ছিন্নবীণা
ছিন্নবীণা
অবসন্ন দুপুরে ঝুলবারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ছেন মনযোগ দিয়ে বনলতা দেবী। বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। পড়তে পড়তে কেমন যেন সব ঝাপসা হয়ে এল বনলতা দেবীর চোখের সামনে। চশমাটা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছে আবার পড়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকালেন। বাড়ির পাঁচিল লাগোয়া রঙ্গন ফুলের গাছটা টকটকে লাল ফুলে ভরে এসেছে। গাছের পাতা দেখাই যাচ্ছে না, চারিদিকে শুধু থোকা থোকা ফুলের সমাহার। বনলতা দেবী একই ভাবে তাকিয়ে রইলেন গাছটার দিকে। বনলতা দেবীর চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠল। বনলতা দেবী অতীতের পথে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু না.... অতীতের স্মৃতিচারণ আর করা হল না...!! তার আগেই পিছন থেকে পিকলু এসে বনলতা দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল.......
------------ডার্লিং তুমি এখানে কি... করছ একা একা আমাকে ছাড়া??? তাও.... আবার এই দুপুরে, তা.....এই সঙ্গীকে বুঝি পছন্দ হচ্ছেনা তোমার!!!
-----------বনলতা দেবী হাসিমুখে বলে উঠলেন, তোমার মত সুন্দর, চঞ্চল, সঙ্গী আমি কোথায় খুঁজে পবো আর দাদুভাই, যে.... তোমাকে পছন্দ হবেনা।
-----------পিকলু বনলতা দেবীর পাশে বসে পিছন থেকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, তাহলে ডার্লিং... এখন তোমাকে আমার সাথে গল্প করতে হবে। এই সঙ্গীকে বাদ দিয়ে।
-----------বনলতা দেবী হাসিমুখে বলে উঠলেন, তা....তোমার গল্প করার সঙ্গী আজ বুঝি ছুটি নিয়েছে, তাই এই.... ঠাম্মিকে মনে পড়েছে!!!
---------পিকলু বনলতা দেবীর কোলে মাথা রেখে আধ শোয়া হয়ে বলে উঠল, হুম.... মামার বাড়ি গেছেন উনি, তাই ফোন করা একেবারে বারন।
----------বনলতা দেবী হাসতে হাসতে বলে উঠলেন তাই বলি, হঠাৎ এই অসময়ে দাদুভাই এর আমার কাছে আগমন কেন!!!
-----------পিকলু হাসিমুখে বলে উঠল ডার্লিং....হিংসে করোনা!!! তুমি আমার প্রথম প্রেম বুজেছো। আর প্রথম প্রেম সবসময় আলাদা হয়।
-----------বনলতা দেবী রঙ্গন ফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলেন, ঠিক বলেছো দাদুভাই প্রথম প্রেমের অনুভূতি সব সময় আলাদা হয়। আর সেই অনুভূতি মনের গোপনে সব সময় রঙিন হয়ে থাকে। সময় স্রোতে ভেসেও তার রঙ ফিঁকে হয়ে যায়না।
---------পিকলু বনলতা দেবীর কোল থেকে মাথা তুলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসে বলে উঠল, কি..... ডার্লিং আজ দাদানকে খুব মনে পড়ছে বুঝি। আজ কি তোমাদের জীবনের কোন স্পেশাল দিন। কি.... হল বলো বলো????
------------বনলতা দেবী আবার চশমা মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, আমাদের জীবনে স্পেশাল দিন বলে কিছু ছিলনা দাদুভাই। প্রত্যেকটা দিন এক রকমই ছিল।
-------------পিকলু মুখে দুষ্টু হাসি এনে বলে উঠল সেটা কি... করে হয়!!!!স্পেশাল দিন না.... হোক স্পেশাল রাত নিশ্চয়ই ছিল, যখন দাদান ভালোবেসে তোমাকে কাছে টেনে নিত তখন। আচ্ছা ডার্লিং... দাদানের সঙ্গে তোমার প্রেম কি... ভাবে শুরু হয়েছিল???? বিয়ের আগে... না... পরে।
--------------বনলতা দেবী হেসে বলে উঠলেন, তোর দাদানের সাথে প্রেম করার সুয়োগ পেলাম কোথায় যে... করব। তোর দাদানের সাথে বিয়ের আগে একবার দেখা হয়েছিল যখন উনি আমাকে দেখতে এসে ছিলেন, তারপর একেবারে বিয়ের মন্ডপে শুভদৃষ্টির সময় দেখা। আর তারপর শুরু সংসার। মানুষটা খুব একটা রসিক ছিলেন না, গম্ভীর এবং রাশভারি প্রকৃতির ছিলেন, সেই ভাবে সাহস করে মানুষটার সাথে চোখে চোখ রেখে কথাই বলতে পারতামনা কোনদিন।
-----------পিকলু অবাক হয়ে বলে উঠল, কি... বলছো ডার্লিং....., দাদান তোমাকে কোনদিন আই.. লাভ... ইউ..বলেনি, তোমাদের এত দিনের সংসারে। সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া, লুকিয়ে লুকিয়ে গিফট দেওয়া কিছুই করেনি।
-----------বনলতা দেবী হেসে বলে উঠলেন, সবসময় কি..... সব কথা মুখ ফুটে বলতে হয়!!!! কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। মানুষটা মুখে না.... বললেও আমি বুঝতে পারতাম মানুষটা আমাকে ভালোবাসে।
-------------পিকলু বলে উঠল তাহলে সেই ভাবে প্রেম করা হয়নি.... তোমার কারোর সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে।
------------বনলতা দেবী বলে উঠলেন, একেবারে হয়নি সে...... কথা বলা যাবেনা!!! হয়েছে....।
------------পিকলু বনলতা দেবীর দিকে চেয়ে দেখল বনলতা দেবীর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে এই বয়সে এসেও। পিকলু ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিয়ে বলে উঠল বলো ডার্লিং... তোমার প্রেমকাহিনী, যার কথা ভেবে আজও তোমার চোখ, মুখ লজ্জায় টুকটুকে লাল হয়ে উঠছে। আর একটা প্রশ্ন সেই প্রেম বিয়ের আগে না পরে...???
------------বনলতা দেবী পাঁচিল লাগোয়া রঙ্গন ফুলের গাছটার দিকে দেখিয়ে বলে উঠলেন, আমার প্রেমকাহিনী রঙ্গন ফুল দিয়ে শুরু হয়ে ছিল।
----------পিকলু অবাক হয়ে রঙ্গন ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল গোলাপ ফুল নয়, কাঠ গোলাপ নয়, রঙ্গন ফুল দিয়ে প্রেম শুরু, বেশ ইনটারেস্টিং... মনে হচ্ছে, দেরী না করে তাড়াতাড়ি বলা শুরু করতো ডার্লিং.....।
-------------বনলতা দেবী রঙ্গন গাছের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, সে.... অনেক বছর আগের কথা, তখন আমার বয়স এই তেরো কি চৌদ্দ। সব সবে বসন্ত দোড়গোড়ায় এসে কড়া নাড়ছে। বাবার কর্মসুত্রে আমরা গিয়েছিলাম তখন এলাহাবাদ। বেশ শান্ত সুন্দর পরিবেশ ছিল আমাদের কলোনির। আশে পাশের সবার সাথে থাকতে থাকতে বেশ ভালো পরিচয় হয়ে গেছিল। বিকেলের দিকে কলোনির আমরা সবাই মিলে সাহিত্য চর্চা করতে বসতাম। তারপর নাটকের রির্হাসাল হত। তখন দেশ সবে সবে স্বাধীন হয়েছে। কোন কোন জায়গায় উত্তপ্ত পরিবেশ তখনও ছিল। একদিন বিকেলে আমাদের সাহিত্য চর্চার আসরে যোগদান করে এক নতুন সদস্য নাম অতনু লাহিড়ী। মানুষটার সুন্দর চেহারা, বলিষ্ঠ গঠন এবং সর্বোপরি কথা বলার ধরন এবং ভদ্র, নম্র, স্বভাব আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু মানুষটার সাথে বিশেষ কথা বলতে পারেনি, শুধু দুই একবার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং দেখে ছিলাম মানুষটাও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
বরাবর আমার ভোরে ওঠা অভ্যাস। পরেরদিন ভোর বেলায় উঠে দেখি আমার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় একটা পাতার মোড়ক রাখা। কৌতূহল বশতঃ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে মড়োকটা খুলে দেখি, এক থোকা টাটকা রঙ্গন ফুল। মনটা খুশিতে নেচে ওঠে, কিন্তু কে এই ফুলের প্রেরক সেটা জানতে পারিনা। এই ভাবে চলতে থাকে টানা দু...... সপ্তাহ ফুল দেওয়া, কিন্তু কে দিচ্ছে সেটাই আমার কাছে রহস্য থেকে যায়। অনেক রাত জেগে থেকেছি, কিন্তু জাগতে জাগতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি কে রেখে গেছে। তাই একদিন সাহস করে সাদা কাগছে লিখি.....
কে.... আপনি জানতে পারলে খুশি হতাম। দয়া করে যদি নিজের পরিচয়টা দেন।
সারা রাত সেদিন আমি ঘুমাতে পারিনি উত্তেজনায়। বারান্দার দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম। ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগে দেখতে পেলাম সেই কাঙ্খিত মানুষটিকে, যে....রোজ আমাকে এই রঙ্গন ফুল উপহার দিয়ে আমার সকালটা সুন্দর করে তুলতো। প্রথমে অবাক হয়ে ছিলাম মানুষটিকে দেখে কারন ভাবতে পারিনি এই মানুষটি অতনু লাহিড়ী হবেন। নিজেকে আর আটকে রাখতে পাড়িনি সেদিন শান্ত স্বরে ডেকে উঠেছিলাম শুনুন.........
-----------মানুষটি আমার দিকে ঘুরে হাসি মুখে বলে উঠেছিলেন সুপ্রভাত। তাহলে আমাকে ধরেই ফেললেন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমোননি.... আমার অপেক্ষায়। আপনার সুখ নিদ্রা ভঙ্গ করার জন্য আমি দুঃখিত।
---------আমি একই ভাবে তাকিয়ে ছিলাম মানুষটির দিকে। ওনার সুন্দর কথা বলার মাঝে আমি হারিয়ে গেছিলাম, কি..... উত্তর দেব বুঝতে পারিনি।
-----------উনি আবার বলে উঠেছিলেন যান, এখনও ভোর হতে কিছুটা সময় বাকি, ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি এখন আসি।
---------আমি মাথা নেড়ে শুধু হ্যাঁ..... বলেছিলাম। সময় স্রোতে এগিয়ে চলল দিনের পর দিন। আর আমরা একে অপরের সাথে এক অদৃশ্য সূতোর বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে লাগলাম। রঙ্গন ফুলের সাথে মাঝে মধ্যে আসত কিছু চিরকূট। তাতে লেখা থাকতো অতি সাধারন দু... চারটে কথা, কখনও কখনও কবিতার লাইন। ওগুলো যেন আমার কাছে হয়ে উঠেছিল অমূল্য উপহার।
বেশ কিছু সপ্তাহ পর হঠাৎ করেই ফুল আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কেমন অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম। মনের ভিতরটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠতে লাগল মানুষটার কথা ভেবে। ঠিক আছেন তো কে জানে??? মাঝখানে পাঁচটা দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু ফুল চিরকূট এমনকি মানুষটারও দেখা পাওয়া গেলনা!!! আমার মনের অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলল, সাহিত্য চর্চার আসরেও তার দেখা মিললো না। কিন্তু আমার পক্ষে হঠাৎ করে এই উধাও হয়ে যাওয়াটা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা, তাই আমার সব থেকে প্রিয় বান্ধবী সুলোচনার মাধ্যমে ওনার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করলাম। এবং বেড়িয়ে পড়লাম ওনার বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে গিয়েও কোনো লাভ হল না....!!! কারন বাড়িতে লোক বলতে একজন বয়স্ক মানুষ, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ওনাদের বাড়িতে কাজ করে আসছেন। ওনার কাছ থেকে জানতে পারলাম ওনার বাবা.... মা দুজনেই গত হয়েছেন বেশ কিছু বছর আগে। তিনি মাঝে মাঝে এই রকম করে থাকেন। কোথায় যান কি.... করেন কিছুই জানা যায়না!!!! আমি নিরাশ হয়ে ফেরার সময় বয়স্ক মানুষটিকে বলে আসলাম, আপনার দাদাবাবু আসলে বলবেন বনলতা সেন এসেছিল।
------------লোকটি মাথা নিচু করে বলে উঠেছিল, আজ্ঞে... বলবো দিদিমনি।
সেই দিনের পর থেকে আমার সমস্ত উৎসাহ, উদ্দীপনা, ভালোলাগা সব কেমন যেন হারিয়ে গেছিল উদাসীনতার আড়ালে। যেমন হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছিল, তেমনি একদিন হঠাৎ করে আবার সেই মানুষটা উদয় হয়ে ছিল আমার জীবনে। কিন্তু সেইদিন ফুল ছিলনা ছিল এক টুকরো সাদা কাগজের চিঠি। তবে মানুষটাকে সচক্ষে দেখতে পায়নি আমি। কখন নীরবে এসে রেখে চলে গেছিলেন। চিঠিটা বুকের কাছে ধরে নীরবে দুফোটা চোখের জল ফেলেছিলাম, অনুভব করতে চেয়ে ছিলাম সেই মানুষটার স্পর্শ। বনলতার দেবীর গলা রুদ্ধ হয়ে এসেছে কান্নায়।
-----------পিকলু বলে উঠল, কি.... লেখা ছিল চিঠিতে ডার্লিং.....।
-------------বনলতা দেবী চোখের জলটা মুছে বলে উঠলেন লেখাছিল.....
প্রিয়তমা....
এই নামেই ডাকতে ইচ্ছে হল আপনাকে। কি... জানি কখন কিভাবে আপনি আমার জীবনে প্রিয়তমা হয়ে উঠেছেন। আমার কঠিন মনটাকে চুরি করে নিয়েছেন। সে এখন আপনার গোলাম হয়ে গেছ। নীরেন কাকার মুখে শুনলাম আপনি আমার খোঁজে এসেছিলেন। ভুল আমারই ছিল আপনাকে খবরটা দেওয়া হয়নি আসলে এই ভবঘুরে মানুষটার জন্য কেউ চিন্তিত হতে পারে সেই ধারনাটা আমার ছিল না!!! আপনাকে চিন্তায় ফেলার জন্য এবং কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। কালকে আমি আসবো ঠিক সময়ে অপেক্ষা করবেন আপনাকে কিছু কথা বলার আছে।
ইতি
অতনু
সেই রাত আমি দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। বসে ছিলাম ওনার আসার অপেক্ষায়। ঠিক সময়ে উনি এসেছিলেন। আর আমি ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন........
---------নিজের কি অবস্থা করেছেন, আমার কথা ভেবে ভেবে!!! ভালো করে খাওয়া, দাওয়া, ঘুম... বিশ্রাম, কিছুই করেননি দেখছি এই কদিনে!!!
---------আমি অভিমানি গলায় বলে উঠেছিলাম আপনি এটা করতে পারলেন আমার সাথে???
----------উনি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিলেন আমার ভুল হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি.... আমার জন্য কেউ এতটা কষ্ট পেতে পারে।
------------আমি দৃঢ় স্বরে বলে উঠেছিলাম কোথায় গেছিলেন এতদিন কোন খবর না দিয়ে??? এ কদিনে অলিখিত ভাবে মানুষটার ওপর কেমন একটা অধিকার বোধ তৈরী হয়ে গেছিল আমার।
---------উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, সংগ্রাম করতে, আমি একজন সৈনিক, সংগ্রামী। দেশের জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল।
------------আমি বলে উঠেছিলাম আমার কথা একবারও মনে পড়েনি আপনার????
-----------উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বলে উঠেছিলেন মনে পড়লেও কিছু করার নেই প্রিয়তমা। আমি যে..... দেশের জন্য নিজের প্রান উৎসর্গ করে দিয়েছি। ও...দিকে যে... যুদ্ধ লেগেছে আমাকে যখন তখন চলে যেতে হতে পারে। তাই যাওয়ার আগে শেষ বারের মত দেখা করে গেলাম, যদি ফিরে আসি তাহলে আপন বন্ধনে বেঁধে নেব, আর যদি ফিরতে না.... পারি তাহলে কথা দিন আমার কথা ভেবে নিজেকে এই ভাবে কষ্ট দেবেননা!!!!
আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেই চোখের দিকে। যে চোখের মধ্যে অগাধ ভালোবাসা থাকলেও, ছিল এক উজ্জ্বল দীপ্তি, আগুন যা... দেশ মাতার জন্য। আমি শুধু বলে ছিলাম, ফিরতে আপনাকে হবেই!!!! আমি অপেক্ষায় থাকবো।
------------উনি হেসে উঠেছিলেন। এবং আমার কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নিয়েছিলেন। পরেরদিন সকালে উঠে দেখি পাতার মোড়কে রঙ্গন ফুল রাখা আছে। ফুলটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে একটা চিরকূট পাই তাতে চারটে লাইন লেখাছিল.......
প্রিয়তমা তোমার আঁখির মায়ায়
বেঁধেছি আমার এই মন,
তোমার ভালোবাসার অপেক্ষায়
কাটিয়ে দিতে পারি এক নয়
সহস্র হাজার জীবন।
তোমার হৃদয়ে রচিত হোক আমাদের ভালোবাসার কাহিনী,
রঙ্গনের রঙে রঙিন হয়ে উঠুক
জীবনের আগমনি।
বনলতা দেবী চুপ করে গেলেন এবং এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন রঙ্গন ফুলের গাছের দিকে।
-----------পিকলু চোখের কোনে আসা জলটাকে মুছে বলে উঠল ফিরে আসেননি না..... ডার্লিং????
----------বনলতা দেবী উদাসী কন্ঠে বলে উঠলেন তার এক সপ্তাহ পর পত্রিকায় বেড়িয়েছিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন অনেক অনেক ভারত মাতার বীর সৈনিক। সবার প্রথম নামটা ছিল অতনু লাহিড়ী। তার কিছুমাস পর বাবা আবার বদলি হয়ে কোলকাতা চলে আসেন, এবং তার এক বছরের মধ্যে তোর দাদানের সাথে আমার গাঁটছড়া বাধা হয়। স্বামী সন্তান নিয়ে আমি ভেসে যাই সংসার সমুদ্রে। পিকলু কোনো কথা না... বলে বনলতা দেবীকে জড়িয়ে ধরে।
******************************
পরেরদিন সকালটা বনলতা দেবীর জীবনে অন্য রকম ভাবে শুরু হল। কারন ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেখলেন দরজার গোড়ায় রাখা আছে একটা পাতার মোড়ক। মোড়কটা হাতে তুলে নিয়ে দেখেন এক থোকা টাটকা রঙ্গন ফুল। আর তার মধ্যে একটা রঙিন চিরকূট। বনলতা দেবী হাসতে হাসতে বলে উঠলেন......
----------কোথায় আমার দাদুভাই????
----------পিকলু বনলতা দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল এইতো আমি ডার্লিং।
--------বনলতা দেবী চিরকূটটা পড়তে শুরু করেন........
"সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের
শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে;
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির
রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী—
ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার,
মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন"।

