Indrani Bhattacharyya

Drama Tragedy Others

4.9  

Indrani Bhattacharyya

Drama Tragedy Others

চিরসখা

চিরসখা

5 mins
296



প্রনীল আজ অন্যদিনের মতই অনেক আপত্তি জানিয়ে স্কুলে গেছে। প্রনীলের গল্প মাসিই নিয়ে গেছে স্কুলে। পরমা আজ অফিস ছুটি নেওয়ায় নিজের হাতেই টিফিনে বানিয়ে দিয়েছে প্রনীলের প্রিয় চিজ অমলেট।

প্রনীলটা বরাবরই এরকম। বড্ড জেদী আর অভিমানী। পরমা সেটা ওর জন্মের আগে থেকেই জানে। পরমার তখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্সি। সেই সময় একদিন সুব্রতর ওপর রাগ দেখিয়ে জোর করে ঘরের সব কাজ নিজে করতে শুরু করেছিল পরমা। বেশ পরিশ্রম হয়েছিল তাতে। আর প্রনীলেরও নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছিল। তাই তো মামমামের ওপর অভিমান করে বেরিয়ে এসেছিল সাত তাড়াতাড়ি।

পরমার দিনটার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল আবার গুরুপূর্নিমা। পুজোর কাজ সেরে পরমা ছাদে উঠেছিল কাপড় মেলতে। তখনই হঠাৎ পেটে হালকা ব্যথা অনুভব করে আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ পরমার মনে হয় ইউরিনে তার কাপড় চোপড় সব ভিজে যাচ্ছে । ভাগ্যিস সুব্রত বাড়িতেই ছিল। তাড়াতাড়ি তখনই নিয়ে রওয়ানা দেয় হসপিটালে। প্রনীল সেদিনই ভূমিষ্ঠ হয়।


যথারীতি এতো আগে জন্মানোয় ওজন হয়েছিল মোটে ১ কেজি। জন্মের পর পরই প্রনীলকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি চলে । প্রায় কয়েক মাস ধরে প্রনীল মৃত্যুর সাথে লড়াই চালায়। শেষ পর্যন্ত লড়াইটা বীরপুরুষের মত জিতে যায় প্রনীল। প্রনীলের প্রাণ সংশয় যদিও এরপর কেটে যায় কিন্তু তবু সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় প্রনীলকে নিয়ে ফিরতে পারেনি পরমা আর সুব্রত। তার ডান হাত আর ডান পা অপরিনতই থেকে যায় সারা জীবনের মত। প্রনীলের এই পরিণতির জন্য পরমা কোনদিন ক্ষমা করতে পারেনি নিজেকে। সুব্রত কোনো কিছু বুঝতে না দিলেও পরমা আজও বিশ্বাস করে যে হয়ত সুব্রতও মনে মনে পরমাকেই অপরাধী ভাবে।

প্রনীলকে যত্নে ভালোবাসায় ধীরে ধীরে বড় করে তুলছিল তারা। প্রনীলও শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও সব সময় হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করত। দিন যত গড়াতে লাগলো ততই দেখতে দেখতে বড় হতে থাকলো প্রনীল। বাবা মায়ের তৈরি করা চেনা জগতের বাইরে যে জগৎটা আছে তার সাথে ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকলো তার। বন্ধ ঘরের জানলাগুলো এক এক করে খুলে যেতে লাগলো তার সামনে। আর ঠিক এই সময় থেকেই শুরু হল সমস্যা।

প্রনীল ছোট থেকেই বই পড়তে বেশ ভালো বাসত। সেই বইয়ের গল্পে কবিতায় লুকিয়ে থাকা বীর রাজা, সাহসী রাজপুত্তুর, হরবোলা রাখাল, ভিনদেশী বাঁশিওয়ালার মত চরিত্ররা তাকে খুব টানত। তবে তার সব থেকে প্রিয় ছিল রবি ঠাকুরের লেখা লেখা বীরপুরুষ কবিতাটি। গল্পমাসি রোজ তাকে খাওয়াতে খাওয়াতে সুর করে শোনাতো সেই কবিতা। প্রনীলও তখন সব দুষ্টুমি ভুলে তন্ময় হয়ে হারিয়ে যেত কোনো এক অচিনপুরে নাম না জানা এক গাঁয়ে যেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকত ভয়ঙ্কর সব ডাকাতের দল। আর প্রতিদিনই তাদের জব্দ করে প্রনীল বীরপুরুষের মত রক্ষা করত তার মাকে।


রোজ সেই কবিতা শুনে শুনে তার মুখস্থ হয়ে গেছিল সবটা। তাই তো স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় যখন তাকে একটা বাংলা কবিতা বলতে বলা হয়েছিল , সে তখন গড়গড়িয়ে বলেছিল তার প্রিয় বীরপুরুষ কবিতা। তিন বছর বয়সেই তার অমন স্মৃতিশক্তি দেখে তাক লেগে গেছিল ম্যাডামদের। পাশাপাশি সে লিখিত পরীক্ষাতেও যথেষ্ট ভালো নম্বর পেয়েছিল। পরমা আর সুব্রতকে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেছিলেন - " প্রনীল শারীরিক ভাবে অন্যদের থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও তার স্মৃতিশক্তি বা বুদ্ধিমত্তা কিন্তু তারিফ করার মত। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমাদের তরফেও প্রনীলকে স্কুলে ভর্তি নেবার ব্যাপারে বিশেষ আপত্তি নেই। বরং আমরা প্রনীলকে ছাত্র হিসেবে পেলে খুশিই হব।"


প্রনীলের ছোট্ট ছোট্ট বন্ধুরা প্রথম দিকে প্রনীলকে বেশ আপন করে নিয়েছিল। প্রনীল বড় হবার সাথে সাথে তার মেধার প্রতিফলন ঘটতে থাকে পড়াশোনাতেও।কলকাতার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এই মেধাবী ছাত্রটি অচিরেই ম্যাডামদের চোখের মণি হয়ে ওঠে আর সেটাই ধীরে ধীরে অন্য বন্ধুদের সাথে তার দূরত্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্লাসের অন্য ছেলে - মেয়েদের মা বাবারা ঈর্ষার চোখে দেখতে শুরু করে প্রনীলকে। তারা তাদের বাচ্চাদের মনেও বপন করে দেয় সেই ঈর্ষার বীজ। ফলে সুস্থ প্রতিযোগিতার পথে না হেঁটে প্রনীলের বন্ধুরা তার শারীরিক সমস্যা নিয়ে খোঁটা দিতে ,মজা করতে শুরু করে। ম্যাডামদের বারণ স্বত্বেও সুযোগ পেলেই আড়ালে আবডালে চলতে থাকে প্রনীলকে নিয়ে কাঁটা ছেড়া। এমনকি প্যারেন্টস মিটিং থেকে শুরু করে প্যারেন্টসদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রপেও সকলে এড়িয়ে চলতে থাকে প্রনীলের মা বাবাকে।


প্রনীলের মা বাবা সব বুঝতে পারলেও বিশেষ কিছু করার ছিল না তাদের। আর সত্যি বলতে অফিস সংসার সামলে দুজনের কারুর পক্ষেই সেই সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার মত অবকাশও ছিল না। তাদের কাছে ছেলেকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাটাই একটা বড় সন্তুষ্টির কারণ ছিল।

এ ভাবেই চলতে চলতে প্রনীলের এখন ছয় বছর বয়স। কিন্তু এই বয়সেই সে একদম একা , নিঃসঙ্গ। তার এখন স্কুলে যেতে ভয় করে রোজ। সেখানে আজ তার কথা বলা বা খেলা করার মত একটাও বন্ধু নেই।


প্রনীল আজও তাই জেদ করছিল স্কুলে যাবে না বলে। পরমা প্রনীলকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে ঘর গোছাতে গোছাতে ভাবছিল তার ফেলে আসা পুরনো সব দিনের কথা। তখনই একসময় চোখে পরলো সেই হলুদ রঙের খাতাটা যার ওপর প্রনীল কালো কালিতে বড় বড় করে লিখে রেখেছে - সিক্রেট বুক ।


গতকাল রাত্রে প্রনীল ঘুমিয়ে পড়ার পর পরমা এই খাতাটা তার বুকের নিচ থেকে পায়। তখন সেটা সরিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিল। খাতাটা আগে কোনদিন চোখে পড়ে নি পরমার। দেখে একটু খটকা লাগলেও ভেবেছিল হয়ত স্কুলের কোনো প্রজেক্টের খাতা। এখন কি মনে হতে একবার খুলে দেখলো সেটা আর তাতেই পেলো এই লেখাটা -

প্রিয় বন্ধু,

তুমি প্লিজ মামমাম বাপিকে বল ,আমার স্কুলে যেতে একদম ভালো লাগে না। ওখানে আমার তোমার মত একটাও বন্ধু নেই। তুমিও তো যেতে না স্কুলে। কিন্তু তুমি তো কত গল্প ,ছড়া লিখেছো। কত বই পড়েছ। তাহলে আমি কেনো পারবো না বলো? আমারও যে তোমার মত মামমামকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে যে মামমাম, কেনো আমাকে স্কুল থেকে ছুটি দিচ্ছে না? তোমার মত আমিও জানো সিড়ি আর রেলিংগুলোকে পড়াই। আর সাথে টেডিদেরও। ওরা খুব বাধ্য। আমার সব কথা শোনে। আমাকে একটুও জ্বালায় না। তুমি তো বীর পুরুষ। ঘোড়া টগবগিয়ে একদিন এসো প্লিজ। আমি তোমার সাথে ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করবো ডাকাতদের সাথে, আর যারা মামমামকে আমার নামে খারাপ কথা বলে কষ্ট দেয় তাদের সাথেও। তুমি এলে তোমাকে আমি দুধ, কলা ,সন্দেশ, আমস্বত্ত খাওয়াবো। তারপর একসাথে বসে মোমবাতির আলোয় ভূত দেখবো। কত্ত মজা হবে বল ।

লেখাটা পড়তে পড়তে কখন যেনো দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে ঝরে পড়ল খাতার ওপর। তারপর খাতাটা বন্ধ করে বুকে চেপে ধরে পরমা ডুকরে উঠে বলল - "চিরসখা হে, ছেড়ো না মোরে, ছেড়ো না.."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama