চির বিদায়
চির বিদায়
প্রত্যেক দিনের মত ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজতে বাজতে সেন্ট জোন্স চার্চের সামনে ভীড় জমে গেল। আর চার্চের সামনের ফাঁকা জায়গায় চেয়ারে বসে পড়লেন ফাদার হেনরি। আর তাকে ঘিরে বসে পড়ল অনেক যুবক যুবতী। এখন গল্প বলার সময়। ফাদার তার দীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে গল্প শোনান। আর সবাই খুব মনযোগ দিয়ে সেই সব শোনে। ফাদার বলতে শুরু করলেন...........
*****************************************
দুহাজার দশ সালের কুড়ি জানুয়ারি রবিবার, কলকাতা শহরের বুকের ওপর দিয়ে সুন্দর করে সাদা অর্কিড দিয়ে সাজানো গাড়ি ছুটে চলেছে। গন্তব্য পার্কস্ট্রিটের সেন্ট জোন্স চার্চ। গাড়ির জানলা দিয়ে যতটা সম্ভব মুখ বাড় করে বাতাস টাকে প্রান ভরে উপভোগ করতে চাইছে লিলি। পড়নে সাদা গাউন,মাথায় সাথা ফুলের ক্রাউন, খুব সুন্দর করে বিয়ের সাজে সেজে উঠেছে। আজ লিলির সাথে স্যামুয়েলের বিয়ে। লিলি আর স্যামুয়েলের সম্পর্ক অনেকদিনের। লিলি আদতে নিউইয়র্কের বাসিন্দা কিন্তু স্যামুয়েল কলকাতার বুকেই বড় হয়ে উঠেছে। লিলির বাড়ি থেকে এই সম্পর্ককে মেনে নিতে কিছুতেই রাজি ছিলনা, তাই লিলি স্যামুয়েলের জন্য সমস্ত কিছু ছেড়ে এই কলকাতাতেই চলে আসে, আর ওদের চোখে ছিল একটাই স্বপ্ন একসাথে একে অপরের পাশে থেকে জীবনের বাকি পথটা এগিয়ে চলা।
**************************************
ওদের বিয়ের বছর তিনেক আগে লিলি নিউইয়র্ক থেকে এসেছিল কলকাতা ঘুরতে। লিলির মা.... বাঙালি। কলকাতা লিলির মায়ের জন্মস্থান, তাই মায়ের জন্মস্থান কে.... দেখতে লিলির আসা। আর এই কলকাতাতে এসে লিলির পরিচয় হয় স্যামুয়েলের সাথে এই সেন্ট জোন্স চার্চে। লিলি কিছুটা আগ্রহ নিয়ে পরিচয় করতে গেছিল, কারন স্যামুয়েল ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে বসে ছিল, মুখের ওপর কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছিল, আর স্যামুয়েলের গাল বেয়ে পড়ে চলেছিল নোনা জলের ধারা।
---------লিলি এগিয়ে গিয়ে স্যামুয়েলের কাঁধে হাত রেখে ধীর কন্ঠে বলেছিল, হোয়াট........ হ্যাপেন্ড....??? আর.... ইউ.... ওকে...???
----------স্যামুয়েল চোখ খুলে লিলিকে দেখে মিষ্টি হেসে বলেছিল, নাথিং.... সিরিয়াস, আই.... অ্যাম.... ফাইন....!!
---------লিলি হাসি হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, হাই.... আই.... এম... লিলি ফারনান্ডেজ.....,
----------স্যামুয়েল হেসে লিলির হাতে হাত মিলিয়ে বলেছিল, হ্যালো.... আই.... অ্যাম.... স্যামুয়েল ডিসুজা। নাইস.... টু.....মিট.... ইউ।
আরও অনেক কথা হয়েছিল সেইদিন লিলির স্যামুয়েলের সাথে। লিলি জেনেছিল স্যামুয়েলের কান্নার কারন। স্যামুয়েলের বাবা.... মা,.., একই সাথে মারা যায়। স্যামুয়েল একাই থাকে প্রত্যেকদিন একবার করে চার্চে এসে প্রার্থনা করে যায়, বাবা... মার সমাধিতে ফুল রেখে যায়। স্যামুয়েলের এই নরম হৃদয়, আবেগ ভরা অনুভূতি লিলিকে আকৃষ্ট করেছিল।
স্যামুয়েল লিলিকে পুরো চার্চটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল, এবং তারপর একগুচ্ছ সাদা অর্কিড নিয়ে গেছিল সমাধি স্থলে, এবং স্যামুয়েল বাবা....মায়ের সমাধির ওপর ফুল রেখে ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে ছিল। অচেনা শহরে এসে, স্যামুয়েলের সাথে লিলির বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বাকি যে.... কটা দিন লিলি কলকাতাতে ছিল রোজ একবার করে চার্চে আসত এবং স্যামুয়েলের সাথে দেখা করত। সময়ের সাথে সাথে লিলি আর স্যামুয়েলের বন্ধুত্বটা গভীর থেকে গভীর হয়ে ওঠে, এবং ওরা ঠিক করে যে একই সাথে বাকি পথ চলবে, আর জানুয়ারির কুড়ি তারিখ হল সেই দিন, যেদিন থেকে ওদের পথচলা একসাথে শুরু হবে।
***************************************
লিলির গাড়ি এসে থামে চার্চের সামনে। লিলি গাড়ি থেকে নেমে একগুচ্ছ অর্কিড হাতে নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে স্যামুয়েলের। চার্চের ভীতরে তখন বিয়ের প্রস্তুতি হতে থাকে। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যেতে থাকে কিন্তু স্যামুয়েল এসে পৌঁছায়না! লিলি বারবার ফোন করতে থাকে, কিন্তু কোন উত্তর আসেনা! হঠাৎ একটা অচেনা নাম্বার থেকে লিলির ফোনে ফোন আসে, লিলি ফোনটা ধরার সাথে সাথে ওপার থেকে কিছু কথা ভেসে আসে, লিলির হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়,
----------লিলি.... গাড়িতে উঠে অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, পার্ক.... ভিউ.... নার্সিংহোম....!!!!!!নার্সিংহোমের সামনে নেমে, ভিতরে ঢুকতে পারেনা... লিলি!!!! ওর পা যেন আটকে গেছে, চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, কোনরকমে নিজেকে সামলে রেখে ভীতরে ঢুকে দেখে কালো কোর্ট প্যান্ট পড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে স্যামুয়েল।লিলি ছুটে গিয়ে স্যামুয়েলকে ডাকতে থাকে, কিন্তু স্যামুয়েল কোন সাড়া দেয়না....! কারন সে.... তো....তখন নিশ্চিন্তে প্রভু যীশুর কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
-----------পুলিশ লিলির কাছে এসে জানায় স্যামুয়েলের গাড়িটা মাঝ রাস্তায় ব্রেকফেল করে, আর তার জেরেই অ্যকসিডেন্ট হয় বাজে ভাবে।
ঘন্টা চারেকের মধ্যে কফিনের মধ্যে করে স্যামুয়েলকে নিয়ে আসা হয় চার্চে। বিয়ের পরিবর্তে শেষ বিদায়ের পাঠ শুরু হয়, তারপর স্যামুয়েলকে সমাধিস্থ করা হয়, আর লিলি ওর হাতে থাকা সাদা অর্কিডের গুচ্ছটা সমাধির ওপর রেখে মাটিতে বসে পড়ে ধপ করে। অঝোর ধারায় লিলির চোখ বেয়ে ঝড়তে থাকে নোনা জল।
************************************
ফাদার হেনরি গল্প বলা বন্ধ করেন। এবং সামনে চেয়ে দেখেন সবার চোখ তখন নোনা জলে ভর্তি। ফাদার সবাই কে নিয়ে স্যামুয়েলের সামাধির কাছে যায়। ওরা গিয়ে দেখে লিলি আজও স্যামুয়েলের সমাধির ওপর এক গুচ্ছ ফুল রেখে পাশে বসে আছে চুপ করে। হয়তো অপেক্ষা করছে সেইদিনের জন্যে যেদিন ও নিজে যেতে পারবে প্রভু যীশুর কোলে আর ওর সমাধি হবে ঠিক স্যামুয়েলের পাশে।