Shwagota Sayeed

Classics

4  

Shwagota Sayeed

Classics

ছেঁড়া ঘুড়ির লাটাই সুতো (৩)

ছেঁড়া ঘুড়ির লাটাই সুতো (৩)

14 mins
525


রঞ্জন স্তিমিত আর আফসোসে ভরা কণ্ঠে বললো, “তুই… আম্মু… তোরা সবাই শুধু নিজেদের সিদ্ধান্ত, চিন্তাভাবনা, হিসাব-নিকাশ আমার উপর চাপায়েই গেলি… আমার দিকটা কেউ ভাবলি না কোনদিন।“

কৌতুকপূর্ণ হাসি হেসে উঠলো শুভমিতা, “তুই হলি গিয়ে ছেলে!... পুরুষ মানুষ!... আন্টির ছেলে বলে কথা! আন্টি তো তোকে বড়ই করেছে দুনিয়া শাসন করার জন্য!... তোর ইচ্ছাই তো সব হওয়ার কথা!... আমি কোথাকার কে যে তোর উপর আমার সিদ্ধান্ত চাপায় দেবো?”

ক্ষুব্ধভাবে রঞ্জন বললো, “মজা নিচ্ছিস? আমার কষ্ট কিছুই কি তোর চোখে পড়ে না? এই না এতো অবজারবেভশনের কথা বললি? সব কি খালি প্রিয়ার জন্যই? আমাকে দেখিস না?”

হাসিটা ধরে রাখলো শুভমিতা ঠোঁটের কোণে, ধীরস্বরে বললো, “রণ, কারও উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়াটা কোনও মুখের কথা না… যদি কেউ সেটা পারে তোর উপর, তাহলে তোর নিজের কিছু আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি…”।

ফোঁস করে উঠলো রঞ্জন, “কি বলতে চাচ্ছিস? আমার কোনও ব্যক্তিত্ব নাই? তাহলে তুই কি? তুই আমার আম্মুর সিদ্ধান্ত মেনে নিস নাই?”

“না! আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি… আমি উনার মতামত বুঝেছি, আর উনার মতে আমার জীবন চলবে না এটা জেনেই আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি রণ! শুধু শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক করিস না… তুই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারিস না, এখনও… এটাই বাস্তব… তুই তোর মায়ের পছন্দ-অপছন্দের কথা জানতি, এবং সেই জন্য কনফিউজড হয়ে, কি করবি বুঝে না পেয়ে আমার সাথে দুরত্ব তৈরি করেছিলি… কিন্তু তোর হয়ে সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে আমাকে… আবার সেই বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তেই প্রিয়াকেও বিয়ে করেছিস… কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তমতো না হওয়ায় সেই সম্পর্কেও নিজেকে কমিট করতে পারছিস না… সবসময় অর্ধেক ঝুলে থাকলে তো চলে না, রণ! হয় নিজেরটা এস্ট্যাবলিশ করতে শেখ, নাহয় অন্যেরটা মেনে নিতে!... আর আমি তোর উপর কোনও সিদ্ধান্ত কখনোই চাপিয়ে দেই নি… আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি… এবং ভুল হোক সঠিক হোক, আমার নিজের সিদ্ধান্তের দায়িত্বও নিয়েছি… তোর সাথে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করেছি… নিজে কি চাই সে ব্যাপারে নিজের কাছে স্বচ্ছ থেকেছি… তোর বা আমার, কারও লাইফ কমপ্লিকেটেড করি নাই… এ্যান্ড আই উইল রিমাইন্ড ইউ এগেইন… তোর তরফ থেকে কোনও চেষ্টাই ছিলো না সেদিনের আমার সিদ্ধান্তটা পাল্টাবার… কিন্তু তুই কি করেছিস, রণ?”।

চুপ করে রইলো দু’জনেই। খানিকক্ষণ পরে শুভমিতা আবার বললো, “ আন্টি জানতেন… তিনি তার বয়স্ক চোখে ঠিকই বুঝেছিলেন যে আমার উপর সিদ্ধান্ত চাপানো যাবে না… যায় না… সে কারণেই প্রিয়ার মতো একজনকে নিয়ে এসেছেন যার নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর কোনও জোর থাকবে না… যার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই সে করে নিয়েছে অন্য সকলের সন্তুষ্টি… ওর দোষও নেই… ওকে শেখানোই হয়েছে সেভাবে… বয়সটাও তো একদমই ছেলেমানুষের!... আর রণ, তোকে শুধু পুরুষ হতে শেখানো হয়েছে, আই এ্যাম স্যরি টু সে… ভীষণ একজন পুরুষ… নিজের মনমতো কিছু না হলে তুই ভাংচুর করা, রাগ দেখানোটাকে নিজের অধিকার বলে ধরে নিয়েছিস, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার দায়িত্ব নিতে শিখিস নাই…”

শুভমিতা চুপ করতে এবার ও নরম কণ্ঠে নিজের মনের কথাগুলো বলেই ফেললো, “মিতা... তোর আর আমার যা ছিলো, তার সবটাই কি শেষ?”

ক্লান্ত চোখে ফেলে আসা দিনের প্রেমিকের চোখের ভেতর দেখলো শুভমিতা। বুকের গভীরে কাঁপন থামিয়ে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলো, “রণ, তুই তো আমাকে চিনিস। তাই না? তোর কি সত্যি মনে হয় অন্য একটা মেয়ের স্বামী নিয়ে গিয়ে নিজের ঘর বসানোর মতো গর্হিত চিন্তা করার মতো মানুষ আমি? থাক আবেগ, যতো বড় পাগলই হই আমি… তবু কি ওই ধরণের কোনও কাজ আমার দ্বারা সম্ভব?”

একটু চুপ করে থেকে রঞ্জন বললো, “তুই এক সময় বলতি, আমার সুখের জন্য তুই সব করতে পারবি... আমি যদি আজকে বলি... তোকে ছাড়া এতোদিন চলে তো দেখলাম... আমার চলে না... আমার সুখ তোর কাছে, তাহলে?”

 রঞ্জনের দিক থেকে মুখটা আড়াল করে নিলো শুভমিতা কায়দা করে। একটু হেসে বললো, “সেটা যদি হয়ও, সেটা বুঝতে অনেক বেশি দেরী করে ফেলেছিস তুই, রণ। তোর সুখ, আনন্দ যাই বলিস না কেন... সে যদি আমার কাছে হয়ও, তাহলেও তোকে সেগুলো ছাড়াই বাঁচতে হবে।“

রঞ্জন জিজ্ঞেস করলো, “শাস্তি দিচ্ছিস?”

হাহা করে হেসে উঠলো এবার শুভমিতা। হাসির ছলে চোখের কোলে এক ফোঁটা পানি সামলে নিলো বুঝতে না দিয়ে। বললো, “কি সব ফালতু ইমোশনাল ডায়ালগ দিচ্ছিস রণ! তোর বা আমার কারোরই কি আর এই সমস্ত কিছুর বয়স আছে? কিসের শাস্তি? একটা সময় একসাথে ছিলাম, আবার একটা সময়ে দু’জনের পথ আলাদা হয়ে গেছে... জোর করে সেই পথ আবার এক জায়গায় মেলানোর চেষ্টা করে তো কোনও লাভ নেই, তাই না? ... অনেস্টলি রণ, এই বিষয়টা নিয়ে তুই এভাবে চাপাচাপি করবি জানলে বা ভুলেও আন্দাজ করতে পারলে আমি কিছুতেই তোদের বাড়িতে আসতে রাজি হতাম না... ইন ফ্যাক্ট সব দিক দিয়েই বুঝতে পারছি যে এই বাসায় আসাটা আমার একটা চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো… ক্ষণিকের আবেগে নিয়ে ফেলা অথবা নিজের যুক্তির কথা না শোনার ফলাফল… আই ব্লেইম মি ফর দ্যাট… যাক গে, রণ! বি ম্যাচিওর... এতোদিনে এটুকু তো তোর বোঝা উচিৎ, তুই আর আমি একই পাজলের দু’টো পিস না... আমাদের জীবনবোধ, দর্শনে আকাশ-পাতাল ফারাক... দু’জন এক হইনি বলে মনে হচ্ছে হয়তো কিছু হারিয়েছি... কিন্তু সব দেখে যা বুঝছি, তুই-আমি এক হলে তিক্ততার চূড়ান্ত হতো।”

