দর্পণ
দর্পণ


আজ এক মাস হয়ে গেল তমালের কোন খবর নেই। রুমেলা অস্থির হয়ে যাচ্ছে। মাত্র ছয় মাস হল ওদের বিয়ে হয়েছে। সেদিক থেকে ওরা নব দম্পতি, ভালবেসে ওরা ঘর ছেড়েছে। রুমেলা গোমস একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ, আর তমাল উত্তর কলকাতার বর্ধিষ্ণু স্যান্যাল বাড়ির একমাত্র উত্তরসূরি । আভিজাত্যের গরিমা আর সম্পত্তির প্রাচুর্যে স্যান্যাল বাড়ি আজও ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। সেখানে একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হওয়া রুমেলাকে , তমালের বাড়ি থেকে মেনে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে তার জন্য তমালকেও বংশ গরিমা ত্যাগ করতে হয়েছিল।
ওদের আলাপ প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। আজ ও মনে পরে সেদিনের ঘটনা। তখন দুজনেই এম এস সি ফাইনাল ইয়ার। এর আগে দুজন দুজনকে দেখে ছিল, আলাপ ছিল না। সেই দিন সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি, কলেজ যাওয়ার প্রয়োজন ছিল রুমেলার। প্রায় আধা ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও কোন বাস পায়নি, আর ঠিক সেই মুহূর্তে রুমেলার সামনে এসে দাঁড়ায় একটা প্রাইভেট কার। তমাল উঠে আসতে বলেছিল। সেই আলাপ দুজনের। তারপর কোথা দিয়ে কেটে যায় পাঁচ টা বছর, দুজনেই প্রেমের সাগরে ভাসতে থাকে। অনেক ঝড়, অনেক অশান্তি তার মাঝেও অটুট ছিল ওদের প্রেম। তারপর তমালের চাকরি, ওদের বিয়ে সব যেন স্বপ্নের মতো ছিল।
আজ একমাস হয়ে গেল সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তমালের কোন খবর নেই। থানা পুলিশ হাসপাতাল কিছুই বাদ দেয়নি রুমেলা। যেন হারিয়ে যাবার জন্যেই তমাল হারিয়েছে, যাতে কেউ আর কোন দিন খুঁজে না পায়। এর মধ্যে রুমেলা দুবার তমালের বাড়িতে ও গেছে, নাহ সেভাবে কেউ কোন হেল্প করতে চায়নি। তাদের কাছে তমাল মৃত, তাই স্বাভাবিক কারনে রুমেলাও অস্তিত্বহীন।
নিজের ফ্ল্যাটে বসে এই সব চিন্তা করছিল সে, নাহ সুখ বোধহয় তার কপালে নেই। সেই ছোট্টো থেকেই সে একলা, আশ্রমে মানুষ। মাঝে জীবনে তমাল এসেছিল, তখন স্বপ্নের মতো দিন গুলো ছিল।
এই সব ভাবতে ভাবতে রুমেলা সিদ্ধান্ত নেয় সে শহর ছেড়ে চলে যাবে। এমনিতেই তার অফিস থেকে বিদেশ সফর অফার করেছিল, তাই সে তমাল ছাড়া কলকাতায় আর কিছুতেই থাকবে না। পরের দিন অফিসে গিয়ে সব পেপার জমা করে দেয়।
অফিসের সাথে চুক্তিবদ্ধ, পাসপোর্ট, ভিসা সব করে কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে, যখন সে অস্ট্রেলিয়া যাবার টিকিট হাতে পেলে, তখন আরও ছমাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। না তমালের কোন খবর সে আর পায়নি।
আজ তাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হল। তমাল নেই, সেও আজ চলে যাচ্ছে বিদেশে। সব ফেলে রেখে গেল, শুধু স্মৃতি নিয়ে চলল।
................................................
সুদীর্ঘ দশ বছর পর রুমেলা আজ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে দুবার এসে ছিল সে। একবার বিদেশ যাত্রার দুবছর পর তমালের বাবা মারা যেতে, বাড়ি থেকে এই সম্পর্কহীন মানুষটিকে খবর দেওয়ায় সে অবাক হয়ে ছিল। প্রথমে ভেবেছিল আসবে না, যে সম্পর্ক কে কেউ মেনে নিল না, সেখানে কিসের অধিকারে সে আসবে? তারপর ভাবলে সে তো এমন নয়। সে ছোট থেকে শিখে এসেছে ক্ষমআর থেকে বড় ধর্ম আর কিছু নেই। সে গিয়ে ছিল, এবং তমালের মায়ের আন্তরিকতায় অবাক হয়েছিল। এরপর আবার তার এক বছর পর সে তমালের মায়ের অনুরোধে গিয়েছিল, তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়, রুমেলা বুঝে ছিল এটাই তার শেষ বন্ধন তমালের সাথে, যা ছিন্ন হতে চলেছে। তাদের ফ্ল্যাটের চাবিটা ওনার হাতে দিয়ে বলে এসেছিল, আপনার ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হোক। আর কিছু জানা নেই তার। কারণ আর কোন খবর পৌঁছায় নি সেখানে।
এয়ারপোর্ট থেকে সে বেরিয়ে সোজা তমালের বাড়ি যাবে ঠিক করেছিল, কিন্তু তারপর ভাবলে, সেখানের সব বাঁধা তো ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে আবার কেন? কিন্তু ও যাবে কোথায়? ফ্ল্যাটের চাবি তো.....
