দরজা
দরজা


১
দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে করিডোরে জ্বলতে থাকা আলোটা আমাকে ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে।
দেওয়ালে জমে থাকা ঝুল আর মাকড়শার জাল দেখে বুঝতে পারলাম এই ঘরে মানুষের পা পড়েনি বহুদিন।কিন্তু তাই বলে ঘরের আসবাবগুলো মোটেও ফেলনা নয়। বিছানাটা বেশ বড়। সাবেকী আমলের। খুব সম্ভবত সেগুন কাঠের তৈরি।
ঘরের এক কোণায় রাখা আছে একটা টেবিল আর চেয়ার।
ডিজাইনে তারাও যেন নিজেদের শরীরে ধরে রেখেছে ফেলে আসা একটা সময়কে।
টেবিলটার উপরে দেওয়াল থেকে ঝুলছে একজন বয়স্ক মানুষের ছবি।
তার মানে এই ভদ্রলোকই রবিন ডিসুজা, যার ঘরে ঢোকা একান্তই মানা আমার।
ঘরটার অন্য কোনায় রয়েছে একটা আলমারি আর বুক সেলফ। আলমারির মধ্যে কি আছে তা দেখা না গেলেও দেখলাম বুকশেলফের মধ্যে রাখা আছে সারি সারি বই।এবার সত্যি সত্যিই অবাক হলাম খুব।
অত বড় বিজনেসম্যান হয়েও রবিন সাহেবও আমার মত বইপোকা ছিলেন!
বুকশেলফটা চুম্বকের মত টানতে শুরু করেছিল আমাকে।
কিন্তু সেদিকে এগোনোর আগেই হঠাৎ আমার চোখ পড়ল ঘরের দক্ষিণে।
অর্ধেক দেওয়াল জোড়া বিশাল জানালাটার সামনে রাখা আছে একটা রকিং চেয়ার।
বাকি ঘরটার মত চেয়ারটাও ফাঁকা। কিন্তু আমি সেদিকে তাকাতেই হালকা দুলে উঠল চেয়ারটা।
না চোখের ভুল নয়। অল্প হলেও দুলেই চলেছে চেয়ারটা। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হল আমার।
গোটা বাড়িতে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও প্রাণী নেই। তবু মনে হল ওই চেয়ারের উপরে বসে আছে একজন, যাকে খালি চোখে দেখা না গেলেও, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে!
২
গোঁ গোঁ গোঁ গোঁ…
কেউ যেন গোঙাচ্ছে পাশের ঘর থেকে।
অস্পষ্ট হলেও বড্ড করুণ অথচ ভয়ংকর সেই আওয়াজ।
ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি চারিদিক অন্ধকার। রাত্তিরে নাইট ল্যাম্পের আলো আমার অসহ্য লাগে। তাই শুতে যাওয়ার আগে নিভিয়ে দিয়েছিলাম ঘরের সমস্ত আলো। বাড়িটা পুরনো হলেও রবিন সাহেব কিন্তু সব আধুনিক ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন অনেক আগেই। শুধু মেন সুইচ নয়, বিছানার পাশেই তিনি বানিয়ে দিয়েছিলেন একজোড়া বেড সুইচ।
টিউব আর ফ্যানের জন্যে।
দেওয়াল হাতড়ে সেই সুইচ অন করলেও জ্বলল না টিউবটা!
খেয়াল করলাম ঘুরছে না মাথার ওপরে ফ্যানটাও।
তার মানে পাওয়ার কাট। মনে মনে বিরক্ত হলাম বেশ খানিকটা। তার সঙ্গে অদ্ভুত একটা শিরশিরানি অনুভব করলাম সারা শরীরে।
দীপ্তেশ ভাই আসতে আসতে ভোর।
তার আগে এই রাতে পুরো বাড়িতে আমি একা!
পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটার লোকেশন এমনই যে চিৎকার করে ডাকলেও শুনতে পাবে না কেউ।
সবথেকে কাছের গ্রামটাও এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে।
অক্টোবর মাসের শেষ দিন। বাতাসে গুমোট ভাবটা কমে গেছে অনেকটাই। তবুও টের পেলাম এর মধ্যেই কয়েক ফোঁটা ঘাম জমতে শুরু করেছে কপালে।
এমনিতে আমি যে খুব ভীতু তা কিন্তু নয়। তাহলে অফিসের অন্য গেস্ট হাউজের ভিড় ছেড়ে একটু একলা থাকার জন্যে স্বেচ্ছায় বদনামের ভাগী এই গেস্টহাউসটাকে বেছে নিতাম না। অনেক বছর আগে রবিন সাহেব শখ করে জঙ্গলের মধ্যে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর প্রায় বছর দশেক খালিই পড়ে ছিল বাড়িটা। এরপর এখানে একটা প্রোজেক্টে হাতে দেওয়ার পর আমাদের কোম্পানি তার কর্মচারীদের থাকার জায়গা হিসাবে ওর ছেলের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিল বাড়িটাকে।
বছর খানেক আগে কয়েকজন লেবারও থাকত এখানে।
কিন্তু সে মাত্র একমাসের জন্য।
রাত্তিরবেলায় অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শুনতে পাওয়ার পর তারা আর থাকতে চায়নি এই বাড়িতে।
তারপর থেকেই বাড়িটার বদনাম। সাইট থেকে বেশ খানিকটা দূরে অন্য গেস্ট হাউসে গাদাগাদি করলেও কেউ থাকতে চায়না এখানে।
এদিকে রবিন সাহেবের ছেলের সাথে কোম্পানির এগ্রিমেন্ট পাঁচ বছরের। বাধ্য হয়েই লস খাচ্ছিল কোম্পানি। তারপর আমি আসায় কিছুটা হলেও পয়সা উসুল হয়েছে ওদের। আমি এখানে আছি প্রায় এক বছর। আজ সন্ধ্যাবেলায় দীপ্তেশ ভাই চলে যাওয়ার পর সাহেবের ঘর খুলে রকিং চেয়ারটা দেখে একটু অস্বস্তি হলেও এর আগে কিছু টের পাইনি কখনও।
কিন্তু এইভাবে ভয় পাওয়ার তো কোনও মানে হয় না। শক্ত করলাম নিজের মনকে। হতেও তো পারে এটা কোনও বন্য জন্তুর ডাক।
হয়তো বাড়ির পাশে কোথাও দাঁড়িয়ে ডাকছে।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই হালকা লাগল খানিকটা।
এর মধ্যে থেমে গেছে শব্দটাও।
পাশ ফিরে শুয়ে ফের চোখ বন্ধ করলাম আমি।
কাল অনেক ভোরে উঠতে হবে।
তন্দ্রাও আসতে শুরু করেছিল একটু একটু করে। কিন্তু এর মধ্যেই আবার আমার কানে এলো সেই বিচ্ছিরি গোঁ গোঁ শব্দটা।
এবার কিন্তু স্পষ্ট।
বোঝা না গেলেও কেউ যেন কিছু বলতে চাইছে আমাকে।
না আর শুয়ে থাকা যায় না। উঠে বসলাম আমি। মাথার কাছে রাখা আছে মোবাইল ফোনটা। সেটাকে চালু করতেই দেখলাম ভোর সাড়ে তিনটে বাজে।
এমনিতেই আমি উঠতাম আর আধঘণ্টা পরে।
কিন্তু সেই ঘুমটা আজ লেখা নেই কপালে!
জ্যোৎস্না থাকলে চাঁদের আলো ধুইয়ে দেয় আমার বেডরুমটাকে। সে এক অনবদ্য বন্য সৌন্দর্য, যাকে শহরে বসে অনুভব করা দায়। কিন্তু এখন শুক্লপক্ষ শেষ হতে চলল। কয়েকদিন পরেই অমাবস্যা। কালী পুজো। আকাশের কোণে যে একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে তার আলো এসে পৌঁছতে পারেনি ঘরের মধ্যে। অগত্যা মোবাইলে ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে নেমে এলাম বিছানা থেকে।
যেটুকু সময় হাতে আছে তাতেই খুঁজে বার করতে হবে এই অদ্ভুত শব্দের উৎস।
রাত্তিরবেলা শোওয়ার সময় নিজের ঘরের দরজাটাও ভেজিয়ে দিই আমি। বিছানা থেকে নেমে এসে খুলে ফেললাম সেই দরজা। বাড়িটা একতলা হলেও বেশ বড়। লম্বা করিডোরের দু’পাশে তিনটে তিনটে করে মোট ছ’টা ঘর। যদিও তার মধ্যে একটা বাথরুম আর কিচেন আছে। এর মধ্যে পশ্চিমদিকের শেষ ঘরটাই রবিন সাহেবের ঘর।
বেডরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে সেই ঘরটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম আমি।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোর জোর খুব বেশি না হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দৃশ্যটা।
ঘরটার দরজার পাল্লা দুটো হাট করে খোলা!
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। চাবি নেই বলে পুরনো তালাটা দিতে পারিনি ঠিকই, কিন্তুশুতে যাওয়ার আগে একটা নতুন তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলাম দরজাটা!
আমার যুক্তিবাদী মন এই ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না কিছুতেই। মহারাষ্ট্রের এই পাহাড়ি জঙ্গলে আর যাই হোক, চোর ডাকাতের উপদ্রব নেই একেবারেই।
সামনে তাকিয়ে দেখলাম বন্ধ করা আছে বাড়ির সদর দরজাটাও!
গোঁ গোঁ শব্দটা আরও তীব্র হয়ে পাক খেতে শুরু করল আমার চারদিকে। যেন একটা ঝড় উঠেছে। সেই ঝড় আমাকে উড়িয়ে দিতে চাইলেও আওয়াজটা যে ঠিক কি বলতে চাইছে তা বুঝতে পারলাম না কিছুতেই। হঠাৎ সেই তীব্র গোঙানির শব্দ ভেদ করে আমার কানে এলো কারুর পায়ের শব্দ। শব্দটা আসছে রবিন সাহেবের ঘর থেকে। মোবাইল ঘুরিয়ে ফ্ল্যাশলাইটের আলো সেদিকে ফেলতেই দেখলাম ওই ঘরের দরজার সামনে ধীরে ধীরে জমাট বাধছে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা মানুষের চেহারা নিলো সেটা।
এই মানুষটা আমার অচেনা নয়। আজই দেখেছি একে। সন্ধেবেলায় রবিন সাহেবের ঘরের দরজা খোলার পর।
দেওয়ালে টাঙানো ছিল এরই ছবি।
ফের মনে পড়ে গেল দীপ্তেশ ভাইয়ের কথা। একদিন ঘরটা নিয়ে খুব প্রশ্ন করছিলাম ওকে। বাড়িটার দেখাশুনা, আমার জন্য রান্না করা― এসব কাজ করলেও মানুষটা কখনও প্রয়োজনের বাইরে একটাও কথা বলেন না। সেদিনও প্রথমে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও আমার প্রশ্নবাণে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু কথা বলেছিলেন দীপ্তেশ ভাই, “সাহেব, আমার মালিক বলতে বারণ করেছেন। তাই কাউকে বলিনি। রবিন সাহেব এই বাড়িটাকে খুব ভালোবাসতেন। তাই মারা যাওয়ার পরেও ছেড়ে যেতে পারেননি। শুধু আমি নই, ওঁর ছেলে এসেও নিজের বাবাকে দেখতে পেয়েছিল কয়েকবার। তারপর বাড়িটা কোম্পানিকে ভাড়া দেওয়ার কথা শুরু হলে আমরা এই অঞ্চলের সবথেকে বড় তান্ত্রিককে ডেকে আনি। তিনি সাহেবকে এখান থেকে পুরো তাড়াতে না পারলেও তার আত্মাকে ওই ঘরে বন্দী করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। ঘরের তালাটা মন্ত্রপূত। জেগে উঠলেও সেটা খুলে সাহেব কখনও বাইরে বেরোতে পারবেন না। কথাটার মধ্যে কোনও মিথ্যা নেই সাহেব। এখন সকালে এসে রাতে চলে গেলেও ওই লেবারগুলো এবং আপনি এখানে আসার আগে আমি আর রবিন সাহেবের ছেলে অনেকগুলো রাত কাটিয়ে গেছি এখানে। আগেও তো আপনাকে বলেছি সাহেব। ওই দরজা না খুললে কোনও বিপদ নেই। আগে যে লেবারগুলো ছিল ওরাও কিছু দেখেনি। শুধু বন্ধ দরজাটা দেখে ভয়েই পালিয়েছে।”
দীপ্তেশ ভাইয়ের কথাতেই প্যারানরমাল দুনিয়ার ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। এই ব্যাপারটায় আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। পৃথিবীর জন্য না পারি, ভেবেছিলাম নিজের জন্য অন্তত শেষ করে দেব এই মিথটাকে।
এরকম সুযোগ তো আর বারবার আসবে না জীবনে!
শেষ পর্যন্ত একটা হেয়ারপিন দিয়ে খুলে ফেলেছিলাম সেই তালা।
কিন্তু তার এই পরিণতি!
একজন মৃত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সমস্ত সাহস অসহায়ভাবে নতজানু হল সীমাহীন এক ভয়ের কাছে। পালাবার জন্য পা বাড়ালাম সদর দরজার দিকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার কানে স্পষ্ট হয়ে উঠল অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকা সেই গোঙানির আওয়াজটা, “মাত যাও। ডোন্ট গো।”
একটা ধাতব এবং যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে রবিন সাহেব আমাকে যেতে বারণ করছেন এখান থেকে!
কিন্তু একজন মৃত মানুষের কথা শুনে…
কেউ যেন একটা কয়েকশো কিলোর হাতুড়ি নিয়ে দমাস দমাস করে পিটোতে শুরু করল আমার বুকের ভিতরে।
আর তার পরেই বেজে উঠল কলিং বেলটা।
আজ তো কাকভোরেই আসার কথা দীপ্তেশ ভাইয়ের! প্রচণ্ড ভয়ে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল কথাটা।
অন্ধকারের মধ্যেও একটা আশার আলো দেখতে পেলাম আমি।
এবার হয়তো মুক্তি পাব এই পিশাচের হাত থেকে!
রবিন সাহেবের কথা উপেক্ষা করে পা বাড়ালাম সদর দরজার দিকে। কিন্তু এক পা এগোতে না এগোতেই থামতে হল আমাকে। শেডসমেত আমার সামনে ভেঙে পড়েছে করিডোরের ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা সিএফএলটা।
মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের হালকা আলোতেই বুঝতে পারলাম মেঝে ভরে গেছে টুকরো টুকরো কাঁচে। পায়ে কোনও চটি নেই। এই কাঁচ পেরোতে গেলে পা কেটে যাবে। কিন্তু সে কথা আর খেয়াল ছিল না। কাঁচের উপর পা দিয়েই এগোতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই অনুভব করলাম প্রচণ্ড ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ ছুঁয়েছে আমার কাঁধ।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম রবিন সাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পিছনে।
তাঁর ডানহাতটা আমার কাঁধে!
সবকিছু আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবুও এক ঝটকায় সেই ছায়ামূর্তির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলাম আমি।
কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর শক্তির সামনে ব্যর্থ হল আমার সবপ্রচেষ্টা।
একবার নয় বারবার।
চিৎকার করতে গিয়েও টের পেলাম কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না আমার গলা থেকে।
ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করল আমার শরীর। আবছা হতে শুরু করল চারপাশ। কিছুক্ষণ পর একটা কালো পরদা নেমে এল আমার চোখের সামনে।
আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।
জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে অনুভব করলাম আমার শরীরটা নেতিয়ে পড়ছে ঘরের মেঝের উপর।
৩
“হ্যালো, মিস্টার বোস, প্লিজ ওপেন ইয়োর আইজ।”
অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসছে কণ্ঠস্বরটা। তার সঙ্গে মিশে আছে আরও অনেক কণ্ঠের ফিসফিসানি।
চোখের সামনের গাঢ় অন্ধকারটা যেন পাতলা হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। তবুও বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথায় রয়েছি আমি! চোখ খুলতে গিয়ে টের পেলাম ভীষণ ভারী লাগছে পাতা দুটো।
কিন্তু সামনে কি আছে তা তো দেখতে হবে আমাকে। চোখ না খুলতে পারলেও আস্তে আস্তে মনে পড়তে শুরু করল সবকিছু।
সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।
মৃতের স্পর্শে জ্ঞান তো হারিয়েছিলাম আমি!
তবে আমিও কি পৌঁছে গেছি মৃতদের জগতে!
মানুষ ভয় পেলে হয় রুখে দাঁড়ায় অথবা পালিয়ে যায় সেখান থেকে। ভয়টা মাথার মধ্যে জমাট বাধতে না বাধতেই ছটফট করে উঠলাম আমিও।
অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত খুলেও ফেললাম পাথরের মত ভারী হয়ে যাওয়া চোখের পাতা দুটো।
সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আলো যেন ঝলসে দিল আমাকে।
সেই তীব্রতা সয়ে যেতে সময় লাগল আরও কিছুক্ষণ। তারপর এক এক করে আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল সবকিছু। আমি শুয়ে আছি আমার বিছানায়। সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। ঘরের পূর্ব দিক খোলা বলে সূর্যের আলো এসেছে পড়েছে আমার চোখে। আর আমার সামনে ঝুঁকে আছেন আমাদের কোম্পানির ডাক্তার রাজেশ পটেল। তাঁকে ঘিরে কোম্পানির অন্য সব কর্মচারী।
“হ্যালো মিস্টার বোস। ক্যান ইউ লিসেন টু মি?” ফের ডক্টর পটেল প্রশ্ন করলেন আমাকে।
আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই ফের কানে এলো আরও একটা কণ্ঠস্বর, “ডাস হি ওপেন হিস আইজ ডক্টর?”
গলার আওয়াজটা যেন আগেও শুনেছি না...!
কিছু বোঝার আগেই দেখলাম একজন মানুষ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে।
মানুষটাকে দেখেই চমকে উঠলাম আমি…
এই মানুষটাকে তো রোজই দেখি; নিজে আয়নার সামনে দাঁড়ালে!
৪
“সাইদুল, অউর থোড়া তেজ চালাও প্লিজ।”
সাইদুল আমাদের প্রজেক্টে ড্রাইভার। বারবার একই কথা বলছিলাম ওকে। সূর্য অস্ত গেছে একটু আগে।
ঝুপ করে অন্ধকার নামল বলে...
তার আগেই মনে-প্রাণেজঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম।
আসলে আমার ভীষণ ভয় করছিল।
রবিন সাহেবের হাতে আবার ধরা পড়ার ভয়!
কাল রাত থেকে যা ঘটে গেছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্ব। রবিন সাহেবের আত্মার জেগে ওঠার মতই অদ্ভুত ঘটনা হল ওঁর ছেলে অ্যালেক্সকেও হুবহু আমার মত দেখতে হওয়া এবং গলার আওয়াজটা আমার কাছাকাছি হওয়া।
ভুতুড়ে বাড়িটা কোম্পানির হাতে তুলে দিলেও সরজমিনে সবকিছু দেখতে গতকাল রাতের ট্রেনে গোয়া থেকে সে নিজেই চলে এসেছিল এখানে।
অ্যালেক্সের সাথে পরিচয় হওয়ার পরেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আমার চোখের সামনে।
নিজের ছেলেকে খুবই ভালোবাসতেন রবিন ডিসুজা। আমি ওঁর ছেলের মত দেখতে বলেই বোধহয় চাননি আমি চলে যাই ওই বাড়ি ছেড়ে।
কিন্তু ভালোবাসা যতই থাকুক, গত রাতের পর প্রেতাত্মার আর্জি শোনার মত সাহস আর আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।
তার উপর মোটা মাইনের নতুন চাকরির হাতছানি।
আগামী পরশুদিনই জয়েনিং সেখানে। তাই দুপুরের পর একটু সুস্থ হয়েই বিকেল পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে পড়েছিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
আপাতত আমার গন্তব্য মুম্বাই। ওখানে গিয়ে কোনও একটা হোটেলে উঠবো।
তারপর কাল সকালের ফ্লাইটে মেঙ্গালুরু।
সবকিছু ঠিকঠাক চললে এখন আমার মেঙ্গালুরুতেই থাকার কথা। আজ দুপুর বারোটার ফ্লাইটে যাওয়ার কথা ছিল ওখানে।
সেই যাত্রা সফল হয়নি। নষ্ট হয়ে গেছে টিকিটাও।
নতুন করে টিকিট বুক করতে হবে আজ রাতেই।
টিকিটের কথা মনে পড়তেই নজর পড়ল মোবাইলের দিকে। গতকাল রাতে আমি যখন জ্ঞান হারিয়েছিলাম তখন আমার হাত থেকে খসে পড়েছিল মোবাইলটাও। তারপর দীপ্তেশ ভাই আমার সাড়া না পেয়ে সমস্ত লোকজন জোগাড় করে দরজা ভেঙে যখন ভিতরে ঢোকে, ততক্ষণে ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে জ্বলে সব ব্যাটারি শেষ।
সমস্ত ধাক্কা সামলে উঠে আমার মোবাইলের কথা মনে পড়েছিল দুপুরের পর।
আমার হাতে তখন সেই নিষ্প্রাণ ডাব্বাটা তুলে দিয়েছিল দীপ্তেশ ভাই।
ভাগ্যিস বাড়িতে ঢোকার পর ও ঠিক খেয়াল করেছিল মেঝেতে পড়ে থাকা মোবাইলটা!