চুপচাপ কিছুটা সময় কেটে গেলো। রঞ্জন নীরবতা ভাঙলো, “এই ডিফারেন্সগুলো যে ছিলো তা কিন্তু কিছুটা হলেও তখনও তুই জানতি আমার সম্পর্কে... আমিও যেমন জানতাম তোর সম্বন্ধে... তখন কিন্তু আরেকটা ম্যাচিওর কথা তুই বলতি... দু’টো মানুষ একে অন্যের সংস্পর্শে এসে পাশাপাশি সহ-অবস্থান করতে করতে নিজেদের সুবিধামতো খাপ খাইয়ে নেয়... যে পাজল পিসের কথা বলছিস... সেই পাজল পিসেরই উদাহরণ দিয়েছিলি একদিন... দু’টো ভিন্ন মানুষ নিজেদের পছন্দ মতো নিজেদের ধারগুলো কেটে, ছেঁটে মাপ অনুযায়ী বসিয়ে নেয়... একসাথে...মনে পড়ে?”

“মনে আছে... কিন্তু সেই সহাবস্থানটা তো তোর আর আমার হয় নি রণ! এখন আর সেটা হয় না। সেই জায়গা থেকে তুইও এগিয়ে গেছিস, আমিও এগিয়ে এসেছি অনেক দূর...”

“চেষ্টা করলেই হয় মিতা! তুই না বলতি তুই চিরন্তন প্রেমে বিশ্বাস করিস? জগৎ-সংসার একদিকে, আর প্রেম একদিকে? সেখান থেকেও কি তুই সরে এসেছিস মিতা?”

নিঃশব্দে গাল ভাসিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে প্রিয়ার চোখ দিয়ে। এবার সাহস করে দেয়ালের কোণ থেকে নিজেকে আড়ালে রেখেই তাকালো শুভমিতার ঘরের দিকে। চেয়ারে বসা রঞ্জন। ওর সামনে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো শুভমিতা, দু’হাত বুকের উপর বাঁধা। প্রিয়া জানে না কি অপেক্ষা করছে ওর ভবিষ্যতে। কিছুক্ষণ আগেও প্রার্থনা করছিলো যাতে এই দু’জন ওর সংসারটা ভাঙার মতো বিধ্বংসী কোনও সিদ্ধান্ত না নেয়। ঠোঁটের আগায় প্রার্থনার ভাষাও ফুরিয়েছে ওর ক্লান্তিতে। স্নায়ুর সাথে লড়াই করে এতোটা সময় ও নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে আছে মনে হচ্ছে ওর। এদের আর কোনও কথায় বা সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছাবে না ওর মন। ও শুনতে লাগলো শুভমিতার কথা।

“এখনও করি রণ!” নরম গলায় জবাব দিলো রঞ্জনের কথার শুভমিতা।

এবার রঞ্জন করলো সেই বহু প্রতীক্ষিত প্রশ্নটা, “ভালবাসিস এখনও?”

শুভমিতা হাসলো, “তোর প্রশ্নটাই গর্হিত, রণ!”

রঞ্জন কণ্ঠে ব্যঙ্গ ফুটিয়ে বললো, “এতোক্ষণ আধুনিকতার বুলি ঝেড়ে এবার কি বলবি? তুই আমার বউ-বাচ্চার অভিশাপ কুড়াতে চাস না?”

রঞ্জনের ব্যঙ্গটুকু অগ্রাহ্য করলো শুভমিতা। বললো, “অভিশাপ বল, প্রকৃতির বিচার বল সেগুলো নিয়ে কোনও তর্কে তোর সাথে আমি যাচ্ছি না। ততোদূর যেতে হবে না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি আপাদমস্তক একজন সৎ মানুষ হিসেবে নিজেকে ভাবতে পছন্দ করি। ঈশ্বরের কৃপায় আজ পর্যন্ত এমন কিছু আমি করি নি যাতে আমার নিজের কাছে নিজেকে ছোট হতে হয়। অসৎ বা অনৈতিক কিছু আমার দ্বারা হবে না। কাজেই তুই যেদিকে কথা টেনে নিয়ে যাচ্ছিস, সেদিকে কথা না বাড়ালেই মঙ্গল।“

রঞ্জন একরোখা সুরে বললো, “যদি আমি নিজে থেকে সব কিছু চুকিয়ে দিয়ে তোর দিকে আগাই, তাহলে তো তোর কোনও দায় থাকছে না, তাই না? তখনও কি তুই আমাকে গ্রহণ করবি না?”

স্পষ্টস্বরে জানালো শুভমিতা, “না। আমি তখনও জানবো আমাকে মাথায় রেখেই তুই অন্য কাউকে বঞ্চিত করেছিস। সেই গ্লানি আমি বইতে পারবো না।“

রাগ আর হতাশা ঠিকরে বেরোলো রঞ্জনের পরের কথায়, “তাহলে এর সমাধান কি মিতা? আমার নিজের সমস্যা থাকতে পারে না? আমি কি আমার সমস্যার জন্য আমার জীবনে সেরকম কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না? এখন কি তুই এগোবি না বলে আমাকেও জোর করে একটা অর্থহীন সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে হবে আজীবন?”

শুভমিতার গলার স্বর শান্ত, “তোর আর প্রিয়ার জীবনে সেরকম কোনও সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন হলে সময়ই সেটা বলে দেবে... কোনও তৃতীয় পক্ষের প্রশ্নই আসবে না সেখানে... টক্সিক কোনও রিলেশনশিপ জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী আমি নিজেও না... কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা ধরে নেয়া যাবে না রণ... তোর আর প্রিয়ার সম্পর্কটার অর্থ তুই কোনদিন খোঁজার চেষ্টাই করিস নি। যদি বন্ধু হিসেবে আমার মত সত্যিই চাস, আমি বলবো, স্রেফ কাগুজে একটা পরিচয় বয়ে না বেড়িয়ে সম্পর্কটাকে একটা জীবন দে এবার... স্বামী-স্ত্রী একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ চেনে! চোখ বাঁধা অবস্থায় স্পর্শে চিনে নিতে পারে একে অপরকে… পায়ের আওয়াজে বলে দিতে পারে দরজার বাইরে তার সঙ্গী উপস্থিত… আমার তো মনে হয় না তুই ভীড়ের মধ্যে প্রিয়াকে দেখলেও চিনতে পারবি!... এমনকি বাচ্চাও জন্ম দিচ্ছিস একের পর এক অন্যের সিদ্ধান্তে!... দু’চোখ খুলে একটাবার পরিষ্কারভাবে দেখার চেষ্টা কর তোর আর প্রিয়ার সম্পর্কের গভীরে, মেয়ে দু’টোকে নিয়ে। আর একটা কথা বলি রণ, তুই বা আমি... আমরা দু’জনেই দু’জনকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছি। বয়সের দিক থেকেও, সামর্থ্যের দিক থেকেও।... প্রিয়া আর তোর মেয়ে দু’টোর ক্ষেত্রে সেটা সত্য না। ওদের অবলম্বন দরকার আছে, সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক, সব দিক দিয়েই। যদি এটা ধরেও নেই যে তোর আর আমার মাঝে আবেগ এখনও রয়ে গেছে, ওরা কিন্তু তোর অনেক বড় দায়িত্বের জায়গা। আমার প্রতি তোর কোনও দায়িত্ব নেই, তোর প্রতিও আমার কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু ওদের প্রতি তোর দায়িত্বটা তুই কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারিস না। আর শুধু টাকাপয়সা দিয়েই দায়িত্ব পালন হয় না... এতো কথার পরে যদি তুই আবার সেই প্রসঙ্গ তুলিস, তাহলে আর তোর সাথে কথা বাড়ানোরই কিছু নেই শুধু শুধু।“

হতাশ গলায় রঞ্জন বললো, “তাহলে আমার ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনও মূল্য নেই? দায়িত্বই সব?”

শুভমিতা একই রকম ধীর, সুস্থির ভাবে বললো, “বাচ্চাকাচ্চার জন্য বাবা-মা আরও বড় সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করে, এইটুকু কিছুই না... দায়িত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং কাজ করা উচিৎ ছিলো তখন, যখন তুই আমাকে একটু একটু করে হারাচ্ছিলি... দায়িত্ব নিয়ে ভাবা উচিৎ ছিলো আমার যখন আমি তোর জন্য আরও একটু ধৈর্য্য না ধরে, আরেকটু অপেক্ষা না করে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্তের দায় তো আমরা আর কোনও নির্দোষের উপর চাপাতে পারি না রণ! এমনিতেই এই বাড়িতে আসতে রাজী হয়ে আমি একটা ভুল করে ফেলেছি... ফেসবুকে দেখতাম কি করছিস… সেটুকুই ঠিক ছিলো… কোনভাবেই এই প্রশ্রয়টুকু নিজেকে বা তোকে আমার দেয়া উচিৎ হয় নি... আর তুই আরও বড় ভুল করেছিস, করছিস এখন... নিজেকে সামলে না নিয়ে... আর এক পা এগোলেই এই ভুলটা আর ভুল থাকবে না রণ... অপরাধ হয়ে যাবে... ভুল ক্ষমা হয়তো করা যায়... কিন্তু সব অপরাধের ক্ষমা হয় না...”

দীর্ঘক্ষণ দু’জন চুপ থাকলো। আর ঈষৎ দূর থেকে একদৃষ্টে ওদের চেয়ে চেয়ে দেখলো প্রিয়া। একজন ওর স্বামী, যার সাথে সম্পর্ক ওর গত ৩ বছরের, যার ঔরসে জন্ম দিয়েছে দু’টো মেয়ের। নিজের সবটুকু দিয়েই গ্রহণ করেছিলো তাকে ও, অথচ আজ মনে হচ্ছে তাকে কিছুই চেনে নি। শুভমিতা যেমন খোলা বইয়ের মতো পড়ে গেলো রঞ্জনকে, সেভাবে রঞ্জনকে কখনোই পড়তে পারেনি প্রিয়া। পড়ার চেষ্টাই কি করেছে কোনদিন? শুধু স্বামী হিসেবে তাকে অনেক অনেক উপরে আসন দিয়ে রেখেছে! তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, মান্য করতে হবে, সব কিছু ভুলে নিজেকে সমর্পন করতে হবে তার কাছে। ভালবাসাটাকেও নিজের দায়িত্ব ভেবে নিয়েছিলো। কিন্তু তার ভালবাসা পাওয়ার জন্য, তাকে মানুষ হিসেবে চেনার, জানার চেষ্টা করেছে কতোটুকু? নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়াটাও কি প্রয়োজন ছিলো না?

আপাতদৃষ্টে ওদের পূর্ণ-সফল সম্পর্কের চকচকে বহিরাবরণের ভেতর বিশাল শূণ্যতা হঠাৎ করেই ওর সামনে বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যেন। বেসামাল লাগছে নিজেকে। হঠাৎ করেই বুঝে গেলো যে এই শূণ্যতাটা একদিন না একদিন সামনে আসতোই, হয়তো বাচ্চাদের বড় করে দেয়ার বিশাল ঝক্কি পাড়ি দেয়ার পরে কোনদিন আসতো, অথবা সংসারের ব্যস্ততার ফাঁকে কোনও একদিন কোনও অবসরে অনুভব হতো, অথবা অভ্যস্ততায় তৈরি জীবনের নিজস্ব গতিপথ দিয়ে মসৃন গতিতে কখনও বাধা পেলে বোঝা যেতো, যে কিছু একটা যেন থেকেও নেই, বা কোনদিনই ছিলোনা। প্রিয়ার ক্লান্ত মন ওদের নীরবতার সাক্ষী হয়ে ভেবে চললো, হয়তো এভাবেই হাজারও যুগল দু’জনের মধ্যকার শূণ্যতাকে চিহ্নিত করতে না পেরেই কাটিয়ে দেয় এক জীবন! হয়তো তারাই ভাগ্যবান! আজকের পরে যদি রঞ্জন রঞ্জনের দিক থেকে এগোয় এই শূণ্যতাকে পূরণ করার উদ্দেশ্যে, প্রিয়া কি পারবে ওর দিক থেকে এগিয়ে যেতে?

আরেকজন! তাকে নিজের প্রতিপক্ষ ভেবেছিলো প্রিয়া। নিদারুণ আক্ষেপ আর আক্রোশ চেপে ছুটে এসেছিলো এই ছাদের চিলেকোঠায় তার মুখোমুখি হতে। পারলো কই? সে কি আসলেও তার প্রতিপক্ষ? সে তো নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে! রঞ্জনের, রঞ্জনের মায়ের বা নিদেনপক্ষে সে নিজে, যার উপস্থিতিই প্রায় নগণ্য, তার জন্যেও তো তার অবস্থানের একচুল কোনও পরিবর্তন হলো না! অটল সে! সে তো কিছু কেড়ে নিলো না! বরং দু’হাত ভরে ফিরিয়ে দিয়ে গেলো এমন অনেক কিছু, যা সে জানতোই না যে তার জীবনে বিশেষ প্রয়োজন! রঞ্জনকে যা চেনার বাকি ছিলো, নিজেকে যতটুকু জানার বাকি ছিলো, তার অনেকটাই যেনো অক্লেশে এক আশ্চর্য সাবলীলতায় সামনের আয়নাটা মুছে পরিষ্কার করে ওদের নিজেদের অবয়বে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুললো সে! এক বুক গরল নিয়ে ছুটে এসেছিলো প্রিয়া, সেই গরল এতো সহজে অমৃতে বদলাবার নয় হয়তো, কিন্তু বুকের সেই বিষাক্ত নদী এখন বইছে শান্ত হয়ে। বয়ে যাক! নিজের মনেই নিজেকে বললো প্রিয়া, বয়ে বয়ে একদিন হয় বুকে চড়া পড়বে, নইলে বিষ গড়িয়ে গড়িয়ে ফুরোবে একদিন, বইবে অমৃতসুধা।

আর এরই মাঝে প্রিয়ার ভাবার আছে অনেক কিছু। নিজেকে নিয়ে, নিজের চারপাশ নিয়ে। নিজেকে অন্যের হাতের পুতুল করে রেখে দেয়ার এই জীবন থেকে মুক্তি দিতে হলে ওর নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে। এই কথাটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ধরা দিয়েছে প্রিয়ার কাছে। স্বামী-নামক এই সামাজিক আশ্রয়, পরিচয়টি যে কতোটা দুর্বল হতে পারে একটা মুহূর্তের ব্যবধানে তা ওর কাছে এখন স্পষ্ট। যেখানে কোনও সত্যিকারের হুমকি ছিলোই না, তারই সামান্য আশঙ্কায় ওর পুরো পৃথিবী টলে গেছে। সেখানে নিজের অধিকার নিয়ে, নিজের অবস্থান নিয়ে, সর্বোপরি নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে নিজে নিশ্চিত না হলে যে কেউ, যে কোনও সময় ওর পৃথিবী, ওর জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার ক্ষমতা রাখবে। হঠাৎই ওর উপলব্ধি হলো, ওর আজন্মলালিত সংস্কার, ওর সামাজিক-পারিবারিক শিক্ষা, ওর পরম আপনজনেরা যে শিক্ষা ওকে দেয় নি, দিতে পারে নি, এই ভর দুপুরে, অবেলায় সম্পূর্ণ অপরিচিত, বহুদূরের একজন ওকে সেই দীক্ষা দিয়ে গেলো, যে, ওর জীবনটাও গুরুত্বপূর্ণ, আর সেই জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজানোর অধিকার ওরও আছে!

রঞ্জন যখন কথা বললো, তখন ওর কণ্ঠে আর কোনও উত্তেজনা নেই, “এতো কথাই বললি যখন, শেষ একটা কথার জবাব দে মিতা! তোর চাওয়া-পাওয়ার কিচ্ছু নেই এখানে? আমার সাথে জড়িয়ে? তোর ভালো লাগার কোনও মূল্য নেই?”

মৃদু হাসলো শুভমিতা, “আমি তো আমার ভালোটাই সবার আগে দেখলাম, রণ!” প্রিয়ার মনে হলো রঞ্জনের বিস্মিত দৃষ্টিটাকে উপভোগ করলো শুভমিতা কয়েকটা মুহূর্ত, “রণ, আমার নিজের সুখ বুঝে নিতে গিয়ে যদি আমি মানুষ হিসেবে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই, সুখের প্রাথমিক জোয়ারটা পেরিয়ে গেলেই সেই হিসেবটা গড়বড় হওয়া শুরু হবে... আয়নাতে নিজের চোখের দিকে নিজে যখন তাকাতে পারবো না, তখন ক্রমেই এই সুখটাকেই আমি প্রশ্নবিদ্ধ করবো। তখন না থাকবে আমার সুখ, না থাকবে নিজের সামনে নিজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস। একই সাথে, যে তুই আজ অনেক কিছু ছেড়ে আমার হাত ধরলি বলে তৃপ্তি পেতাম, সেই তোকেই মনে হবে, কেমন মানুষ সে? যে স্ত্রী-সন্তানের কথা বিবেচনা করে নি? সে কি সৎ? তাকে কি নীতিতে প্রখর বলা যায়? ঠিক একই রকম ভাবে, অপরাধবোধ একসময় তোর মনের সুখের পারদের উপরে উঠে যাবে। নিজে ভালো থাকতে গিয়ে অন্য কাউকে কি যন্ত্রণায় ডুবিয়েছিস সেই চিন্তা গ্রাস করবে তোকে। নিজেকে প্রশ্ন করবি... আমাকে প্রশ্ন করবি... সুখের চাইতে গ্লানিটা যখন বড় হয়ে উঠবে, না পারবি নিজের দিকে চাইতে, না পারবি আমার দিকে চাইতে।“

থামল শুভমিতা। রঞ্জন তখনও ওর দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। শুভমিতা আবার বলতে শুরু করলো, “সেজন্যই বলছি... আমি আমার সুখটাই দেখেছি রণ! জগতে আর কার কাছে সুখের সংজ্ঞা কি আমার জানা নেই হয়তো। আমার নিজের কাছে সততা ছাড়া যেকোনো সুখ ক্ষণস্থায়ী। অসততা দিয়ে অনেক বড় সুখ হয়তো কিনে ফেলা যায় অনায়াসে, কিন্তু তার স্থায়িত্ব বেশিদিন হয় না।... আমি নিজের সম্মানটা দেখেছি রণ, সেই সাথে তোরও।“

রঞ্জন প্রশ্ন করলো, “এবার কি আমার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিবি? ব্লক করবি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে?”

হালকা হাসলো শুভমিতা, “তার কোনও প্রয়োজন পড়বে না রণ!...”।

নীরবতা নেমে এলো ওদের মাঝে। প্রিয়া ধীরে চোখ সরিয়ে নিলো দু’জনের উপর থেকে। ও জানে না রঞ্জনের মনের যে ঠিকানা আজ ও পেলো, সে ঠিকানা ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, ও নিজে কখনও সেই ঠিকানায় পৌঁছাতে পারবে কিনা। শুভমিতার দিকে যে দৃষ্টিতে রঞ্জনকে তাকাতে দেখেছে, তারপরেও কি ও রঞ্জনকে স্বামী হিসেবে, ওর সন্তানদের বাবা হিসেবে একইভাবে একই আসনে আসীন করে জীবন কাটাতে পারবে কিনা। চেয়েছিলো ওদের মুখোমুখি হতে, তার প্রয়োজন পড়েনি। যা জানতে এসেছিলো তার চাইতে অনেক বেশিই জেনে ফিরছে সে। অভিমান হচ্ছে খুব, কিন্তু কার উপর তা ঠাহর করতে পারছে না। রঞ্জনের উপর? কিন্তু যেখানে ভালবাসাটাই ঠিকঠাক বসত গাড়তে পারেনি, সেখানে অভিমান আসবে কি করে? নিজের উপর? ওর কি অপরাধ ছিলো আজকের জন্য? ভাগ্যের উপর? গলা ছেড়ে হাসতে ইচ্ছে করলো ওর। জীবন এ কেমন মোড়ে এনে দাঁড় করালো ওকে? কোন পথে যাবে ও? কি করেই বা যাবে? ও তো একা নয়! ওর সাথে জড়ানো যে আরও দু’টো জীবন! ও বুঝে উঠতে পারছে না, রঞ্জন কি ওর অধিকার, নাকি শুভমিতার দান!

ঠায় এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অসাড় হয়ে আসা দু’টো পা টেনে নিয়ে ও ফিরে চললো ঘরের দিকে। শুনতে পেলো রঞ্জন জানতে চাইছে শুভমিতার গাড়ি লাগবে কিনা। শুভমিতার জবাব ভেসে এলো, বলছে উবার ডেকে নেবে, গাড়ি দরকার হবে না।

ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে ছেড়ে দিলো তিন্নির ঘুমন্ত শরীরের পাশে। সকালের ব্রেকফাস্টের পরে এটা তার একটুখানি ঘুমের সময়। আজকে ও ছিলো না, তাই তুলতুলি, তিন্নি দুজনেরই গোসলের অনিয়ম হয়ে গেলো। আয়া আছে, কিন্তু প্রতিদিন ওর উপস্থিতিতেই গোসল-খাওয়া চলে মেয়েদের। তুলতুলি কোথায়? দেখা যাচ্ছে না ওকে আশে পাশে!

ঘুম পাচ্ছে প্রিয়ার। মেয়েদের কথা ভাবছে, কিন্তু কিছুতেই চোখ দু’টো খুলে রাখতে পারছে না ও। চেষ্টাও করছে না অবশ্য। ওর মনের ভেতর কেউ যেন বলে যাচ্ছে ওকে, ঘম ভেঙে উঠে নতুন চোখে পৃথিবীটাকে দেখার সময় এসেছে এবার।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুধু শুনলো ওর শাশুড়ি জোর গলায় অভিযোগ করছেন ওর এই অসময়ে শুয়ে থাকা নিয়ে। ভুল শুনলো নাকি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন আর বাস্তবতা গুলিয়ে ফেললো কে জানে, ওর মনে হলো রঞ্জনের গলার আওয়াজ পেয়েছে, যেন বলছে, “ঘুমালে ওকে ঘুমাতে দাও আম্মু... একদিন অনিয়ম হলে কিছু হবে না... সারাক্ষণ দোষ খোঁজো কেন ওর? ওর বাচ্চা ওকে বুঝতে দাও… দু’টো বাচ্চা নিয়ে ক্লান্ত থাকে প্রিয়া অনেক বেশি… এটা বোঝো না? একটু ঘুমাক............”। আর কিছু কানে এলো না প্রিয়ার, তলিয়ে গেলো কেমন ঘুমের ঘোরের মধ্যে।

সেদিন রাতে পাঁচ তারা হোটেলের সুইমিং পুলে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে এসে গায়ে গাউন চাপিয়ে পুলের পাশে পাতা চেয়ারে বসেছে মনোবিজ্ঞানী শুভমিতা। হাতে তুলে নিলো মোবাইল, খুব প্রিয় গান খুঁজে চলেছে আঙুল। জায়গাটা এখন নির্জন। আরও লোকজন থাকার কথা ছিলো, সচরাচর থাকে, কিন্তু কেউ নেই। মানুষের মন নিয়ে গবেষণার কাজ তার। আপন মনেই হেসে ফেললো। দীর্ঘ পরিপূর্ণ একটা জীবন পার করেও মানুষ তার মনের সমস্ত অলিগলি চিনে উঠতে পারে না! তবু এই অসম্ভবকে জানার চেষ্টা মানুষ করেই যাচ্ছে পৃথিবীর কোটি কোটি রহস্যের মতো করেই। আজকের দিনে অনেক অনেক কথা হয়েছে ওর নিজের মনের সাথে। মানুষের মন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি যার কাজ, সে কি নিজের মনটাকেই চেনে?

খোলা আকাশের দিকে চেয়ে আবারও নিজেকে প্রশ্ন করলো শুভমিতা, হাহাকার আছে কি? থাকলে কতোখানি? জবাব এলো, নাহ। অতৃপ্তি আছে, কিন্তু তৃপ্তিটাও কম নেই। আজ বরং একটা ছেঁড়া ঘুড়ির লাটাইয়ের সুতোটা অযথা হাতে করে টেনে নিয়ে বেড়ানোর অনুভবটা আর হচ্ছে না। অপূর্ণতা আছে, গ্লানির বিরাট ভার নেই। ছেড়ে যাওয়ার গ্লানিটাও নেই, ফিরিয়ে নেয়ার গ্লানিও না। কিন্তু চাওয়াটুকু কি ছিলো না?

থাকুক! অপূর্ণতা তো থাকবেই! সব কিছু পেয়ে গেলে পরের কিছু পাবার যাত্রাটা শুরু হবে কি দিয়ে?

মুচকি হাসলো শুভমিতা। হাসিটা তারার আলোয় ওর চোখের কোলে হীরের কুঁচির মতো একদানা অশ্রুর মতোই ঠিক ঝিকমিকিয়ে উঠলো।

মোবাইলে মৃদু ভলিউমে বাজছে,

“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে!...”

সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics