Prithwish Basu

Horror Tragedy

3  

Prithwish Basu

Horror Tragedy

ডেথ এক্সপ্রেস

ডেথ এক্সপ্রেস

8 mins
642


"বাড়িগুলো দেখ, প্রত্যেকটা হন্টেড!"


খানিকটা লালমোহনবাবুর ঢঙে বলে উঠলো প্রণয়। চারদিকে অন্ধকারে আশপাশের বাড়িগুলো সত্যিই ভূতের বাড়ি লাগছিলো। শীতের রাতে বলে কি একটাও বাড়ির জানলা, একটা দোকানপাটও খুলে রাখতে নেই! স্ট্রিটলাইটের আশা তো ছেড়েই দিয়েছি। এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে আমাদের টোটো। আলো বলতে টোটোর হেডলাইট আর আমাদের কারোর কারোর হাতের মোবাইলের আলো।


"ধুর, এরকম অন্ধকারে আমরা ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতাম। গ্রামগঞ্জে এরকম প্রায়ই হতো।" সুমিতদার কথায় আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। সুমিতদা কি লেভেলের গুল মারতে পারে তা আমাদের কারোর অজানা নয়, তাই কোনটা সত্যি, কোনটা ঢপ বোঝা মুশকিল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তবে সুমিতদা ছাড়া আমাদের সবার কাছেই এরকম পরিবেশ একটা নতুন অভিজ্ঞতা।


আমরা চারজন, অর্থাৎ অভীক, প্রণয়, সুমিতদা আর আমি এসেছিলাম বিষ্ণুপুর, এক অফিস কলিগের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে। আর সেই মওকায় বিষ্ণুপুরটাও ঘোরা হয়ে গেলো। প্রথমে আরো অনেকে আসবে বলেও শেষঅব্দি আমরা চারজনই বেঁচে ছিলাম। আর আমাদের পা বেড়াতে যাওয়ার জন্য সবসময় বাড়িয়েই রাখি। অগত্যা শনিবার সকালে ট্রেন ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। দুদিন ধরে ঘুরেঘারে রবিবার রাতে বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে এখন আমাদের বাড়ি ফেরার পালা।


"লাইনের কিছু কাজ চলছে, বুঝলেন কিনা? ওই জন্যি লোডশেডিং করে দিছে, বুঝলেন কিনা?" জড়ানো গলায় ভেসে এলো সামনে থেকে। আর গলারই বা দোষ কী, টোটো চালানোর ফাঁকে মাঝে মাঝেই ছোট কাঁচের শিশি থেকে গলায় কিছু ঢালা হচ্ছে যে!


"ট্রেন কিন্তু অনেক লেট, অলরেডি ৪৫ মিনিট লেটে চলছে।" ফোনে ট্র্যাক করতে করতে অভীক বলে উঠলো। অভীক আমাদের মধ্যে সবচেয়ে দায়িত্ববান ছেলে, তাই ওর সাথে কোথাও গেলে কোনো চিন্তা থাকেনা। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, ঘোরার প্ল্যান, সব ওই করে, আর আমরা ওর ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরি। কিন্তু এখন ও যে খবরটা দিলো সেটা শুনে খুব একটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেলোনা। "মানে এই হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় স্টেশনে বসে থাকো একঘন্টা!", বিরস গলায় বললাম আমি।


"আজকে শুনলাম কিসব অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে রেলে।" প্রণয় বললো। অভীক বললো, "হ্যাঁ তাও আবার দুদুটো। নাগপুরে চারজন রেললাইনে কাটা পড়েছে, বাচ্চাও ছিলো। আর মাদুরাইয়ের কাছে একটা প্যাসেঞ্জারের একটা বগি উল্টে গেছে।" "শিট ম্যান! ব্ল্যাক ডে ফর ইন্ডিয়ান রেল তো আজ তাহলে!", বললো সুমিতদা। এসব শুনে খানিক চাপ খেয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম আমাদেরটা ঠিকঠাক হাওড়া পৌঁছে দিলে হয়।


স্টেশন যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে এগারোটা। অন্ধকার চারদিকে, শুধু কয়েকটা টিউবলাইট জ্বলছে, যা একদমই পর্যাপ্ত নয় পুরো স্টেশনকে আলো দিতে। অর্থাৎ লোডশেডিং এখানেও চলছে। প্ল্যাটফর্মে প্রতিটা শেডে একটা করে টিউবলাইট জ্বলছে। ট্রেনের টাইম ছিলো রাত বারোটা পাঁচ, আরো লেট মিলিয়ে হিসেব মতো দেড় ঘন্টা আমাদের এই ঠান্ডার রাতে জনমানবহীন স্টেশনে কাটাতে হবে।


জনমানবহীন বললাম এ কারণে, কারণ পুরো প্ল্যাটফর্মে শুধু আমরা চারজনই। স্টেশনে ঢোকার মুখে দুটো ভিখিরিকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আর একটা কুকুর আশেপাশে দুবার ঘুরঘুর করছিলো। প্ল্যাটফর্মের পিছনে একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ অনেকটা জায়গায় ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। এতটা ফাঁকা স্টেশনে এত রাতে আগে কখনো থাকিনি। 


আমি আর প্রণয় বসলাম একটা বেঞ্চিতে, সুমিতদা আর অভীক বসলো একটু দূরে আরেকটায়। সুমিতদা বসেই মোবাইলে গেম খেলতে লেগে গেলো, অভীক চিন্তিত মুখে ফোন হাতে এদিক ওদিক একটু পায়চারি করলো। আমি আর প্রণয় গল্প করতে লাগলাম। 


নানারকম গল্প করতে করতে কখন যে সময় কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ প্রণয় বললো, "এতক্ষনে ট্রেনের এসে যাওয়া উচিৎ ছিলো।" ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা পাঁচ। অর্থাৎ একঘন্টা লেট। ট্রেনের কোনো নামগন্ধ দেখলাম না। না কোনো ডিসপ্লে বোর্ডে কোনো ইনফরমেশন, না কোনো অ্যানাউন্সমেন্ট।


ঠিক সেই সময়ে সুমিতদার গলা পেলাম। "অভীক? অভীক?" অভীককে খুঁজে পেলাম না চারদিকে তাকিয়ে। সুমিতদার তাকাতে বললো, "জল ভরতে গেছে বললো। চলে আসবে।" 


আরো বেশ কিছুক্ষণ গেলো। প্রায় আধঘন্টা অভীকের খোঁজখবর না পেয়ে এবার আমাদের ভয় হলো। ট্রেন যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে। এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ তো অভীক কখনো করেনা! সুমিতদাকে লাগেজ সামলাতে বলে আমি আর প্রণয় খুঁজতে গেলাম অভীককে। সারা প্ল্যাটফর্ম তন্নতন্ন করেও কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে। আশ্চর্য! গেলো কোথায় ছেলেটা জল ভরতে যাবে বলে! প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে ছুটে খুঁজেও তাকে কোথাও দেখলাম না। 


ফোন করার কথা ভেবে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি সিগন্যাল নেই। প্রণয়ের ফোনেও একই অবস্থা। বাহ রে বাহ! এতক্ষণ তো দিব্যি 4জি দিচ্ছিলো, হঠাৎ কী হলো? আর সঙ্গে মারাত্মক ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। গলার মাফলারটা নাক অব্দি তুলে দিয়েও ঠান্ডা বাগে আসছেনা। তীব্র ঝড়ে আশেপাশে গাছপালা গুলো প্রচন্ড দুলছে। অশ্বত্থ গাছটায় মনে হচ্ছে যেন একদল বাঁদর উঠে ভয়ানক নাড়াচ্ছে ডালগুলো।


রীতিমত চিন্তায় পড়ে গেলাম আমরা। চতুর্দিকে একটি জনপ্রাণীকে দেখতে পাচ্ছিনা আমরা। এনকোয়ারি কাউন্টার ফাঁকা, টিকিট কাউন্টার ফাঁকা, এমনকি যে দুটো ভিখিরিকে আসার সময় ঘুমোতে দেখেছিলাম তাদেরও দেখতে পেলামনা। 


প্রচন্ড ভয়ে আমরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম যেন। অভীককে কি কেউ কিডন্যাপ করে নিলো? ওই ভিখিরিগুলো কি আসলে কিডন্যাপার? স্টেশন থেকে বেরিয়ে আশপাশে একটু দেখেও এলাম, কিন্তু চারপাশে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লোনা। সাথে সমানে চলছে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ার ঝড়। একবার মনে হলো বিয়েবাড়ি অব্দি ফিরে যাই। কিন্তু অন্ধকারে অচেনা জায়গায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে বিয়েবাড়ি খুঁজে বের করার মতো পাগলামি করতে কেউই সাহস পেলাম না।


মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত এরপর শুরু হলো স্টেশনের লাইটগুলোর দপদপানি। ভয় ও ঠান্ডায় যখন হাত পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই দূর থেকে দেখলাম একটা জোরালো আলো। ট্রেন আসছে! 


ট্রেনের আলো দেখে মনে অদ্ভুত বল পেলাম। চারদিকে যতটা পারা যায় ঘুরে অভীকের নাম ধরে ডাকতে থাকলাম আমরা। প্রত্যুত্তরে তীব্র হাওয়ার শনশনানি ছাড়া আর কিছুই এলোনা। সুমিতদা হঠাৎ আমার হাত ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে, বললো, "ট্রেনে আমাদের উঠতেই হবে।"


আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, "পাগল হয়ে গেছো নাকি? অভীককে ছাড়া কিভাবে যাবো?"


সুমিতদা বললো, "অভীক নেই এখানে। দেখছিস না অবস্থা? থাকলে এতক্ষণে চলে আসত।"


"নেই মানে?! হারিয়ে গেছে নাকি?", প্রণয় ভীত কণ্ঠে বলে উঠলো।


-"তাই ধরে নে। আমাদের এই অবস্থায় একা এখানে একমুহূর্ত থাকা উচিৎ না। আর এই ট্রেনটা মিস করলে কাল ভোরের আগে আর ট্রেন নেই। ততক্ষণ ওয়েট করলে আমরাও গুম হয়ে যাবো।"


বলতে বলতে ট্রেন এসে পড়লো প্ল্যাটফর্মের ধারে। আমরা সম্পূর্ণ রকম কান্ডাকান্ড জ্ঞানরহিত হয়ে পড়েছি। অভীককে না খুঁজে পেয়ে মনের ভিতর প্রবল তোলপাড় হচ্ছে। কিন্তু এই অন্ধকারে প্রবল ঝড়ে অভীককে খুঁজতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। বড় রকম বিপদেও পড়তে পারি। সুমিতদা বললো, "এরপর বড় কোনো স্টেশন দেখলে নেমে পুলিশে রিপোর্ট করবো। এখন তো কাউকে যোগাযোগও করতে পারছিনা। দেখি যদি একটু এগিয়ে সিগন্যাল আসে। পুলিশে আর অভীকের বাড়িতে জানাতেই হবে।"


ঠিক এই সময়ে ট্রেন বিকট শব্দ করে হর্ন দিলো, তারপরই আস্তে আস্তে গড়াতে শুরু করলো। সুমিতদা উঠে পড়লো ট্রেনে, আমরাও যন্ত্রের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে উঠে পড়লাম তার পিছন পিছন। ট্রেন স্টেশন ছাড়া পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে অভীককে খোঁজার চেষ্টা করলাম। নিভু নিভু আলোয় যেটুকু দেখা যায় তার মধ্যে কাউকে দেখতে পেলাম না। মনে মনে বললাম, "স্যরি অভীক। কোথায় চলে গেলি বলতো তুই! ঠিক আছিস তো? কাল সকালেই খুঁজতে আসবো তোকে। ততক্ষণ যেখানেই থাকিস সাবধানে থাক।"


ভীতসন্ত্রস্ত, চিন্তিত মনে যখন কামরার ভিতরের দিকে তাকালাম, দেখলাম সুমিতদা আর প্রণয় দাঁড়িয়েই আছে, যেন কিছু দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, "কি হলো?" প্রণয় পিছনে তাকিয়ে উত্তর দিলো, "পুরো কামরা তো খালি মনে হচ্ছে।" সুমিতদা বললো, "ট্রেনটা পুরো বুকড বলেছিলি না? টিকিট পাচ্ছিলিসনা। এতো দেখছি পুরো খালি!"


দেখে খানিক সন্দেহই হলো, আমরা ঠিক ট্রেনে উঠেছি তো? সুমিতদাকে বলতে বললো এই ট্রেনটা বাদে আর কোনো ট্রেন ছিলোনা সকাল অব্দি। যাইহোক, আমরা বসলাম একটা সিটে। কেউই নেই, সিটের নাম্বার মিলিয়ে বসারও খুব একটা প্রয়োজন বোধ করলাম না। এমনিতেই মন প্রচন্ড ভারাক্রান্ত। সুমিতদা বললো, "এরপর বড় স্টেশন মোস্ট প্রব্যাবলি খড়গপুর। ওখানে নেমে আগে পুলিশে রিপোর্ট করতে হবে। দেন ভোর হলেই আসবো আবার এখানে খুঁজতে।"


নিশ্ছিদ্র অন্ধকার চিরে প্রবলবেগে দুলে দুলে ছুটে চলেছে আমাদের ট্রেন। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে থাকতে একটু তন্দ্রা এসে যাচ্ছিলো, পরক্ষণেই কেন জানিনা চমকে ভেঙে যাচ্ছিলো ঘুম। মনের ভিতর প্রচন্ড পাপবোধ জেগে উঠছিলো বারবার। সুমিতদা আর প্রণয়ের মুখ দেখে মনে হলো তাদেরও একই অবস্থা।


হঠাৎ মনে হলো কামরার করিডোর দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি হেঁটে যাচ্ছে বাথরুমের দিকে। চোখ কচলে ভালো করে দেখলাম, হ্যাঁ ঠিকই দেখেছি, কেউ একটা যাচ্ছে ওদিকে, কামরার আলো নেভানো বলে মুখ দেখা গেলোনা। তবে একটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে কামরায় একা নই তাহলে। আমি উঠে গিয়ে সবকটা ক্যুপ খুঁজতে লাগলাম, কোথাও কেউ আছে কিনা।


হঠাৎ ওপরে চোখ যেতে দেখলাম একটা বাচ্চা, বড়জোর দশ হবে বয়েস, আপার বার্থে বসে পা দোলাচ্ছে। সেখানে আর কোনো বড় কাউকে দেখতে পেলাম না। খুব অবাক লাগল, ভাবলাম হয়তো এ ওই বাথরুমে যাওয়া লোকটার ছেলে, ছেলেকে এখানে বসিয়ে রেখে বাথরুমে গেছে। 


ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, "হাওড়া যাচ্ছে তো ট্রেনটা?" মনে মনে কেন জানিনা এখনো সন্দেহ ছিলো যে আমরা ভুল ট্রেনে উঠেছি। তবে যাই ট্রেন হোক না কেন, খড়গপুর হয়েই যেতে হবে তাকে, আর সেখানেই আমরা নামবো।


ছেলেটা কোনো উত্তর দিলোনা, শুধু পা দোলাতে লাগলো। ভাবলাম হয়তো জানেনা, তাই জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার মা বাবা কোথায়?" ছেলেটি নিশ্চুপে শুধু ডানহাতটা তুলে দেখালো, সেটা নির্দেশ করছে আমার পিছনে। পিছনে ঘুরতেই যে দৃশ্য দেখলাম হাড়হিম হয়ে গেলো।


সেই লোকটা, যাকে বাথরুম যেতে দেখেছিলাম, সে পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। এই অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম তার চোখগুলো যেন জ্বলছে, এবং প্রচন্ড লাল। আমি সভয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলাম, লোকটি গিয়ে লোয়ার বার্থে বসলো। হঠাৎ তখন যেন দেখতে পেলাম লোকটির পাশে একটি মহিলাও বসেছিলো, পরনের সাজপোশাক দেখে অবাঙালি মনে হলো। এতক্ষণ দেখতেই পাইনি, যেন ভোজবাজির মতো উদয় হয়েছে হাওয়া থেকে। উল্টোদিকে একটি বাচ্চা মেয়েকেও বসে থাকতে দেখলাম। বয়স চোদ্দ পনেরো হবে। একেও দেখতে পাইনি আগে। আমি সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম লোকটিকে, "আপলোগ কাঁহাসে আ রাহে হ্যায়?"


লোকটি জলদগম্ভীর স্বরে জবাব দিলো, "নাগপুর"


আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, "ইয়ে ট্রেন হাওড়া যা রাহি হ্যায় না?"


লোকটি একবার তাকালো আমার দিকে, মুখে যেন একটা ব্যাঙ্গের হাসি। তারপর হাতের তর্জনী তুলে উপরের দিকে দেখালো।


আমি দৌড়ে আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখানে গেলাম। সুমিতদা দেখলাম মাথা দুহাতে ধরে বসে আছে, যেন খুব মাথা যন্ত্রণা করছে। প্রণয়কে বললাম, "আমরা কামরায় একা নই। ঐদিকে একটা ফ্যামিলি আছে। তবে খুব অদ্ভুত লাগলো ওদের। একবার আয় তো আমার সাথে। এই ট্রেনটা নাগপুর থেকে আসছেনা, রাইট? আমি তো জানি পুরুলিয়ায় লাস্ট স্টপেজ।"


প্রণয়ের সাথে যখন আবার সেখানে গেলাম, দেখলাম কেউ নেই সেখানে। হঠাৎ পিছন থেকে সুমিতদা আমাদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। সামনের কামরা থেকে কিছু কিছু আওয়াজ আসছিলো, যেন সেখানে অনেকে আছে। সুমিতদা সেদিকেই এগিয়ে গেলো। আমরাও ওর পিছু নিলাম।


পরের কামরায় যেতেই দেখলাম প্রচুর লোকজন সেখানে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ সিটে বসে। তবে এত লোক থাকলে যেরকম আওয়াজ হওয়া স্বাভাবিক সেরকম হচ্ছেনা। সুমিতদা প্রথমে ঢুকতেই সবাই তার দিকে তাকালো। তারপর কিসব ভাষায় যেন কথা বলতে লাগলো, শুনে মনে হলো তামিল হবে। হঠাৎ ওই নিভন্ত আলোয় দেখতে পেলাম এরা কেউই স্বাভাবিক নয়। কারোর হাত ভাঙা, কেউ খোঁড়াচ্ছে, কারোর কাঁধ থেকে অনেকটা অংশ নেই।


এতটাই অবাক হলাম যে গলা দিয়ে চিৎকারের শক্তিটুকু চলে গেলো। হঠাৎ দেখলাম আমার সারা জামাটা রক্তে ভিজে গেছে, হাতপা ক্ষতবিক্ষত। পিছনে ঘুরতে দেখলাম প্রণয়েরও মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে, রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে। আবার সামনে ঘুরতে দেখলাম সুমিতদার মাথার অর্ধেকটাই নেই, আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললো, "ডেথ এক্সপ্রেস"। 


আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। 


*************************************************


বিষ্ণুপুর স্টেশন, রাত বারোটা পাঁচ।


প্ল্যাটফর্মের মাঝে বিশাল একটা ধ্বংসস্তূপ যেন। একটা শেড ভেঙে পড়েছে। চারিদিক লোকে লোকারণ্য, আরপিএফ, সাধারণ মানুষ, কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভ করতে শুরু করে দিয়েছে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে অভীক, একহাতে একটা জলের বোতল, অন্যহাতে ফোন, কানে ধরা।


"হ্যালো… হ্যালো কাকু, তোমরা … তোমরা প্লিজ বিষ্ণুপুর চলে এসো। হ্যাঁ একটা অ্যাক্সিডেন্ট … হয়ে গেছে কাকু। হ্যাঁ ময়ূখ, প্রণয় আর সুমিতদা ওর তলাতেই বসেছিলো…. তোমরা তাড়াতাড়ি চলে এসো প্লিজ!"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror