Partha Pratim Guha Neogy

Classics

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Classics

ছট পূজা

ছট পূজা

4 mins
575


ভারতবর্ষের হিন্দিভাষী হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজা ছট্‌ পূজা [ছট >ছটা >সূর্য রশ্মির ছটার পূজা অর্থাৎ সূর্যের পূজা] । ছট্‌ অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পূজা। এই রশ্মি সূর্য থেকেই পৃথিবীর বুকে আসে। সুতরাং এই পূজা আসলে সূর্যদেবের পূজা। প্রত্যক্ষভাবে ‘ছট;-এর পূজা হলেও এই পূজার সঙ্গে জড়িত আছেন স্বয়ং সূর্যদেব, আছেন মা গঙ্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণা। ছট পূজা (বা ছঠ পূজা) হিন্দু বর্ষপঞ্জীর কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে উদযাপিত একটি প্রাচীন হিন্দু পার্বণ।সূর্য্যোপাসনার এই অনুপম লৌকিক উৎসব পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে পালিত হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এই পার্বণ প্রবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হয়েছে। ছট পূজা সূর্য্য ও তার পত্নী ঊষার (ছটী মাঈ) প্রতি সমর্পিত হয়, যেখানে তাকে পৃথিবীতে জীবনের স্রোত বহাল রাখার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আশীর্বাদ প্রদানের কামনা করা হয়। ছটে কোনও মূর্তি পূজা করা হয় না।


ছট পূজা - পৌরাণিক প্রেক্ষাপট:

******************************************** 


পৌরাণিক কাহিনিতে রয়েছে — বর্ষার আগমন ঘটেছে। কিন্তু বৃষ্টি তেমন হয়নি। চাষিদের মাথায় হাত। মাঠের ফসল মাঠেই মারা যাচ্ছে। মা অন্নপূর্ণা ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকেন। সকল দেবতা মা অন্নপূর্ণার এহেন দুর্দশায় ব্যথিত। ঘরে ঘরে অন্নাভাব হাহাকার ওঠে। সূর্যের তাপ হ্রাস করে বাঁচার জন্য মা অন্নপূর্ণা সূর্যদেবের ধ্যান করতে শুরু করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। সূর্যের প্রখর ছটায় মা অন্নপূর্ণা দিন দিন শ্রীভ্রষ্টা হয়ে ক্ষীয়মান হতে থাকেন। দেবলোকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেবতারা সম্মিলিতভাবে সূর্যদেবের কাছে গেলে তিনি মা অন্নপূর্ণার এই দশার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। এবং বলেন, মা অন্নপূর্ণা যেন গঙ্গাদেবীর আশ্রয় নেন। সূর্যদেব আরও বলেন, অস্তগমনকালে গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এবং সপ্তমীর উদয়কালে মা অন্নপূর্ণা গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে উদীয়মান ছটা বা রশ্মিকে দেখে আমার স্তব বা ১২টি নাম উচ্চারণ করলে আমার স্মরণকারীকে সমস্ত পৃথিবী অন্নে পূর্ণ হতে থাকল। মা অন্নপূর্ণা আবার তাঁর শ্রী ফিরে পান। 


তাই ছট্‌ পূজা বা ব্রত একাধারে সূর্যদেব, মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গাদেবীর পূজা। 


ছট বা ছঠ, ষষ্ঠী নামের অপভ্রংশ। মূলত সূর্য ষষ্ঠী ব্রত হওয়ার দরুণ একে ছট বলা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলি পালনের পর এই চার দিনের ব্রতের (কার্তিক শুক্লা চতুর্থী থেকে কার্তিক শুক্লা সপ্তমী) সবচেয়ে কঠিন ও তাৎপর্যপূর্ণ রাত্রি হল কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী; বিক্রম সংবতের কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত উদযাপিত হওয়ার কারণে এর নাম ছট রাখা হয়েছে। 


ছট পূজা রামায়ণ ও মহাভারতের প্রেক্ষাপট:

******************************************

রামায়ণ

সূর্য বংশের সন্তান হওয়ার কারণে শ্রীরামচন্দ্র নিয়মিত ছট পুজো করতেন। বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যা ফেরার সময় রাম ও সীতা সূর্য দেবের উদ্দেশ্যে পুজো ও উপবাস করেন। সেই থেকেই ছট পুজোর সূচনা বলে মনে করা হয়। 


মহাভারত

মহাভারত অনুযায়ী সূর্যদেব ও কুন্তীর পুত্র কর্ণ। কথিত, কর্ণ এই সময় সূর্যের আলোয় আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে দরিদ্রদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করেছিলেন। আবার নিজেদের রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরাও এই পুজো করেছিলেন বলেও কথিত রয়েছে। 


বৈজ্ঞানিক কারণ:

********************************************

বৈজ্ঞানিক ভাবে মনে করা হয় এই পুজোর মাধ্যমে শরীর থেকে টক্সিন দূর করা হয়। সূর্যের প্রথম আলোয় গঙ্গাস্নান করলে শরীরে সোলার বায়ো-ইলেকট্রিসিটি সঞ্চালিত হয় যা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় সাহায্য করে। অনেকে মনে করেন শীতকাল শুরুর আগে এই প্রক্রিয়া শরীর থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দূর করতে সাহায্য করে। 


                                       ছট পূজার রীতিনীতি :

******************************************** 


প্রথম দিন: নাহা খা -

ছট পুজোর প্রথম দিন ভক্তরা স্নান না করে মুখে কিছু তোলেন না। স্নান করে চানা ডাল, ক্ষীর, কদ্দু কী সব্জি তৈরি করার নিয়ম। 


দ্বিতীয় দিন: খরনা -

খরনা পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত ভক্তরা উপবাস রাখেন। গুড়ের পায়েস ও পুরি খেয়ে উপবাস ভাঙার নিয়ম। 


তৃতীয় দিন: পহেলা অর্ঘ্য -

তৃতীয় দিনের উপবাস হয় সবচেয়ে কঠোর। এই দিন মহিলারা নির্জলা উপবাস করেন। সূর্যের উপাসনার সঙ্গেই চলে লোকগীতির মাধ্যমে ছটি মাইয়ার আরাধনা। সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত দিনব্যাপী গঙ্গা স্নান চলে। 


চতুর্থ দিন: দুসরা অর্ঘ্য/পরণ-

উদীয়মান সূর্যের পুজো করে উপবাস ভাঙেন ভক্তরা। 


********************************************

ভারতে সূর্য্যোপাসনার জন্য প্রসিদ্ধ পার্বণ হল ছট পূজা। এটি বছরে দুবার পালিত হয় — প্রথমবার চৈত্র মাসে (চৈতী ছট) এবং দ্বিতীয়বার কার্তিক মাসে (কার্তিকী ছট)। পারিবারিক সুখ-সমৃদ্ধি তথা মনোবাঞ্ছিত ফল লাভের জন্য এটি পালন করা হয়। নারী-পুরুষ সমানভাবে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। 


ছট পূজায় কোনো মূর্তি উপাসনার স্থান নেই। এতে ডুবিত এবং উদিত সূর্যকে পূজা করা হয়। আজকাল পূজা অনুষ্ঠিত করা কমিটিগুলিকে সকল ঘাটের কাছে সূর্য এবং ঊষার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায়। পূজার দুদিন আগে লাউ ভাত এবং একদিন আগে খির ভাত খাওয়ার সঙ্গে ৩৬ ঘণ্টার এক কঠোর ব্রত পালন করতে হয়। পূজায় সম্পূর্ণ সাত্বিক নৈবেদ্য ইত্যাদি কুলো, ডলা বা পাচিতে রেখে উৎসর্গ করা হয়। বিভিন্ন ফলমূল, মিঠাই ইত্যাদির সঙ্গে পরম্পরাগত বিহারী লোকখাদ্য "ঠেকুয়া" প্রস্তুত করে নৈবেদ্যরূপে প্রদান করা হয়। এই সময় নুন-মশলাবর্জিত সম্পূর্ণ নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করা হয়। পূজার শেষে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের প্রসাদ বিতরণ এই পূজার অন্যতম নিয়ম। এই পূজায় অনেককে বাগরি নদীর ঘাটে গিয়ে পূজা করার দৃশ্যও দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই পূজা এক সার্বজনীন রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী, ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ এই পূজার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে পূজায় সামিল হতে শুরু করেছেন। 


বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বাংলার হিন্দিভাষী বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে সাথে আজকাল বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মানুষেরাও এই ছট পূজাকে আপন সংস্কৃতির অঙ্গ করে নিয়েছে।। ছট পূজার এই কদিন সম্প্রীতির সুরে মানুষ সব সুখ দুঃখ ভুলে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে।। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics