকে ঝাঁপিয়ে পরে | 


 বেশ কয়েকবছর পরে --

 বিধান বিয়ে করেছে তার সেই কলিগকে | বিমানের পাঁচবছরের ফুঁটফুঁটে একটি মেয়ে সারাবাড়ি দাঁপিয়ে বেড়ায় | মোহনবাবু বছরখানেক আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন | মানবীর চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়েছে | বিধানের অফিস থেকে তিনবছরের জন্য তাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছে | বৌ রুমানা বাপের বাড়িতেই থাকে অধিকাংশ সময় | মাঝে মধ্যে দুএকদিনের জন্য এ বাড়িতে আসে | তারউপর বিধান বাইরে চলে যাওয়ার পর জানতে পেরেছে সে মা হতে চলেছে | তাই মানবী এখন তাকে  পুরোপুরি বাপের বাড়িতেই থাকতে বলে | বাড়িতে ঠিকে কাজের মেয়ে ছাড়াও আর একটি মেয়ে সবসময়ের জন্য থাকে | হঠাৎ করেই একদিন অন্নদাদেবী বাথরুমে পা পিছলে পরে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন | মানবী কলেজ ছুটি নিয়ে কিছুদিন থাকলেও বিমান সেই মুহূর্তে কোন ছুটি পায়না | যতই কাজের লোক থাকুকনা কেন --- মানবী দশভূজার মত দুরন্ত পাঁচ বছরের শিশুকন্যা , অসুস্থ্য শ্বাশুড়ি আর সংসার সুনিপুনভাবে করে যেতে থাকে | অন্নদাদেবীর সেই রাগ আর তেজ  অনেকদিন আগেই চলে গেছে | এখন তিনি বড়বৌমা বলতে অজ্ঞান | পরিবারের সব সিদ্ধান্তই এখন মানবীই নেয় | আর শান্তশিষ্ট বিমান তার বৌয়ের সব সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে কারণ মানবীর সিদ্ধান্তগুলি সবই তার সংসার আর পরিবারের উন্নতিই সাধন করে সবসময় |

   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama