দানব ও দেবতা
দানব ও দেবতা
আমার সামনের বিস্তৃত সুনীল আকাশে তখন সূর্যাস্তের গেরুয়া ছোপ লেগেছে।বহুদুরে দেখা যাচ্ছে সাদা বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।ক্যানভাসের অর্ধেক ঢেকে রয়েছে চিরসবুজ বৃক্ষে।আমার উল্টোদিকে রালং মনাস্ট্রি।সেখান থেকে গুরুগম্ভীর স্বরে ঢং ঢং করে বেজে উঠছে পবিত্র ঘন্টাধ্বনি।প্রকৃতির এই অপার মুগ্ধতায় আমি অবশ হয়ে গেলাম।আমি চিত্রার্পিতের মত বসে রইলাম সেই অনিন্দ্যসুন্দর স্থানটিতে।
''ও দাদা..আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?''
আমি চমকে উঠলাম।দেখলাম আমি যে পাহাড়ি রেস্তোঁরা টিতে বসে আছি সেখানেই আমার পাশের টেবিলে বসে আছে লোকটা।
লোকটাকে দেখেই আমি কেমন যেন হকচকিয়ে গেলাম।কোথায় দেখেছি ওকে?
ভদ্রলোকের বেশ পেটানো চেহারা,গায়ের রঙ মাজা মাজা,আমারই সমান লম্বা,চোখে চশমা,মোটা গোঁফ,মাথায় ঠাসা কোঁচকানো চুলের বাহার।বয়স মোটামুটি ভাবে চল্লিশ- টল্লিশ।লোকটা আমার ভীষনই চেনা অথচ কোথায় দেখেছি কিছুতেই মনে পড়ছেনা।
আমি বললাম,'' -না ঘুমাইনি,মেডিটেশন করছিলাম।''
এ কথায় লোকটা বিশ্রী রকমের হেসে বলল,''-আরে ধুর মশাই,ও সব ধ্যান ট্যান তো সাধু সন্ন্যাসীদের ব্যাপার..আমরা ওসব পারি নাকি?''
আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল।এই লোকটা আমার ওয়েভ্- লেংথ্ এর নয়।সুতরাং একে অ্যাভয়েড করতে হবে।
রেস্তোরাঁতে আলো জ্বলে উঠেছে।দুজন সিকিমিজ তরুণী পকোড়া,চা,কফি ও মদ পরিবেশন করছে।
লোকটি এবার নিজের জন্য একটা হুইস্কির অর্ডার দিয়ে নিজের টেবিল ছেড়ে সোজা আমার টেবিলে উঠে এসে বলল,''-আপনার হুইস্কি চলে?তাহলে আরেকটা নিই-''
এ তো মহা মুশকিল!এই ধরনের গায়ে পড়া লোকেদের আমি দু-চক্ষে দেখতে পারিনা।অবশ্য প্রয়োজনে আমি ভয়ঙ্কর রূঢ় হতে পারি।
আমি বললাম,''-না..আমার চলেনা,আমি চা খাব-''
''ঠান্ডার জায়গা..একটা নিন না-''
''নাঃ, আমি চা নেব-''
''কোথায় থাকেন দাদা?''
''কোলকাতায়, নিউটাউনে.''
''আরে!আমিও তো নিউটাউনে,ডিএলএফ ওয়ানের পাশে..আপনি?''
সেরেছে!এ যে আমারই প্রতিবেশী।কিন্তু এই প্রগলভ্ লোকটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা।আমি কোনো উত্তর না দিয়ে কাকের ডানার মত আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।আমার কানের মধ্যে ঝাপটা মারতে লাগল ঠান্ডা হাওয়া।
''আপনি কী একাই এসেছেন দাদা?''
''হুমম্-''
''ভালই করেছেন।বউ,বাচ্চা নিয়ে এলে নিজের মত এনজয় করা যায়না..সারাদিন শুধু ক্যাঁচরম্যাচর-''
''তাই কি?আমার তা মনে হয়না।আমি রিগ্রেট করছি কেন ওদের জোর করে নিয়ে এলামনা!আই মিস্ দেম এ লট্,নেহাত মেয়ের স্কুলে এখন পরীক্ষা চলছে,মিসেস মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে,তাই আসলনা..কিন্তু সারাক্ষন শুধু ওদের কথাই মনে পড়ছে--''
লোকটি হুইস্কির গ্লাসে বড় একটা চুমুক দিয়ে বলল,''-ধুর মশাই,একা একা বিন্দাস ঘুরছি। যত ইচ্ছা মাল খাও, কেউ বিরক্ত করবেনা।যত ইচ্ছা....''
পাহাড়ি তরুণীটি আমার সামনে এক প্লেট পকোড়া আর ধোঁয়া ওঠা চা রেখে গেল।-
লোকটি আমার কানের সামনে মুখ এনে বলল,''-মেয়েটার বুক আর পাছাটা দেখলেন?ওঃ, বিছানায় একেবারে ..ডেলিশাস!''
আমার কাছে নারী হল রোমান্টিকতার প্রতিমূর্তি।মেয়েদের শরীর নিয়ে নোংরা কথা শুনলে আমার ঘেন্না করে।আমার ইচ্ছে হল ঠাস করে লোকটার গালে একটা থাপ্পড় কষাই।
এইমুহূর্তে অন্য টেবিলে উঠে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু, লোকটার মধ্যে কী একটা আছে আমি কিছুতেই ইগনোর করতে পারছিনা।লোকটা আমার ভীষনই চেনা অথচ কোথায় দেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা।
''আপনি কি নিয়মিত বেড়াতে আসেন?''
''হুমম্''-
''আমারও বেড়ানোর নেশা।মোটামুটি সারা ভারত দেখে ফেলেছি।এইতো গতবছর কাশ্মীর গেলাম,গন্ডগোলের মধ্যে,উইথ ফ্যামিলি-''
গতবছর আমিও কাশ্মীর গেছিলাম কিন্তু এই বর্বর লোকটির সঙ্গে সেকথা শেয়ার করার কোনো মানে হয়না।
''কোন হোটেলে উঠেছেন?''
''হোটেল রালং-''
''আমিও তো ওখানেই! রুম নম্বর কত?''
''বোধহয় চারশো এক''-
''না না ভুল হচ্ছে,চারশো এক তো আমার''-
আমার পকেটে চারশো এক এর চাবি রয়েছে কিন্তু আমি আর কথা বাড়ালাম না,লোকটা কখন বিদায় হবে কে জানে?
আমার চারপাশের পাহাড়ি জনপদ ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে আসছে,একটানা ডেকে কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে অজস্র পাহাড়ি পোকা।গুম্ফা থেকে সমবেত প্রার্থনার আওয়াজ আসছে।সেইসঙ্গে হু হু করে বেড়ে চলেছে শীত।
একটা কবিতা মাথার মধ্যে বিনবিন করে উঠল।আমি আমার ট্যাবে কবিতার নাম লিখলাম-'বুকের ভিতর বৃষ্টি পড়ে'-
লোকটির বেশ নেশা হয়ে গেছে।সে একটানা নিজের মনে বকে চলেছে..''আপনি কি কবি টবি নাকি মশায়?এককালে আমারও এসব চর্চা ছিল জানেন!এখন ব্যাবসার চাপে..আমি শুধু নীল আর লাল নোটের কবিতা পড়ি..হ্যা..হ্যা..হ্যা..হ্যা।জীবনে কিছুই হলনা মশাই..কত স্বপ্ন ছিল,কত অ্যাম্বিশান ছিল,কতকিছু হওয়ার ছিল।কিচ্ছু হলনা..কিচ্ছু হলনা,একটা ছাপোশা বউবাচ্চাওয়ালা পাতি মধ্যবিত্ত...ধুর শালা!''
''আর ইউ সাকসেসফুল স্যর?''
''হ্যাঁ, আমি সফল,চূড়ান্ত ভাবে সফল।আসলে কী জানেন,জীবনের কাছে খুব বেশি চাইতে নেই।তাতে দুঃখ পেতে হয়,একমনে শুধু নিজের কাজটুকু.....''
আমি কবিতায় কনসেনট্রেট করে প্রথম লাইনটা লিখলাম-
'ঘন নীল সমুদ্রের নীলিমায় অথবা ছাই রঙা আকাশে আমি অক্লান্ত খুঁজে ফিরি তোমাকে'-
দ্বিতীয় লাইনটা লিখতে যাব এমন সময় লোকটা আমার হাত চেপে ধরে বলল,''-দাদা,একটা কথা বলি-আপনিও একা,আমিও একা।এই শীতের রা্ত,একই হোটেল,একটা পাহাড়ি মেয়েকে-মানে এই মেয়েটাকেই !কিছু টাকা দিলে,টাকায় কি না হয়-মানে চোখের সামনে এমন একটা টাটকা মেয়ে''....
নাঃ,এনাফ ইজ এনাফ।এই বদমাইশ মাতালটার সঙ্গে আর এক মুহূর্তও নয়।আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,''-ভীষন শীত করছে,চলি।''
লোকটি আমার দিকে হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকের জন্য,আমি চমকে উঠলাম।লোকটির ডানহাত অবিকল আমারই হাতের মত-পুড়ে যাওয়া,আসল চামড়ার বদলে সাদা হয়ে যাওয়া!লোকটির হাতেও আমারই মত ছটি আঙুল!-
লোকটি বলল,''-এবারের কালীপুজোয় মেয়ের সঙ্গে বাজি পোড়াতে গিয়ে একটা চকলেট বোম্ বার্ষ্ট করে গেল জানেন? অত শীতেও এবার আমি কুলকুল করে ঘামতে লাগলাম।আমারও যে একই রকমভাবে..
আমি এবার লোকটিকে বেসিনের আয়নার সামনে হ্যাঁচকা টান মেরে নিয়ে এলাম।আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত সাপের মত নেমে গেল।লোকটির চোখ,নাক,ঠোঁট,চুল,থুতনির কাটা দাগ এমনকি চশমাটা পর্যন্ত হুবহু আমার মত।আমি ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম,''-আপনার নাম ও কি ইন্দ্রনীল চৌধুরী?''
লোকটি এবার আমার দিকে ক্রূর হেসে বলল,''-যাক, চিনতে পেরেছো তাহলে..! হ্যাঁ বন্ধু আমিই তুমি,তোমার কালো রূপ।''-লোকটি অশ্লীলভাবে হেসে উঠল-
আমার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে।এই লোকটা আমারই দ্বৈত সত্ত্বা।আমার ভিতরে লুকিয়ে থাকা একটা অসৎ,শয়তান লোক।যে লোকটা আমাকে শুধু পা ধরে নিচের দিকে টেনে নামায়,যে প্রতি মুহূর্তে আমাকে জ্বালাতন করে,বিরক্ত করে,,বিব্রত করে..আমাকে মারতে চায়।আমি বহুদিন ধরে এই শয়তান কে খুঁজে চলেছি-
আজ যখন সুযোগ এসেছে.....
আমি নেশাগ্রস্থ ইন্দ্রনীলের হাত ধরে গাঢ় অন্ধকার পাহাড়ের কিনারা ধরে ছুটতে লাগলাম,কোনো নিশির ডাকে পাওয়া মানুষের মত-
তারপর একজায়গায় সুযোগ বুঝে ওকে পিছন থেকে সজোরে এক ধাক্কা মারলাম-
এক ভয়ঙ্কর মর্মভেদী আর্তনাদে চারিদিক আলোড়িত হয়ে উঠল।
আমি গলদঘর্ম হয়ে গেছি,তবু আমার মনটা অদ্ভুত ভারহীন লাগছে,আমার মনের মধ্যে বাজছে খুশির জলতরঙ্গ।
ও আমাকে মারবার জন্য এসেছিল..পারেনি...
আমি জিতে গেছি!!
#positiveindia