দূরে কোথাও, দূরে দূরে...
দূরে কোথাও, দূরে দূরে...
।। দূরে কোথাও, দূরে দূরে... ।।
নবকুমার দাস
রক্তে আমার সুদূরের আহবান।
আরো দূরে। আরো দূরতর প্রান্তে কোথাও আমাদের এই পৃথিবীর মত অন্য কোন গ্রহ থেকে নিরন্তর আহবান আসছে।সুদূরতর গ্রহ নক্ষত্রের জগৎ থেকে বাসিন্দারা ডাকছে, বলছে, "এসো আমাদের দেখ. . .। তোমরা যারা আর্থ লাইক প্ল্যানেট খুঁজছ আমাদের দেখ ? কিন্তু আমরা খুঁজছি আমাদের মত জগৎ। "
আমিও বোলপুরে খোয়াইয়ের বনবাংলোর গবেষণাগারে বসে ওদের আহ্বান টের পাই । ওই মহাশূন্যের ওপর থেকে কি আহ্বান ভেসে আসে তা ধরার জন্যে আমার গবেষণাগারে ছোট্ট একটা যন্ত্র বসিয়েছি। অবশ্য যন্ত্রটি আমারই তৈরী। নাম দিয়েছি ''বি কিউব প্রোব''। বি কিউব-এর পুরো কথা আমার নাম বন বিহারি বক্সী। এবং প্রোব বা PROBE হল প্ল্যানেট রিসার্চ অবজার্ভার বিয়ন্ড আর্থ। সোজা কথায় পৃথিবীর বাইরে পৃথিবীর মত গ্রহ অনুসন্ধানের উপযোগী যন্ত্রটি ।
সেই ছোটবেলা থেকে পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও প্রাণীজগৎ আছে কিনা জানার জন্যে হন্যে হয়ে আছি। বলা যায় পৃথিবীর দোসর খোঁজার জন্যে মুখিয়ে থাকি কিন্তু প্রায় পৃথিবীর মত সাত হাজার গ্রহের সন্ধান পেলেও আমরা এখনো নিশ্চিন্ত নই। আসলে শুধুমাত্র পৃথিবীর মত আকৃতি হলেই তো হবে না। চাই পৃথিবীর মত আবহমন্ডল,মধ্যাকর্ষন ,আলো-বাতাস। আরো কত কি আছে। সবটুকু মেলা সহজ নয় মোটেও। তবুও সন্ধান চলছে। এবং যতদিন মানুষ আছে,বিজ্ঞান গবেষণা আছে এই সন্ধানও চলতে থাকবে।
কিন্তু নতুন বছরের প্রথম দিনে এমন আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটবে তা আমি তা আমি ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বলতে গেলে একটুও টের পাইনি আগে। সবই আমাদের প্রতিবেশীর ইচ্ছে। প্রতিবেশী বলতে আমার বাগানবাড়ির পড়শি রাখহরি দত্ত নয়। এই পড়শি সারা পৃথিবীরই পড়শি ।পুরোপুরি মহাজাগতিক ব্যাপার। আমার তৈরি ছোট্ট মানমন্দির বি কিউব প্রোব গবেষণা কেন্দ্রের নীলকান্ত সুপারকম্পিউটারে যেসব বার্তা গতরাত থেকে আসতে শুরু করেছে তা অভাবনীয়। আমি বুঝতে পারছি না যে আমি জেগে আছি না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। উঁহু জেগেই আছি ,নিজেকে চিমটি কেটে এবং আমার পোষা কুকুর টাইগারের হাঁকডাক এবং পোষা পুঁচকে কুমীর ডারউইনের নড়াচড়া দেখে তাই বুঝেছি।তাছাড়া আমার অজানা ভাষা বোঝার যন্ত্র কথাভাষ্য যে বার্তা দিচ্ছে তা মিথ্যে হতে পারে না।
নীলকান্ত সুপারকম্পিউটার এবং কথাভাষ্য নামের এই বহুভাষাবিদ অনুবাদক টেলিপ্রেটার এর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের আকাশসীমার প্রান্তে অন্যবিশ্ব বা অন্যগ্রহের প্রাণী এসেছে। ওরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়।
" চমৎকার সংবাদ,অভাবনীয় সংবাদ - ওঁরা অন্তরীক্ষে এসে গেছে । "
- এই মেসেজটা শুধু কম্পিউটারের মনিটরে নয় , আমার 'মনমোহন' গ্যাজেট এও বিপবিপ শব্দেও জানিয়ে দিচ্ছে। ভাবলাম নতুন কোনো ভাইরাস একযোগে আক্রমণ শানিয়েছে সবগুলি বৈদ্যুতিন যন্ত্রে। কিন্তু ,মনমোহন গ্যাজেট যা কিনা আমার ভাবনা তরঙ্গের সঙ্গে ম্যাচিং পেয়ার - সেটি বলছে - এই বার্তা ভুল নয়- ভাইরাসও নয়।
ওদিকে অন্য যে কোন ভাষা থেকে শুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজিতে অনুবাদ করার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র কথাভাষ্য এক রকম যান্ত্রিক ও ধাতব খ্যাড়খেরে গলায় বলতে শুরু করেছে,"মাননীয় বি কিউব থুড়ি ডক্টর বনবিহারী বক্সি আমরা আসছি তৈরি থাকুন।"
এইসব শুনে আমার মাথা খারাপ হবার যোগার কারণ দশকের পর দশক ধরে যাদের প্রতীক্ষায় সারা পৃথিবীর তাবৎ মহাকাশ বিজ্ঞানী নিরন্তর গবেষণা ও সন্ধানে মেতে আছে সেই ই.টি. বা এলিয়েন আমাদের দোরগোড়ায়।কিন্তু আমরা বলতে ঠিক কারা ? কোথা থেকে আসছে ?
আমি অবাক হলাম।এ কি ঘটতে চলেছে ? অজস্র প্রতি প্রশ্ন জেগে উঠল মনের মাঝে। সত্যিই কি আছে মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী এই বিশ্ব নিখিলে ? থাকা সম্ভব?
এইসব নিয়ে যখন একা ভাবছি তখন আমার কুক কাম কেয়ার-টেকার-কাম-লোকাল গার্জেন করালী কিঙ্কর আমায় ডাকলো। অত্যন্ত জরুরী কিছু না হলে সাধারণত এভাবে আমাকে ডাকার কিংবা খবর দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু আমার বাংলো ধাঁচের এই বাগানবাড়ি বনবাসে এমন কি ঘটলো যে করালীকিংকর আমার গবেষণাগারেই ছুটে এলো। ল্যাবের দরজা খুলে দেখি সে উদ্বিগ্নমুখে দাঁড়িয়ে আছে। উস্কোখুস্কো চুল, চোখ লাল। ঠিক তার পিছনে জিজ্ঞাসু চোখে টাও দাদুভাই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে অজস্র প্রশ্ন।
করালি বলল,"টাও দাদুভাই এসেছে কি সব জিজ্ঞেস করছে ?"
এই সাত সকালে আমার তুতো নাতি টাও যার পোষাকি নাম সোমশুভ্র বক্সী বিশ্বভারতীর হোস্টেল ছেড়ে এসেছে কেন ? নিশ্চয়ই হ্যাপি নিউ ইয়ার বলতে নয়। সেই কথা জিজ্ঞাসা করতেই সোমশুভ্র বলল,"তো, ছোড়দাদু কি হয়েছে বলোতো ? দেখলাম তুমি আজ ভোরবেলায় আমার হোস্টেলে গিয়েছিলে। এবং কিছু না বলে চলেও এলে। ফোন করে ডাকলেই তো পারতে।"
আমি অবাক হলাম। তারপর বললাম," গতকাল সন্ধে থেকে তো আমি ল্যাবে কাজ করছি। সারারাত ঘুমোইনি। বাইরেও যাইনি। কয়েকবার মাত্র ল্যাবের পাশের টয়লেটে গিয়েছিলাম। তুমি কি দেখতে কি দেখেছ কি জানি ! শরীর ঠিক আছে তো ? ডাক্তার ডাকবো ?"
তবুও বুঝলাম কেমন যেন গোলমেলে লাগছে ব্যাপারটা । তাছাড়া আমি হঠাৎ ওর হোস্টেলেই বা যাব কেন ? দরকার পড়লে করালী কিংকরকে পাঠিয়ে দিই কিংবা হোস্টেলের ল্যান্ডফোনে ফোন করি। তারপর সুবিধামত দেখাশোনা হয়। বিশ্বভারতীর ওই হোস্টেলে ওদের কাছে মোবাইল ফোন রাখার নিয়ম নেই নইলে ব্যক্তিগত ফোনেই কথা বলতাম।কিন্তু খামোখা ভোরবেলায় ছুটবো কেন ? আমার তো স্লিপ ওয়াকিংয়ের অসুখ নেই ! তাহলে ?
কিন্তু কিছু একটা যে ঘটেছে সেটা টের পেলাম এর পরেই। আমার বাগান বাড়ির পাশের বাড়িতে থাকেন রাখহরি দত্ত। ছোট্ট একটা বাগান আছে ওঁর বাড়িতে। উনি বয়স্ক মানুষ। অবসর নেওয়া হাইস্কুল শিক্ষক। একটু পরেই গলায় কাশির আওয়াজ তুলে বাড়ির সদর দরজা থেকেই হাঁক পাড়লেন ,"বলি, ও বক্সী মশাই বাড়িতে আছেন ?"
করালী সাড়া দিল প্রথমে। তারপর সদর দরজা খুলে দিতেই ভদ্রলোক বাড়ির ভিতরে ঢুকে হন্তদন্ত হয়ে যা বললেন তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম।!
বলে কিনা আজ ভোর বেলায় আমি নাকি ওঁর বাগানে পায়চারি করেছি,ওঁর শখের বাগানের গাজর নাকি আমি ইচ্ছে মত তুলে নিয়েছি। লজ্জার মাথা খেয়ে তখন তিনি নাকি আমায় ডাকতে পারেন নি.পাগল কোথাকার !
আমি বললাম," বলেন কি ? গতকাল সারারাত আমি ল্যাবরেটরির বাইরেই আসিনি। সেই আমি কিনা চল্লিশ টাকা কেজি দরের গাজর চুরি করতে আপনার শখের সবজি বাগানে ঢুকেছি ? ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে লাগছে।
কথাটা শুনে উনিও চিন্তায় পড়লেন তা দেখে আমি বললাম,"কই চলুনতো, দেখে আসি আপনার গাজর ক্ষেতের হাল। "
ভদ্রলোকের রাগে গজগজ করতে গিয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললেন," বিশ্বাস না হয় চলুন।"
আমি এবং টাও দুজনে রাখহরি বাবুর সঙ্গে তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখি সত্যি সত্যিই ওনার পরিপাটি সবজি বাগানের গাজর ক্ষেতের ঠিক মাঝখানে ইংরেজি "টি " আকৃতির জমি থেকে সমস্ত গাজর কেউ যেন এক হ্যাঁচকা টানে তুলে নিয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে আশেপাশে কোথাও কোন পায়ের ছাপ নেই। কি আশ্চর্য !
কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার আরো বাকি ছিল। বনবাসে ফিরে আসতেই করালী কিংকর বলল,"একটু আগে কলকাতা থেকে সোমশুভ্রর বাবা রজতশুভ্র ফোন করেছিল। আপনাকে ফোন করতে বলেছে ।"
মোবাইল ফোনটা ছিলো বসার ঘরে টেবিলের উপর। টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি সেটা বেজে উঠলো। একটা আইএসডি কলের আওয়াজ। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলাম বললাম,"হ্যালো..."
ও প্রান্ত থেকে মার্কিন ইংরেজি উচ্চারণের কেউ বলল," আমি রিচার্ড বলছি হনলুলু থেকে।" বুঝলাম রিচার্ড বলতে রিচার্ড টমসন, এম.আই.টিতে আমার সহকারি গবেষক ছিল।
-"হ্যা, হ্যাপি নিউ ইয়ার। তুমি কেমন আছো ? ",আমি জিজ্ঞাসা করলাম। রিচার্ড যা বলল তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। ও বলল, "আপনি হনলুলুতে এসেছেন , আমায় একবার জানালেন না?"
একি বলছে রিচার্ড ? আমি দিব্যি আছি বোলপুর-প্রান্তিকেআমার খোয়াইয়ের বাড়িতে। আমি সে কথা বলতেই রিচার্ড বলল, "সে কি করে হয় ? হনলুলু সিটি সেন্টারে আমি আপনাকে দেখেছি। একটা গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন। আমি জানতে চাই আপনি কোথায় উঠেছেন ? আর যদি কোনো হোটেলে উঠে থাকেন তার নাম ও ঠিকানা বলুন প্লিজ। "
কী আশ্চর্য হনলুলুতে এখন বছর শেষের শেষ সন্ধ্যা। সবাই মেতেছে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে। আমি নাকি সেই উৎসবে মেতেছি সেখানে। অথচ আমি দিব্যি সশরীরে আছি ভারতবর্ষে,পশ্চিমবঙ্গে । কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই একই সঙ্গে আমাকে দেখা গেছে আমার ল্যাবরেটরীতে। প্রতিবেশী রাখহরি দত্তের সবজি বাগানে , বিশ্বভারতীর হোস্টেলও। ভাবতেই পারছিনা। কলকাতায় ফোন করলাম। সোমশুভ্রর বাবা (আমার ভাইপো) রজতশুভ্র মোবাইল ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলল কাকা তুমি কখন কলকাতায় এসেছো বলনিতো। তাছাড়া আর এই সাত সকালে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছ কিন্তু আমরা কেউ এসে সেই দরজা খোলার আগেই বা তুমি কোথায় চলে গেলে ?"
ওকেও আমি আমার পরিস্থিতির কথা বললাম। শুনে সে বিশ্বাস করতে চাইল না। সোমশুভ্র আমার ফোন নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সে জানালো যে আমি এখন বোলপুরের বনবাসেই আছি।
কি বিপদ, আমি প্রান্তিকের এই বনবাসের গবেষণাগারে আছি অথচ একই সময় অন্তত চারজন চার জায়গায় দেখেছে। সবার কি মতিভ্রম হলো? নাকি দৃষ্টি বিভ্রম যাকে বলে হ্যালুসিনেশন !ভাবতে হচ্ছে।
এতদিন আমি গবেষণা করছিলাম মহা বিশ্বের নানা প্রান্তের গ্রহ-উপগ্রহ-অন্তরীক্ষে কোনরকম প্রাণের সম্ভাবনা আছে কিনা তা নিয়ে। মহাবিশ্বে পৃথিবীই কি একমাত্র জায়গা যেখানে জটিল ও উন্নত জীবনের অস্তিত্ব আছে ,নাকি এই অসংখ্য রাশি-নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে কোথাও কোনো ঠাঁই আছে যেখানে উন্নত বা অনুন্নত কোন না কোন সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্বলিত জীবজগৎ আছে ? এ প্রশ্নের উত্তর
দেওয়া সম্ভব নয় সে কথা সবাই জানে, কিন্তু বিগত কয়েক শতক ধরে এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে আসছে।
মোটামুটি ভাবে ভৌতপদার্থবিদ, মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে প্রায় একশো কোটি গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে মাত্র গোটা দশেক গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা আছে। ওই সম্ভাব্য প্রাণ সম্পন্ন গ্রহ জ্যোতিষ্কের সন্ধানে মানুষ মহাকাশে বেশ কয়েকটি মহাকাশযান পাঠিয়েছে। সমানতালে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ চলছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত বহির্জগতের কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়নি। প্রচুর তত্ত্ব ও তথ্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ঠিক তবে আরো বেশি করে পাওয়া গিয়েছে কল্পবিজ্ঞানের গল্পে নানান উদ্ভট ভাবনা ও কাহিনী। তবে এইসব গল্প ও উপন্যাসগুলি নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে, আমাদেরকে ভাবিয়েছে। তবে এর বেশিরভাগই অবাস্তব।
কিন্তু আমার চারপাশে যেসব কান্ড ঘটছে সেইসব দেখে চমকে উঠছি।একইসঙ্গে পৃথিবীর নানান প্রান্তে মানুষজন আমাকে সশরীরে দেখতে পাচ্ছে আর তাঁরা ফোন কল এবং ইমেইল করে যাচ্ছে। এসব দেখেশুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেছি। কি করব বুঝতে পারছি না। আসলে দিন কয়েক ধরে গবেষণার প্রায় চূড়ান্ত পর্বে এসে পৌঁছেছি। এই পরিস্থিতিতে এমন উদ্ভট ঝামেলা নেওয়া যাচ্ছে না আর।
সশরীরে আছি বোলপুরে কিন্তু আমি কাল রাত্রে যেখানে যেখানে যাব ভেবেছি কিংবা যে সব জায়গার কথা কখনো কোনো মুহূর্তের জন্যও ভেবেছি সেই সব জায়গায় আমাকে দেখা গিয়েছে ! অর্থাৎ মনের গতিতে গতিশীল হয়ে আমার চেহারা ওই সব জায়গায় পৌঁছেছে যা কিনা কোন মহাকাশযান এর পক্ষে অসম্ভব। আলোর গতিবেগে চলাফেরা করা কল্পনাতেও সম্ভব নয়। কতটা যুক্তিযুক্ত হওয়া উচিত জানিনা তবে বিশ্ব নিখিল বিশ্বের সব ঘটনার কি ঠিকঠাক যুক্তি পাওয়া গিয়েছে ? অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি, পৃথিবীর নানান প্রান্তে সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে অসংখ্য নামী-অনামী গবেষক-বিজ্ঞানী। আমি সামান্য একজন বাঙ্গালী গবেষক মাত্র।খুঁজছি নিজের মত করে।
আজ রাতে আমার নিজের তৈরি মহাকাশযান আর্যভট্ট চড়ে আমি আকাশ-মহাকাশের সীমান্তে রওনা দেব। সঙ্গে থাকবে আমার মনমোহন গাজেট ,কথাভাষ্য ইন্টারপ্রেটর যন্ত্র এবং বিমোচনগান। এছাড়া অনেকগুলো দর্শক এবং পরিদর্শক যন্ত্রও থাকবে। কিন্তু দুপুরের মধ্যেই একটা অঘটন ঘটে গেল। আকাশযানে সোলার প্যানেলগুলো সম্পূর্ণ রিচার্জ করব বলে বাংলোর আমলকি গাছের কাছে ফাঁকা মাঠে রেখেছিলাম।বেলা বারোটা নাগাদ হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ চমকে দেখি আমলকি গাছটাকে ঘিরে এক অদ্ভুত কুয়াশা। ওই দিকে মানে আমার ছোট্ট ক্যাপসুল মহাকাশযান আর্যভট্টের কাছাকাছি থাকা সব গাছপালা অদৃশ্য-অস্পষ্ট। কি ঘটেছে তা জানার জন্য সেদিকে ছুটে এসে দেখি আমি মহাকাশযানের ভিতরে আরাম কেদারায় বসে আছি। ডিম্বাকৃতি এই মহাকাশযানের জানালা ভিতর থেকে বন্ধ। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে আমি দেখলাম আমি দ্রুত উপরে উঠছি। প্লেন টেক অফ করার পর যেমন ভূতলকে যেমন দুই মাত্রিক ,তিন মাত্রিক দেখায় তারপর অদৃশ্য হয়ে যায় ঠিক তেমনি নিচের বাড়িঘর,গাছপালা,কোপাই নদী,বোলপুর শহর শান্তিনিকেতন অজয় নদ সব দেখতে পাচ্ছি। তারপর একসময় সবকিছু দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
তাহলে আমি আছি কোথায় এখন ? প্রশ্নটা মাথায় এলো এবং কী আশ্চর্য গতকালের সেই খ্যারখেরে গলা শোনা গেল। মহাকাশযানের ভিতরে থেকে কথাগুলো ভেসে এলো," ডক্টর বক্সী এখন আপনি আছেন আমাদের মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামের গ্যালাক্সির শেষপ্রান্তে। এবার ওখান থেকেই এক ঝটকায় পৌঁছাবেন আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জে।"
অবাক বিস্ময়ের উপর মহাবিস্ময় কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তবু ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞাসা করলাম,"বেশ আপনি বা আপনারা কারা ? কোথায় আপনাদের নক্ষত্রপুঞ্জ ?"
খ্যারখেরে গলাতেই বললো," আমরা যে কি এবং কোথা থেকে এসেছি সে কথা বললেও আপনারা মানে মানুষেরা বুঝবেন না। তবে এটুকু জেনে রাখুন আমরা যাকে ইটি বা এলিয়েন বলেন তা নই। জীব ও জড়ের যে ধারণা আপনাদের পৃথিবীতে আছে তার সঙ্গে বিচার করলে আমাদের বুঝতে পারবেন না। আমরা মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়। পার্টিকেল কণার মত। উপস্থিত আছি, আবার নেইও।"
এসব শুনে থমকে গেলাম। কি সব উদ্ভট কথা বলছে !
তার পরের কথা শুনে আবার চমকে উঠলাম। অদৃশ্য কণ্ঠটি বলল ভয় পাবেন না। আমরা পৃথিবীর মানুষের মত অত ভাল বা মন্দ বুঝিনা। আপনাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি এমন এক জায়গায় যা নিয়ে আপনাদের খুব আগ্রহ আছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সেটি (SETI) বা সার্চ ফর এক্সট্রাতেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স এই শব্দটা ব্যবহার করেন না ?
আমি বললাম,"হ্যাঁ - সেই নিয়ে SERENDIP বা 'সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল রেডিও এমিশনস ফ্রম নিয়ার বাই ডেভেলপড ইন্টেলিজেন্ট পপুলেশন' শুরু হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে তারপর 'ব্রেকথ্রু লেসন' শুরু হয়েছে কোটি কোটি ডলার খরচ করে।"
অন্য একটা অশরীর গলা বলে উঠলো ,"সেকথা আমি বা আমরা জানি। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রীন ব্যাংক অবজারভেটরি এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পার্কস অবজারভেটরি থেকে মহাবিশ্বের দশ দিকের নজরদারি চালাচ্ছে সে কথা যেমন জানি ঠিক তেমনভাবে জানি স্যাটেলাইট এবং মহাকাশযান থেকে নজর রাখা হচ্ছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিট ফল বলতে গেলে শূন্য। এদিকে আমরা আপনাদের ওপর নজরদারি করছি কিন্তু আপনারা সেসব কিছুই টের পাচ্ছেন না।
আরেকটি কন্ঠ বলে উঠল,"অবশ্য আপনারা নিজেদেরকে মহাবিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে মনে করেন অথচ ভূমিকম্প এবং ঝড়ের পূর্বাভাসও ঠিকঠাক করতে পারেন না। চাঁদের মাটিতে পা দিয়েছেন বলে গর্বে বুকের পাটা চৌষট্টি ইঞ্চি করে ফেলেছেন কিন্তু আদৌ গিয়েছেন কিনা সে নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। "
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যিই অনেক প্রশ্নেরই উত্তর নেই। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আগের কণ্ঠস্বরটি বলল,"যাক ভাবুন, ভালো করে ভাবা প্র্যাকটিস করুন।পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষের প্রাকপুরুষের সম্পত্তি নয়,এখানে অজস্র প্রাণী ও উদ্ভিদঅর্থাৎ জীব আছে, অজীব আছে তাদের কথা ভাবুন। আপনাদের ভালোর জন্যই ভাবুন নইলে একদিন আমাদের গ্রহের মতো অবস্থা আপনাদের।"
আমার মনের মাঝে প্রশ্ন ভেসে এলো," সে আবার কি?"
দ্বিতীয় কণ্ঠটি বলল,"শুনুন মশাই মনদিয়ে। অবশ্য পুরো মন দিয়ে শুনবেন কি করে ?আপনার এক টুকরো মন পড়ে আছে বোলপুরের বনবাসের ল্যাবরেটরির হাত ভাঙ্গা চেয়ারে। ওখানে একজন বনবিহারী বক্সী বসে আছেন। একজন বনবিহারী এখন কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে বই ঘাঁটছে। আরেকজন বিকিউব আমাজনের জঙ্গলে এখনো ঘুরছেন, অন্য একজন বি কিউব দিল্লীর পেটেন্ট অফিসে হন্যে হয়ে ঘুরছে আর একটা ডক্টর বক্সী বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে চক্কর কাটছেন। অন্যদিকে পৃথিবীর মহাসাগরের গভীরে জিল্যান্ডিয়ার সন্ধানে মেতে আছেন। এই সব নিয়ে মেতে থাকলে থাকুন কিন্তু একই সঙ্গে আপনি চলেছেন আমাদের সঙ্গে। মিরা নক্ষত্রের জগতে।"
"মিরা নক্ষত্র - বিষম তারা , সেটাস নক্ষত্রপুঞ্জ যা সেটাস রাশিতে আছে !" অস্ফুট কন্ঠে আমি বললাম।
আগের কণ্ঠটি বলল,"হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, তবে 'টাও সেটি' নিয়ে আপনাদের পৃথিবীতে বড় বেশি আদিখ্যেতা। আপনাদের কেউ কেউ গল্প লিখেছে - সে সব অবশ্য সম্পূর্ণ কষ্টকল্পনা। সভ্যতা ছিল মীরা নক্ষত্রমণ্ডলীতে। আমরা ছিলাম সেখানকার ছোট্ট গ্রহ সুরমাই-এর অধিবাসী।
একি কাণ্ড ! ছিলাম বলছে কেন ? অদৃশ্য থেকেও কি ওরা নেই ?
এরকম যখন ভাবছি তখন হঠাৎ মনে পড়ল যে কিছুদিন আগেই তো মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার 'চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি' সম্ভাবনাময় 'টাও সেটি' নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে নজর রাখতে শুরু করেছে। "টাও সেটি" হল মিরা নক্ষত্রপুঞ্জ বা কন্সটেলেশনের প্রতিবেশী কন্সটেলেশন মীন রাশির পরের দিকের অতি দূরে অবস্থিত নক্ষত্র মন্ডল। ভারতীয় বা প্রচলিত পশ্চিমী রাশি পাইসিস-এর সঙ্গে মেলে না তবে এর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সেটাস কন্সটেলেশন-এর অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো মিরা। মাত্র কয়েক দিন আগে থেকে ভারতীয় মহাকাশ পদার্থবিদ বিজ্ঞানী সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর নামে নামাঙ্কিত মহাকাশ পর্যবেক্ষণ এই মিরা নক্ষত্রের জগতে নজর রাখতে শুরু করেছে।
কি আশ্চর্য ! একটি কন্ঠে বলল," মিরা নক্ষত্রের আরেক নাম অমিক্রণ সেটি। তবে আমরা বলি মা নক্ষত্র। নীলগ্রহ বা পৃথিবীর হিসেবে আপনাদের বাড়ীর পাশের সূর্য থেকে এর দূরত্ব মাত্র দুশো কুড়ি আলোক বর্ষ অর্থাৎ দুশো কুড়ি বছরে আলো যত দূরে যেতে পারে ঠিক ততটাই দূরে।"
আমি নতুন করে আর অবাক হলাম না, কারণ পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি এই তারাটির কথা জানতেন প্রাচীন ব্যাবিলনের মানুষজনও। কিন্তু কত দূরে আছে সেটা তারা তখন জানতেন না। যা জানা গেছে টলেমি, আল সফি, উলুখ বেগ, টাইকো ব্রাহে মিরা নক্ষত্র কথা বলেছেন ,তবে বিশদে নয়। হয়ত ভারতীয় মুনি-ঋষিরাও জানতেন কিংবা হয়ত জানতেন না। সে কথা বড় নয়। ইদানিং জানা গেছে মিরা নক্ষত্র জগত আসলে দুটো বাইনারি নক্ষত্রের খেলা। মিরা-এ এবং মীরা-বি।
মিরা নামটা কেমন যেন ভারতীয় ভারতীয় শোনায় তবে সম্ভবত মিরা-বি একটি হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন নক্ষত্র।
মনে মনে ভাবছি এ কিসের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা। মহাকাশের কোন অন্দরমহলে চলেছি যেখানে আলোর বেগে পৌঁছলেও দুশ কুড়ি বছর লাগে! একটি অদৃশ্য কন্ঠে বলল,"না লাগে না। মাত্র কুড়ি মিনিটই যথেষ্ট।পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করলে কুড়ি মাইক্রো-সেকেন্ড-এও সম্ভব। অসম্ভব মনের গতিতে গতিবান আমরা এবং আমাদের যন্ত্রযান। আপনার যন্ত্রের বেগ একটু কম - পৃথিবীর তো -বুঝতেই পারছেন।"
বুঝলাম যে আমি কিছু বুঝলাম না। বোঝার চেষ্টা করছি আমি বনবিহারী বক্সী এখন ঠিক কোথায়? প্রথম কন্ঠটি বলল,"বন বিহারীবাবু আপনি গগনবিহারে আছেন।"
দেখি সামনের দিকটা কেমন উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল। চোখ ঝলসে যাচ্ছে।
জানিনা কোথায় চলেছি আর মহাশূন্যের ওই ওপারে কি আছে বা কি নেই ...
( বনবিহারীর গগনবিহার -গল্পের পরিবর্তিত রূপ )