ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব —3
ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব —3
পর্ব —3
রাতে শোবার ব্যবস্থাটা ঠিক মনঃপুত হল না আঁখির। দুটো ঘরেই বেশ বড় বড় দুটো খাট রয়েছে । তিনজন খুব ভালোভাবে শোয়া যায়। জ্ঞানদারঞ্জনের ঘরটা প্রভাস দখল করলেন দুই ছেলেকে নিয়ে। আর আঁখির ঘরটায় ওরা চারজন ।
মাসিমনির বড় মেয়ে রাণী বলল, "এই খাটে চারজন কি করে শোব মা"! মাসিমণি বললেন, "কেন! তুই আর মণি খাটে শুবি। আমি আঁখিকে নিয়ে মাটিতে বিছানা করে শুয়ে পড়ছি।" আঁখি বলল, "বাবার ঘরে একটা সোফা কাম বেড রয়েছে। ওটা এঘরে নিয়ে এলেই তো হয়"।
"না না। রণো অনেক রাত অবধি শুয়ে শুয়ে বই পড়ে। ওটা ওর লাগবে।"ঈষৎ বিরক্তি মিশিয়ে কথাগুলো বললেন মীনা। খুব খারাপ লাগছিল আঁখির। আর কিছু না বলে মাসিমনির সাথে মাটিতেই শুয়ে পড়ল।
অনেক রাতে নিজের মায়ের স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল আঁখির ।ঘরে একটা কম পাওয়ারের নীল রঙের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখতে পেল, মাসিমণি ওর পাশে নেই। কখন যেন উঠে গিয়ে রাণী আর মণির মাঝখানে শুয়েছে। অবাক হয়ে দেখছিল আঁখি, রাণী আর মণি কেমন সুন্দর ওদের মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে। মনে মনে ভাবছিল, আমার মা ও হয় তো ওরকমই আমাকে বুকের কাছে জড়িয়ে নিয়ে শুতো। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে আবার শুয়ে পড়ল আঁখি।
বেশ কিছুদিন ধরেই একটা কথা ভাবছিলেন মীনা। অত বড় পিয়ানোটা বসার ঘরের কতখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে। ওটাকে বিক্রি করে দিলে তো অনেকগুলো টাকা হাতে আসে। আর ঘরের জায়গাটাও অনেকটা বাড়বে। প্রস্তাব টা শুনে প্রভাস বললেন, "বেশ তো। তোমার যদি মনে হয় সেটা ভালো হবে, তাহলে তাই করো। তবে জিনিসটা তো আমাদের নয়, তাই একটু ভেবে চিন্তে কাজ করাই ভালো।
আঁখির প্রচন্ড আপত্তি সত্ত্বেও বিক্রি হয়ে গেল ওর পিয়ানো। ওর চোখের সামনে দিয়েই ওর প্রিয় জিনিসটা চলে গেল চিরদিনের মতো। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল মেয়েটা। ওর এই ফালতু সেন্টিমেন্টের দাম সেদিন কেউ দেয় নি। মেসোমশাই আর দাদাদের কঠিন দৃষ্টি আর মাসিমণির তিরস্কারে নিজেকে সংযত করতে বাধ্য হয়েছিল।
এরপর শুরু হল দিনবদলের পালা। আঁখির সমস্ত দামী দামী খেলনা, পুতুল, ওর ভালো ভালো ফ্রক সব চলে যেতে লাগল ওর থেকে ছ মাসের ছোট বোন মণির দখলে। আঁখি আপত্তি করলে রাগ করতেন মীনা, "ও তো তোর ছোটবোন নাকি! এত হিংসুটে কেন তুই!" অদ্ভুত লাগত আঁখির। রাতে একটু দুধ আর মিষ্টি না থাকলে রুটি খেতে পারত না আঁখি। মীনা সে ব্যবস্থা করেছিলেন আঁখি আর মণির জন্যে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, সেই দুধ আর মিষ্টি উঠছে মেসোমশাই আর দুই দাদার পাতে। রাণী আর মণিও বঞ্চিত হচ্ছে না প্রসাদ পাওয়া থেকে। মাঝে মাঝেই মেসোমশাই জিজ্ঞেস করেন, "আঁখির জন্যে রেখেছো তো। মেয়েটা আবার দুধ ছাড়া খেতে পারে না।" উত্তর টা রেডিই থাকে মীনার, "হ্যাঁ রে বাবা, রেখেছি। তোমরা আগে খেয়ে ওঠো তো"। মাসিমনির স্বার্থপরতায় আঁখি আর অবাক হয় না। এমনি ভাবেই আরও দুটো বছর কেটে গেল। কিছুদিন হলো ওর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সামনের মাসেই ওর জন্মদিন। আঠারো বছর বয়স হল আঁখির। মাসিমণি বলেছেন, এবারের জন্মদিন টা ঘটা করে করবেন। একটু অবাক লেগেছিল বৈকি। মনে মনে ভাবছিল আঁখি, আবার এসব ঝামেলা করছে কেন কে জানে। শুধুমাত্র আমার মন ভালো রাখার জন্যে তো মাসিমণি কোনোদিন কিছু করেনি। আগে আমার জন্মদিনের দিন কত আনন্দ হতো। বাবা কত উপহার দিত । বই, খেলনা, পোষাক, চকোলেট, কতো কি। বেড়াতেও নিয়ে যেত। ভালো রেষ্টুরেন্ট এ নিয়ে গিয়ে খাওয়াতো।আনন্দে ভরিয়ে রাখত বাবা আমাকে। আর এখন! হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলো।
জন্মদিনের দিন মীনা ওকে একটা সোনার দুল উপহার দিলেন। ছোটোর ওপরে খুব সুন্দর দেখতে ।অবাক হয়ে গেল আঁখি। "কি দরকার ছিল এত খরচ করার!"
মীনা বললেন, "তোকে কি আমরা কিছুই দিতে পারি না! ওরে! আমরা কি এতটাই খারাপ!" চুপ করে থাকে আঁখি। মীনা আবার বলেন, "আমাদের তুই বিশ্বাস করিস না, তাই না!" একথারও উত্তর দেয় না আঁখি। গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মীনা। রাতে বেশ কিছু আত্মীয় কে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সারাদিনে ব্যস্ততা প্রচুর। ওই ঠ্যাঁটা মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে থাকলে এখন চলবে না।
ক্রমশ :—