এ যুগের শ্বাশুড়ি
এ যুগের শ্বাশুড়ি


-- বলি ও গিন্নি এবার বেরোও অনেক দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই | শুভক্ষণ থাকতে থাকতে তো সেখানে পৌঁছাতে হবে |
-- বাবা , আমি রেডি |
সমরবাবু তাকিয়ে দেখেন তার অষ্টাদশী মেয়ে জিন্স আর টিশার্ট পরে দাদার আশীর্বাদে যাবে বলে সেজেগুজে চলে এসেছে |
-- আজকের দিনে তুই এই ড্রেসটা না পড়লেই পারতিস | বাঙ্গালীর সাংস্কৃতি বলে তো একটা কথা আছে | যা মা ঘরে গিয়ে শাড়ি বা চুড়িদার পরে আয় |
-- আমি তো এই ড্রেস পরেই সবজায়গায় যাই | তবে আজ পড়লে অসুবিধা কোথায় ?
--- কইগো চলো আমার হয়ে গেছে | এতক্ষণ তো চেঁচাচ্ছিলে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে , আমার তো ছেলেটার জন্য দুটি ফুটিয়ে বেরোতে হবে --- ওই বাড়িতে আমরা নাহয় আজ ভালোমন্দ খাবো --- আরে হা করে দাঁড়িয়ে --
-- দেখো তোমার মেয়ের ড্রেস | যাবো ওর দাদার বিয়ের আশীর্বাদ করতে, বললাম ছোটদের যেতে নেই , যদিবা রাজি হলাম উনি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে চলে এলেন --|
এতক্ষণে সাবিত্রীদেবী মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার পোশাক |
--- এখন সকলেই এই পোশাক পরে | তবে হ্যা আজ না পড়লেই পারতো | খারাপ কিছু লাগছেনা | আমরা আর আমাদের সমাজের যতই উন্নতি হোকনা কেন কিছু কিছু জায়গায় আমরা আজও আমাদের বাঙালীয়ানাকে অস্বীকার করতে পারিনা | বিদেশী কালচার আজ আমাদের প্রতিটা পরিবারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে | ওয়েস্টার্ন পোশাক আর খাবার যতই খাইনা কেন আজও আমাদের কিছু কিছু অনুষ্ঠান আছে যেখানে এগুলো একটু বেমানান লাগে কিছু মানুষ বিরূপ সমালোচনাও করে থাকে | তাই জায়গা বুঝে পোশাকআশাক পরাই ভালো | তবে তোমাকেও বলে রাখছি আমি তুমি কিন্তু ভেবোনা তোমার বৌমাটি এসে কাপড় পরে ঘোমটা দিয়ে ঘুরঘুর করে বেড়াবে |
-- আরে ঘরের বৌ শাড়িতেই মানাই -- গিন্নির উদ্দেশ্যে কথাগুলি ছুড়ে দিলেন সমরবাবু |
--- সে দেখা যাবে এখন চলো | দিদি আবার পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবে | দূর্গা দূর্গা করে এখন বেরিয়ে পড়ি | বলি ও বাবু , দরজাটা দে --
ছেলের উদ্দেশ্যে হাক পারলেন |
একমাত্র বড় ননদ শিবানী | তিনি বালিগঞ্জ থাকেন | ভগ্নিপতির শরীর খারাপ থাকাতে তিনি যেতে পারবেননা | সমরবাবুরা বেহালায় থাকেন | তারা যাওয়ার সময় দিদিকে নিদ্দিষ্ট জায়গা থেকে তুলে নেবেন বলেই কথা হয়েছে আর সমরবাবুর একছেলে একমেয়ে | মেয়ে সঞ্চালি এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে ইংলিশে অনার্স নিয়ে আর ছেলে সুখময় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে | অফিস থেকে পাঁচ বছরের জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা হচ্ছে তাই তড়িঘড়ি ছেলের বিয়েটা দিয়ে দিচ্ছেন সমরবাবু | তার মনে আবার ভয় রয়েছে ছেলে কোন বিদেশিনীকে বিয়ে করে নিয়ে না আসে | এ পর্যন্ত তিনি অনেক মেয়েই দেখেছেন কিন্তু বিয়ের পর কোন মেয়ের বাপ মা ই তাদের মেয়েকে অত দূরে পাঠাতে রাজি হননি | শেষে ভগ্নিপতির সহায়তায় এই মেয়েটি পছন্দ হয় আর পরিবারটিও রাজি হয় মেয়ে জামাই বাইরে গেলে তাদের কোন আপত্তি নেই এতে বরং তারা খুশিই হবেন |
জোরকদমে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল | সাবিত্রীদেবী একদিন মেয়েকে ডেকে বললেন ,
--- শোন মা আজ বিকালে আমি আর তুই একটু শপিংয়ে যাবো | কাউকে কিছু বলবিনা |
--- কেন মা ? কি কিনতে যাবো ?
--- সে গেলেই দেখতে পাবি | বাবাকে কি বলবে ?
--- ও নিয়ে তোকে কিছু ভাবতে হবেনা |
শপিংমলে ঢুকে একটা কাগজের চিরকুট মেয়ের হাতে ধরিয়ে বললেন , "একটু ভালো দেখে এই তুই যেমন ড্রেস পরিস এইরকম দুচারটে ড্রেস কেন তো |
-- এগুলো কার মা ?
--- এতো প্রশ্ন করিস কেন বলতো ? এগুলো সব তোর বৌদির |
--- বৌদির জন্য জিন্স , টিশার্ট , ল্যাগিস, কুর্তা এইসব কিনবে ?
--- কেন অসুবিধা কোথায় ? তুই যদি পরতে পারিস সে পরলে দোষ কোথায় ? ওহ তুই নিজের মেয়ে আমার পেটে হয়েছিস আর ও পরের মেয়ে অন্যের পেটে হয়েছে সেই কারণে ?
--- আরে না , আমি সেসব কিছু মিন করে বলিনি | আচ্ছা মা কখন আনলে তুমি বৌদির এই মাপগুলো ?
--- আরে আশীর্বাদে যাওয়ার আগেই আমি ওকে একদিন ফোন করে বলে দিয়েছিলাম দোকানে গিয়ে মাপগুলো লিখে আনতে | ও রেডি করে রেখেছিলো তোরা যখন তিনজন বেরিয়ে গেলি আমি বাথরুমে যাওয়ার নাম করে ভিতরে ঢুকলাম না ? ওই তখনই মাপটা আনতে গেছিলাম | জানিস মুক্তা আমার হাতে কাগজটা দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে কি আদর | আর বলে, 'আমার খুব চিন্তা ছিল ; আমি তো শাড়ি পরতেই পারিনা | আজ কদিন ধরে মা শাড়ি পরা শেখাচ্ছেন | সত্যি তুমি খুব ভালো মামনি |'
-- তোমায় মামনি বললো ?
--- হ্যাঁ তাই তো বললো -- আর ওর মা কি খুশি | আমায় জড়িয়ে ধরে বললো ,' বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেলো দিদি | একমাত্র মেয়ে আমার | খুব চিন্তায় ছিলাম ওর শ্বশুরবাড়ি কেমন হবে তাই নিয়ে | যেদিন আপনি ফোন করে ওকে দোকানে গিয়ে মাপগুলি আনতে বললেন সেদিনই বুঝতে পেরেছি কোন ভুল আমরা করিনি | জম্মের পর থেকে মেয়েকে মানুষ করে পরের হাতে তুলে দিতে যে কত কষ্ট তা যার মেয়ে নেই সে কোনদিনও বুঝবেনা |'
বিয়ে হয়ে গেলো সুখময় ও মুক্তার | বৌভাতের দিন সকালবেলা ভাত কাপড় দেওয়ার সময় দু ট্রে ভর্তি জামাকাপড় আর এক থালাতে মাছ , ভাত ,মিষ্টি ,পায়েস , পঞ্চব্যঞ্জন | জামাকাপড়ের ট্রেটায় সকলের নিচুতে কাপড়টা আর উপরের দিকে জিন্স , চুড়িদার | এক প্রতিবেশী কিছু বলতে গেলে সাবিত্রীদেবী বলে ওঠেন ,
--- এখনকার মেয়েরা কাপড় খুব কম পরে | তাই যে পোশাক তারা পরে সেগুলিই তো দেওয়া হয়েছে | নিয়ম রক্ষার্তে একটি তাঁতের শাড়ি তো আছে | তারা যা পরে বা পরতে ভালোবাসে বিয়ের সাথে সাথে সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে আজকের যুগেও ঘোমটা পরা বৌ হয়ে থাকতে হবে | আমাদের সময়ে আলাদা ব্যাপার ছিল | কিন্তু আজকের দিনের মেয়েরা ঘরে বাইরে সমান পাল্লা দিয়ে চলেছে | আমরা আমাদের সময়ে সুখস্বচ্ছন্দ সবকিছু ভুলে পরের বাড়িতে এসে তাদের সুখস্বচ্ছন্দকেই আপন করে নিয়েছি | যুগের পরিবর্তন হয়েছে | আমাদের মানসিকতারও তো পরিবর্তন আনতে হবে | আমার মেয়েটি জিন্স পরে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা যদি আমার চোখে দৃষ্টিকটু না লাগে ছেলের বৌটি পরলে মেনে নিতে পারবোনা কেন ? মেয়ের বিয়ে দিয়ে জামাইকে ছেলে ভাবতে পারবো , ছেলের বিয়ে দিয়ে তার বৌটিকে মেয়ে ভাবতে পারবোনা কেন ? আর এটা কেউ ভাবতে পারেনা বলেই শ্বাশুড়ি বৌয়ের ঝামেলাটা লেগেই থাকে | যাগকে এসব কথা | এবার দে দেখি বৌমাকে ভাত কাপড়টা দে |
আত্মীয়স্বজন , পাড়াপ্রতিবেশীরা এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মুখে তাদের কোন কথা নেই | কারণ সাবিত্রীদেবীকে পাড়ার বৌঝিরা একটু এড়িয়েই চলে | অনেকেই তার অনুপস্থিতিতে তাকে ঠোঁটকাটা বলে সম্মোধনও করে থাকেন | সোফায় বসে থাকা সমরবাবুর কানে সবই গেলো | কিন্তু তিনিও কোন বাক্য ব্যয় করলেননা | কারণ গিন্নির কথাগুলো তার আজ যুক্তিগ্রাহ্য বলেই মনে হল | তিনি অনুষ্ঠান মিটে গেলে হাসিমুখে সেখান থেকে উঠে যেতে যেতে মনেমনে বললেন, 'গিন্নি তোমার মত একটি শ্বাশুড়ি যেন আমার মেয়েটিও পায়|'