তারপর গাড়িতে বসে পাওয়ার ব্যাঙ্কে লাগিয়ে মোবাইলটাতে চার্জ দিলেও টাওয়ার পাচ্ছিলাম না কিছুতেই।
জঙ্গলে সিগন্যালের প্রবলেম লেগেই থাকে।
ভেবেছিলাম শহরে ঢুকে টাওয়ার পেলেই বুক করব ফ্লাইটের টিকিট।
মনটাকে একটু অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফের হাতে তুলে নিলাম মোবাইলটাকে। কিছু না হলেও গান শোনা যাবে।
কিন্তু সেটা আনলক করতেই দেখলাম ফুল টাওয়ার দেখাচ্ছে।
হাতের মুঠোয় চাঁদ পেলাম। নেট অন করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে।
ওয়াটস অ্যাপে হুহু করে ঢুকতে শুরু করল গতকাল রাত থেকে জমে থাকা সব ম্যাসেজ।
অনেক ম্যাসেজের মধ্যে রয়েছে পঙ্কজেরও বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ। পঙ্কজ আমার প্রিয় বন্ধু এবং হিসাবমত দেখতে গেলে আমার একমাত্র আপনজন। আমাদের দু’জনের ছোটবেলা কেটেছিল একটা অনাথ আশ্রমে। তখন থেকেই হাজারো ভিড়ের মধ্যেও কেমন করে জানিনা এই ছেলেটা ভীষণ আপন হয়ে উঠেছিল আমার। তাই আরও অনেকগুলো ইম্পরট্যান্ট ম্যাসেজ থাকলেও সবার আগে আমার আঙুল ছুঁল পঙ্কজের শেষ ম্যাসেজটাকে, “সুবি তুই কোথায়? প্লিজ উত্তর দে। খুব চিন্তা হচ্ছে তোর জন্য। ফোনেও পাচ্ছি না।”
দেখলাম এখনও অনলাইন রয়েছে পঙ্কজ। তবুও সোজা ফোন করলাম ওকে। একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো পঙ্কজের গলার আওয়াজ, “সুবি তুই ঠিক আছিস তো? যা দেখছি…”
“কি দেখছিস?”
“টিভিতে দেখাচ্ছে। ছেয়ে গেছে ফেসবুকও। মুম্বাই থেকে একটা মেঙ্গালুরু একটা ফ্লাইট হঠাৎ মাঝরাস্তায় ভেঙে পড়েছে। বলছে কেউ আর বেঁচে নেই।”
এখানকার বাইরে ওই একমাত্র জানত আমার মেঙ্গালুরু যাওয়ার কথা। ওর চিন্তা হওয়াটা তো খুব স্বাভাবিক। কিন্তু পঙ্কজের কথা শুনে সরে গেল আমার পায়ের তলার মাটি। কিছুক্ষণ লাগল নিজেকে সামলাতে। তারপর ওকে বললাম, “নারে, আজ বেরোতে পারিনি। কিন্তু ফ্লাইট নাম্বার কত বলছে?”
আমার কথা শুনে ওপাশ থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পঙ্কজ। তারপর বলল, “দাঁড়া বলছি এক মিনিট।”
কয়েক মিনিট সময় নিলো পঙ্কজ। তারপর ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ও আমাকে বলল ফ্লাইট নাম্বারটা।
সঙ্গে সঙ্গে আরও একবার ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।
এই ফ্লাইটে ওঠার কথা ছিল আমারও…
তবে কি রবিন ডিসুজার প্রেতাত্মা দেখতে পেয়েছিল আমার ভবিষ্যৎ?
আর সেইজন্যেই...
এই প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর পাইনি আমি।
তবে সেদিন জঙ্গল পেরবার আগেই অন্ধকার নেমে এলেও, মুম্বাই পৌঁছতে বা পরের দিন ফ্লাইটে সেখান থেকে মেঙ্গালুরু যেতে আর কোনও অসুবিধা হয়নি আমার।
------------