তখনই মনে আসে ডুপ্লিকেট চাবির কথা, যা রাখা ছিল রুমেলার ব্যাঙ্ক লকারে। তাই আপাতত হোটেলে উঠল সে। পরের দিন কি মনে করে দেখতে গেল ফ্ল্যাটটা, আর সেখানে গিয়ে ভীষণ অবাক হল তমাল কে দেখে।
তমাল তবে বেঁচে আছে? শুধু তাই নয় দেখল তমালের সংসার, যেটা রুমেলার হাতে তৈরি। সেখানে তমালের ছোটো একটা আট ন বছরের ছেলে। তমাল ও অবাক হল রুমেলা কে দেখে। হয়ত ভেবেছিল রুমেলা আর কখনো ফিরবে না। কিন্তু না সব কৌতুহলের অবসান ঘটিয়ে ঘর থেকে একজন মহিলা বেড়িয়ে বলেছিলেন, "তুমি রুমেলা? ভিতরে এসো, তোমার যা কিছু সব তোমারই আছে। শুধু মাঝের কটা বছর হারিয়ে গিয়েছিল।"
রুমেলা ভিতরে যায়, দেখে সত্যি সব আগের মতোই আছে। সেই সোফা সেট, সেই জানলার পর্দা, সেই টিভি কিছু তো বদলায় নি। শুধু আসল মানুষ টা আর তার নেই।
মহিলা রুমেলা কে বললেন, "তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি খুব অসুস্থ, আজ আমার ছেলেটা হোস্টেলে চলে যাবে। তমাল ওকে পৌঁছে দিয়ে কাল ফিরবে। তুমি ততক্ষণ আমার কাছে থেকে যাও। "
না এ ডাক উপেক্ষা করতে পারল না রুমেলা, কারণ এর মধ্যে ছিল আন্তরিকতা। তমাল ছেলে কে নিয়ে ততক্ষণ বেড়িয়ে গেছে।
রুমেলা জিজ্ঞেস করল, "তোমার নাম কি? "
- "সাগরিকা। তবে তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমি তমালের বিয়ে করা বৌ নয়। আমরা এক অফিসে চাকরি করতাম। আমি একজনকে ভালবাসতাম, তার ফসল ঐ ছেলে। কিন্তু সে আমায় ঠকিয়ে চলে যায়। তখন আমার সামনে দুটো পথ খোলা, হয় মৃত্যু, নয়তো বিয়ে। কিন্তু কে করবে আমায় বিয়ে? ঐ অবস্থায়? তাই মৃত্যু কেই বেছে নিলাম। আর ঠিক সেই সময় দেবদূত হয়ে এসেছিল তমাল। আমার মরণ আর হলো না। সমাজের কাছে আমায় স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে দুটো জীবন বাঁচিয়ে দিলে। কিন্তু বিশ্বাস কর বোন তুমি ছাড়া আর কোন নারী কেই স্পর্শ করেনি তমাল। আমার ছেলে পিতৃ পরিচয় পেয়েছে, আমি সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে বাঁচাতে পেরেছি, এর বেশি কিছু আমিও চাই নি। তমালের মা সব জানতেন, উনি তাই অপরাধ বোধে ভুগতেন। তাই বোধহয় তোমায় ডেকে ছিলেন, কিন্তু বলতে পারেননি। উনি মারা যাবার পর ওনার থেকেই চাবি নিয়ে আমরা এখানে চলে আসি, আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে। আর এই মুহূর্তে তোমার সংসার তোমাকেই দেখতে হবে।" এই পর্যন্ত বলে ভীষণ হাঁপাতে লাগলো সাগরিকা।
রুমেলা বলল, "কি হয়েছে তোমার? "
- "ব্লাড ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ, এখন শুধু দিন গোনা। আর আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে, ঠিক তোমার সাথে আমার দেখা হবে। তাই বোধকরি প্রাণ টা বের হয়নি।" বলে একটা করুণ হাসি হাসলে সাগরিকা।
- " না বোন আমি তোমাকে এ ভাবে চলে যেতে দেব না।" রুমেলা জড়িয়ে ধরলে তার অসুস্থ শরীর টা।
- "তা হয়না। তুমি এবার তোমার সংসার বুঝে নাও। আর ঐ মানুষটা কে নিজের কাছে টেনে নাও। জীবনে কিছুই পেল না। আর কষ্ট দিও না ওনাকে। "
-"কে বলেছে পায় নি? তোমার মতো বন্ধু পেয়েছে। আর একটা মিষ্টি ছেলে পেয়েছে। তোমায় কথা দিচ্ছি ও আজ থেকে আমার ও ছেলে। আমি ওকে এখানে এনে রাখব, আমার কাছে। "
কৃতজ্ঞতায় রুমেলার হাত টা চেপে ধরল সাগরিকা।
এর দুমাস পর সাগরিকার ছেলে কে আইনত দত্তক নেয় রুমেলা। সেদিন টা আর সাগরিকার দেখা হলো না