দেবদূত
দেবদূত


-এই রুপকথা শোন না।
- হুম বল
-আমি না তোকে খুব ভালোবাসি। আই লাভ ইউ রে।
-নিজের মুখটা দেখেছিস আয়নায়। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা সবসময় নাকের ডগায় এসে থাকে। নিজের শার্টের বোতামটাও ঠিক করে লাগাতে পারিসনা।দ্যাখ একবার কেমন উঁচু নীচু হয়ে আছে। মাথার চুল এলোমেলো। বড্ড অগোছোলা তুই। তুই একদম ব্যাগডেটেট
-কেনো তুই পারবি না আমায় গুছিয়ে রাখতে।
-এই দ্যাখ বাপু আমার ওতো সময় নেই বুঝলি। আমাকে দ্যাখ আমি রূপবতী, গুণবতী, কলেজের টপার।সবসময় টিপ টপ থাকতে পছন্দ করি আমি। আর আমার যোগ্য বয়ফ্রেন্ড হোলো সায়ন্তক,সেও কত্ত স্মার্ট টিপটপ থাকে।
সো প্লিজ অর্ক আমাকে বিরক্ত করিস না।
আমার মতো মেয়েকে পেতে হলে ভাগ্য করে জন্মাতে হয় বুঝলি।
নিজের চশমা সামলাতে পারিস না আর তুই সামলাবি আমাকে?
রুপকথা চলে যায় আর সেই চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে অর্কদ্যুতি চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আমি তোর অপেক্ষায় থাকবো।
রুপকথা যেতে যেতেই পেছন ফিরে বুড়ো আঙুল নীচে দেখিয়ে ইঙ্গিত করলো কোন লাভ নেই।
****
দীর্ঘ দুবছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর রুপকথার বিয়ের দিন চলে এল।
পাত্র অবশ্যই সায়ন্তক। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিলো যে সায়ন্তক এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে রাজি ছিলো না কিন্তু বিয়ের আগেই রুপকথা অন্ত্বসত্তা হয়ে পড়ায় একরকম বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজি হয়।
বিয়ের দিনক্ষণ, ভবন, বিয়ের সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে। শুধু এনগেইজমেন্টের আংটি কেনা হয়নি। তাই দুজনে জুয়েলারি শপে যায় আংটি কিনতে, সায়ন্তক তার নিজের গাড়ি নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে আসে।
-একি সায়ন্তক তুমি ড্রিংক করেছো। আর এভাবে গাড়ি চালাবে।
-আরে ডার্লিং কিচ্ছু হবেনা। আমার অভ্যেস আছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুপকথাকে বসতে হোলো গাড়িতে।
কিন্তু ভাগ্যের এমনি পরিহাস বাড়ির ফেরার পথে দুজনে এক মারাত্মক পথ দুর্ঘটনার সন্মুখীন হয় যার মাশুল স্বরূপ রূপকথার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়।
অক্ষত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যায় সায়ন্তক কারণ বিপদ সন্মুখীন জেনে সে আগেই গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় লাফিয়ে পড়েছিলো।
****
বিয়ের দুদিন আগে এনগেইজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু সায়ন্তকের বাড়ি থেকে কোন উত্তর আসেনা। রুপকথার বাড়ির লোকজন চেষ্টা করলেও ওপাশ থেকে কোন আগ্রহ দেখা যায়নি। শুধু একবার কে যেনো ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে এ বিয়ে হবে না, একজন অন্ধ মেয়েকে তাদের বাড়ির বউ করা অসম্ভব। যোগাযোগ করেও কোন লাভ নেই কারণ তারা এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এই খবর শোনার পর বাড়িতে রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়, হুলুস্থুল কান্ড দেখা যায়।
রূপকথা তো কেঁদে কেঁদে ঘর ভাসাচ্ছে, আর রূপকথার বাড়ির লোকজন যখন চিন্তায় মগ্ন তখন সেই মুহুর্তে দেবদূতের মতো আবির্ভাব ঘটে অর্কদ্যুতির।
রুপকথার বাবার সামনে গিয়ে অর্ক বলে -আরে আঙ্কেল চিন্তা করছেন কেনো। সমস্ত কিছুর আয়োজন করুন। বিয়ে ঠিক ভাবেই সম্পন্ন হবে। নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি তো আছি। আমি সমস্ত বিষয়টা দেখছি।
****
রুপকথা কনে সাজে তৈরী। সে জানে না তার কার সাথে বিয়ে হবে শুধু এইটুকু জানে যার সাথেই হোকনা কেনো সে নির্ঘাৎ দেবদূত ছাড়া আর কেউ নয় কারণ সে বর্তমানে অন্ধ আর অন্যের সন্তানের অন্ত্বসত্তা সুতরাং তার মতো মেয়ে কে যে বিয়ে করবে সে তো দেবদূতই বটে আর ধন্যবাদ ভগবান কে সে জীবনে যাকে আশা করেছিলো ভাগ্যিস সেই অমানুষের হাত থেকে নিজের বাকিটা জীবন বেঁচে গেছে।
একে একে বিয়ের সমস্ত নিয়ম শেষ এবারে সিঁদুর দান।
সিঁদুর দানের পূর্বে রূপকথার কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বর বললো- কিরে রূপবতী, গুনবতী, কলেজের টপার তোর সিঁথিতে আমায় সিঁদুর পড়াতে দিবি?
এই ক্যাবলা কে বর বলে মেনে নিতে পারবি তো?
কথাটা শোনা মাত্রই যেন রূপকথার সারা শরীরের বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকলো সুনামী, টাইফুন, এক এক রকম বিধ্বংসী ঝড়।
রূপকথার চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে এলো শুধু মুখ দিয়ে একটাই কথা বেড়োলো -অর্কদ্যুতি!
বিয়ের সমস্ত নিয়ম শেষ হতেই পুরোহিত মশাই বললেন আজ থেকে আপনারা স্বামী স্ত্রী।
****
আজ বিয়ের তিন বছর হোলো। অনেক চেষ্টা করেও রুপকথার চোখ ঠিক করা যায়নি। তবুও একটুও বদলায়নি রূপকথা। বদলায়নি তার কথা বলা, বদলায়নি টিপটপ থাকা,অর্ক কে বকা ঝকা করা। সে এখন অফুরন্ত ভালোবাসে সিনিয়র অর্ক আর জুনিয়র অর্ককে।
***-
-বাবা, তুমি সবসময় সব কিছু টিপ টপ করে গুছিয়ে রাখো কেনো। আধো আধো গলায় জুনিয়র অর্ক বলে।
- তোমার মামনি যে অগোছালো থাকা পছন্দ করে না বাবু।
- সব সময় গুছিয়ে রাখতে হয় বুঝি।
-তা নয়তো কি, যদি কখনো দেখে সব কিছু অগোছালো আছে তাহলে তো খুব বকবে আমায়।
-মামনি কি করে দেখবে, মামনি তো দেখতেই পায়না।
-ধ্যুত! পাগল ছেলে একদিন তো নিশ্চই দেখতে পাবে আর সেদিন যদি অগোছালো থাকে তখন।
চলো চলো অনেক রাত হয়েছে বাবু ঘুমোতে হবে।
দূর থেকে সমস্ত কথা রূপকথা শুনছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো।
হ্যাঁ সেই অগোছালো ছেলেটাই আজ কত্ত খেয়ালি। আমায় সাজিয়ে রাখে জুনিয়র অর্কের খেয়াল রাখে আদর্শ পিতার মতো, সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে রাখে একদম আমার মনের মতো করে। আমার সবথেকে বেশী ভালো লাগে তখন যখন সবাই আমায় বলে ভাগ্য করে বর পেয়েছিস রে রূপ।
অর্ক নিজের চশমা সামলাতে না পারলেও সে আমার অহেতুক বায়না গুলো ঠিক সামলে নেয়।
হ্যাঁ অর্ক আমি সত্যি ভাগ্যবতী যে তোমার মত একজন দেবদূত কে স্বামী হিসেবে পেয়েছি। আনমনেই বলে ওঠে রূপকথা, রূপকথার অলক্ষ্যেই চোখের কোণ টা ছল ছল করে ওঠে।
এক দুর্ঘটনা সত্যিই জীবনের কত্ত কিছু পরিবর্তন এনে দেয়।