দিন দুপুরে
দিন দুপুরে
অফিসের কাজে যেতে হয়েছিল বড়বাজার, কলাকার স্ট্রীট আর বিবেকানন্দ রোড এর মোড়ে। কাজটা নিয়ে একটু টেনশন তো ছিলই উপরন্তু ঠিকানাটাও খুঁজেই পেলাম না। অথচ কাজটা না করলেই নয় - ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ চলছে, টার্গেট ফুলফিল না হলে চাকরিটাই না ভোগে চলে যায়।
দশটা থেকে ক্রমাগত একে ওকে যাকে পাচ্ছি জিজ্ঞাসা করে চলেছি ভদ্রলোকের নাম ও ঠিকানা সম্পর্কে কিন্তু কেউ কোনো সদুত্তর দিল না! দুপুর প্রায় আড়াইটা বাজে তখনও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, অথচ এমনটা হবে আশাই করিনি আজ। একটাই লোন কোটি টাকার, এটা যদি করাতে পারি আজ তো ম্যানেজার সাহেবের নেকনজরে থাকবো।
লকডাউন পরবর্তী সময়ে এতবড় একক লোন একটাও হয়নি কোম্পানিতে এখনও। তাই জামাইবাবুর বন্ধুর থেকে এই ভদ্রলোক লোনের খোঁজ করছেন খবরটা পেতেই দৌড়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমারই পোড়া কপাল - এক তো সারাদিন এই গাড়ি ঘোড়া লোক লস্করের ভিড়ে রোদে গরমে ঘোরা, তারওপর ম্যানেজার সাহেবকে কিছু না বলেই এতবড় একটা লোন করিয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দেবার চক্করে মজে আজ সময়ে অফিসে না যাওয়া - এবার না আমার চাকরিটাই চলে যায়!
এদিকে পেটেও ছুঁচোয় ডন মারছে, যা আর কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছি না। তাই ওখান থেকেই আর দু'পা এগিয়ে গণেশ টকিজ মোড়ের কোণে একটা মিষ্টির দোকানে এলাম। নিমকি, সিঙারা আর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস এই দিয়ে আপাতত পেটকে শান্ত করার একটা ছোট্ট প্রয়াস করতে আর কি!
খেতে খেতেই দেখলাম ফুটপাতের ধারে একজন বয়স্কা বিধবা মহিলা দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চাইছেন, বোধ হয় কাউকে খুঁজছেন। আমি নিজেও এই এলাকার খুব বেশি কাউকে চিনি না, তাই সকাল থেকে এই একই সমস্যায় ভুগছি আমিও। তাই তাঁকে ইচ্ছা সত্ত্বেও কোনো সাহায্য করতে পারলাম না, তবে তাঁর দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম।
দোকানের সামনেই একপাশে একটা বেশ উঁচু চৌপায়ার ওপর রাখা ছিল একটা স্টিলের ওয়াটার ট্যাঙ্ক, তার ট্যাপ খুলে খাওয়ার আর হাত ধোওয়ার জল মিলছে। নিচে একটা বেশ বড় প্লাস্টিকের ড্রামে সেই জল জমছে। আমার খাওয়া শেষ হলে, ঐ ট্যাপে হাত মুখ ধুয়ে যেই ঘুরেছি এবার কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতলটা নেবো বলে, দেখি সেই বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়ে আমার সামনে!
ইশারায় বললেন একটু জল খাওয়াতে। তাঁর একহাতে একটা কাপড়ের পুঁটলি যেটা তিনি মাটিতে রাখতে চান না, আর সেই কারণেই একহাতে ট্যাপটা ধরে অন্য হাতে জল খেতে পারছিলেন না বোধ হয়। আমি ট্যাপের মুখটা একহাতে খুলে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম, তিনি আঁচলা ভরে জল খেলেন খানিকটা। তারপর হাতটা খানিকটা তুলে মৃদুস্বরে 'বেঁচে থাকো বাবা' বলে আস্তে আস্তে আবার সেই ফুটপাত ধরে জেব্রা ক্রসিং পার হয়ে চলে গেলেন।
আমি দোকান থেকে কোল্ডড্রিঙ্কস নেবার সময়েই লক্ষ্য করলাম - সবাই কেমন যেন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সামনের বেঞ্চে বসে বোতলে চুমুক দিতেই একজন বললেন - ভাই, তোমার হাত মুখ তো ধোওয়া হয়েই গিয়েছিল, তারপরও ওভাবে ট্যাপটা খুলে দিয়ে অতটা জল নষ্ট করলে কেন?
বিরক্ত হয়ে বললাম - ঐ বয়স্কা মহিলা একটুখানি জল খেয়েছেন, সেটা নষ্ট করা হলো? আপনি জল খান না? কি ধরণের মানুষ আপনি? এই কথা বলতে আপনার কি লজ্জাও লাগলো না? তাছাড়া যার দোকানের জল তিনি তো কিছুই বলেননি, আপনার সমস্যাটা কোথায়?
ভদ্রলোক এত কড়া কথা শুনেও রাগ করলেন না, উল্টে হাসিমুখে দোকানের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কি এবার বিশ্বাস হলো তো সুরজ ভাই?" তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, "ওখানে কোনো মানুষকেই দেখতে পাইনি আমরা, যাকে তুমি জল খাওয়ালে বলছো ভাই। বিশ্বাস না হলে নিজেই জিজ্ঞাসা করে দেখো। এই ঘটনা আমি আগেও ঘটতে দেখেছি এখানে।"
আমি তো শুনে অবাক - ভর দুপুরে এ আবার কি কাণ্ড! কিন্তু সকলের অভিব্যক্তি দেখে বুঝলাম বিষয়টি মিথ্যা নয়। তাই নিজেই বললাম, "একজন বয়স্কা বিধবা মহিলা, একহাতে একটা কাপড়ের পুঁটলি থাকায় তিনি ট্যাপটা খুলে অন্য হাতে জল খেতে পারছিলেন না। তাঁকে আমি জল খাওয়ালাম আর আপনারা কেউ তাঁকে দেখেননি বলছেন?"
সেই ভদ্রলোক বললেন - বয়স্কা বিধবা, হাতে পুঁটলি... তার চেহারাটা একটু মোটা কি? একটু কম উচ্চতার আর গায়ের রঙ কুচকুচে কালো?
আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লাম। তিনি আবার তখন বললেন - বুঝেছি, ও তবে রামুর মা। এই ব্রিজ ভেঙে পড়ার দিন রামু চাপা পড়েছিল প্রথমেই। তারপর তার আর্ত চিৎকারে ছুটে যায় ওর মা আর তখনই ছিটকে আসা লোহার বীমটা আঘাত করে তাকেও। রামুকে তো সশরীরে আর পাওয়াই যায়নি, পিশে চ্যাপটা হয়ে গিয়েছিল। তবে ওর মা চাপা পড়ার পরও বেঁচে ছিল অনেকক্ষণ, তারপর জল চেয়ে আর্তনাদ করতে করতে মারা যায়।
আমার বিশ্বাস হলো না কথাগুলো। দিনদুপুরে এই কলকাতার রাস্তায় আমি একজন বছর চারেক আগে মৃতা মহিলাকে জল খাওয়ালাম? অসম্ভব, এ হতে পারে না! ভাবতে ভাবতে আপন মনেই মাথা নাড়াচ্ছিলাম আমি। তাই দেখে ভদ্রলোক বললেন, "এই দোকানেই তো কাজ করতো রামুর মা। তুমি দোকানের ভিতরে ঢুকে তার ছবি দেখে মিলিয়ে নাও না কেন - তুমি যাকে জল খাওয়ালে সে ঐ মহিলাই কিনা?"
আমি খাবারের পয়সা দেবার জন্য দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে দেখি - সত্যিই সেই মহিলার একটা ছবি টাঙানো আছে দেওয়ালে, তাতে চন্দনের ফোঁটা কাটা আর একটা বাসি ফুলের মালাও চড়ানো! দেখে তো পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। টাকা মিটিয়ে দিয়ে দোকানের বাইরে এসে চোখে মুখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিলাম আবার।
ঠিক তখনই শুনি দোকানের সেই সুরজ নামের লোকটি একজনকে বলছে, "দাদা, আজ অফিস যাওয়া হয়নি নাকি?" ভদ্রলোক উত্তর দেবার আগেই আবার নিজেই বললো সে, "তা' তো না, সকালে তো অফিস গেলেন গাড়ি নিয়ে - আমি দেখেছি তো, তাহলে কি জলদি ছুটি হয়ে গেল?"
এবার ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিলেন - হ্যাঁ, ঠিকই দেখছো। অফিস গিয়েছিলাম সকালে, কিন্তু ঐ ফ্ল্যাটের লোন ট্রান্সফারের কথা বলছিলাম না সেদিন তোমায়? এখনই খবর পেলাম, আমার এক বন্ধুর পরিচিত এক ভদ্রলোক এসেছেন ব্যাঙ্ক থেকে, সেই ব্যাপারেই আমার সঙ্গে কথা বলতে। তিনি বোধহয় সকাল থেকেই এসে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য, যাই গিয়ে একটু মিষ্টিমুখ করাই তাঁকে! লোনটা হয়ে গেলে একটা ঝক্কি কমে।
এই বলে, হাসতে হাসতে ভদ্রলোক চলে যেতেই আমি সুরজকে জিজ্ঞাসা করলাম - ঐ ভদ্রলোকের নাম কি রতন ঝা? কলাকার স্ট্রীটের অমুক নম্বর বাড়িতে থাকেন? অমুক ঠিকানায় তাঁর ফ্ল্যাট আছে, যার লোন ট্রান্সফার করতে চাইছেন উনি?
সুরজ যা জানালো, বুঝলাম ঐ ব্যক্তিই হলেন সকাল থেকে হন্যে হয়ে খোঁজা আমার সেই ক্ল্যায়েন্ট! আমি তৎক্ষণাৎ তাঁর পিছু পিছু দৌড়ালাম। যেতে যেতে শুধু একবার পিছন ফিরে চেয়ে দেখি - সেই মহিলা আমার দিকে মৃদু হাসি মুখে চেয়ে দাঁড়িয়ে ফুটপাতের ধারে, ঠিক সেই জায়গাতেই। আমি এবার থমকে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে ফিরে তাকাতেই যেন হাওয়ায় মিশে গেলেন তিনি।